Recent Tube

হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর খিলাফাত ও ইকামতে দ্বীন: কুফুরী অভিযোগ ও দলিলভিত্তিক জবাবঃ মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।

 



হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর খিলাফাত ও ইকামতে দ্বীন: কুফুরী অভিযোগ ও দলিলভিত্তিক জবাবঃ
--------------------------------- 

      আল্লাহ তা'য়ালা যে ক'জন নবীর নাম উল্লেখ করে 'ইকামতে দ্বীন' এর নির্দেশ দিয়েছেন, হযরত ইবরহীম (আ) তাঁদের অন্যতম (সূরা শুরাঃ ৪২/১৩)।
       
   মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আ) ছিলেন হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্ভবত: এগারোতম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর পর থেকে যত নবী রাসূল পৃথিবীেত এসেছিলেন সবাই ছিলেন ইবরাহীম (আ) এর বংশধর। এ জন্য তাঁকে বলা হয় ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের পিতা। হযরত নূহ (আ) এর মত তাঁর বিরুদ্ধেও ইকামতে দ্বীন বিরোধী তাগুত পন্থী দরবারী আলেমরা এ কুফুরী আকিদা পেশ করেন যে, তিনি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করেননি। এ কথার অর্থ দ্বারায়, তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে তৎকালীন তাগুত শাসক নমরূদের বিধান মেনে নমরূদকে রব হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন, নাউযুবিল্লাহ! এটি একটি জঘন্যতম কুফুরী আকিদা, এ আকিদা লালনকারী ও প্রচারকারী কাফির। কেননা, ইবরাহীম (আ) এর জন্মই হয়েছিল নমরূদে কুফুরী শাসন ব্যবস্থা ধ্বংস করে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠা করে ইকামতে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করা।

    ইবরাহীম (আ) এর জন্মের পূর্বে আকাশে একটি নক্ষত্র উদিত হয়। তার জ্যোতির সম্মুখে সুর্য ও চন্দ্র নিষ্প্রভ হয়ে যায়। এ অবস্থা দেখে লোকজন ভীত-সম্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে। নমরূদ বিচলিত হয়ে দেশের সব গণক ও জ্যোতির্বিদদের একত্রিত করে এর কারণ জিজ্ঞেস করে। তারা ভাবল, আপনার রাজ্যে এমন এক শিশুর জন্ম হবে যার হাতে আপনার বাদশাহীর পতন ঘটবে। নমরূদ তখন রাজ্যব্যাপী ঘোষণা দিল, এখন থেকে কোন পুরুষ স্ত্রীর কাছে যেতে পারবে না এবং কোন পুত্র সন্তান জন্ম নিলে তাকে হত্যা করতে হবে। এতসত্তেও ঐ সময়ই হযরত ইবরাহীম (আ) জন্ম গ্রহণ করেন। আল্লাহ তাকে হেফাজত করেন এবং পাপীষ্ঠদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেন। তিনি তাকে উত্তম ভাবে লালনপালনের ব্যবস্থা করেন। ক্রমস বড় হয়ে তিনি যৌবনে পদার্পণ করেন এবং নমরূদেরর বাদশাহীর পতন ঘটান। আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আ) এর হাতে নমরূদের পতন ঘটানোর পর তিনি ইকামতে দ্বীনের দায়িত্ব পালনে প্রথমে হারানে এবং পরে শাম দেশে হিজরত করেন এবং সেখান থেকে ইলিয়ায় যান। (আল্লামা ইবনে কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, বাংলা, ইফাবা ১/৩৮৭-৩৮৮)

     গাইরুল্লাহর ইবাদত ও দাসত্ব অপসরণ করে এক আল্লাহর দাসত্ব ও ইবাদত প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে তাঁর জাতিকে দাওয়াত দেন এই বলে যে, 
 اعْبُدُوا اللَّهَ وَاتَّقُوهُ ۖ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ-
‘তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাঁকে  ভয় করে (তাঁর বিধান মেনে) চল; এটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জান’। (সূরা আনকাবুতঃ২৯/১৬) 
তিনি তাঁর পিতাকেও বুঝানোর চেষ্টা করেন এবং বলেন, 
يَا أَبَتِ إِنِّي قَدْ جَاءَنِي مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِي أَهْدِكَ صِرَاطًا سَوِيًّا يَا أَبَتِ لَا تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ ۖ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَٰنِ عَصِيًّا-
‘হে আমার পিতা! আমার কাছে এমন জ্ঞান এসেছে যা তোমার কাছে আসেনি, সুতরাং আমার অনুসরণ কর, তাহলে আমি তোমাকে সঠিক পথ দেখাব’। হে আমার পিতা, তুমি শয়তানের ইবাদাত করো না। নিশ্চয় শয়তান হল পরম করুণাময়ের অবাধ্য। (সূরা মারইয়ামঃ১৯/৪৩-৪৪) 
এখানে বলা হচ্ছে, لَا تَعْبُدِ الشَّيْطَان “শয়তানের ইবাদাত করো না”। যদিও ইবরাহীমের পিতা এবং তার জাতির অন্যান্য লোকেরা মূর্তি পূঁজা করতো এবং নমরূদের বিধান মানতো কিন্তু যেহেতু তারা এর মাধ্যমে শয়তানের আনুগত্য করছিল তাই ইবরাহীম তাদের এ শয়তানের আনুগত্যকেও শয়তানের ইবাদাত গণ্য করেন। এ থেকে জানা যায় "ইবাদত" নিছক পূজা-উপসনা ও আরাধনারই নাম নয় বরং আনুগত্য ও বিধান পালনের নামও ইবাদত।
 
     ইবরাহীম (আ) এর এ দাওয়াত তাগুত শাসক নমরূদ ও তার অনুসারীদের বিচলিত করে তুলে। নমরূদ  ইবরাহীমকে জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নির্দেশ জারি করলেন। সাথে সাথে জনগণকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বললেন, حَرِّقُوهُ وَانصُرُوا آلِهَتَكُمْ إِنْ كُنتُمْ فَاعِلِيْنَ ‘তোমরা একে পুড়িয়ে মার এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৮)। 
অতঃপর ‘একটা ভিত নির্মাণ করা হ’ল এবং সেখানে বিরাট অগ্নিকুন্ড তৈরী করা হ’ল। তারপর সেখানে তাকে নিক্ষেপ করা হ’ল’ (ছাফফাত ৩৭/৯৭)। জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপের সময় ইবরাহীম (আঃ) বলে ওঠেন, حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ، ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’। (বুখারী, হাঃ৪৫৬৩) এই কঠিন মুহূর্তের পরীক্ষায় জয়লাভ করার পুরস্কার স্বরূপ সাথে সাথে আল্লাহর নির্দেশ এল يَا نَارُ كُونِيْ بَرْداً وَّسَلاَماً عَلَى إِبْرَاهِيمَ، ‘হে আগুন! ঠান্ডা হয়ে যাও এবং ইবরাহীমের উপরে শান্তিদায়ক হয়ে যাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৯)। অতঃপর ইবরাহীম মুক্তি পেলেন। অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইবরাহীম (আঃ) ফিরে আসেন এবং পরবর্তীতে নমরূদকে আল্লাহ তা'য়ালা মশার কামড়ে ধ্বংস করেন। এভাবে আল্লাহ কাফিরদের সমস্ত কৌশল বরবাদ করে দেন। 

       অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে ইবরাহীমের দাওয়াত ও তার প্রভাব সকলের নিকটে পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি আল্লাহর হুকুমে স্ত্রী সারা ও ভাতিজা লূত (আ) কে নিয়ে হিজরত করে বায়তুল মুকাদ্দাসে যান। এক পর্যায়ে সেখানে তাঁর ভাতিজা লূত (আ) কে নিয়ে খিলাফাত প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিরোধী পক্ষের সাথে জিহাদ করে তাগুতী শাসন অপসরণ করেন এবং আল্লাহ বিধান কায়েম করেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ 
وَنَجَّيْنَاهُ وَلُوطًا إِلَى الْأَرْضِ الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا لِلْعَالَمِينَ 
আর আমি (তাঁর স্ত্রী সহ) তাকে ও লূতকে উদ্ধার করে সে দেশে নিয়ে গেলাম, যেখানে আমি বিশ্ববাসীর জন্য বরকত রেখেছি। (সূরা আম্বিয়াঃ২১/৭১) , 
   আল্লামা ইবনে কাসীর বলেন, 
হযরত ইবরাহীম (আ) মিসর থেকে তাঁর পূর্ববর্তী বাসস্থান বরকতের দেশ তথা বায়তুল মুকাদ্দাসে যান। তাঁর সাথে বহু সম্পদ, গোলাম, বাঁদী ও ধন-সম্পদ ছিল। মিসরের কিতবী বংশোদ্ভূত হাজেরাও সাথে ছিলেন। এ সময় হযরত হুদ (আ) তাঁর ধন-সম্পদসহ হযরত ইবরাহী (আ) এর আদেশক্রমে গাওর দেশে চলে যান। তিনি সে অঞ্চলে ঐ যুগের প্রসিদ্ধ শহর সাদদূমে অবতরণ করেন। শহরের বাসিন্দারা ছিল ফাফের, পাপাসক্ত ও দুষ্কৃতিকারী। . . . . কিছু দিন পর দুরাচারীরা হযরত লূত (আ) এর উপর চড়াও হয় এবং তাঁর পশু ও ধন-সম্পদ কেড়ে নিয়ে তাকে বন্দী করে রাখে। এ সংবাদ হযরত ইবরাহী (আ) এর নিকট পৌঁছিলে তিনি তিনশত আঠারো জন সৈন্য নিয়ে তাদের উপর আক্রমণ করেন এবং লূত (আ) কে উদ্ধার করেন, তাঁর সম্পদ ফিরিয়ে আনেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিপুল সংখ্যক শত্রুকে হত্যা করেন। শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করেন ও তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে দামেশকের পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছেন। শহরের উপকণ্ঠে বারযাহ নামক স্থানে সেনা ছাউনি স্থাপন করেন। আমার ধারণা- এই স্থানকে মাকামে ইবরাহীম বলার কারণ এই যে, এখানে ইবরাহীম খলিলুল্লাহর সৈন্যবাহিনীর শিবির ছিল। 

   তারপর হযরত ইবরাহীম আল্লাহর সাহায্যপুষ্ট অবস্থায় বিজয়ী বেশে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বায়তুল মুকাদ্দাসের শহর সমূহের শাসকবর্গ শ্রদ্ধাভরে ও বিনীতভাবে এসে তাকে অভ্যর্থনা জানান। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, বাংলা, ইফাবা ১/২৪৭-২৪৮) 

 আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ 
وَإِذِ ابْتَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ ۖ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا. 
আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীমকে তার রব কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে তা পূর্ণ করল। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে মানুষের জন্য নেতা বানাব’। (সূরা বাকারাঃ২/২৪) 
 যেসব কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে ইবরাহীম (আ) তাঁকে বিশ্বমানবতার নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত করার যোগ্য প্রমাণ করেছিলেন কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। সত্যের আলো তাঁর সামনে সুস্পষ্ট রূপে প্রতিভাত হবার পর থেকে নিয়ে মৃত্যুকাল পর্যন্ত সমগ্র জীবন ছিল কুরবানী ও ত্যাগের মূর্ত প্রতীক। দুনিয়ার যেসব বস্তুকে মানুষ ভালোবাসতে পারে এমন প্রতিটি বস্তুকে ইবরাহীম (আ) সত্যের জন্য কুরবানী করেছিলেন। দুনিয়ার যে সমস্ত বিপদকে মানুষ ভয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ইকামতে দ্বীনের খাতিরে তার প্রত্যেকটিকে তিনি বরণ করে নিয়েছিলেন। এর ফলে আল্লাহ তা'য়ালা তাকে নেতৃত্বের পথে সমাসীন করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ 
فَقَدْ آتَيْنَا آلَ إِبْرَاهِيمَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَآتَيْنَاهُمْ مُلْكًا عَظِيمًا 
 আমি তো ইবরাহীমের বংশধরকে কিতাব ও হিকমত প্রদান করেছিলাম এবং তাদেরকে বিশাল রাজত্ব দান করেছিলাম। (সূরা নিসাঃ৪ /৫৪) 
 আর এই ইসলামী রাজত্বের সূচনা হযরত ইবরাহীম (আ) এর মাধ্যমেই হয়। আল্লামা ইবনে কাসীর রাহঃ বলেন, আল্লাহ তা'য়ালা হযরত ইবরাহীম (আ) কে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে তাকাতে বলেন এবং এ সুসংবাদ দেন যে, এই সমুদয় স্থান তোমাকে ও তোমার উত্তরসূরীদের দান করব। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১/৩৪৭) 
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, 
إنَّ اللّهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوْحاً وَآلَ إِبْرَاهِيْمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِيْنَ- 
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, আলে ইবরাহীম ও আলে ইমরানকে বিশ্ববাসীর উপরে নির্বাচিত করেছেন’ (আলে ইমরান ৩/৩৩)। 

     এই নির্বাচন ছিল বিশ্ব সমাজে আল্লাহর তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য। ইবরাহীম (আ) ছিলেন নবীগণের পিতা এবং পুত্র মুহাম্মাদ (সাঃ) ছিলেন নবীগণের নেতা, এ বিষয়টি সর্বদা মুমিনের মানসপটে জাগরুক রাখার জন্য দৈনিক সালাতের শেষ বৈঠকে পঠিত দরূদের মধ্যে ইবরাহীম (আ) ও মুহাম্মাদ (সাম) এর উপরে এবং উভয়ের পরিবার বর্গের উপরে আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষণের জন্য দো‘আ করার বিধান রাখা হয়েছে। ইবরাহীমের বংশে বরকত হ’ল নবুঅত, ওহী ভিত্তিক পরিচালিত সাম্রাজ্য ও ঐশী কিতাবের বরকত এবং মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর বংশে বরকত হ’ল বিজ্ঞানময় কুরআন ও হাদীস এবং তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বরকত।

      উরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটি প্রমাণিত যে, 'ইবরাহীম (আ) খিলাফাত প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করতে পারেননি' এ কথা ভিত্তিহীন ও কুরআন বিরোধী কুফুরী আকিদা।

Post a Comment

0 Comments