Recent Tube

বিতি কিচ্ছা-৬৪ নুর মুহাম্মদ চৌধুরী (মুবিন)।



বিতি কিচ্ছা-৬৪

রম্য রচনা-মানুষ ডাক্তারঃ
-------------------
         ডাঃ মুহাম্মদ মুজতাবা। ভিনগ্রহের কেউতো সে নয়! তবে পতনোন্মুখ এ জাতির সামনে বলতেই হয় "বিচিত্র"। কেননা আর সব ডাক্তারের জীবনাচার, লেনদেন, কিংবা রোগী-ডাক্তার সম্পর্ক অথবা সাধারণ মানুষের সাথে যেমন খুশি  মেলামেশা আর আলাপচারিতার ধরণ-বরন সবই এখানের ব্যতিক্রম। আধুনিক যুগে আপন স্বার্থ সংরক্ষণের বিপরীতে জনস্বার্থে বাক্য ব্যয় করে - এমন বেওকুপ আবার আছে নাকি কোথাও ? ধন-দৌলতের প্রতিযোগিতায় আত্নাহুতি দিয়ে জীবন করে নাই পানি-এমন কাউকে মানুষ বলা যায় কি কখনও ? পরকালকে সদা প্রাধান্য দেবে, আর নিজ স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে থাকবে উদাসীন- তাও কি কভু হয়? বরং এর বিপরীতই হচ্ছে ডাঃ মুজতাবা। তার চেম্বারের চিত্র কিন্তু বাস্তবিকই আলাদা। এখানে রোগী নিয়ে নাই দলাদলি কিবা চল-চাতুরী মোটে। দালাল কিংবা ফড়িয়ারা কদাচ নাহি তার দৃষ্টিসীমায় হাটে। প্যাথলজি ল্যাব করে নাই আশা মনমতো পাবে ট্রীপ।  কিংবা কোথাও থাকেনা আঁটানো কোন এক ল্যাবের বাহারি  ছাপানো  স্লীপ। রোগী আসে ক্লিষ্ট পদে, ফিরে যায় হৃষ্ট পদে। এ যেন এক মায়াবী সেবালয়। এভবুনে হেন চিত্র, কভূনা হেরে এ নেত্র। আব্দুল্লাহ এতে দারুণ আপ্লুত হয়।

         মনের পুলক ছড়ায়ে আব্দুল্লাহ ভাবছে।  সে ভাবনার সাগরে ডুবে চলে যায় নিকট অতিতের তিক্ত অভিজ্ঞতার দহলিজে। এ চুয়ান্ন বছরের দীর্ঘ জীবনে হাজারো অনাচার অযাচারের চাক্ষুষ সাক্ষী সে। বাস্তবতার সাথে তাল রেখে অংক করলে আজ ডাঃ মুজতাবার চেম্বারের এ দৃশ্য দেখার আশা দুরাশা হিসাবেই কল্পনা করে সে। অথচ প্রকৃত বাস্তবতা আজ তাকে আশান্বিত করেছে। জীবনে যদি মানুষ মানুষের কাছ থেকে মানবতার পরশ পায় তবে তার বাঁচাটা হয় আশাব্যজ্ঞক,  হয় অর্থবহ। অন্যতায় হাজারো প্রতিকুলতা কাটিয়ে উটে জীবন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া মোটেই কোন সহজসাধ্য বিষয় হয় না। 

        আব্দুল্লাহ'র মনে পড়ে যায় তার প্রতিবেশী এলু'র মার কথা। অত্যন্ত হত দরিদ্র ষাটোর্ধ এলু'র মা সামান্য জ্বর নিয়ে গিয়েছিল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনৈক ডাক্তারের কাছে। তিনি সরকারী চেম্বারে বসে  এলু'র মা'র কাছ থেকে মাত্র পঞ্চাশ টাকা ফি নিয়েছিলেন। এলু'র মা খুশি হয়েছিল এই কারণে যে শ্রদ্ধেয় জনদরদী ডাক্তার মহোদয় তার কাছ থেকে গরীব বলে মাত্র পঞ্চাশ টাকা ফি নিয়েছেন। অথচ সরকারের বেতনভোগী এই ডাক্তারের এটা কোন ন্যায় কর্মই ছিল না যে সে সরকারী দায়ীত্বের মধ্যে থেকে কারো কাছ থেকে ফি আদায় করবে।
      
       আব্দুল্লাহর স্মৃতিপটে ভেষে উটে অশ্রু ভরা চোখে রুস্তম আলীর চেহারা। রুস্তম ছিল পেশায় একজন টেক্সী চালক। ছোট বোন তেরাবিবির পেটে টিউমার অপারেশন করবে। জেলা শহরের বড় হাসপাতালে বোনকে নিয়ে ভর্তি হল। পেশার সুবাদে বড়সড় বেশ ক'জন ডাক্তারের সাথে তার মোটামুটি খাতির ছিল  বলা যায়। কিন্তু সব খাতির সমাদরের খেতাপুড়িয়ে দীর্ঘ সাত সপ্তাহ পায়চারীর পর তিন হাজার টাকা ঘুষ প্রদান সাপেক্ষে  অবশেষে হাসপাতাল থেকে কার্য উদ্ধার করে বেরিয়ে আসে সে। সস্তায় সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা পাবার আশায় মাথা মারতে মারতে তার দুদেল গাভীটি বিক্রি করতে হয়েছে। আসা আর যাওয়া বাবত খরছ দাঁড়িয়েছে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। এরপর রুস্তম তার নীজ হাতে দুই কান ধরেছে, দুই গালে দুই চড় মেরে ওয়াদা করেছে, আর কোনদিন কোন ডাক্তারকে সে ভাড়ায় খাতির করবে না। 

        আব্দুল্লাহর মনে পড়ে যায় কুয়েত ফেরত আব্দুঅল বারীর গল্প। আব্দুল বারীর প্রস্রাবের সমস্যা নিয়ে পূর্ব পরিচিতির সুবাদে হাজির হয় ডাক্তার পাড়ার  চেম্বারে।  জনাব ডাক্তার তার বন্ধুর কাছ থেকে ফি নিলেন না বটে, তবে তাকে ধরিয়ে দিলেন সাড়ে চার হাজার টাকা মূল্যের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার লম্বা একটি ব্যবস্থাপত্র। আব্দুল বারীর বুজতে বাকি রইল না যে, জনাব ডাক্তার মশাই ফি নেননি যদিও, কিন্তু প্রকারান্তরে তিনি এক ট্রিপেই দশ ভিজিটের ফি ই আদায় করে নিতে চান। এখানে অনৈতিক  কমিশন বানিজ্যের মাত্রা এতদূর বিস্তৃতি লাভ করেছে যে জনৈক ভদ্রলোক আলাপছলে বলেই ফেললেন, "আল্লাহ যেন আমার চৌদ্দগুষ্টীর কাউকে ডাক্তার না বানায়"।

        আরেক ঘটনা, এক ডাক্তার পত্নী রোখসানার বাচ্চা হবে। ভর্তি হল ক্লিনিকে। অপারেশন ছাড়া নাকি বাচ্চা আসতে চাচ্ছেনা দুনিয়ায়। বাঁচানো যাবেনা নাকি রোখসানাকে। কি আর করা,  দেখা যায় রোখসানার ডাক্তার স্বামীটিও পারেনি তার সহকর্মীর লোভের ছোবল থেকে বাঁচতে প্রীয় মানুষটিকে।

       এই তো গেল মাসের ঘটনা,  আব্দুল্লাহর একই ফ্ল্যাটে থাকা প্রতিবেশী ডাঃ জি. আকন্দের ছেলের জন্মদিন অনুষ্ঠান হল বেশ জমিয়ে। তবে মেহমান বলতে গেলে সকলেই ছিল কোন না কোন ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধি। উপহারের স্তুপে কামরা বোঝাই হল। তবে ডাক্তারের আপনজনদের কাউকে দেখা যায়নি উক্ত অনুষ্ঠানে। কি জানি, হয়ত দাওয়াতই দেয়া হয়নি ওদের। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অনুষ্ঠানে আসলে উপহার একত্রীকরণের উদ্দেশ্যটিই প্রাধান্য পেয়েছিল। 

       আব্দুল্লাহর চোখ ছল ছল করে উটছে ভাতিজি রোজির কথা স্বরণ হওয়ায়। বড় আশা নিয়ে বিয়ে দিয়েছিল বেলালের সাথে। বেলাল চাকরি করে একটি দেশীয় ঔষধ কোম্পানিতে। সময় অসময় বালাই নাই, ডাক্তারের খাটুনি খাটতে খাটতে বেলালের হাতে ফোস্কা পড়ে। এই এক ডাক্তারের গোলামী তো এই অন্য ডাক্তারের গোলামীতে সে আছেই পড়ে। আশ্চর্য্য এটাও আবার কেমন আচার ? নিজের বাজার করতে কি আর পারছে বেলাল মিয়া। ঐ শোনা যায়  রিং করেছে ডাক্তার ওলিভিয়া। পাগলপারা দৌড়ে এসে বলে কি চাই স্যার? লাগবে নাকি খরছাপাতি না অন্য সমাচার। ইজি হালে আয়েশ করে হাসলো অলিভিয়া, দেখছো  বেলাল পেরেক গেল জুতোয় ঢুকিয়া। পায়ের ব্যাথায় চলতে নারি একটু আছে কাজ,, কি আর করা বাজার করা ভেস্তে গেল আজ। মানুষের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে অশ্রু মুছে নিল আব্দুল্লাহ। এটা একটা চাকরি হল নাকি? দুমুঠো ভাতের জন্য একটা উচ্ছ শিক্ষিত লোকও এমন ভাড়া খাটতে হবে? আর ওদেরও বা কি বিবেক!! ভাবতে লজ্জা হয় আব্দুল্লাহ'র। 

       এই মুল্লুকে ডাক্তাররা সবাই বেশই ধনী। ওদের কাছে হার মানিছে স্বর্ণ হীরের খনি। জীবন যাপনে যা প্রয়োজন দেরিতো শুধু চাওয়া, কোম্পানিগুলো মজুততো  আছেই কিসের পরোয়া। ধনী ও বড়লোকদের সাথে তাদের খাতির তথা বন্ধুত্ব জারি আছে, ফলে গরীব আলীরা বিনে ফি'তে ডাক্তারের নিকট ভিড়তে না পরলেও ধনীরা ঠিকই বিনে ফি'তে কার্যসিদ্ধি করে নতে সক্ষম হন সচরাচর। 

       এতসব ভাবনা নিয়ে অস্তির আব্দুল্লাহ এবার আশার নদী তীরে হাটতে থাকলো। সে দেখলো পৃথিবীতে দু'চার জন মানুষ  ডাক্তার তথা মানবতার চাষী মানুষ আছে বলেই আজও আমরা টিকে আছি। হৃদয়ের গভীর থেকে অজস্র শ্রদ্ধাবোধ এসে জমা হল ডাক্তার মুজতাবার প্রতি। বেঁচে থাকো ডাঃ মুহাম্মদ মুজতাবা, বেঁচে থাকুক মানবতা প্রতিটি মনুষ্য জনপদে।

Post a Comment

0 Comments