Recent Tube

বর্তমান সমাজে ইসলাম, কুরআন, মাসজিদ ও আলিমদের অবস্থা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সতর্কতামূলক ভবিষৎবাণীঃ মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।







 
 বর্তমান সমাজে ইসলাম,   কুরআন, মাসজিদ ও   আলিমদের অবস্থা   সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)   এর সতর্কতামূলক   ভবিষৎবাণীঃ
------------------------------------

   হযরত আলী (রা) কর্তৃক বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, 
يوشك أن ياتي علي الناس من زمان لا يبقي من الإسلام إلا إسمه ولا يبقي من القرآن إلا رسمه مساجدهم عامرة وهي خراب من الهدي علماءهم شر من تحت أديم السماء من عندهم تخرج الفتنة وفيهم تعود-
 "শীঘ্রই মানব জাতির উপর এক যুগ আসবে, যখন শুধু নাম ব্যতীত ইসলামের কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, কুরআনের অক্ষরই শুধু অবশিষ্ট থাকবে, (কুরআনের বিধান প্রতিষ্ঠিত থাকবে না), তাদের মাসজিদগুলো চাকচিক্য থাকবে তবে তা হবে হিদায়াত শূণ্য। তাদের আলিমরা হবে আকাশের নিচে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট লোক, তাদের নিকট থেকেই ফিতনা সৃষ্টি হবে। তারপর এ ফিতনা তাদের দিকেই ফিরে আসবে।" (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান হাঃ ১৯০৮; মিশকাত হাঃ ২৭৬)
ইমাম বায়হাকীর বর্ণিত হাদীসটির সনদে দুর্বলতা আছে। তবে হাদীসটি অনুরূপভাবে ইমাম হাকীমের তারীখে ইবনে উমার (রা) থেকেও বর্ণিত হয়েছে। দাইলামী হযরত মুয়াজ এবং আবু হুরায়রা (রা) থেকেও বর্ণনা করেছেন। ফলে হাদীসটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

 ১. প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ভবিষৎবাণী করেছেন যে, এমন পরিস্থিতি আসবে যখন ইসলামের নামমাত্র সালাত, সাওম, হজ্জ, যাকাত ছাড়া ইসলামী বিধি-বিধান, তাহযীব-তামাদ্দুন এবং প্রকৃত সালাত, সাওম, হজ্জ, যাকাত কিছুই থাকবে না। বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটা সে রকম। আজ নামমাত্র ইসলাম বিদ্যমান থাকলেও ইসলামের কোনো বিধান প্রতিষ্ঠিত ও বিজয়ী নেই। অথচ ইসলাম এসেছে সকল মানবরচিত মতবাদের উপর আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করতে। আর এটাই ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মিশন (সূরা তাওবা : ৯/৩৩; ফাতাহ : ৪৮/২৮; সফ :৬১/০৯)। ইসলাম শুধু নামায, রোযা, মাসজিদ, মাদরাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান (মায়িদা : ৫/০৩)। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এ দ্বীন ইসলাম আমাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত নেই এবং প্রতিষ্ঠা করার তৎপরতা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। অধিকাংশ লোক সালাত, সাওমের মত আংশিক দ্বীন মেনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জাহেলিয়্যাতের কুফুরী বিধান সন্তুষ্টির সাথে পালন করে। অথচ এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ আমরা তা চিন্তা করি না। হারিস আল-আশয়ারী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, 
مَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُثَاءِ جَهَنَّمَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَإِنْ صَامَ وَإِنْ صَلَّى قَالَ وَإِنْ صَامَ وَإِنْ صَلَّى وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ. 
"যে (মানবরচিত) জাহেলী বিধানের দিকে মানুষকে আহ্বান জানাবে (আর যে তা মেনে চলবে) সে/তারা জাহান্নামী হবে। বলা হলো- হে আল্লাহর রাসূল! সে যদি সিয়াম পালন করে এবং সালাত আদায় করে? তিনি বললেন, সে যদি সিয়াম পালন করে, সালাত আদায় করে এবং নিেজের মুসলিম বলে ঘোষণা করে তবুও।" (মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৬৭১৮, ১৭৩৪৪, জামে তিরমিযী হাঃ ২৮৬৩, সহীহ ইবনে হিব্বান হাঃ ৬২৩৩, সহীহ ইবনে খুযাইমা হাঃ ১৮৯৫, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাঃ ৫১৪১, জামিউল আহাদীস হাঃ ৪৪, মিশকাত হাঃ ৩৬৯৪, সহীহুল জামে হাঃ ১৭২৮; হাদীসটি সহীহ। গৃহীত: নির্বাচিত হাদীস, পৃঃ ৩৯-৪০, হাদীস নং ১০০)

 ২. কুরআনের শুধু অক্ষরই অবশিষ্ট থাকবে অর্থাৎ কুরআনের লিখিত অক্ষরওয়ালা কিতাব ছাড়া কুরআনের কোন আইন প্রতিষ্ঠিত থাকবে না। বর্তমান সময়েও রাষ্ট্রীয়ভাবে কুরআন কোনো আইন প্রতিষ্ঠিত, কুরআনের বিচার শাসন নেই। অথচ কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ-
"নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি যথাযথভাবে কিতাব নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষের মধ্যে বিচার ফয়সালা কর সে অনুযায়ী যা আল্লাহ তোমাকে দেখিয়েছেন।"(সূরা নিসাঃ ৪/১০৫)
তিনি আরো বলেন,
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ-
"আর যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে ফয়সালা করে না, তারাই কাফির।" (সূরা মায়িদা: ৫/৪৪)

 ৩. মাসজিদসমুহ উঁচু দালান ও কারুকার্য খচিত প্রাচীর দ্বারা বাহ্যিক দৃষ্টিতে আবাদ হবে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা হবে হিদায়াত শূণ্য। এক মাসজিদে ননবীর হিদায়াতের আলোই গোটা দুনিয়ায় কল্যাণ ও সমৃদ্ধির বন্যা বয়ে দিয়েছিল। আজ বাংলাদেশে চার পাঁচ লক্ষ মাসজিদসহ গোটা দুনিয়ায় কোটির অধিক মাসজিদ রয়েছে। কিন্তু সেগুলো নির্জীব, প্রভাবহীন ও হিদায়াত শূণ্য; যার ফলে সমাজে অন্ধকার বিরাজ করছে। মাসজিদ হচ্ছে ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধান কেন্দ্র। এখান থেকে ইলম, আমল, জ্ঞানবিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং ইসলামী দাওয়াত ও জিহাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু আজ মাসজিদে হিদায়াতিমূলক হক কথা বলা বা শোনা যায় না, ফলে তা হয়েছে হিদায়াত শূণ্য। এখন সমাজপতি ও শাসকগণ জাঁকজমক ও চাকচিক্যপূর্ণ মাসজিদ তৈরি করে গর্ব করে কিন্তু তারা মাসজিদে কুরআন সুন্নাহ নির্ভর হক কথা বলতে  দেয় না। বরং অনেক মাসজিদে ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ লক্ষ্য করা যায়। এ যেন কিয়ামতের আলামত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَتَبَاهَى النَّاسُ فِي الْمَسَاجِدِ -
"যতদিন লোকেরা মাসজিদ নিয়ে গর্ব না করবে, ততদিন কিয়ামত হবে না।" (আবু দাউদ হাঃ ৪৪৯; মুসনাদে আহমদ হাঃ ১১০৭১, ১২১২৮, ১২৯৯১; সুনান দারিমী হাঃ ১৪০৮; সহীহুল জামে হাঃ ৭২৯৮)

 ৪. এক শ্রেণির আলিমরা হবে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট লোক। তাদের দ্বারা ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং তার মন্দ পরিণতি তাদের দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে। এরা দরবারী আলিম, ইকামতে দ্বীনের দুশমন। হাদীসে এদের ফিতনাকে দাজ্জালের চেয়েও ভয়ঙ্কর বলে সাবধান করে দিয়েছেন। আবূ যার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, 
كُنْتُ مُخَاصِرَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا إِلَى مَنْزِلِهِ فَسَمِعْتُهُ يَقُولُ غَيْرُ الدَّجَّالِ أَخْوَفُ عَلَى أُمَّتِي مِنْ الدَّجَّالِ فَلَمَّا خَشِيتُ أَنْ يَدْخُلَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيُّ شَيْءٍ أَخْوَفُ عَلَى أُمَّتِكَ مِنْ الدَّجَّالِ قَالَ الْأَئِمَّةَ الْمُضِلِّينَ.
"একদা আমি নবী (সাঃ) এর নিকটে উপস্থিত ছিলাম এবং আমি তাকে বলতে শুনেছি, 'এমন কিছু রয়েছে যেটির ব্যাপারে আমি আমার উম্মাহ্-এর জন্য দাজ্জালের অপেক্ষাও অধিক ভয় করি।’ তখন আমি ভীত হয়ে পড়লাম, তাই আমি বললাম,‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! এটি কোন জিনিস, যার ব্যাপারে আপনি আপনার উম্মাহ্-এর জন্য দাজ্জালের চাইতেও অধিক ভয় করেন?’ তিনি বললেন, ‘পথভ্রষ্ট (ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয়) নেতা'।" (মুসনাদ আহমাদ হাঃ ২০৭৯০; আরো দেখুনঃ মুসনাদ আহমাদ হাঃ ২৭৫৯৩; সুনান দারিমী হাঃ ২১১ এবং জামে তিরমিযী হাঃ ২২২৯; সুনান আবূ দাউদ হাঃ ৪২৫২; মুসনাদে আহমদ হাঃ ২১৮৮৮, ২১৮৮৯, ২১৯৪৬, ২৭৭০৩; সুনান দারিমী হাঃ ২০৯, ২৭৫২; সহীহাহ হাঃ ১৯৫৭)
   হাদীসে বর্ণিত الْأَئِمَّة শব্দটি إمام (ইমাম) শব্দের বহুবচন, যার অর্থ নেতা। এটি সাধারণত দু'টি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ১. ধর্মীয় নেতা তথা আলিম ২. রাষ্ট্রীয় নেতা তথা শাসক। এখানে একই সাথে দু'টি অর্থই গ্রহণ করতে হবে। কেননা, পথভ্রষ্ট আলিম ও শাসক উভয়ই ইসলাম ধ্বংসকারী। (দেখুনঃ-সুনান দারেমী হাঃ ২১৪; মিশকাত হাঃ ২৬৯) 

     ইসলাম প্রচার ও বাস্তবায়নে আলিম সমাজ ও শাসক মণ্ডলী যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তেমনি ইসলাম ধ্বংসের ক্ষেত্রেও দাজ্জালের চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে। মুসলিম শাসক ও আলিম ওলামার প্রচেষ্টার ফলে গোটা দুনিয়ার উপর প্রায় এক হাজার বছর যাবত ইসলামের প্রভুত্ব বিস্তৃত থাকে। কিন্তু আজ ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ পরাজিত ও লাঞ্ছিত। যে জাতির উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর দাসত্ব করা, সে জাতি আজ পথভ্রষ্ট ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নেতার বদৌলতে তাদের সেই উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে তাগুতের বান্দা ও কাফিরদের গোলামে পরিণত হয়েছে। আর এই পথভ্রষ্ট শাসক ও দরবারী আলিমরাই দাজ্জালের চেয়েও ভয়ঙ্কর। কেননা, দাজ্জাল ইসলামের ক্ষতি করবে তার আসল রূপ ধারণ করে, পক্ষান্তরে এ সকল জালিম শাসক ও দরবারী আলিম ইসলামের ক্ষতি করবে তাদের দাজ্জালী রূপ গোপন করে। তাই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দাজ্জালের ফিতনার চেয়েও পথভ্রষ্ট শাসক ও পথভ্রষ্ট দরবারী আলিমদের বেশি ভয় করতেন।
------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা আলোচক ও দাঈ। 

Post a Comment

0 Comments