Recent Tube

যুগশ্রেষ্ঠ এক স্বপ্নদ্রষ্টা পণ্ডিত ও উম্মাহর সুযোগ্য অভিভাবক শাহ আব্দুল হান্নান রহঃ. ওয়াহিদুল ইসলাম।




 
স্র আলোকোজ্জ্বল সৃষ্টিশীল পাণ্ডিত্য ও  কর্মের অম্লান স্মৃতির মাঝে চিরভাস্বর তিনি ;

                   শেষ পর্ব (৫):

যুগশ্রেষ্ঠ এই স্বপ্নদ্রষ্টা পণ্ডিত ও উম্মাহর সুযোগ্য অভিভাবক শাহ আব্দুল হান্নানের সাথে আমার কিছু সুখকর ব্যক্তিগত স্মৃতি...
--------------

    আমি যখন জেদ্দায় ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকে কর্মরত, তখন শাহ আব্দুল হান্নান চাচা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রাইভেট ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশে লিমিটেড এর সর্বোচ্চ পদে নিয়োজিত। থাকতেন ঢাকার সেগুন বাগিচার একটি ফ্ল্যাট বাসায়। প্রথমবার জেদ্দা থেকে দেশে বেড়াতে গিয়ে একফাঁকে উনাকে সংবাদ পাঠালাম যে আমি দেশে। আমাকে সস্ত্রীক এক বিকেলে উনার বাসায় যেতে বললেন। আমরা সময় মতো উনার বাসায় হাজির হলাম। চাচা আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে অতিথি রুমে বসিয়ে তড়িঘড়ি এদিক সেদিক পায়চারী করতে লাগলেন। বুঝলাম উনি আমাদেরকে সময় দেয়ার আগে উনার ঝুলন্ত কাজ গুলো এক পলক দেখে নিচ্ছেন কাজ গুলো সময় মতো সুসম্পন্ন করতে পেরেছেন কিনা সেতা নিশ্চিত করার জন্য। এ সুযোগে আমার স্ত্রী চাচার পুরো বাসাটা এক নজরে দেখে নিলো। এবার চাচা একজনকে আমাদের জন্য নাস্তা পানির ব্যবস্থা করতে বলে আমাদের কাছে এসে বসলেন। আমার স্ত্রী কিছু এটা সেটা গিফট হিসেবে চাচার হাতে তুলে দিলে চাচা কৃতজ্ঞতার সাথে খুব আপত্তি জানালেন। উনি বললেন, তোমরা এসেছো তাতেই আমি অনেক খুশী। চাচাকে খুশী করার জন্য এগুলো আনার তো কোনো দরকার ছিলো না। তাছাড়া তোমাদের এতো দামী জিনিস আমার ব্যবহার করার সময়ও হবে না। তোমরা অন্য কাউকে দিয়ে দিতে পারো। আর আমাকে যদি রাখতেই হয়, তাহলে তোমরা আমাকে অনুমতি দাও আমি অন্য কাউকে দিয়ে দেবো যিনি এগুলো ব্যবহার করতে পারবেন। 
     চাচা আমাদের অবস্থান কালের প্রতিটা মুহূর্ত গঠনমূলক আলোচনায় কাটালেন। আমাকে অনেক গুলো বইয়ের লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে পড়তে বললেন। আমার আশেপাশে যারা থেকেছেন তারা সবাই জানে্ন যে আমার জীবনের সবচে বেশী অনাগ্রহের বিষয় যা আমি পারতপক্ষে এড়িয়ে চলি তা হলো পড়া। বিশেষতঃ বইয়ের কলেবর যদি পঞ্চার পৃষ্ঠার বেশী হয় তাহলে ঐ বই একান্ত বাধ্য না হলে আমার ছুঁয়ে দেখতেও মন চায় না। চাচা বললেন, আল্লাহ তোমার মধ্যে অনেক প্রতিভা, যোগ্যতা ও সুযোগ দিয়েছেন। এসবকিছুকে কাজে লাগিয়ে তুমি বিশ্বের একজন সেরা পন্ডিত হবে এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে আধুনিক জাহেলিয়াতের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় তোমাকে অনেক উদ্ভাবনী শক্তি অর্জন করতে হবে। বেশী বেশী না পড়লে তা তুমি অর্জন করতে পারবে না। তোমাকে ভালো চিন্তাশীল লেখক হতে হবে; বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর লিখতে হবে। বেশী বেশী না পড়লে তুমি কিছুই লিখতে পারবে না। তুমি যতো বেশী অন্যান্যদের বই পড়বে ততো বেশী জোরালো ভাষায় লিখতে পারবে। প্রতিদিন দুই তিনশ পৃষ্ঠা পড়ার পরিকল্পনা করবে। পড়াটাকে নেশায় পরিণত করবে। আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করেছিলো – চাচা জীবনে বিভিন্ন ব্যস্ততা আছে যা অস্বীকার করা যায়না। এসব ব্যস্ততার মাঝে এতো সময় কই দুই তিনশ পৃষ্ঠা বই পড়ার? চাচা বললেন, আম্মু প্রথম দিকে একটু কষ্ট হবে। এই কষ্টটা মেনে নিয়ে পড়া অব্যাহত রাখলে যখন তোমার মধ্যে পড়ার তীব্র আগ্রহ ও নেশা জন্মে যাবে তখন কাজটা সহজ হয়ে যাবে। ব্যাপক পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার পর একপর্যায়ে কোনো একটা বই পড়ার জন্য হাতে নিলে দেখবে যে বইটির সবকিছু তোমাকে হুবহু পড়তে হবে না। কিছু পৃষ্ঠা না পড়লেও চলবে, কিছু পৃষ্ঠা কোনো রকম চোখ বুলিয়ে যাবে আর কিছু পৃষ্ঠা তোমাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। একটা বইয়ের যেসব বিষয় তোমার ইতোমধ্যে পড়া ও জানা হয়ে গেছে, সেসব বিষয় আবার পড়ে সময় নষ্ট করবে না। বইটির যেসব বিষয়গুলো তোমার কাছে নতুন মনে হবে শুধু সেগুলোই গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়বে। চাচা আমাদের হাতে তার লেখা কিছু বই ধরিয়ে দিলেন এবং আমরা বিদায় নিলাম। 

     ফেরার পথে আমার স্ত্রী আমাকে জিজ্ঞেস করলো, চাচার বাসায় কি কিছু লক্ষ করেছো? আমি বললাম, চাচাকে খুব ব্যতিব্যস্ত দেখলাম। কথাবার্তা সহ সবকিছুতে চটপটে তাড়াহুড়া ভাব লক্ষ্ করলাম। তাছাড়া আর কিছুই আমার চোখে পড়েনি। আসলে এটা ব্যক্তিগতভাবে একান্ত আমার না  আমাদের সকল পুরুষের সীমাবদ্ধতা তা জানিনা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বিশেষতঃ কোনোকিছু পর্যবেক্ষনের ব্যাপারে যখন আমার পর্যবেক্ষনটা আমার স্ত্রীর পর্যবেক্ষনের পাশাপাশি রাখি তখন নিজেকে স্রেফ অন্ধ হিসেবে আবিষ্কার করি। আমি একজন মানুষকে কয়েক সেকেন্ড দেখে হয়তো তার সম্পর্কে দুই তিনটা পর্যবেক্ষন পেশ করতে পারি তাও আবার সবকিছুই তার বাহ্যিক বিষয়ে যা কোনোভাবেই চোখ এড়াতে পারেনা। কিন্তু আমার স্ত্রী ঐ একই সময়ে ব্যক্তিটিকে দেখে তার বাহ্যিক, আভ্যন্তরীণ, চালচলন, স্বভার-চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গির একটা দীর্ঘ বর্ণনা দিতে পারে। চাচার বাসায় স্বল্পকালীন অবস্থানের প্রেক্ষিতে চাচা কিংবা তার বাসা সম্পর্কে উপরে যা বললাম তা ছাড়া আমার মনের মধ্যে অন্য এমন কোনো বিশেষ ধারণা জন্মেনি যা আমি পাঠকের কল্যাণে পেশ করতে পারি। অথচ আমার স্ত্রির ভাবসাব দেখে মনে হলো সে যেনো চাচার উপর পিএইচডি অর্জন করে ফেলেছে। আমার স্ত্রী বললো, চাচা এতো বড়ো মাপের একজন মানুষ, সরকারের এতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন এবং এখন এতো বড়ো পজিশনে আছেন সে হিসেবে উনার বাসাটা যতো সুন্দর হতে পারতো, যতো সাজানো গোছানো হতে পারতো তার কিছুই নেই। যা কিছু দেখলাম সবই হতবাক করার মতো। এমনকি আমাদেরকে যেখানে বসতে দিয়েছেন সেখানটাও আরও পরিপাটি ও দৃষ্টিনন্দন হতে পারতো। আসবাব-পত্র সবই অনেক পুরনো। আমার স্ত্রী একে একে অনেক কিছুর বর্ণনা দিলো যা আমার মনে গাঁথা তো দূরের কথা নজরেও পড়েনি। আমার স্ত্রীর বর্ণনা মতে এককথায় চাচার বাসাটা খুবই দিন আনি দিন খায় মানুষের বাসা এবং বাসার সবকিছুই অবহেলিত। আমার স্ত্রী আরও একটা পর্যবেক্ষন দিয়েছিলো, চাচার মতো অবস্থানে থেকে একজন মানুষ স্বভাবতই পারিবারিক সুখের জন্য যেসব জিনিস নিশ্চিত করে চাচার জীবনেও সেসব সুখের কিছুটা থাকতে পারতো, কিন্তু চাচা হয়তো সেগুলোকে পাত্তাই দেননি। আমার র‍্যাডারে যা বিন্দুমাত্রও ধরা পড়েনি এমন অনেক বিষয়ে চাচার প্রতি আমার স্ত্রীর অনেক  সমবেদনা ও করুণা হলো। 

    বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো প্রাইভেট ব্যাংক এবং বিশ্বের একটা নামকরা ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, এর চেয়ারম্যান হিসেবে এক সময় শাহ আব্দুল হান্নানকে IDB’র প্রেসিডেন্ট দাওয়াত দিলেন একটি উচ্চ পর্যায়ের ওয়ার্কশপের বক্তা হিসেবে। সে উপলক্ষে চাচা জেদ্দায় আসার কথা ইমেইলে আমাকে জানালেন। আমি IDB’র সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে চাচার ফ্লাইটের তারিখ ও সময় জেনে নিলাম। সে মোতাবেক চাচাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এয়ারপোর্টে হাজির হলাম। স্বভাবতই প্রটোকল হিসেবে এমন ভিআইপি মেহমানদের থাকা, খাওয়া, যাতায়াত ও ওমরাহ পালনের জন্য IDB’র ভিআইপি ব্যবস্থা থাকে। তাই চাচা সরাসরি এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় আসবেন কিনা সন্দিহান ছিলাম। বাসায় এলে ভালো না হয় অন্ততঃ এয়ারপোর্টে প্রথম দেখা করার স্বল্প পরিকল্পনায় এয়ারপোর্টে গিয়ে চাচার জন্য অপেক্ষা করছি।  চাচা ইমিগ্রেশন চুকিয়ে সিকিউরিটি পেরিয়ে বেরিয়ে এলেন। চাচার হাত থেকে ব্রিফকেস নিয়ে কোলাকুলি করলাম। লাগেজ বেল্ট থেকে লাগেজ সংগ্রহ করতে ভুলে যাননি নিশ্চিত করার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, চাচা লাগেজ সংগ্রহের ব্যাপারে কিছু করতে হবে? উনি ব্রিফকেসের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, না লাগেজ তো তোমার হাতেই আছে। আমি বললাম, তাহলে আর কিছু বাকী না থাকলে চলেন গাড়ির দিকে যাই। উনি বললেন, তোমাদের অফিস থেকে আমাকে বলা হয়েছিলো যে হোটেল থেকে লোক এসে আমাকে হোটেলে নিয়ে যাবে। তাই আগে লোকটাকে খুঁজে বের করতে হবে। দুজনে এদিক ওদিক চাকাতেই চোখে পড়লো এক ব্যক্তি Mr. Shah Abdul Hannan লেখা একটা প্লাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা লোকটার দিকে এগিয়ে যেতেই লোকটা চাচাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, Are you Mr. Shah Abdul Hannan? চাচা yes বলার সাথে সাথেই লোকটা অতি ভদ্রতার সাথে সালাম জানিয়ে হ্যান্ডশেক করে চাচাকে বললো যে সে হোটেল থেকে এসেছে চাচাকে নিতে। চাচাকে অনুরোধ করলো তাকে অনুসরণ করে হোটেলের গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে। চাচা কিছুটা ইতস্ততঃ প্রকাশ করলেন প্রথম। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমাকে নিতে এসেছো? আমি বললাম, জ্বি। উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমার ওয়ার্কশপের দিন গুলোতে আমাকে ওখানে নামিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে? কোনো ঝামেলা হবে না তো? আমি বললাম, চাচা আমার কোনো ঝামেলা হবেনা। আপনার ওয়ার্কশপ তো IDB টাওয়ারেই। আমরা প্রতিদিন একসাথে রেডি হয়ে সকালে বেরিয়ে যাবো। আপনাকে ওয়ার্কশপে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিস করবো। তারপর অফিস শেষে আপনাকে নিয়ে আবার একসাথে বাসায় ফিরবো। চাচা আমার ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়ে লোকটাকে বিণয়ের সাথে বললেন, তুমি চলে যাও। আমার ভাতিজা এসেছে তো আমি ওর বাসায় যাই। লোকটি বললো, কিন্তু আপনার সব ব্যবস্থা তো আমাদের সাথে করা আছে! আপনার জেদ্দায় অবস্থানকালে থাকা, খাওয়া, যাতায়ার, মক্কায় গিয়ে ওমরাহ সম্পন্ন করানো সহ যাবতীয় দায়ভার আমাদের উপর ন্যস্ত। আপনি এসব সুবিধা কেনো ত্যাগ করবেন? একটু ভেবে বলুন। চাচা বললেন, না তুমি চলে যেতে পারো। আমি আমার ভাতিজার বাসায় থাকতে বেশী স্বস্তি বোধ করবো। ভাতিজা আমার জন্য যা যা করার দরকার সবকিছু করবে। তোমার প্রটোকল অনুযায়ী তুমি রিপোর্ট করো যে আমি আমার ভাতিজার বাসায় উঠেছি।  

    বাসায় ঢুকে চাচা ব্রিফকেস খুললেন। পরনে যেমন প্যান্ট, গেঞ্জি, শার্ট, স্যুট আছে, ব্রিফকেসের মধ্যে ঠিক তেমন আরেকটি করে গেঞ্জি, শার্ট ও প্যান্ট আছে। আর কিছুই নেই; না আছে টাই আর না আছে আরেকটা স্যুট। ভাবলাম আমরা সপ্তাহের প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, টাই পরে অফিসে যাই আর চাচা এতো বড়ো মেহমান হয়ে এতো উচ্চ পর্যায়ের ওয়ার্কশপ মাত্র একটা স্যুট, দু’টো শার্ট আর দু’টো প্যান্ট দিয়ে চালিয়ে দিবেন! আমরা চাচাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলাম জেদ্দার মার্কেট থেকে ভালো ব্রান্ডের অন্ততঃ আরেকটা করে শার্ট, প্যান্ট ও স্যুটের ব্যবস্থা আমরা করে দিতে চাইলাম। চাচা ভেটো দিলেন, লাগবে না। লাগবে না তো লাগবেই না। কি হবে এতো বেশী কাপড় চোপড় দিয়ে। আমার যা আছে তাতে তো ভালো ভাবেই চলে যাবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু ব্যবহার করা একেবারেই আমার পছন্দ না। আমাকে তোমরা একটু ইস্ত্রির ব্যবস্থা করে দিয়ো ব্রিফকেসের কাপড় গুলো ভাঁজ পড়ে গেলে ওগুলো ঠিক করে নেবো। আর কিছু লাগবে না। টাই এর কথা বললে উনি জানালেন যে উনি টাই এর বিরোধী না তবে ব্যক্তিগতভাবে উনি টাই পরাটা পছন্দ করেন না। 

   আমার স্ত্রী চাচাকে ঢাকায় তার বাসায় যেভাবে দেখেছে তাতে তার মনে হয়েছে চাচার জীবনে কোনো চাওয়া-পাওয়া, উপভোগ, বিলাস বা আরাম আয়েশ কিংবা বিশ্রামের স্থান নেই। এমন একজন মানুষের প্রতি কার না অনুকম্পা হয়? এবার চাচাকে নিজের বাসায় খুব কাছে পেয়ে আমার স্ত্রী বিশাল পরিকল্পনা এটেছে চাচাকে কয়েকটা দিনের জন্য যথেষ্ট বিশ্রাম ও আরাম আয়েশের সুযোগ করে দিতে হবে। যে কয়বার চাচা বাসায় খাওয়ার সুযোগ পান, প্রতিবারের খাবারের মেন্যুতে নতুন নতুন আইটেম রাখার পরিকল্পনা। কিন্তু দুয়েক ওয়াক্ত খাওয়া-দাওয়ার পর একটা সমস্যা বেঁধে গেলো। কোনো এক ওয়াক্তে চাচার কাছে যদি কোনো খাবার পছন্দ হয়ে যায়, মুখে ভালো লেগে যায়, তাহলে পরবর্তী প্রতি ওয়াক্তে চাচাকে আর অন্যান্য কিছুই খাওয়ানো যায়না। আগের ঐ জিনিসটাই চাচা সব ওয়াক্তে খেতে চান। প্রথমদিন সকালে চাচাকে জিজ্ঞেস করা হলো তিনি নাস্তা কি করবেন। চাচা বললেন, আম্মু তুমি এতো ঝামেলা করো না। তুমি যেটা ভালো মনে করো এবং যা দিতে তোমার কোনো ঝামেলা হবে না, এমন কিছু দিলেই আমি খেয়ে নেবো। আমার স্ত্রী বললো, চাচা তাহলে আজকের নাস্তার জন্য প্যানকেক বানাই মধু বা ম্যাপল সিরাপ দিয়ে খেয়ে নিবেন। সাথে ডিম পোচ, ব্রেড এবং কিছু ফলমুল থাকবে। চাচা জিজ্ঞেস করলেন, আম্মু প্যানকেকটা কি? আমার স্ত্রী বললো, চাচা বানাই আগে তারপর দেখবেন এবং খাবেন। চাচা বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে বানাও।

  চাচা সেদিন সকালে প্যানকেক খেয়ে খুব মজা পেলেন। মজা পেয়ে চাচা দুয়েক টুকরো বেশীই খেলেন। চাচার রাতের খাবার খুব সাদামাঠা। ভিন্ন ভিন্ন রকমারি আইটেম সামনে থাকলেও চাচা একটু দেশীয় শাক-সবজি, ডাল এবং সামুদ্রিক মাছ বেশী মজা করে খেয়েছেন। পরের দিন সকালে নাস্তার জন্য আমার স্ত্রী অন্য কোন নতুন আইটেম বর্ণনা করে অনুমতি চাইলো। চাচা বললেন, না আম্মু তুমি অন্য কোনো কিছু বানায়ো না। কোনো ঝামেলার দরকার নেই। কালকে যেনো কি বানিয়েছিলে ঐটাই আবার বানাও। ওটা খুব ভালো লেগেছে। আমার স্ত্রীর স্বভাব হলো বাসায় মেহমান থাকলে কোনো আইটেম দ্বিতীয়বার সামনে না দেয়া। আর ওদিকে চাচার স্বভাব উল্টো। বেশী আইটেম উনার পছন্দ না। আর যেটা মুখে একবার ভালো লাগে প্রতি ওয়াক্তে সেটা হলেই চাচা খুশী। প্রতিদিন সকালে নাস্তার সময় চাচা প্যানকেকই খেয়েছেন। অন্যান্য আইটেমের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। 

   IDB তে চাচার ওয়ার্কশপ তিনদিনে শেষ হয়ে গেলো।  দেশের ফেরার এখনো কয়েকদিন বাকী। বাকী সময়টা উনি অনুগ্রহ করে আমাদের জন্য বরাদ্দ করেছেন, আমাদের সাথে থাকবেন। আমার স্ত্রী মহা খুশী। চাচাকে খুব আপন করে, পরিবারের একজন সর্বোচ্চ মুরুব্বীর মতো করে সেবা করা এবং সরাসরি প্রশ্ন করে অনেক কিছু জানার সুযোগ। জেদ্দায় অনেক বাংলাদেশী পেশাজীবি পরিবারের বসবাস। স্বামীরা অফিসে গেলে মহিলারা সারাক্ষণ বাসায় একাকী কাটান। ড্রাইভিং নিষেধ তাই স্বামীরা বাসায় ফেরার আগ পর্যন্ত মহিলারা বাইরে যাওয়ার সুযোগও পাননা। গৃহস্থালীর কাজকর্ম সেরে যে প্রচুর সময় তাদের হাতে থাকে সেটা অন্যান্য মহিলাদের সাথে ফোনালাপ বা টিভি দেখে কাটে। এ কারণে মহিলাদের জন্য যদি কোনো সময় একত্রিত হওয়ার বা পারিবারিক ও সামাজিক কোন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার সুযোগ আসে সে সুযোগের দখিনা মলয় যেনো তাদের অন্তরাত্মা জুড়িয়ে দেয়। চাচার সাথে আলাপ করে উনার অনুমতি নিয়ে আমার স্ত্রী প্রতিদিন বাসায় মহিলাদের সমাবেশের আয়োজন করে। আমি যখন অফিসে থাকি তখন চাচার সাথে মহিলাদের এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মহিলাদেরকে চাচার মিটিংয়ে নিয়ে আসা এবং মিটিং শেষে তাদের বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্য কিছু ভাই, যাদের ঐ সময় কাজ নেই, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কয়েকদিনের জন্য আমার বাসা চাচার Witness এর ক্লাসে রূপ নিলো। মহিলাদের যার যত প্রশ্ন আছে সব সাজিয়ে গুছিয়ে চাচার সামনে হাজির হন। চাচাও তাদের প্রশ্ন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্য বোধ করেছেন। বিশেষতঃ উল্লেখ্য যে, আমাদের সমাজে মহিলারা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত ও পিছিয়ে থাকার কারনে চাচা মহিলাদেরকে বেশী গুরুত্ব দিতেন এবং তাদেরকে কিভাবে আরও বেশী সম্মানিত করা যায়, তাদের অধিকার নিশ্চিত করা যায় এবং সমাজ সংসারে তাদেরকে আরও বেশী অবদান রাখার সুযোগ করে দেয়া যায় তা নিয়ে তিনি খুব ভাবতেন এবং পথনির্দেশনা দিতেন। 

    চাচা জানালেন উনি আমার সুযোগ সুবিধা মতো কোনো একদিন মামুন আল-আযামীর বাসায় যেতে চান। উনি বললেন, অধ্যাপক গোলাম আযম ভাই রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার পর এখন জেদ্দায় উনার বড়ো ছেলে মামুন আল-আযামীর বাসায় আছেন। উনি জেদ্দায় আছেন আর আমি জেদ্দায় এসে উনার সাথে দেখা না করে দেশে ফিরে গেলে কেমন দেখায়? মামুন আযামী ভাই IDB’তেই চাকরী করেন এবং IDB’র IRTI টাওয়ারে বসেন। IDB তে যোগ দেয়ার পর অন্যান্য বাংলাদেশীদের মতো উনার সাথেও অনেক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক হলো আমার। অসম্ভব ভালো মানুষ এবং সদা হাসিমুখ সদালাপী। মামুন ভাইকে জানাতেই উনি অত্যন্ত খুশী হয়ে চাচাসহ আমাদের পরিবারকে উনার বাসায় রাতের খাবারের দাওয়াত দিলেন। চাচাকে নিয়ে এক সন্ধ্যায় হাজির হলাম মামুন ভাইর বাসায়। দেখা হলো এমন একজন ব্যক্তির সাথে যিনি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী আলোচনা সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন এবং বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে যিনি বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের অবিসংবাদিত শীর্ষ নেতা। এর আগে অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবকে দেখিনি এমন না। তবে এই প্রথম ঘরোয়া পারিবারিক পরিবেশে তার একান্ত সান্নিধ্য, তাকে পর্যবেক্ষন করার এবং আরেকজন বিশিষ্ট পন্ডিত ও গুণীজনের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে তার ধীরস্থির ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শোনার সুযোগ এই প্রথম। আমি নিজেও দু’জনকে অনেক প্রশ্ন করেছি। সেদিন আমার মনে হয়েছিলো বাংলাদেশের আকাশের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র যেনো আমাদের মাঝে আমাদের সামনে একই সোফায় পাশাপাশি বসে খোশ গল্প করছেন। 

     এবার আমাদের ছেড়ে চাচার দেশে ফেরার পালা। আমার স্ত্রী অনেক চিন্তা গবেষণা করেছে চাচাকে কি গিফট দেয়া যায় যা চাচার জন্য দরকারী এবং চাচা তা নিতে অস্বীকার করবেন না। চাচা যে ব্রিফকেসটা সাথে এনেছেন সেটা বেশ পুরনো। আমার স্ত্রী কৌশলে জেনে নিলো চাচা ঐ একই ব্রিফকেস অফিসে নিয়ে যান কিনা। চাচা জানালেন তিনি অফিসে যাওয়ার সময় কাগজপত্র সাথে নিতে হলে ফাইলে করে নিয়ে যান। আমার স্ত্রী হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো যে চাচাকে একটা অফিস ব্যাগ গিফট করা যাবে। এতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার জন্য একটা অফিসব্যাগ খুবই জরুরী। এটা উনি ঠেলে ফেলে দিতে পারবেন না। আমার স্ত্রী চাচার জন্য খুব ভালো ব্র্যান্ডের একটি মাঝারি সাইজের অফিস ব্যাগ কিনলো। বিদায়ের আগে ব্যাগটি চাচার হাতে দিলে চাচা জিজ্ঞেস করলেন, আম্মু এটা কি ঢাকায় গিয়ে কাউকে পৌঁছে দিতে হবে? আমি কিন্তু কোথায় গিয়ে কাউকে পৌঁছে দিতে পারবো না। তুমি তোমার লোকটাকে বলবে আমার কাছে এসে সংগ্রহ করে নিতে। আমার স্ত্রী বললো, না চাচা এটা অন্য কারও জন্য নয়। এটা আপনার জন্য আমাদের একটা ক্ষুদ্র উপহার। আপনি যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এই ব্যাগে ঢুকিয়ে অফিসে নিয়ে যেতে পারবেন। চাচা বললেন, তুমি কেনো এই অযথা খরচ করতে গেছো। আমি তো ফাইলে করে সব কাগজপত্র অফিসে নিয়ে যাই। তাতে তো আমার বেশ চলছে। আমার তো ব্যাগের দরকার নেই। এই ব্যাগট্যাগ আমার ব্যবহার করা হবে না। এটা আমার জন্য অনেক ঝামেলার কাজ। এই ব্যাগ আমাকে দিলে এটা বাসায় পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাবে। তুমি বরং এটা অন্য কাউকে দিলে তিনি ওটার সদ্ব্যবহার করবেন। চাচা কিছুতেই ব্যাগটি নিতে রাজি হলেন না। পরে ব্যাগটি আমার হয়ে গেলো। চাচা চলে গেছেন তার মহান প্রভুর সান্নিধ্যে। মহান আল্লাহ তার এই সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপনকারী প্রিয় বান্দাহকে অনন্তকালের অনাবিল শান্তিতে রাখুন এ দোয়া করছি। আর কখনো তিনি আমাদের মাঝে, আমার বাসায় ফিরে আসবেন না।  কিন্তু চাচার স্মৃতিমাখা সেই ব্যাগটি এখনো আছে আমার বাসায়। চাচার সব স্মৃতিগুলো সবসময় গাঁথা থাকবে হৃদয়ের গভীরে, আলোকোজ্জ্বল হয়ে আয়নার মতো দেখাবে চোখের সামনে।
--------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ কলামিস্ট গ্রন্থপ্রনেতা, এটর্নি এট ল' টেক্সাস ইউএসএ এল এল এম, হার্ভার্ড ল স্কুল। 

Post a Comment

0 Comments