Recent Tube

কুরআনিক থট প্রসেস; আল কুরআনের চিন্তামানস (৬)। জিয়াউল হক।



কুরআনিক থট প্রসেস; আল কুরআনের চিন্তামানস ।
            পর্ব-৬;
---------------------------------

    এই বিশেষ চিন্তামানসের কারণেই সে বিশ্বাস করে তার উপরে আপতিত বিপদ আপদ, দু:খ কষ্ট বিপদ আপদ, উত্থান পতন, ক্ষয় ক্ষতি এগুলো তার মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ। এগুলো তার ধ্বংস বা ক্ষতির জন্য নয়, বরং কল্যাণের জন্যই এসেছে। যেমনটা প্রিয় রাসুল সা: বলেছেন; ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে বিপদে আক্রান্ত করেন।’ (বুখারি)

      অন্য একবার তিনি সা: আরও বলেছেন; হজরত আবু সাঈদ খুদরি ও হজরত আবু হুরায়রা রা: বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, মুসলিম ব্যক্তির ওপর যেসব যাতনা, রোগ ব্যধি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দুঃশ্চিন্তা কষ্ট ও পেরেশানি আপতিত হয়। এমন কি যে কাঁটা তার দেহে বিদ্ধ হয় এ সবের দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন (ঐ)।

    তদুপরি আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন তো বলেই দিয়েছেন;
‘এবং অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয় ক্ষুধা সম্পদ জীবনের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। হে নবি! ধৈর্যধারণকারীদের আপনি সুসংবাদ দিন যখন তারা বিপদ পড়ে তখন বলে নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং তার কাছেই ফিরে যাবো।’(সুরা বাকারা :১৫৫-১৫৭]

    বিপদ আপদ, দু:খ কষ্ট ও ক্ষয় ক্ষতির সম্মুখিন করে ব্যক্তি চরিত্রে ধৈর্য ও সবর, মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি সামাল দেবার যোগ্যতা তৈরি করা, এরকম বৈরি ও কঠিন সময়েও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারার মতো যোগ্যতা ও অসাধারণ বৈশিষ্ঠগুলো অর্জনের মাধ্যমে ব্যক্তিকে তার পরবর্তি জীবনে আরও বড়ো দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত করে তোলার জন্য এ ধরনের প্রশিক্ষণ বস্তুত তার কল্যাণটাকেই নিশ্চিত করে থাকে।

    আল্লাহর এ নিয়মটা কেবলমাত্র সাধারণ মানুষের জন্যই নয়। এরকম ঘটনা, তথা, বিপদ আপদের মুখোমুখি তাঁর অতি প্রিয়ভাজন নবী রাসুলগণও হয়েছেন। বরং সাধারন মানুষদের তুলনায় তাঁরাই বেশি বিপদ আপদের মুখোমুখি হয়েছেন। এবং তাঁরা নিজ নিজ জীবনে এরকম নানা কষ্টকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে ধৈর্যের পরিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত আইয়্যুব আ: ভীষণ কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে নিদারুণ কষ্টে নিপতিত হয়েছিলেন। এমন কষ্টের মধ্যেও তিনি সবর করেছেন, ধৈর্য ধারন করেছেন। তাঁর ধৈর্যের বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে আল্লাহ রাব্বুল আ‘লামিন বলেন; 

    ‘তুমি তোমার হাতে এক মুঠো তৃণশলা নাও, তদ্বারা আঘাত কর এবং শপথ ভঙ্গ করো না। আমি তাকে পেলাম সবরকারী। চমৎকার বান্দা হিসেবে। নিশ্চয় সে ছিল প্রত্যাবর্তনশীল। (সুরা সা’দ :৪৪)

     কাজেই বিপদ আপদ, দু:খ কষ্ট, লাভ লোকসান এগুলো অতিতে যেমন মানুষের জীবনে এসেছে আগামি দিনেও তা আসবে। পরিক্ষার জন্য বিপদ আপদ হিসেবে আল্লাহর রাব্বুল আলামিনের পক্ষ হতেই সকল মানুষের জীবন তা দেয়া হবে। আল্লাহ সে ঘোষণা আগাম দিয়েই রেখেছেন, সে সব ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কি সেটাও বলে দিয়েছেন সেই একই ঘোষণার সাথে সাথে;

     হে ঈমানদানগণ! ধৈর্য্য ধারণ কর এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পার। (আলে ইমরান :২০০)

    মানুষ বিপদে মুসিবতে অধৈর্য হয়ে পড়ে, হা হুতাস করে, এটাই মানবিক প্রবৃত্তি, মানবিক দূর্বলতা। এই মানবিক দূর্বলতার মুখেও ধৈর্য ধারন করে অবিচল থাকার জন্য বলা হয়েছে। যারা আল্লাহর উপরে ঈমান পোষণ করে, তাদের উদ্দেশ্যে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি (আল্লাহ) যখন আমার মুমিন বান্দার কোনো আপনজনকে মৃত্যু দিই, আর সে সবর করে, তখন আমার কাছে তার একমাত্র প্রতিদান হলো জান্নাত।’ (বুখারি)

     মানবজীবনে সর্বোচ্চ সফলতা প্রাপ্তির সার্বজনীন সুত্র হিসেবে যে চারটি মৌলিক কাজের কথা বলেছেন তার প্রধানতম একটি হলো; ধৈর্য (সুরা আসর: ১-৩)।  অন্যত্র আরও বলেছেন;

    হে ঈমানদারগন! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিতই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন। (সুরা বাকারা :১৫৩) 
     একবার রাসুল (সা.) আনসার সাহাবিদের কিছু লোককে বললেন, ‘যে ব্যক্তি ধৈর্য ধরে, তিনি (আল্লাহ) তাকে ধৈর্যশীলই রাখেন। আর যে অমুখাপেক্ষী হতে চায়, আল্লাহ তাকে অভাবমুক্ত রাখেন। ধৈর্যের চেয়ে বেশি প্রশস্ত ও কল্যাণকর কিছু কখনো তোমাদের দান করা হবে না (বুখারি)।

     অন্য এক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মুসলিম ব্যক্তির ওপর যে কষ্ট-ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি আসে, এমনকি, যে কাঁটা তার দেহে ফোটে, এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেন’ (বুখারি)।

     বড়ো অস্থিতিশীল মানুষের মনে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিপদ আপদের সময় প্রশ্ন জাগে, তারা এতা বিশাল বিশাল ক্ষয়ক্ষতি, কঠিন ও ভয়ংকর বিপদ আপদের মুখোমুখি হয়ে কিসের আশায় ধৈর্য ধরবে? কিভাবেই বা ধৈর্য ধারন করবে? মনস্তাত্তিক এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা দেখি আল্লাহর সম্মানিত নবী হযরত মুসা আ: ও বিজ্ঞ বান্দাহ খিজির আ: এঁর দেখা হওয়া পরবর্তি ঘটনাসমূহের ধারাবহিকতায়। 

     পৃথিবীতে যারা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে চান, তাদের মধ্যে প্রচন্ড বৈরি পরিবেশেও ধৈর্য ধারন করে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে সক্ষমতা অর্জনের কোন বিকল্প নেই। আর সেই যোগ্যতা অর্জন করা তখনই সম্ভব যখন ব্যক্তি তার মনাসকিতায় আল কুরআনের থট প্রসেস বা চিন্তাধারাকে ধারণ করবে। এ কারণেই কুরআনের প্রত্যেক পাঠকের উচিৎ আল কুরআন যে চিন্তামানসকে তুলে ধরতে চায় সেটা উপলব্ধী করা এবং পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে ধারন করে রাখা। (সংক্ষেপকৃত)
--------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ, গ্রন্থপ্রনেতা, গীতিকার, ইতিহাস বিশ্লেষক, গবেষক, ইংল‍্যান্ডের বেসরকারী মানসিক হাসপাতালের সাবেক সহকারী পরিচালক ও প্রবন্ধ লেখক, ইংল‍্যান্ড।

Post a Comment

0 Comments