Recent Tube

আগামী তুরস্ক। মাহদি গালিব।




                       আগামী তুরস্ক;



    ওসমানি সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিস্তার ঘটে ১৫২১ সালে। পুরো সাম্রাজ্যের আয়তন দাঁড়ায় ৩৪ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার প্রায়। ২৩টা বাংলাদেশের সমান। বিভিন্ন সময় আয়তন বাড়ে-কমে। শুরু থেকে শেষ অবধি হিসেব করলে গড় আয়তন হয়- ১.৮ মিলিয়ন (১৮ লক্ষ) বর্গ কিলোমিটার।  

   প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ হয়। মিত্রশক্তি যুদ্ধে জিতে। মিত্রশক্তি হচ্ছে- সার্বিয়া, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য (ইংরেজ), ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।  হেরেছিল কেন্দ্রীয় শক্তি। এরা হচ্ছে- ওসমানি সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়া।

    মিত্রশক্তি ওসমানি সাম্রাজ্য জবাই করে। টুকরো টুকরো করে। বর্তমান তুরস্ক ৭ লক্ষ ৮৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার (৭৮৩,৫৬২ km²)। মানে, ১০ লক্ষ ১৬ হাজার (১,০১৬,৪৩৮) বর্গ কিলোমিটারের বেশি এলাকা আলাদা করা হয়।  বানানো হয় নতুন নতুন রাষ্ট্র।   

   ওসমানিদের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকে লুজানের চুক্তি। এটি ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত হয়। এর মূল ক্রীড়নক ছিল বৃটেন। এ চুক্তিকে ‘শতাব্দী চুক্তি’ বলা যায়। চুক্তির মূল পয়েন্ট পাঁচটি। 

  ১. খেলাফাত ধ্বংস : ওসমানি খেলাফাত সমূলে শেষ করা হয়। উত্তরাধিকারীদের গুপ্তহত্যা করা হয়। নিখোঁজ করা হয়। সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়, পাচার করা হয় পশ্চিমা মুলুকে মুলুকে। মুসলিম উত্থানের টুঁটি চিপে ধরা হয়। 

  ২. সেকুলার রাষ্ট্র : তুর্কি হয় একটি সেকুলার রাষ্ট্র। ইসলাম চর্চা হয় প্রায় নিষিদ্ধ। আরবিতে আযান নিষিদ্ধ করা হয়। কামানের মুখে কোরআন রেখে উড়িয়ে দেয়া হয়। এমনকি ভাষাও বদলে যায়। আগে আরবি ও ফার্সির ব্যাকরণ অনুসারে লেখালেখি হত। অক্ষর বা বর্ণমালাকে বলা হত আবজাদ। আরবি বর্ণমালার মত ছিল সেটি।  একে ওসমানি ভাষাও বলা হয়।  এসব বদলিয়ে ল্যাটিন অক্ষরে লেখালেখি আরম্ভ হয়। রাতারাতি একটি জাতি হয় অক্ষরজ্ঞানহীন। চিন্তা করুন, কাল সকাল থেকে যদি অফিসিয়াল ভাষা হয় চাইনিজ, আপনার অবস্থাটা কী হবে? সত্য রূপটা হচ্ছে, সেকুলারের নামে জায়নিস্টদের মনের সমস্ত ঝাল মেটানো হয় তুরস্কে। একটি সুমহান জাতিকে ফেলে দেয়া হয় পরিচয়হীনতার অন্ধকূপে। 

  ৩. জ্বালানী উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা : তুর্কি জীবাশ্ম জ্বালানী বা খনিজ তেল উৎপাদন করতে পারবে না। না নিজের দেশে, না অন্য দেশে। দেখুন, বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতি প্রায়পুরোটাই পেট্রো-ডলারের দখলে। সৌদি, কুয়েতিসহ গালফের দেশগুলো তেল বেঁচেই আঙুল ফুলে কলাগাছ। এখানে, তুর্কিকে পেট্রো-অর্থনীতি থেকে বোল্ড আউট করা হয়। 

  ৪. বাসফরাস প্রণালী : বাসফরাস প্রণালীকে তুর্কির এখতিয়ার একেবারেই তুলে নেয়া হয়। সহজ ভাষায় প্রণালী হচ্ছে- দুই সমুদ্রসীমার শর্টকাট রাস্তা। ধরুন দুই দিকে দুটি সাগর। মাঝখানে একটা জমি। আপনি ওপাড়ের সমুদ্রে যেতে চান। তাহলে আপনাকে পুরো জমিটা ঘুরে এপাড়ে আসতে হবে। পেরোতে হবে হাজার হাজার কিলোমিটার। কিন্তু জমিটার মাঝ দিয়ে যদি একটা রাস্তা থাকে, তবে বিষয়টা সহজ হয়ে যায়। হাজার কিলোমিটার ঘুরতে হয় না। সময় বাঁচে। অর্থ সাশ্রয় হয়। 

     বাসফরাস হচ্ছে এমনি এক প্রণালী। যা এশিয়া থেকে ইউরোপে যাবার সহজ রাস্তা। এখন চিন্তা করুন, কী পরিমাণ ব্যবসা ইউরোপ-এশিয়ায় হয়? কী পরিমাণ মাল বোঝাই জাহাজ চলাচল করে? এই জাহাজগুলোতে উঠানো টোল কী পরিমাণ হবে? ভৌগলিকভাবে তাহলে বসফরাস কতটা গুরুত্বপূর্ণ? 

     লুজানের চুক্তিতে বসফরাস থেকে তুর্কির কর্তৃত্ব কেড়ে নেয়া হয়। মানে যে যতই এ পথে ব্যবসা করুক, তুর্কি শুল্ক তুলতে পারবে না। ভাবুন, কতটা আর কত ভাবে তুর্কিকে পঙ্গু করা হয়েছে। 

   ৫.হেজাজ নিয়ন্ত্রণ : আজকের সৌদিআরব কিন্তু আসল নাম না। এটা গোত্রবাদী সৌদদের সৌদবংশ অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সৌদি রাজবংশের সূচনা হয়। এর আগে মক্কা-মদিনা ওসনানিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল কয়েক শতাব্দী। ওয়সমানিগণ নিজেদের আরবের শাসক বলত না। বলত খাদেম বা সেবক। লুজান চুক্তি অনুসারে, ১৯২৩ পড়ে ১০০ বছর ওসমানিরা জাজিরাতুল আরবের দিকে প্রশাসনিক ভাবে অগ্রসর হতে পারবে না।   

    তুর্কিরা এখনো হজ্ববে গেলে একটা আলাদা মানচিত্র সাথে রাখে। সৌদি-ওহাবিরা মুসলিমদের প্রায় সমস্ত নিদর্শন ধ্বংস করেছে। কার মাজার কোনখানে বুঝা কষ্টকর। কিন্তু তুর্কিরা ঠিকই জানে। কারণ তাদের মানচিত্রে সেসব চিহ্নিত আছে। কোন সাহাবির মাজার কোনখানে, কোন স্থাপত্য কোথায় ছিল তারা সবই জানে। ওহাবিরা মাজার জিয়ারত সহ বিভিন্ন কাজে বাঁধা দেয় মুসলিমদের। বিরক্ত করে। কিন্তু তুর্কিদের দেখলে ভয়ে ভাগে। 

     তুর্কিরা এখনো কাবা শরিফের গিলাফ ধরে কান্না করে। বলে- ইয়া আল্লাহ্! মক্কা-মদিনার খেদমতের সুযোগ আমাদের আবার দান করো, তোমার হাবিবের ওয়াস্তে আমাদের ক্ষমা করো। 

 -------
   মূল কথায় আসি। ৩ বছর পর ২০২৩ সাল। মানে ১০০ বছরের চুক্তি শেষ হতে চলেছে। এরপর কী হবে? তুর্কি কী করবে? 

    প্রথমেই তারা তেল উঠাবে। মধ্যপ্রাচ্যের তেল ব্যবসার লাল বাতি জ্বালিয়ে ছাড়বে। বসফরাস প্রণালী নিয়ন্ত্রণে নিবে। ইউরোপ-এশিয়ার বাণিজ্য চলাচলে ছড়ি ঘুরাবে। যা ইউরোপিয়দের জন্য অশনিসংকেত। তুর্কির অর্থনীতি এখনো বিশাল না। কিন্তু তেইশের পরে ফুলেফেঁপে উঠবে। 

    তুর্কি যেকোন মূল্যে সুপার পাওয়ার হতে প্রস্তুত। মার্কিন মুলুকের সাথে সমস্ত প্রতিযোগিতায় নামতে প্রস্তুত। চিন, রাশিয়া সহ মার্কিন বিরোধী প্রায় সমস্ত শক্তিগুলোর সাথে বর্তমান তুর্কির বেশ সখ্যতা। এমনকি পাকিস্তানের সাথেও তুর্কির জমজ ভাইয়ের সম্পর্ক। ভুলে গেলে চলবে না যে, পাকিস্তান একমাত্র মুসলিম রাষ্ট্র যে কী-না পারমানবিক শক্তিধর। পাকিস্তান যার দিকে, বাজিমাৎ তার দিকে অনেকখানি ঘুরে যায়। 

    আর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হতেও পারে। মুসলিমদেশগুলোর প্রতি তুর্কির আচরণগুলো খেয়াল করুন। ফিলিস্তিনের প্রতি সবচে বেশি কার্যকারী পদক্ষেপ নেয় সবার আগে তুরস্ক। রোহিঙ্গা সহ নিপীড়িত মুসলিমদের সাহায্যে লাফিয়ে এগিয়ে আসে। তুর্কি মুসলিমদের মাঝে শত বছর আগের সেই চেতনা ফেরাতে চাচ্ছে। দিরিলিস আর্তাগুল, কুরুলুস উসমান, সুলতান আবদুল হামিদ  মাহের জাইন এর মত সাংস্কৃতিক বিপ্লব সে দিকেই স্পষ্ট ইংগিত দেয়। আর এমন হলে, মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন তাবেদার রাজবংশগুলো অবস্থা কী হবে নিজেই ভাবুন। 

     ভবিষ্যৎ আমি জানি না। অনুমান করাও সুকঠিন। হয়ত তুর্কির মাধ্যমে ফিরতে পারে মুসলিমদের সোনালী অতীত। মনে রাখতে হবে, মদিনা-মুনিব দ. তাঁর পবিত্র কন্ঠে বলেছেন- কেয়ামতের আগে একবার প্রতিষ্ঠিত হবে খেলাফাত।

লেখক -

Post a Comment

0 Comments