যেখান থেকে মাওলানা মওদূদী(রহ)- ও জামায়াতে ইসলামীর আকিদা খারাপ হল সমাধান তো সেখান থেকে নিতে হবে।
অথচ,আমরা গোড়ায় না গিয়ে যদি শাখা প্রশাখা নিয়ে বছরের পর বছর,যুগের পর যুগ আলোচনা করি সমাধান হবে না।আসলে বিরোধটা আকিদাগত না কি ব্যক্তি আক্রোস এবং হিংসা থেকে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখতে পারি।আসুন,দেখি শিকড়ে ফিরে যায়।
১৯২৪ সাল। তরুন উদীয়মান সাংবাদিক মাওলানা মওদূদী জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের 'আল জমিয়ত পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তিনি আপন গতিতে স্বাধীনভাবে তাঁর কার্য চালিয়ে যেতে লাগলেন।তখন কংগ্রেসের সর্বভারতীয় জাতীয়তা আন্দোলন তথা অখন্ড ভারতে রামরাজ্য স্হাপনের আন্দোলনে মুসলিম জাতী বিভ্রান্ত পথ হারা হয়ে পড়েছিল।
কারণ,কংগ্রেস চেয়েছিল সকল জাতীর সমন্বয়ে একটা ভৌগলিক ও আঞ্চলিক জাতি গঠন এবং সমগ্র ভারতে এক জাতীয়তা সৃষ্টি করে তারই ভিত্তিতে দেশের স্বাধীনতা লাভ।
আর 'জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ' রাজনৈতিক অঙ্গনে কংগ্রেসকে সমর্থন জানায় এবং 'আল জমিয়ত' পত্রিকায় মাওলানা মওদূদীকে কংগ্রেসের অনুকূলে প্রোগাগান্ডা করতে চাপ দেয়।
কিন্তু মাওলানা মওদূদী এই সর্বনাশা আন্দোলন মেনে নিতে পারেননি।বরং কংগ্রেস থেকে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে মুসলমানদের একটা স্বতন্ত্র আদর্শবাদী দল বা জাতী হিসাবে বসবাস করতে হবে-এ ছিল তার বক্তব্য।
কংগ্রেস তার আপন লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য একজন শ্রেষ্ঠ আলিমকে কাজে লাগালো।তারা ভারতের শ্রেষ্ঠতম ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র দেওবন্দ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী(রহঃ)-কে দিয়ে 'এক জাতীয়তাবাদ' নামে একটি বই লিখালো।
উক্ত বইতে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসকারী হিন্দু,মুসলিম,খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ ও জৈন সবাই একই জাতী।তার এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের আলিম সমাজ প্রতিবাদের ঝড় তুললেন।
এ সময় আল্লামা ইকবাল রোগ শয্যায় শায়িত ছিলেন।তিনি রোগ শয্যায় মাদানী সাহেবের এই বক্তব্যের খবর শুনে অত্যন্ত ব্যথিত ও চঞ্চল হয়ে পড়েন।তিনি এই অন্তিম সময়েও মাওলনা মাদানীর এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে বলেন,'তাহলে মুহাম্মদ (সঃ) ও আবু লাহাব আরবি বলে কি একই জাতী?'
এই যগ সন্ধিক্ষণে মাওলানা মওদূদীও বসে থাকতে পারেননি।তিনি চিন্তা করলেন,হিন্দু-মুসলিম কখনো এক জাতী ও ভাই হতে পারেনা।এটা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে নিষিদ্ধ।
তা ছাড়া ইংরেজদের হাতে মুসলিম উম্মাহর যে ক্ষতি সাধন হয়েছিল তা থেকেও বহুগুণ ক্ষতি হবে যদি এক জাতী হিসাবে স্বাধীনতা লাভ করে।
কারণ,১০ কোটি মুসলমান ৩০ কোটি হিন্দুর সাথে একজাতী হিসাবে স্বাধীনতা লাভ করে তাহলে তিনগুণ ভোটের জোরে চিরদিনই রামপন্থীগণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে।ফলে মুসলিম জাতী হিন্দুদের ক্রীতদাসে পরিনত হবে।মুসলমানিত্ব বলতে কিছুই রক্ষা করা সম্ভব হবেনা।
মাওলানা মওদূদী(রহঃ) মুসলসমানদের সাথে নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ফলে কংগ্রেসবাদীরা সফল হতে পারেনি।
তবৃু্ তখন থেকে এখন পর্যন্ত দেওবন্দ মাদরাসা এবং এই গ্রুপের আলিমগণ কংগ্রেসকর সমর্থন করে আসছেন।এমন কি বেশ কয়েক বছর আগে দেওবন্দ মাদরাসার শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে একজন অমুসলিম মহিলাকে প্রধান অতিথি হিসাবে আনার পেছনে কংগ্রেসের ষঢ়ডন্ত্র ছাড়া কী কারণ থাকতে পারে?
কাজেই দেওবন্দ মাদরাসা এবং এর আলিমগণ কংগ্রেসের পলিসিতে চলেছে এবং এখনো চলছে তা আজ জাতীর কাছে স্পষ্ট।
যারা বাবরি মসজিত ভেঙ্গে ফেলে তারা কিভাবে আলিম সমাজের সাথে একই টেবিলে খাওয়া দাওয়া করে, একই সাথে উঠা বসা করে এবং তাদের প্রতিষ্ঠানকে বরদাস্ত করে?এটা এবমাত্র কংগ্রেস প্রীতির কারণেই সম্ভব,যা আজও মুসলমান জাতী বুঝতে অক্ষম!
কিন্তু তীক্ষ্ণ জ্ঞানের অধিকারী বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা মওদূদী তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে,কংগ্রেসের সাথে একাত্নতা ঘোষণা করলে মুসলমানদেরকে কী পরিনতি ভোগ করা লাগতে পারে।তাই মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী(রহঃ) যখন 'এক জাতীয়তাবাদ' নামে বই লিখে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের পক্ষে অবস্হান নেন তখন সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী(রহঃ) 'আল জমিয়ত' পত্রিকার সম্পদনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে 'ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ' নামে একটি বই লিখে কুরআন ও হাদিসের বলিষ্ঠ যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে,জাতি গঠিত হয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে।
যারা আল্লাহ ও মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ)-কে শেষ নবী হিসাবে মেনে চলে তারা হলো এক জাতি অর্থাৎ মুসলিম।আর যারা এটা বিশ্বাস করেনা তারা হলো অন্য জাতি অর্থাৎ কাফের।
এই বিশ্বাসের ভিত্ততে জাতি গঠিত হয় বিধায় কুরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলিম কখনো এত জাতি হতে পারেনা।মাওলানা মওদূদীর এই যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যের দ্বারা মাওলানা মাদানীর বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হয় এবং ভারত উপমহাদেশের মুসলমানগণ দ্বিজাতীতত্ত্বের ভিত্তিকে মেনে নিয়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের পক্ষ নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে।
যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রস্হানের পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়, যার একাংশ আজ বাংলাদেশ নামে অভিহিত।
সেদিন মাওলানা মওদূদী (রহ) ক্ষুরধার লিখনির মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম এক জাতী'-এই ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের বিরুদ্ধে গর্জে না উঠতেন তাহলে আজ হয়তো ইসলামের ইতিহাস বিকৃত হয়ে যেত এবং পাকিস্তান হতনা।আর পাকিস্তান না হলে আজকের বাংলাদেশও হতনা।
মুসলামানদের এই সংকটময় মুহূর্তে মাওলানা মওদূদী (রহ.) যে অবদান রেখেছেন সেজন্য তিনি মুসলমানদের নিকট চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
শায়েখ মওদূদীর এই অবদানের ফলে মাওলানা মাদানীর উচিত ছিল তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।কিন্তু তিনি তা না করে উল্টো মাওলানার প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠেন।এই বিদ্বেষীর ফলে মাওলানা মাদানী পরবর্তীকালে মওদূদীর উপর আক্রমনাত্নক কথা বলে প্রজ্জ্বলিত ফতুওয়ার গোলাবর্ষণ শুরু করেন।আর এটায় হচ্ছে মাওলানা মওদূদীর বিরোধীতার গোড়ার কথা বা মূল কারণ এবং তাঁর বিরুদ্ধে ফতুওয়াবাজির প্রকৃত ইতিহাস।
আমাদের দেশের অধিকাংশ আলিম মাওলানা মাদানী(রহ.)-এর ছাত্র অথবা তাঁর মুরিদ।অতএব,তারা তাদের পীরের অন্ধ অনুসরণ করেই যাচ্ছেন।এমনকি মাওলানা মওদূদীর বিরুদ্ধে মাওলানা মাদানীর কোন কথাকে যাচাই-বাছাই করাকে তারা গুনাহের কাজ মনে করেন।তাই হুজুরের অন্ধ অনুসরণ করণার্থে তারাও মাওলানা মওদূদী(রহ.) এর বিরুদ্ধে ফতুওয়াবাজির ও বিভিন্ন ভাষায় কটাক্ষ করে তাঁর সমালোচনা করে থাকেন।
ছাত্র-শিক্ষকের ধারা যেহেতু আজও চালু রয়েছে, সুতরাং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিরোধীতার ধারাও আজ পর্যন্ত চালু আছে।
তবে তাদের বোঝা উচিত যে,সত্য একদিন স্বর্গীয় আলোক আভায় উদ্ভাসিত হয়ে পড়বেই এবং সেদিন শূণ্যে বিলীন হয়ে যাবে যত সব মিথ্যার ফানুস।
তথ্যসূত্রঃ মাওলানা মওদূদী একটি জীবন একটি ইতিহাস,আব্বাস আলী খান,(প্রকাশক ;অধ্যাপক মোঃ তাসনিম আলম,প্রকাশনা বিভাগ,জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ,বড় মগবাজার,ঢাকা,৭ম মূদ্রণ ২০০৭)পৃঃ ৭৭-৮৫; বিশ্ববরেণ্য ওলামাযে কিরামের দৃষ্টিতে মাওলানা মওদূদী ও জামায়াতে ইসলামী,(সংকলনে, আরিফ দেহলবী;ভাষান্তরে ;আলম হাতিয়ুবী,প্রকাশক;আবুৃ এরফান মোঃ মাহমুদুর রহমান,নোয়াখালীঃপৃঃ৮-১০-আলোচিত অভিযোগের কাঙ্খিত জবাব,আসলাম হোসাইন, পৃ ১৭-১৮)
---------------------------------
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট।
0 Comments