Recent Tube

ইসরা ও মিরাজের শিক্ষা এবং তাৎপর্য; আজকের প্রেক্ষিত ; ড. বি. এম. মফিজুর রহমান। সংকলনে ঃ শামীম আজাদ।



 ইসরামিরাজের শিক্ষা এবং তাৎপর্য: আকের প্রেক্ষিত ;
             ১ম পর্ব;
ড. বি. এম. মফিজুর রহমান

الحمد لله رب العالمين. والصلاة والسلام على سيد المرسلين، نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين، أما بعد:

ইসরা ও মিরাজের  পরিচয়:

ইসরা ও মিরাজ হচ্ছে রাসূল (স.) এর জীবনে, বরং মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর,অলৌকিক ও শিক্ষণীয় ঘটনা। নির্ভরযোগ্য মতানুসারে, নবুওয়্যাতের দশম সালে রজব মাসের ২৭তম রজনীতে এই মহান ঘটনা সংঘটিত হয়। এ ঘটনার দুটে অংশ রয়েছে। এক. ইসরা, দুই. মিরাজ।
ইসরা (الإسراء)অর্থ নৈশভ্রমণ। মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত রাসূলের রাত্রিকালীন ভ্রমনকে ইসরা বলা হয়। এ প্রসেঙ্গ কুরআনে বলা হয়েছে:
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ
“পরম পবিত্র ও মহামহিম সত্তা তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে নৈশকালে ভ্রমণ করিয়েছেন সমজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের নিদর্শনগুলো দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা” (বনী ইসরাঈল: ১)।
মিরাজ(المعراج) শব্দটি ‘উরুজ(عروج) শব্দ থেকে মিরাজের উৎপত্তি। এর অর্থ: সিঁড়ি বা সোপান, আরোহন করা, ওপরে চড়া বা ঊর্ধ্বগমন করা। মসজিদুল আকসা থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত ভ্রমনকে মিরাজ বলা হয়। মিরাজ একাধিক এমন বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, যা অনেকের মতে মুতাওয়াতির কিংবা মাশহুরের পর্যায়ভুক্ত। তবে কুরআনেও এর প্রতি পরোক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে। সূরা নাজমে আল্লাহ ইরশাদ করেন:
وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَى (৭)ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى (৮) فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى (৯) فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى (১০) مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى (১১) أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى (১২) وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى (১৩) عِندَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى (১৪) عِندَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى (১৫) إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى (১৬) مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى (১৭) لَقَدْ رَأَى مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى (১৮)
তখন সে ঊর্ধ্ব দিগন্তে। তারপর সে নিকটবর্তী হল, অতঃপর আরো কাছে এল। তখন সে নৈকট্য ছিল দু’ ধনুকের পরিমাণ, অথবা তারও কম। অতঃপর তিনি তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহী করার তা ওহী করলেন। সে যা দেখেছে, অন্তকরণ সে সম্পর্কে মিথ্যা বলেনি। সে যা দেখেছে, সে সম্পর্কে তোমরা কি তার সাথে বিতর্ক করবে? আর সে তো তাকে আরেকবার দেখেছিল। যার কাছে জান্নাতুল মা’ওয়া অবস্থিত। যখন কুল গাছটিকে যা আচ্ছাদিত করার তা আচ্ছাদিত করেছিল। তার দৃষ্টি এদিক সেদিক যায়নি এবং সীমাও অতিক্রম করেনি। নিশ্চয় সে তার রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ থেকে দেখেছে” (নাজম:৭-১৮)।

ঘটনাবহুল মিরাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:

মহানবী (স.) ওই রাতে তাঁর চাচাতো বোন উম্মেহানী বিনতে আবি তালিবের ঘরে (মতান্তরে কাবা চত্বরে) নিদ্রিত ছিলেন। এমনি সময় আল্লাহর নির্দেশক্রমে হযরত জিব্রাইল(আ.) এলেন, সাথে ছিলেন হযরত মিকাইল (আ.) ও হযরত ইসরাফিল (আ.)। তারা রাসূল (স.) কে জাগ্রত করে তাদের আগমনের হেতু জানালেন। রাসূল (স.) দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। অতঃপর ফেরেশতারা তাকে ঝমঝম কূপের কাছে নিয়ে শুঁইয়ে দিয়ে সিনা মোবারক থেকে কলব বের করে পবিত্র পানি দিয়ে ধৌত করেন। তারপর দুই কাঁধের মাঝখানে নবুওয়্যাতের সিল মেরে মহানবীকে (স.) মহাশূন্যে ভ্রমন উপযোগী করে বোরাকের ওপর বসিয়ে বোরাককে যাত্রা শুরুর নিদের্শ দেয়া হয়। বোরাক ছুটে চলল মহানবী (স.) কে নিয়ে। প্রথমে মদীনা মনোওয়ারা, তারপর সিনাই পর্বত, হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মস্থান বায়তুল লাহম হয়ে পবিত্র মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। সেখানে নবী-রাসূলদের সাথে নিয়ে রাসূল (স.) দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। এতে তিনি ইমামতি করেন। অতঃপর উপস্থিত নবী-রাসূলদের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এই পর্যন্ত ইসরা।

এরপর শুরু হলো মিরাজ বা উর্ধ্বগমন। যথাক্রমে রাসূল (স.) নভোমন্ডলে আল্লাহর সৃষ্টির অপূর্ব নিদর্শন দেখে অভিভূত হন। তিনি প্রথম আসমানে হযরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা (আ.) ও হযরত ইয়াহইয়া (আ.), তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসূফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা (আ.) এবং সপ্তম আসমানে বাইতুল মামুরের সাথে হেলান দিয়ে বসে থাকা হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সাথে সাক্ষাত ও কুশল বিনিময় করেন। সাত আসমানে কাবার সোজা উপরে সাত আসমানের উপরে যেখানে বায়তুল মামুর অবস্থিত সেখানে পৌঁছে যান। সেখানে অগনিত ফেরেস্তা দেখেন যার সীমা সংখ্যা নেই। তিনি দেখলেন বায়তুল মামুরে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতার একটা করে নতুন দল এসে সে ঘরকে তাওয়াফ করছে। কোন ফেরেশতা ২য় বার তাওয়াফ করার সুযোগ পায় না। সেখানে তিনি দেখলেন যে, আল্লাহর রাজত্বের পরিসীমা কত দূর দূরান্ত নিয়ে পরিব্যাপ্ত। পৃথিবীর লোক সংখ্যার চাইতেও কোটি কোটি গুণ বেশী ফেরেশতারা সেখানে সৃষ্টি করে রেখেছেন। সে আর এক স্বর্গীয় জগত। এরপর নবী করিম (সাঃ) এমন এক জগতে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে শুধু আল্লাহর নুরের তাজাল্লী দ্বারা পরিব্যাপ্ত ছিল। যার দিকে চোখ মেলে চেয়ে দেখতে গেলে মানুষ গলে পানি হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ নবী করিম তা দেখতে পেলেন। তাই আল্লাহ বলেন مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى  [ সুরা নাজম ৫৩:১৭ ]  অর্থাৎ দেখার সময় নবী (সাঃ) এর দৃষ্টিতে বক্রতা আসেনি এবং চোখ ঝলসে যায়নি’। অতঃপর আল্লাহর সাথে রাসুল (সাঃ) এর কথা শুরু হলো। মানুষ যেমন কোন মহামান্য ব্যক্তির নিকট গিয়ে উপস্থিত হয়ে প্রথমে সালাম করে সামনে দাঁড়ায় ঠিক তেমনই নবী (সাঃ) মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে সালাম দিলেন ﺍَﻟﺘَّﺤِﻴَّﺎﺕُ ﻟِﻠﻪِ ﻭَﺍﻟﺼَّﻠَﻮَﺍﺓِ ﻭَﺍﻟﻄَّﻴِّﺒَﺎﺕُ আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস সালাওয়াতু ওয়াত্তায়্যেবাতু বলে আল্লাহ তার জবাবে বললেন ﺍَﻟﺴَّﻼَﻡُ ﻋَﻠَﻴْﻚَ ﺍَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟﻨَّﺒِﻲُّ ﻭَﺭَﺣْﻤَﺔُ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﺑَﺮَﻛَﺎﺗُﻪ ‘আস্-সালামু আলাইকা আইয়ু্যহান নাবীয়ু্য ওয়া রামাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু,। রাসুল (সাঃ) পুনরায় বললেন ﺍَﻟﺴَّﻼَﻡُ ﻋَﻠَﻴْﻨَﺎ ﻭَﻋَﻠَﻰ ﻋِﺒَﺎﺩِﺍﻟﻠﻪِ ﺍﻟﺼَّﺎ ﻟِﺤِﻴْﻦَ আস-সালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস সালিহীন।  ফেরেশতাগণ যারা এসব কথা শুনছিলেন তাঁরা এই কথাগুলো শোনার পর সবাই মিলে সমস্বরে বলে উঠলেন- ﺍَﺷْﻬَﺪُ ﺍَﻥْ ﻻَّ ﺍِﻟَﻪَ ﺍِﻻَّ ﺍﻟﻠﻪُ ﻭَﺍَﺷْﻬَﺪُ ﺍَﻥَّ ﻣُﺤَﻤَّﺪً ﻋَﺒْﺪُﻩ ‘ ﻭَﺭَﺳَﻮْﻟُﻪ আশহাদু আল-লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু। এরপর জিব্রাইল নবীজীকে সাথে করে জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করে সিদরাতুল মুনাতাহায় আসেন। সেখান থেকে রফরফ নামক বাহনে করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেন। এ হচ্ছে মিরাজের অতিসংক্ষিপ্ত কাহিনী। তবে নিচে উপস্থাপিত শিক্ষা ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আরো কিছু ঘটনা আলোচিত হবে।

ইসরা ও মিরাজের শিক্ষা এবং তাৎপর্য: আজকের প্রেক্ষিত

অসংখ্য শিক্ষার অপূর্ব সমাহার ইসরা ও মিরাজের ঘটনা একদিকে যেমন সুদূর প্রসারি তাৎপর্য মন্ডিত। অন্যদিকে আজকের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সামগ্রিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় আমাদের সামনে এক সুমহান আলোকবর্তিকা। এ পর্যায়ে আমরা ইসরা ও মিরাজের কিছু অতীব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও তাৎপর্যের উপর আলোকপাত করব।

এক. সত্যের উপর অবিচলতা এবং নীতির প্রশ্নে আপোষহীনতা:

ইসরাকালে সংঘটিত মাসিতা (ফেরাউন কন্যার কেশবিন্যাসকারী/পরিচারিকা মহিলা) সম্পর্কে যে দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে, তাতে এ শিক্ষাই ফুঠে ওঠেছে। হযরত ইবনুআব্বাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেন,
“لَمَّا كَانَ اللَّيْلَةُ الَّتِى أُسْرِىَ بِى فِيهَا أَتَتْ عَلَىَّ رَائِحَةٌ طَيِّبَةٌ، فَقُلْتُ: يَا جِبْرِيلُ، مَا هَذِهِ الرَّائِحَةُ الطَّيِّبَةُ؟ فَقَالَ : هَذِهِ رَائِحَةُ مَاشِطَةِ ابْنَةِ فِرْعَوْنَ وَأَوْلاَدِهَا. قَالَ: قُلْتُ: وَمَا شَأْنُهَا؟ قَالَ: بَيْنَا هِىَ تَمْشُطُ ابْنَةَ فِرْعَوْنَ ذَاتَ يَوْمٍ إِذْ سَقَطَتِ الْمِدْرَى مِنْ يَدَيْهَا، فَقَالَتْ: بِسْمِ اللَّهِ. فَقَالَتْ لَهَا ابْنَةُ فِرْعَوْنَ: أَبِى؟ قَالَتْ: لاَ، وَلَكِنْ رَبِّى وَرَبُّ أَبِيكِ اللَّهُ. قَالَتْ :أُخْبِرُهُ بِذَلِكَ؟ قَالَتْ: نَعَمْ. فَأَخْبَرَتْهُ فَدَعَاهَا، فَقَالَ: يَا فُلاَنَةُ، وَإِنَّ لَكَ رَبًّا غَيْرِى؟ قَالَتْ : نَعَمْ، رَبِّى وَرَبُّكَ اللَّهُ. فَأَمَرَ بِبَقَرَةٍ مِنْ نُحَاسٍ فَأُحْمِيَتْ ثُمَّ أَمَرَ بِهَا أَنْ تُلْقَى هِىَ وَأَوْلاَدُهَا فِيهَا’ قَالَتْ لَهُ : إِنَّ لِى إِلَيْكَ حَاجَةً. قَالَ: وَمَا حَاجَتُكِ ؟ قَالَتْ: أُحِبُّ أَنْ تَجْمَعَ عِظَامِى وَعِظَامَ وَلَدِى فِى ثَوْبٍ وَاحِدٍ وَتَدْفِنَنَا. قَالَ: ذَلِكَ لَكِ عَلَيْنَا مِنَ الْحَقِّ. قَالَ :فَأَمَرَ بِأَوْلاَدِهَا فَأُلْقُوا بَيْنَ يَدَيْهَا وَاحِدًا وَاحِدًا إِلَى أَنِ انْتَهَى ذَلِكَ إِلَى صَبِىٍّ لَهَا مُرْضَعٍ وَكَأَنَّهَا تَقَاعَسَتْ مِنْ أَجْلِهِ ، قَالَ: يَا أُمَّهْ اقْتَحِمِى؛ فَإِنَّ عَذَابَ الدُّنْيَا أَهْوَنُ مِنْ عَذَابِ الآخِرَةِ فَاقْتَحَمَتْ”.
ইসরা রাত্রে আমার কাছে খুব সুন্দর একটি সুঘ্রাণ ভেসে আসে। আমি জিব্রাইলকে জিজ্ঞাস করি, এই সুঘন্ধি কিসের? তিনি বলেন, ফেরাউন কন্যার পরিচারিকা (মাসিতার) সুগন্ধি। আমি বললাম, তার বিষয়টি আসলে কী? তিনি জবাব দিলেন, কোন একদিন সে যখন ফেরাউন কন্যার কেশ বিন্যাস করছিল, হাত থেকে চিরুনীটি পড়ে যায়। সে বিসমিল্লাহ বলে সেটি তুলে নেয়। ফেরাউন কন্যা তখন বলে, তুমি কি আমার বাবার কথা বলছ? মহিলা জবাব দিল, না। বরং আমার এবং তোমার প্রতিপালক আল্লাহ। মেয়েটি বলল, আমি কি বাবাকে বলে দেবো? মহিলা বলল, হ্যাঁ। বলে দাও। অতঃপর ফেরাউন ঐ মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, হে অমুক! আমি ছাড়া কি তোমার অন্য কোন রব আছে? মহিলা উত্তর দিল, হ্যাঁ। আমার রব এবং আপনার রব হচ্ছেন আল্লাহ। ফেরাউন তখন পিতল দিয়ে একটি গোমূর্তি নির্মাণের নির্দেশ দেয় এবং তাতে আগুন ধরিয়ে তার মধ্যে ঐ মহিলা ও তাঁর সন্তানদেরকে নিক্ষেপ করতে বলে। ঐ মহিলা তখন বলে, আপনার কাছে আমার একটি আরজ আছে। ফেরাউন বলল, কি? বল। মহিলা বলে, আমার এবং আমার সন্তানদের অগ্নিদগ্ধ কংকালগুলো একটি কাপড়ে একটিত করে দাফন করে দেবেন। ফেরাউন তাতে রাজি হল। বলল, তাই হবে। তারপর এক এক করে তাঁর সন্তানদেরকে সেই উত্তপ্ত আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হল। শেষ পর্যন্ত যখন মাসিতার দুগ্ধপোষ্য সন্তানটিকে নিয়ে আসা হল, দুধের বাচ্চার কথা চিন্তা করে তাঁর মধ্যে একটু দুর্বলতার ভাব দেখা গেল। তৎক্ষণাৎ শিশুটি মাকে বলল, মা ঝাঁপিয়ে পড়। নিশ্চয়ই দুনিয়ার শাস্তি পরকালের তুলনায় খুবই সহজ। সাথে সাথে সে তাতে ঝাঁপ দেয়”। (মুসনাদে আহমাদ)।
আজকের প্রেক্ষাপটে এ শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খোদাদ্রোহীদের নির্যাতনে নিষ্ঠাবান মুমিনের প্রতিদিন যেন এখন অগ্নিগর্ভ গোমূর্তি। মাসিতা ও তার সন্তানতের মত মুমিনদের আত্মত্যাগে ধর্মদ্রোহীদের প্রাণ যখনই প্রকম্পিত হয়, তখনই তারা নির্যাতনের নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়। তবুও মুমিনকে সত্যপথের উপরই থাকতে হয়। কারণ এ পথের যে কোন বিকল্প নেই। বিনিময়ে আল্লাহর কাছে তার জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।

দুই. সালাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রদান:

ইসরা ও মিরাজের রাত্রিতে আল্লাহ তা‘আলা কোন প্রকার মাধ্যম ব্যতীত সপ্তম আকাশের উপর থেকে একটিমাত্র বিধান ফরজ করেছিলেন। সালাত যার নাম। এ প্রসঙ্গে রাসূল (স.) বলেন,
“ثُمَّ فُرِضَتْ عَلَيَّ الصَّلَوَاتُ خَمْسِينَ صَلَاةً كُلَّ يَوْمٍ، فَرَجَعْتُ فَمَرَرْتُ عَلَى مُوسَى، فَقَالَ: بِمَا أُمِرْتَ، قلت: أُمِرْتُ بِخَمْسِينَ صَلَاةً كُلَّ يَوْمٍ، قَالَ: إِنَّ أُمَّتَكَ لا تَسْتَطِيعُ خَمْسِينَ صَلَاةً كُلَّ يَوْمٍ، وَإِنِّي ـ وَاللَّهِ ـ قَدْ جَرَّبْتُ النَّاسَ قَبْلَكَ، وَعَالَجْتُ بَنِي إِسْرَائِيلَ أَشَدَّ الْمُعَالَجَةِ، فَارْجِعْ إِلَى رَبِّكَ، فَاسْأَلْهُ التَّخْفِيفَ لِأُمَّتِكَ فَرَجَعْتُ فَوَضَعَ عَنِّي عَشْرًا، فَرَجَعْتُ إِلَى مُوسَى فَقَالَ مِثْلَهُ، فَرَجَعْتُ، فَوَضَعَ عَنِّي عَشْرًا، فَرَجَعْتُ إِلَى مُوسَى فَقَالَ مِثْلَهُ، فَرَجَعْتُ فَوَضَعَ عَنِّي عَشْرًا، فَرَجَعْتُ إِلَى مُوسَى فَقَالَ مِثْلَهُ، فَرَجَعْتُ، فَأُمِرْتُ بِعَشْرِ صَلَوَاتٍ كُلَّ يَوْمٍ، فَرَجَعْتُ فَقَالَ مِثْلَهُ، فَرَجَعْتُ، فَأُمِرْتُ بِخَمْسِ صَلَوَاتٍ كُلَّ يَوْمٍ، فَرَجَعْتُ إِلَى مُوسَى، فَقَالَ: بِمَ أُمِرْتَ ؟ قُلْتُ: أُمِرْتُ بِخَمْسِ صَلَوَاتٍ كُلَّ يَوْمٍ، قَالَ: إِنَّ أُمَّتَكَ لا تَسْتَطِيعُ خَمْسَ صَلَوَاتٍ كُلَّ يَوْمٍ، وَإِنِّي قَدْ جَرَّبْتُ النَّاسَ قَبْلَكَ، وَعَالَجْتُ بَنِي إِسْرَائِيلَ أَشَدَّ الْمُعَالَجَةِ؛ فَارْجِعْ إِلَى رَبِّكَ، فَاسْأَلْهُ التَّخْفِيفَ لِأُمَّتِكَ! قَالَ: سَأَلْتُ رَبِّي حَتَّى اسْتَحْيَيْتُ، وَلَكِنِّي أَرْضَى، وَأُسَلِّمُ … فَلَمَّا جَاوَزْتُ نَادَى مُنَادٍ: أَمْضَيْتُ فَرِيضَتِي، وَخَفَّفْتُ عَنْ عِبَادِي॥”[البخاري: ৩৫৯৮].
“অতঃপর আমার উপর প্রাত্যাহিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয়। (সেই নামায নিয়ে) আমি যখন মুসা (আ.) এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাকে কী নির্দেশ দেয়া হয়েছে? আমি বললাম, আমাকে প্রাত্যাহিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন, আপনার উম্মাত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায পড়তে পারবে না। লোকদের ব্যাপারে আমার পুর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। বনী ইসরাঈলের অবাধ্যপরায়ণতার প্রতিকারে আমি খুব শক্ত ছিলাম। আপনি আপনার রবের নিকট ফিরে যান এবং উম্মতের উপর এ গুরুভার দায়িত্বকে লঘু করে দেয়ার আবেদন জানান। অতঃপর আমি গেলাম এবং আমার থেকে দশ ওয়াক্ত উঠিয়ে নেয়া হলো। তারপর আবার যখন আগের মত মুসার কাছে এলাম। তিনি আগের মতই বললেন। আমি আবার ফিরে গেলাম। আবারও দশ ওয়াক্ত কমিয়ে দেয়া হলো। এরপর যখন মুসার কাছে আসলাম, তিনি আগেরই মত বললেন। আমি আবার গেলাম। এবারও দশ ওয়াক্ত কমানো হলো। এরপর আবারও এলাম মুসার কাছে। তিনি এবারও একই কথা বললেন। আমি আবারও রবের কাছে ফিরে গেলাম। আমাকে প্রতিদিন দশ ওয়াক্ত করে পড়লে বলা হলো। আমি আবার ফিরে এলাম মুসার কাছে। তিনি একই কথা বললেন। আমি আবার গেলাম। আমাকে তখন পাঁচ ওয়াক্তের নিদের্শ দেয়া হলো প্রতিদিন। এরপর যখন মুসার কাছে ফিরে এলাম। তিনি আবার বললেন, আপনার উম্মত পাঁচ ওয়াক্তও পারবে না। উম্মতের ব্যাপারে আমার পূর্ব (তিক্ত) অভিজ্ঞতা আছে। বনী ইসরাইলকে আমি কঠিনভাবে চিকিৎসা করেছি। আপনি আবারও যান এবং আরও কমিয়ে দিতে বলুন। রাসূল (স.) তখন বললেন, আমি আমার রবের কাছে চেয়ে চেয়ে লজ্জিত বোধ করছি। তবে এ গুলো নিয়েই সন্তুষ্ট। আমি মেনে নিলাম। অতঃপর যখন সে স্থান অতিক্রম করছিলাম, একজন ঘোষক ঘোষণা দিলেন, আমি আমার ফরয কে অবধারিত করে দিলাম আর বান্দাদের উপর থেকে বোঝা হালকা করে দিলাম”।
অন্য হাদীসে রয়েছে,
أول ما يحاسب عليه العبد يوم القيامة الصلاة فإن صلحت صلح سائر عمله وإن فسدت فسد سائر عمله
“নামায সেই বিধান, যে সম্পর্কে কিয়ামত দিবসে প্রথম জিজ্ঞাসা করা হবে। নামায যার সঠিক হবে, অর্থাৎ এ বাপারে সঠিক জবাব দিতে পারবে, তার সব আমলই সঠিক বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে, যার নামায বিনষ্ট হয়ে যাবে, অর্থাৎ নামাযের ব্যাপারে কোন সন্তোষজনক উত্তর দিত পারবেন, তার সমস্ত আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে”।
এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, নামাযের সুফল মানুষের প্রতিটি কাজের উপর গিয়ে পড়ে। একমাত্র নামাযীদের পক্ষেই সম্ভব জাগতিক সমস্ত দায়-দায়িত্ব সুচারূ রূপে, আমানাতদারিতা, সততা, পেশাদারিত্বের সাথে পালন করা। নামাযীরাই সমাজ-রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেবে, এমনটিই আল্লাহর ইচ্ছা। নামাযীদের উপর বেনামাযীরা শাসন-শোষণ প্রতিষ্ঠা করবে, তা হতে পারে না। কারণ যে লোক আল্লাহর প্রতিই উদাসীন, সে মানুষের প্রতি নিষ্ঠাবান হবে, তা কি হয়?
হযরত ‘উমার তাঁর গভর্ণরদের কাছে যে সব নির্দেশনা পাঠিয়েছিলেন, তার মধ্যে এ কথাও ছিল,
إن أهم أمركم عندي الصلاة، فمن حفظها وحافظ عليها حفظ دينه، ومن ضيعها فهو لما سواها أضيع
“তোমরা যে সব কাজ সম্পাদন কর, নামায আমার কাছে সে সবের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যক্তি নামাযকে সংরক্ষণ করে, নামাযের ব্যাপারে যতশীল থাকে, সে তাঁর দ্বীন (তথা সার্বিক দায়-দায়িত্ব) কে সংরক্ষণ করে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি নামায নষ্ট করে দেয়, সে অন্যান্য দায়িত্বের সর্বনাশ সাধনে আরো বেশি সক্রিয়”। 
এমন কি রাসূল (স.) অন্তিমমূহুর্তেও নামাযের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে বলেছিলেন, “الصَّلاَةَ الصَّلاَةَ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ” নামায, নামায এবং যারা তোমাদের অধীনস্থ”।
মূলত নামাযীদের সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। এ জন্যই কুরআন বলছে,
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ
“আর তাদেরকে যখন আমি ক্ষমতায় অধিষ্ঠীত করি, তারা নামায কায়েম করে, তারা যাকাত আদায় করে। ভালো কাজের আদেশ দেয় আর মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে..” (হাজ্জ:৪১)।

ইসলামের মূল শিক্ষাই হচ্ছে, আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ততা ও সৃষ্টির প্রতি ইহসান বা সদাচরণ, সহানুভূতি (الاتصال مع الله، والإحسان إلى خلقه)। নামাযের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সান্নিধ্যার্জনের স্তরগুলো অতিক্রম করতে থাকে। সে বস্তুজাগতিক কুহেলিকা থেকে বিশ্বাসের জগতে উন্নীত হয়।
কল্পনাবিলাসিতা থেকে হাকীকতের আলোকে উদ্ভাসিত হয়। তুচ্ছ জীবন পেড়িয়ে উন্নত জীবনসোপান অতিক্রম করে। পাশব প্রবৃত্তির কাদামাটি থেকে সান্নিধ্যের জান্নাতে এসে গড়াগড়ি করে। এজন্য আল্লাহ বলছেন, وأقم الصلاة لذكري “আর আমার স্মরণে নামায প্রতিষ্ঠা কর”। নামাযের মাধ্যমে সে আল্লাহর মিরাজ তথা দিদার লাভে ধন্য হয়। প্রভুর সাথে একান্ত অভিসারে মগ্ন হয়। রাসূল (স.) এজন্য বলছেন, ولو يعلم المصلى من يناجي ما التفت منها “নামাযী যদি জানতো সে কার সাথে একান্তে মিলিত হয়েছে, তাহলে সে নামাযের মধ্যে অন্য দিকে মন দিতে পারত না”। অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, ليس للمرء من صلاته، إلا ما عقل নামায থেকে মানুষের প্রাপ্তি ততটুকু, যতটুকু সে হৃদয়-মনের ধ্যানমগ্নতা দিয়ে আত্মস্থ করেছে”।
যে নামাযের প্রতি উদাসীন, সে কি করে নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়? রাসূল বলছেন,
“الْعَهْدُ الَّذِي بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمُ الصَّلاَةُ فَمَنْ تَرَكَهَا فَقَدْ كَفَرَ”
“আমাদের মধ্যে আর কাফিরদের মধ্যে পার্থক্য হলো নামায। তাই যে ব্যক্তি নামায ছেড়ে দিলো, সে কাফির হয়ে গেল”। নামাযই হবে মুসলিমর উম্মাহর জীবনে হারিয়ে যাওয়া ইসলামের সর্বশেষ বিধান। রাসূল (স.) বলছেন,
“أَوَّلُ مَا تَفْقِدُونَ مِنْ دِينِكُمُ الأَمَانَةُ، وَآخِرُ مَا تَفْقِدُونَ مِنْ دِينِكُمُ الصَّلاَةُ”
“তোমরা প্রথমে ইসলামের যে শিক্ষা হারিয়ে ফেলবে তা হচ্ছে আমানাতদারিতা। আর সর্বশেষ হারিয়ে যাওয়া বিধান হচ্ছে নামায”। সামষ্টিকভাবে মুসলিমরা যখন নামায ছেড়ে দেবে, তখন ইসলামের সাথে তাদের আর কোন বন্ধন থাকবে না। অন্য হাদীসে এভাবে বলা হয়েছে,
لتُنقَضَنَّ عُرى الإسلام عُروةً عُروة، وكلما انتقضت عروة، تشبّث الناس بالتي تليها، فأوّلها نقضاً الحكم، وآخرها الصلاة.
“ ইসলামের বিধানগুলোকে একটি একটি করে ধ্বংস করা হবে। যখনই একটি বিধান ভেঙ্গে দেয়া হবে, মানুষ অন্যটি ধরে রাখার চেষ্টা করবে। এভাবে প্রথম যে বিধানটি ভেঙে দেয়া হবে, তা হচ্ছে কুরআনের শাসনব্যবস্থা। এবং সর্বশেষ বিধানটি হচ্ছে নামায”।
আজ মুসলমানদেরকে নামাযে খুঁজে পাওয়া যায়না। আল্লাহর সান্নিধ্য ছেড়ে এখন অধিকাংশ মুসলমান প্রবৃত্তির সান্নিধ্য লাভে অধিক আগ্রহী। দুর্নিতিবাজ, যালিম স্বৈরাচারি নেতা-নেত্রীদের সান্নিধ্য লালসায় কাতর। তারা ভুলে গেছে, আল্লাহর সান্নিধ্য ব্যতীত কখনো মনের প্রশান্তি ও প্রকৃত চিত্ত তৃপ্তি অর্জিত হতে পারে না। বরং নামায ছাড়া মুসলিমদের অস্তিত্বই থাকতে পারে না।
যারা নামায তরক করবে, তাদের শাস্তিও রাসূল (স.) কে মিরাজের রাত্রিতে দেখানো হয়েছে। সহীহ বুখারীতে রাসূল (স.) এর দীর্ঘ হাদীসে এসেছে:
وَإِنَّا أَتَيْنَا عَلَى رَجُلٍ مُضْطَجِعٍ ، وَإِذَا آخَرُ قَائِمٌ عَلَيْهِ بِصَخْرَةٍ ، وَإِذَا هُوَ يَهْوِي عَلَيْهِ بِالصَّخْرَةِ لِرَأْسِهِ ، فَيَثْلَغُ بِهَا رَأْسَهُ فَيَتَدَهْدَهُ الْحَجَرُ هَاهُنَا ، فَيَتْبَعُ الْحَجَرَ يَأْخُذُهُ ، فَمَا يَرْجِعُ إِلَيْهِ حَتَّى يَصِحَّ رَأْسُهُ كَمَا كَانَ ، ثُمَّ يَعُودُ عَلَيْهِ ، فَيَفْعَلُ بِهِ مِثْلَ مَا فَعَلَ الْمَرَّةَ الْأُولَى …. ، فَإِنَّهُ رَجُلٌ يَأْخُذُ الْقُرْآنَ فَيَرْفُضُهُ ، وَيَنَامُ عَنِ الصَّلَوَاتِ الْمَكْتُوبَةِ
“আমরা এক শায়িত ব্যক্তির কাছে আসলাম। তার মাথার কাছে পাথর হাতে নিয়ে অন্য একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। দাঁড়ানো ব্যক্তি শায়িত ব্যক্তির মাথায় সেই পাথর নিক্ষেপ করছে। পাথরের আঘাতে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং পাথরটি বলের মত গড়িয়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। লোকটি পাথরটি কুড়িয়ে আনতে আনতে আবার তার মাথা ভাল হয়ে যাচ্ছে। দাঁড়ানো ব্যক্তি প্রথমবারের মত আবার আঘাত করছে এবং তার মাথাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। (রাসূল (স.) তাঁর সফরসঙ্গী ফেরেশতাদ্বয়কে জিজ্ঞেস করলেন, কি অপরাধের কারণে তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছে? উত্তরে তারা বললেন), এ ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করেছিল। কিন্তু কুরআন অনুযায়ী আমল করেনি। এবং সে ফজর নামাযের সময় ঘুমিয়ে থাকত”।

তিন. রাত যত গভীর হয়, প্রভাত তত সন্নিহিতে আসে:

নবুয়্যতের দশম সনে রাসূল (স.) এর অতীব প্রিয়, অতি আপন দুই ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করেন। যারা মক্কায় মুশরিকদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাসূলের হৃদয়ে শক্তি, সাহস ও স্বান্তুনা সঞ্চয় করতেন। একজন ঘরের ভেতরে তাকে অনুরাগের পরশ বুলিয়ে ভুলিয়ে দিতেন কষ্টের অসহনীয় বোঝা। আরেকজন বাহিরে বটবৃক্ষের মত ছায়া দিতেন কুরাইশের রক্তচক্ষু থেকে।
একজন তাঁর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী খাদিজাতুল কুবরা (রা.)। যার সম্পর্কে রাসূল বলেছিলেন,
قد آمنت بي إذ كفر بي الناس، وصدقتني إذ كذبني الناس، وواستني بمالها إذ حرمني الناس
“মানুষ যখন আমাকে অবিশ্বাস করেছে, খাদিজা তখন আমার প্রতি ঈমান এনেছে। লোকেরা যখন আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, সে তখন আমাকে সত্যায়িত করেছে। মানুষ যখন আমাকে বঞ্চনা দিয়েছে, সে তখন আমাকে তাঁর সমস্ত সম্পদ দিয়ে সমবেদনা জানিয়েছে”।
অন্যজন হচ্ছেন তার পিতৃতুল্য চাচা আবু তালিব। রাসূলকে আশ্রয় দিয়ে যিনি কুরাইশদের প্রবল শত্রুতার কোপানলে পড়েছিলেন। এই বিয়োগ ব্যথার উপরে মুশরিকদের ক্রমবর্ধমান নির্মমতা, বিশেষ করে রাসূলের বক্ষ যখন পাষান্ড তায়িফবাসীর অমানবিক নির্যাতনে, দগদগে ক্ষতের মত রক্তে রঞ্জিত। তখনই এলো আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসরা ও মিরাজের আমন্ত্রণ। দুনিয়াবাসীর উপেক্ষার বিনিময়ে প্রভু পরোয়ারদেগার নবী (স.) কে দিলেন অফুরন্ত ভালোবাসা সওগাত । মানুষের নিষ্ঠুরতার বিনিময়ে দিলেন উর্ধ্বজগতে ফেরেশতাদের সম্মাননা। পরিণামে কাফিরদের বিশাল আয়োজন ও বাহিনীর সামনে রাসূলের হৃদয় পেয়েছিল দৃপ্ত দৃঢ়তা। এভাবেই কষ্টের পরে আসে সুখ(بعد كل محنة منحة)। ধৈর্যের পরে বিজয়। রাতের পরে প্রভাত। সংকটের পরে মুক্তি। তিরস্কারের পর পুরস্কার। তাই মুমিনের উচিত তার পথে অবিরাম এগিয়ে চলা। বাধার প্রাচীরকে দুপায়ে মাড়িয়ে যাওয়া। আল্লাহই যেহেতু এ পথের নির্দেশ দাতা, তাই তিনিই উত্তম সাহায্যকারী, রক্ষাকারী ও জামিনদার। মুমিনের পথে কোন হতাশা নেই। নেই নিরাশার কোন হাতছানি। যতই আসুক নির্যাতনের সুনামি-সাইক্লোন। সে লোহার মত হয় আরো শাণিত ও শক্ত।

চার. আল্লাহর বিসম্ময়কর সৃষ্টিরহস্য, অপার শক্তির মহিমা ও নিদর্শনাবলী প্রত্যক্ষভাবে অবহিতকরণ :

আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বতা, অসীম ক্ষমতা, সৃষ্টি নৈপুণ্য বিষয়ে জ্ঞানার্জন মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয়ে বলিষ্ঠতা এনে দেয়। ফলে সে অনুধাবন করতে পারে যে, এমন এক সুমহান সত্ত্বার নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ বেষ্টনীতে সে আবদ্ধ যিনি সর্বদা তাকে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথেই আহ্বান করেন। যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সবকিছুই যিনি পরিবেষ্টন করে আছেন। মিরাজের মাধ্যমে বিশ্বনবীকে এ সব বিষয়ের প্রত্যক্ষ জ্ঞান দান করা হয়েছে। যাতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর চলার পথ হয় নির্ভুল ও আত্মপ্রত্যয়দীপ্ত। এ অর্থেই ইসরার আয়াতে বলা হয়েছে “যাতে আমি তাকে কুদরতের নিদর্শনগুলো দেখিয়ে দেই”।

পাঁচ. নতুন যুগের সূচনা ও ঈমানের অগ্নি পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্য প্রজন্ম তৈরি:

ইসরা ও মিরাজ ছিল ইসলামী দাওয়ার ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা। সেটি হলো হিজরত এবং তৎপরবর্তী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এ জন্য প্রয়োজন ছিল ঈমানের অগ্নি পরীক্ষার মাধ্যমে একটি সুযোগ্য প্রজন্ম তৈরি করা। যারা হবে এই নতুন যুগের প্রতিষ্ঠাতা। ইসলামী রাষ্ট্রের কর্ণধার। যাদের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে নব যুগের অগ্রযাত্রা। যাদের স্কন্ধে অর্পিত হবে ইসলামী নেতৃত্বের গুরুভার। আর এ কথা সত্য যে, প্রতিকূল পরিস্থিতি ও সংকটাপন্ন অবস্থার ভেতর দিয়েই গড়ে ওঠে বিচক্ষণ ও মানসম্পন্ন নেতৃত্ব। এ রকম কিছু নির্বাচিত, নিবেদিত প্রাণ, নিষ্কপট, শক্তিমান ঈমানদার তৈরি করা ছিলো ইসরার অন্যতম লক্ষ্য। এমন ঈমান, যার অনঢ়তার কাছে পার্থিব চাওয়া-পাওয়া কিংবা পাহাড়ের অটলতা পর্যন্ত হার মানে। যে ঈমান আল্লাহ প্রদত্ত পথের মৌলিকত্ব ধারন করে। ঈমানের এই অগ্নিপরীক্ষায় আবু বকরের মত ঈমানদারগণ উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এ জন্য বর্ণিত আছে যে,
جاءته قريش يقولون له انظر ما قاله صاحبك إنه يدعي أنه أتى في بيت المقدس وعاد في ليلة، ونحن نضرب إليه أكباد الإبل شهرا ذهابا وشهرا إيابا فقال أبو بكر: وهو قال ذلك، قالوا نعم، قال: إن كان قد قال فقد صدق
কুরাইশরা এসে যখন আবু বকরকে বলল, দেখেছ তোমার বন্ধু কি বলছে? সে দাবী করছে, সে নাকী বাইতুল মুকাদ্দাসে গিয়ে আবার রাত্রিতেই ফিরে এসেছে। অথচ উটের পিঠে চড়েও সেখানে যেতে আমাদের একমাস এবং ফিরে আসতেও একমাস সময় লাগে! আবু বকর বললেন, সত্যিই কি তিনি এ কথা বলেছেন? তারা বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তিনি যদি বলে থাকেন, তাহলে অবশ্যই সত্য কথা বলেছেন। এতে তারা হতবাক হয়ে গেলে তিনি বলেন,
إني لأصدقه فيما هو أبعد من ذلك ، أصدقه بخبر السماء في غدوة أو روحة
“আমিতো তাঁকে এর চেয়েও বিস্ময়কর বিষয়ে বিশ্বাস করি। তিনি সকাল-বিকাল আসমান থেকে যে খবর (ওহী) বলেন, তাতে আমি তাকে বিশ্বাস করি”। এভাবেই তিনি সিদ্দীক উপাধীতে ভুষিত হলেন।
পক্ষান্তরে, দুর্বলচেতারা ছিটকে পড়েছিল ঈমানের কক্ষপথ থেকে। যাদের ব্যাপারে ইবনু কাসীর বলছেন, ((وارتد ناس ممن آمن بالنبي عليه الصلاة والسلام)) “রাসূলের উপর ঈমান এনেছিল এমন কিছু লোকও এ ঘটনার পর মুরতাদ হয়ে যায়”। বাস্তবেই রাসূল (স.) তাবৎ পৃথিবীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে এই নির্বাচিত সাহাবীদের নিয়ে হিজরত করে মদীনায় গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ছয়. রাসুলের  দূরন্ত  সাহসিকতা  ও বীরত্ব  প্রমাণ  করা:

যে আল্লাহকে ভয় করে, সে অন্য কাউকে ভয় পায় না। আর যে আল্লাহকে ভয় করে না, সে সবাইকে ভয় পায়। আল্লাহর ভয়, মুমিনের শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ স্বপ্ন।
এ কারণে সে সত্য উচ্চারণে কুণ্ঠিত হয় না। রাসূল বলছেন,
((ومن التمس رضا الناس بسخط الله سخط الله عليه وأسخط عليه رواه ابن حبان
“যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার অসন্তুষ্টির বিনিময়ে মানুষের সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে, তার উপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এবং মানুষকেও তার উপর অসন্তুষ্ট করে দেন”। এ অদর্শই মুমিনকে বাতিলের সামনে অকুতোভয় রাখে। মিরাজের ঘটনা মক্কাবাসীদের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এই বীরত্বের সুমহান আদর্শই ফুটে ওঠেছে রাসূল (স.) এর মধ্যে।
হযরত উম্মেহানী বলেছিলেন,
يا رسول الله إني أخشى أن يكذبك قومك فقال عليه الصلاة والسلام: ((والله لأحدثنهموه)) ((سأخبرهم وإن كذبوني))
ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার ভয় হয় আপনি যদি এ কাহিনী লোকদেরকে বলেন, তাহলে তারা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করবে। রাসূল (স.) তখন দীপ্তকন্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই তাদেরকে এ ঘটনা বলব”। অন্য বর্ণনায়, “তারা যদি আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেও তবুও তাদেরকে আমি এ কথা বলব”।
এভাবে বীরত্বের সাথে সর্বাবস্থায় আল্লাহর দ্বীনের পথে মানুষকে আহ্বান জানানোর এই শিক্ষা মিরাজের এক অনন্য আবেদন। ইসলাম কাপুরুষ, ভীরুদের ধর্ম নয়। ইসলাম বীরপুরুষদের ধর্ম। অথচ সত্যকথা বলতে আজ আমরা ভয় পাই।
নতজানু উম্মতকে রাসূল সতর্ক করে দিয়েছেন এভাবে:
“إذا رأيت أمتي تهاب أن تقول للظالم يا ظالم فقد تودّع منهم”
“যখন আমার উম্মতকে যখন দেখবে যে, তারা কোন যালিমকে, হে যালিম! বলতে ভয় করে, তখন তাদের মধ্যে কোন কল্যাণ থাকবে না” (হাকিম)।

সাত. নবুওয়্যাতের সত্যতা প্রমাণ ও নবী রাসূল, আওলীয়াদের সাথে আল্লাহর সাহায্য-সমর্থন:

দ্বীন প্রতিষ্ঠার সুমহান দায়িত্বভারই রিসালাত ও নবুওয়্যাতের মূল কথা। নবী-রাসূলদের ধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যা বর্তিয়েছে এখন উম্মতের উপর। কিন্তু এ পথ নয় সুগম, সুপ্রশস্ত ও কুসূমিত। বরং এ পথে বিছানো থাকে ঘাত-প্রতিঘাত, বাতিলের আক্রমণ, নির্যাতন, ষড়যন্ত্র, অপবাদ ইত্যাদি। এ সত্য যেমন পরীক্ষিত, তেমনি এ পথের পথিকদের উপর যথাসময়ে আল্লাহর সাহায্যও পরীক্ষিত। মিরাজোত্তর এই ঘটনাই যার প্রমাণ। কুরাইশরা এক পর্যায়ে রাসূলকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। রাসূলের কাছে তারা বাইতুল মুকাদ্দাসের আনুপাঙ্খিক বিবরণ দাবী করে। অথচ রাসূলের তা জানার কথা নয়। কারণ তিনি জানাল-কপাট গণনা করতে সেথায় যাননি।
রাসূল (স.) বলেন,
فأصابني كرب لم أصب بمثله قط ، فجلى الله لي بيت المقدس فصرت أنظر إليه وأصفه لهم باباً بابا وموضعاً موضعا
“আমি তখন এমন বিপদে পড়ে গেলাম যে এমনটি জীবনে কখনো হয়নি। আল্লাহ তা‘আলা আমার সামনে তখন বাইতুল মাকদাসকে উদ্ভাসিত করে দিলেন। আর আমি সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এক এক করে এর দরজা-জানালা ও প্রতিটি অংশের বিবরণ দিতে লাগলাম”। এভাবে আল্লাহ হযরত সুলায়মান (আ.) কেও সাহায্য করেছিলেন রাণী বিলকিসের সিংহাসন এনে দিয়ে।
প্রভু মহিয়ানের এ সাহায্যের প্রতিশ্রুতিই দেয়া হয়েছে মুমিনকেও:
إنا لننصر رسلنا والذين آمنوا في الحياة الدنيا ويوم يقوم الأشهاد
“নিশ্চয় আমি আমার রাসূলদেরকে ও মুমিনদেরকে দুনিয়ার জীবনে এবং যেদিন সাক্ষীগণ দন্ডায়মান হবে সেদিন সাহায্য করব” (মুমিন:৫১)।

আট. জিহাদের  প্রেরণায়  উজ্জীবিতকরণ:

জিহাদ বাতিলের চোখের কাঁটা, পথের বাঁধা, প্রাণের শত্রু ও মহা আতঙ্ক। কারণ, জিহাদের নির্ভীক চেতনাই মুমিনকে বাতিলের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়তে উজ্জীবিত রাখে। এজন্য দুনিয়ার তাগুত বাতিল শক্তি জিহাদী চেতনার বিরুদ্ধে সর্বদাই একযোগে অপ্রপ্রচারে লিপ্ত। মিরাজের একটি অন্তর্নিহিত শিক্ষা হল মুমিনকে জেহাদী চেতনায় উজ্জীবিত রাখা। রাসূল (স.) সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে বাইতুল মামুর দেখলেন। এটি হচ্ছে আসমান জগতের কাবা। ফেরেশতারা যার হজ্জ করে।
((رأى النبي عليه الصلاة والسلام جند الله عز وجل من الملائكة يدخلون البيت المعمور في كل يوم سبعون ألف ملك لا يعودون إليه إلى يوم القيامة)) رواه احمد
রাসূল দেখলেন প্রতিদিন সেখানে ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করছে। তারপর চলে যাচ্ছে। কিয়ামত পর্যন্ত আর ফিরে আসবে না। তাহলে আসমান-যমীনে আল্লাহর সৈন্যবাহিনী ফেরেশতাদের সংখ্যা যে কত তা কেবল তিনিই জানেন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে এই অগণিত সৈন্য দিয়ে ‘কুন’ (হয়ে যাও) প্রক্রিয়ায় যমীনে তাঁর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে পারতেন। আমাদের উপর জিহাদ ফরজ করতেন না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তার সাহায্য ঐ সব অলস, দায়ীত্বজ্ঞানহীনদের উপর পাঠান না, যারা আল্লাহর জন্য নিজের জান-মাল কুরবানী করতে অনাগ্রহ প্রদর্শন করে। রাসূলের (স.) সাহাবীরা এ সত্য কিভাবে অনুভব করেছিলেন, তার একটি নমুনা দেখুন।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন জাহশ (রা.) উহুদ যুদ্ধের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছেন:
((اللهم إنك تعلم أنه حضر ما أرى (أي من التقاء الجيشين) فأسألك ربي أن تبعث إلي رجلا كافرا صنديدا قويا يقتلني ويجدع أنفي وأذني ويضعها في خيط (زيادة في النكال والتمثيل) ثم آتيك ربي بدمي فتقول: فيما ذاك يا عبد الله؟ فأقول: فيك يا رب، فيك يا رب قد تمزق جسدي وسال دمي))
হে আল্লাহ! তুমিতো জান (যুদ্ধের ময়দানে) কি অবস্থানে আমরা আছি। তোমার দরবারে আমার ফরিয়াদ, হে রব! আমার কাছে এমন একজন শক্তিশালী কাফিরকে পাঠিয়ে দাও, যে আমাকে হত্যা করবে। আমার নাক-কান কেটে ফেলবে। তারপর তা সুতায় বেঁধে রাখবে। অর্থাৎ আমার মৃত দেহকে সম্পূর্ণ বিকৃত করে দেবে। যাতে আমি কিয়ামত দিবসে তোমার কাছে রক্তমাখা দেহ নিয়ে আসতে পারি। তুমি আমাকে বলবে, হে আব্দুল্লাহ! তোমার এ অবস্থা কেন? আমি বলব, হে আমার রব! আমার এ অবস্থা শুধু তোমারই জন্য। হে আমার রব! তোমার জন্যই আমার দেহ ক্ষত-বিক্ষত, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তোমার জন্যই আমার রক্তধারা প্রবাহিত হয়েছে”। এই ছিল আল্লাহর পথে জিহাদ করে সাহাবীদের শহীদ হওয়ার অকৃত্রিম তামান্না।
এজন্য রাসূল (স.) বলেছেন,
((من سأل الله الشهادة بصدق بلغه الله منازل الشهداء وإن مات على فراشه))
“যে আল্লাহর কাছে নিষ্ঠার সাথে শাহাদাতের প্রার্থনা করেন, আল্লাহ তাকে শহীদদের আসনমূহে পৌঁছিয়ে দেন, যদিও সে মারা যায় বিছানায় বসে”।

নয়. আল্লাহর দাসত্ব মানবতার শ্রেষ্ঠ সম্মান:

ইসরা ও মিরাজের  আরেকটি  মহাশিক্ষা  হচ্ছে,
أن العبوديةَ له هي أسمى المراتب التي يصل إليها الإنسان، فالعبودية لله عزة ما بعدها عزة ، كفى بالمرء عزا أن يكون عبدا لله، كفى بالمرء فخرا أن الله له ربا.
আল্লাহর দাসত্ব মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান। মর্যাদার সর্বোচ্চ সোপান বা শীর্ষচূড়া। এর উপর কোন মর্যাদা নেই। এর চেয়ে সম্মানের আর কি থাকতে পারে একজন মানুষের জন্য যে, সে একমাত্র আল্লাহর বান্দা! তদ্রƒপ একজন মানুষের গর্ব ও গৌরবের জন্য কি এতটুকুই যথেষ্ট নয় যে, আল্লাহর তার রব? আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে তার সর্বাধিক প্রিয় বান্দাদের পরিচয় দিতে গিয়ে ইরশাদ করছেন,
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الأَرْضِ هَوْنًا
“আর রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে” (আল-ফুরকান:৬৩)।
নবী-রাসূলদের আল্লাহ ‘আবদ’ বলে পরিচয় দিয়েছেন । যেমন, নুহ (আ.) সম্পর্কে বলছেন, إِنَّهُ كَانَ عَبْدًا شَكُورًا “নিশ্চয় সে ছিল কৃতজ্ঞ বান্দা” (বনী ইসরাঈল:৩)।
হাদীসে রয়েছে,
“إن الرسول قد خير بين أن يكون نبيَّا ملكًا أو عبدًا رسولاً فاختار أن يكون عبدًا رسولاً.
রাসূলকে ‘বাদশাহ নবী ও বান্দা নবী’ এ দুটোর যে কোন একটি গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। তিনি আল্লাহর বান্দা নবী হওয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন”। অতিরিক্ত ইবাদাতের কারণে তার পদযুগল ফুলে উঠেছিল। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনার জীবনের পূর্বাপর গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, তবুও এত ইবাদাত করেন? তিনি জবাব দিয়েছিলেন,
أفلا أكون عبدًا شكورًا”
“আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞপরায়ণ বান্দা হব না?” অন্য হাদীসে রাসূল (স.) নিজেকে আল্লাহর বান্দা হিসেবেই নিজেকে সর্বোচ্চ সম্মানিত ও গৌরবান্বিত বোধ করে ঘোষণা দিয়েছেন,
“لا تطروني كما أطرت النصارى المسيح ابن مريم، ولكن قولوا عبد الله ورسوله”.
“তোমরা আমার প্রশংসায় সীমা লংঘন করো না। যেমনটি করেছিল মারইয়াম তনয় ঈসা (আ.) এর ব্যাপারে খ্রীষ্টানরা। বরং বল, আল্লাহর বান্দা ও রাসূল”।
যারা আল্লাহর যথার্থ ইবাদাত করবে, তাদের হাতেই আল্লাহ তুলে দিবেন পৃথিবীর নেতৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা। ঈমানদের প্রতি এটি আল্লাহর অকাট্য প্রতিশ্রুতি।
এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে:
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُم فِي الأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمْ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে এ মর্মে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি নিশ্চিতভাবে তাদেরকে যমীনের প্রতিনিধিত্ব প্রদান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দীনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তিনি তাদের ভয়-ভীতি শান্তি-নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা আমারই ইবাদাত করবে, আমার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না” (নূর: ৫৫)।
ইবাদাতের এই সুউচ্চ মর্যাদা শিক্ষা দেয়ার জন্যেই কুরআনে ইসরার প্রসঙ্গে রাসূলকে ‘আবদ’ বা বান্দা হিসেবে ভূষিত করা হয়েছে। মুহাম্মাদ, রাসূল, হাবীব, খলীল বা অন্যকোন শব্দ ব্যবহার করা হয়নি।
ইরশাদ করছেন আল্লাহ:
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى
“পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন আল মাসজিদুল হারাম থেকে আল মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত” (বনী ইসরাঈল:১)।

দশ.  বাইতুল  মাকদাসে  রাসূলের  ইমামতির   তাৎপর্য ও শিক্ষা:

বাইতুল মুকাদ্দাসে রাসূলের ইমামতিতে নবী-রাসূলদের দু’রাকাত নামায আদায়ের মধ্যে রয়েছে গভীর তাৎপর্য ও একাধিক শিক্ষা। যেমন:

ক. সমস্ত নবী-রাসূল তথা গোটা বিশ্ব সৃষ্টির মধ্যে মুহাম্মাদ (স.) এর সম্মান ও মর্যাদা সর্বোচ্চ তা প্রমাণ করা।

খ. মুহাম্মাদ (স.) এর রিসালাতের বিশ্বজনীনতা ও সর্বজনীনতা প্রমাণ করা।

গ. সব নবী-রাসূল কর্তৃক আনীত আসমানী দ্বীনের মৌলিকত্ব আসলে এক ও অভিন্ন, তা বোঝানো।
এ ব্যাপারে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
“আর তোমার পূর্বে এমন কোন রাসূল আমি পাঠাইনি যার প্রতি আমি এই ওহী নাযিল করিনি যে, ‘আমি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই; সুতরাং তোমরা আমার ইবাদাত কর” (আম্বিয়া:২৫)।

ঘ. রিসালাতের দরজা মুহাম্মাদ (স.) এর মাধ্যমে চিরতরে বন্ধ ঘোষণা করে পূর্বের সমস্ত শরীয়ত রহিত করা।

ঙ. রাসূলকে স্বান্তুনা দেয়া। দুনিয়ার মানুষ ঈমান না আসলে কি হবে? সমস্ত নবী ও রাসূল তাঁর উপর ঈমান এনেছে।

চ. ইসলাম বিশ্বময় প্রসারিত হবে, সে সত্যকে নির্দেশ করা।

ছ. উম্মতে মুহাম্মাদিয়াকে উচ্চ সম্মান প্রদান এবং এ কথা বোঝানো, এখন থেকে নেতৃত্বের পালাবদল হয়ে গেছে। ইয়াহুদী, খ্রীষ্টানদের হাত থেকে এবার নেতৃত্ব হস্তান্তরিত হলো মুহাম্মাদ (স.) ও তাঁর উম্মতের হাতে। শত শত বছর সত্যি সত্যি মুসলিম উম্মাহ জগতবাসীকে সুখ-সমৃদ্ধি, সাফল্যের পথে নেতৃত্ব দিয়েছিল। কিন্তু ইসলামের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে আজকে তারা নেতৃত্ব হারিয়েছে। তাতে তারা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বিশ্বও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মানুষ হারিয়েছে নিরাপত্তা, অধিকার ও বেঁচে থাকার সঠিক অর্থ ও অবলম্বন।
এ জন্যই আল্লাহ মুসলিমদেরকে লক্ষ্য করে বলছেন,
وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
“আর তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং দুঃখিত হয়ো না, আর তোমরাই বিজয়ী যদি মুমিন হয়ে থাক” (আল-ইমরান:১৩৯)। রাসূল (স.) ইরশাদ করেন, الإسلام يعلو ، ولا يعلى عليه “ইসলাম সর্বদাই উচ্চ আসনে অধিষ্ঠীত। এর উপরে কিছু হতে পারে না”।
জ. বাইতুল মাকদাসের প্রতি মুসলিমদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য।

এগারো.  ইসলাম  স্বভাবজাত  ধর্ম:

মিরাজের পবিত্র রজনীর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, রাসূল (স.) কে দুধ ও মদের পাত্র পান করতে দেয়া হলে তিনি দুধের পাত্র গ্রহণ করেন, প্রত্যাখ্যান করেন মদের পাত্র।
এ প্রসঙ্গে হযরত জিব্রাইল (আ.) বলেন,
هُدِيتَ الْفِطْرَةَ، أَوْ أَصَبْتَ الْفِطْرَةَ، أَمَا إِنَّكَ لَوْ أَخَذْتَ الْخَمْرَ غَوَتْ أُمَّتُكَ
“আপনি ফিতরাতের (প্রকৃত মানবীয় স্বভাবের) পথ অবলম্বন করেছেন। কিংবা ফিতরাতকেই পেয়েছেন। পক্ষান্তরে, আপনি যদি মদ গ্রহণ করতেন, তাহলে আপনার উম্মত পথভ্রান্ত হয়ে যেত”।
ইমাম কুরতুবী বলেন,
يحتمل أن يكون سبب تسمية اللبن فطرة؛ لأنه أول شيء يدخل بطن المولود ويشق أمعاءه
দুধকে ফিতরাত বলার একটি সম্ভাব্য কারণ হল, এই দুধই সর্বপ্রথম মানব সন্তানের পেটে প্রবেশ করে এবং তার নাড়িভুড়ি ভেদ করে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, هِيَ الْفِطْرَةُ الَّتِي أَنْتَ عَلَيْهَا وَأُمَّتُكَ “এটিই হলো সেই ফিতরাত, যার উপর আপনি এবং আপনার উম্মত প্রতিষ্ঠিত”।
মানবীয় স্বভাবের সুস্থতা বিধান করা ও এর বিকৃত রোধ করাই ইসলামের সারকথা। কেননা, স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা ও কুপ্রবৃত্তির প্রভাবমুক্ত মানবীয় স্বভাবের দাবী-দাওয়ার সাথে ইসলামী আকীদাহ, শরীয়ত,আহকাম (বিধি-বিধান) সমূহ সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যময়। এ জন্যই ইসলামকে স্বভাবজাত ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করে ইরশাদ করছেন,
فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لاَ تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُونَ
“অতএব তুমি একনিষ্ঠ হয়ে দীনের জন্য নিজকে প্রতিষ্ঠিত রাখ। আল্লাহর প্রকৃতি, যে প্রকৃতির উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না” (রূম:৩০)।
অতএব, যারা ইসলাম নিয়ে আজ ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করে, ইসলামের নবীকে নিকৃষ্টতম ভাষায় গালি দেয়, হেয় প্রতিপন্ন করার চক্রান্ত করে, কিংবা ইসলামকে প্রগতি, মুক্তচিন্তা ও মেধা-মনন বিকাশের অন্তরায় মনে করে, তারা স্বভাববিরোধী বিষাক্ত মতাদর্শে আক্রান্ত। তারাই মূলত প্রগতিবিরোধী, মানবতার প্রকৃত শত্রু। মানুষের মৌল স্বভাবের বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে যতই তারা স্বাধীনতা, মুক্তি আর উন্নয়নের শ্লোগান উচ্চারণ করুক না কেন, আসলে সবই অন্তঃসারশূন্য প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। তাদের হাতে মানবতা নিরাপদ নয়। যেন ক্ষুধার্ত খাচামুক্ত হিংস্র সিংহের সামনে অসহায় জনপদ।

বারো.  রাত্রীকালীন ইবাদাতকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান:

আল্লাহর কাছে দিবসের তুলনায় রাত অধিক প্রিয়। রাত্রের এ মূল্য ও মর্যাদার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তিনি তাঁর নবীকে রাত্রিকালীন পরিভ্রমণ করিয়েছেন। যেমনিভাবে আল্লাহ কুরআনের বিভিন্ন স্থানে রাতের নামে কসমও খেয়েছেন। এ কথা সত্যি যে, আল্লাহ তা‘আলা কোন গুরত্বহীন বস্তুর নামে কসম করেন না। যে জাতি আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে, মুহাম্মাদ (স.) কে নবী ও রাসূল হিসেবে, কুরআনকে জীবন বিধান, রাষ্ট্র বিধান, সংবিধান ও সত্যপথের দিশা হিসেবে পেয়ে আনন্দিত হয়েছে, সে জাতির উচিত এমন বস্তুর গুরুত্ব ও সম্মান অনুধাবন করা যে বস্তুকে স্বয়ং আল্লাহ সম্মানিত করেছেন। রাতের বরকত কুড়িয়ে নেয়া এ পর্যায়েরই একটি দৃষ্টান্ত। এ জন্যই রাসূল একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত ইশার পরে জেগে থাকা পছন্দ করতেন না। যেন শেষ রাতে তাহাজ্জুদ ও ইবাদাত করা সহজ হয়। সাহাবায়ে কেরামদের (রা.) জীবনধারা ছিল, فرسانًا بالنهار رهبانًا بالليل إذا جنَّ الليل سمعت لهم دويًّا كدوي النحل দিবসে যোদ্ধা, রাত্রে ইবাদাতমগ্ন। রাত যত গভীর হত, মৌমাছির গুঞ্জরনের মত তাদের কান্নার রোল শোনা যেত।
জান্নাতীদের পরিচয় প্রসঙ্গে কুরআন বলছে,
كَانُوا قَلِيلاً مِنْ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ . وَبِالأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
“রাতের সামান্য অংশই এরা ঘুমিয়ে কাটাতো। আর রাতের শেষ প্রহরে এরা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকত” (আয-যারিয়াত:১৭,১৮)।
تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنْ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا
“তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা হয়। তারা ভয় ও আশা নিয়ে তাদের রবকে ডাকে” (সিজদাহ:১৬)।
রাতের নির্জনতায় মহান আল্লাহ প্রথম আসমানে এসে বান্দাদের তাঁর নৈকট্যপানে আহবান করেন। অপরাধ মার্জনা, রিযিক অন্বেষা যার যা প্রয়োজন তা চেয়ে নিতে ডাকতে থাকেন। রাতের ইবাদাত মুমিন জীবনের এক অনন্য শক্তির ফল্গুধারা। আধ্যাত্মিক সংশুদ্ধি লাভের মাধ্যমে খাঁটি মানুষ হওয়ার এক অনুপম ব্যবস্থা। প্রভুর সাথে গোপন অভিসারে হারিয়ে যাওয়ার মোক্ষম সময়। মুসলিম উম্মাহর অনেকেই আজ এ সত্য ভুলে যেতে বসেছে। কিন্তু ইসলামের শত্রুরা ভোলেনি। তারা এমন সব আয়োজন করছে আমাদের জন্য যাতে রাত থাকে আমাদের পাপাচারে জাগ্রত আর দিন হয় অলস নিদ্রার কারাগার। এভাবে যুব শক্তি, সমাজ ও পরিবার তলিয়ে যাচ্ছে অনৈতিকতা ও অবক্ষয়ের অতল তলে। বঞ্চিত হচ্ছে জাতি রাত ও প্রভাতের বরকত থেকে। রাসূল (স.) বলেন, بارك الله في بكور أمتي “আল্লাহ আমার উম্মতের প্রভাতে বরকত দান করেছেন”।

তেরো.  মসজিদের গুরুত্ব ও মর্যাদার উপলদ্ধি:

মসজিদ থেকে মসজিদ। মসজিদ থেকে শুরু আবার মসজিদে এসেই শেষ। এভাবে ইসরার শুরু-সমাপ্তির সাথে মসজিদের সম্পৃক্ততা ইসলামী সমাজে সমজিদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নির্দেশ করে। মসজিদ শুধু নামাযের জায়গা নয়; এটি পার্থিব ও পারলৌকিক জ্ঞান বিকীরণের সর্বোত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। মুসলিমদের বিশ্ব জয়ের সূচনাকেন্দ্র। যেথায় ভাষা, বর্ণ ও বিচিত্র বৈষম্য একাকার হয়ে যায়। গড়ে ওঠে পারস্পরিক দায়বদ্ধতা, সম্প্রীতি ও বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত এক অনুপম মানব সমাজ। এ জন্যই মহানবী হিজরতের অব্যবহিত পরে মদীনায় সর্বপ্রথম যে কাজটি করেছিলেন, তাহলো একটি মসজিদ নির্মান করা। যেখানে এসে পারস্যের সালমান, হাবশার বেলাল, মক্কার আবু বকর, ওমর আর মদীনার আনসারগণ একীভূত হয়েছিলেন। যাদের পদতলে পৃথিবীর নেতৃত্ব এসে ঊর্মীভঙ্গের মত আচড়ে পড়েছিল। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় মসজিদের সেই ভূমিকা পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়া ক্রমান্বয়ে তীব্রতর হচ্ছে। বিশেষ করে, ঘুনে ধরা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, গণহত্যা, খুন-গুম, নাস্তিক্যবাদ ও স্বৈরাচারের সর্বগ্রাসী থাবা আতংকে দিশেহারা আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভুমি সোনার বাংলাদেশে। তাহলে আবার এই পবিত্র শিক্ষাঙ্গন থেকে তৈরি হবে সাহাবীদের মত সাহসী, নেতৃত্বের গুণাবলীসমৃদ্ধ সুশিক্ষিত প্রজন্ম । যারা দিকে দিকে ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দেবে ইসলামের সুবিমল জ্যোতি। যাদের উপর প্রযোজ্য হবে আল্লাহর এ বাণী:
فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَنْ تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالآصَالِ . رِجَالٌ لا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلا بَيْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ الْقُلُوبُ وَالأَبْصَارُ.
“সেসব ঘরে যাকে সমুন্নত করতে এবং যেখানে আল্লাহর নাম যিক্র করতে আল্লাহই অনুমতি দিয়েছেন। সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর তাসবীহ পাঠ করেÑসেসব লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর যিক্র, সালাত কায়েম করা ও যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা সেদিনকে ভয় করে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে” (নূর:৩৬,৩৭)।
হাদীসে  কুদসীতে  আল্লাহ তা‘আলা  বলছেন,
“بيوتي في الأرض المساجد، وزوارها عُمَّارها، فطوبى لعبدٍ تطَّهر في بيته ثم زارني في بيتي فكان حق على المزور أن يُكرم زائره”.
“পৃথিবীতে আমার ঘর হল মসজিদ। এর জিয়ারাতকারীরাই হচ্ছে এর আবাদকারী। সুসংবাদ সে ব্যক্তির জন্য যে ঘরে বসে পবিত্রতা অর্জন করে। অতঃপর আমার ঘরে এসে আমাকে জিয়ারত করে। কারণ অতিথিকে সম্মানিত করাতো ঘরের মালিকের দায়িত্ব”।
চলবে..............
---------------------------------
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments