একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা;
বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান। ৭১ এর সমর সম্মুখের লড়াকু সৈনিক। সুন্দর ফর্সা পরিপাটি ড্রেসাপ মোলায়েম কন্ঠের অধিকারী মানুষ তিনি।
আমাদের শ্রদ্ধেয় মতিউর ভাই।
তাঁর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা দৈনিক জালালাবাদ থেকে। এর আগে মুখ পরিচয় থাকলেও ঘনিষ্ঠতা ছিলনা।
আমার পেশাগত জীবনে যে কজন অভিভাবক পেয়েছি তার মধ্যে অন্যতম ভাল বিচক্ষন দায়িত্বশীল অভিভাবক ছিলেন মতিউর ভাই।
তিনি যখন দৈনিক জালালাবাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আসেন তখন থেকেই খুব অল্প সময়ে আমাদের সবাইকে ঘনিষ্ঠ করে নেন। তাঁর কথা আচরন ব্যবহার মাধুর্যতা দায়িত্বশীলতা ব্যবস্থাপনা সব মিলিয়ে তিনি অল্প সময়ে সবার আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেন।
এরমধ্য থেকে কেন যেনো তিনি আমাকে একটু বেশিই স্নেহ করতেন। প্রায় সময় ফ্রি থাকলে আমাকে তাঁর রুমে ডেকে নিতেন।
কেমন আছি, পরিবারের খোজ খবর, ব্যক্তিগত পারিবারিক সহ সব বিষয়ে খুটিনাটি খোঁজ খবর সব সময় রাখতেন মতিউর ভাই। শুধু কি তাই? তাঁর পরিবারের অনেক কথাই আমার সাথে অকপটে শেয়ার করতেন। যা সবাই সবার সাথে করতে পারেনা।
এই প্র্যাকটিসটা তিনি প্রতি সপ্তাহান্তে করতেন। আমার আমাদের ভাল লাগতো। প্রয়োজনীয় পরামর্শ নির্দেশনা দিতেন।
মাঝে মাঝে যখন অনেক বিষয় নিয়ে বিষন্নতায় ভুগতাম, ডেক্সে মন খারাপ দেখলেই আলাদা ডাক দিতেন। কেন মন খারপ, মুখ এরকম ফ্যকাশে দেখাচ্ছে কেন মতিউর ভাইকে বলতেই হতো।
মাঝে মাঝে কোন কোন বিষয় নিয়ে মতানৈক্যে দেখা দিলে সন্ধ্যায় ভিতরে ভিতরে প্রস্ততি নিতাম আজ বাদ এশা মতিউর ভাই অফিসে আসার পর এই কথাটা বলবোই। কিন্তু বলার সকল প্রস্ততি নিয়ে উনার সামনে যাওয়ার পর আর বলতে পারতামনা।
যখন চেহারার দিকে তাকাতাম যখন সালাম দিতাম তখন ফর্সা গোলগাল চেহারা থেকে যে হাসিটা আসতো আমি কি বলতে গিয়েছি তাই ভুলে যেতাম।
একবার আমি কোন এক বিষয়ে খুবই ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম। বলার বা পরামর্শ করার মতো কাউকেই পাচ্ছিলাম না। তিনি আমার চেহারা দেখে বুঝে ফেললেন।
একান্তে ডাকলেন। জানতে চাইলেন আমিও সব খুলে বললাম। তিনি এমন কিছু কথা আমাকে শুনালেন এমন কিছু উদাহরণ এমন কিছু স্বপ্নের কথা জানালেন আমি তাঁর চেম্বার থেকে বের হওয়ার পর আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
প্রিয় মতিউর ভাই রাজনৈতিক অনেক প্রকাশিত/অপ্রকাশিত বিষয়ে আমার সাথে শেয়ার করতেন। আমি কখনোই তার বিশ্বাসের অমর্যাদা করিনি।
একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেন "কখনোই রাজনীতির সাথে নিজেকে জড়াবেনা, রাজনীতি আর সাংবাদিকতা এক সাথে করা যায় না"। মনে রেখো তোমার কাজই হলো সাংবাদিকতা"। অনেকেই না বুঝলেও তিনি গভীরতা বুঝতেন।
অনেক সময় বিবৃতি পত্রিকায় বক্তব্য আমাকেই লিখে দিয়ে দিতে বলতেন। আমিও লিখে দিতাম আস্থা ও বিশ্বাস ছিলো কত গভীরে।
আমার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার আগে প্রতিটি পরতে পরতে মতিউর ভাই আমাকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।
বিশেষ করে বিয়ের খরচ কোথায় কখন কিভাবে করতে হবে এসব বিষয়ে তার যে পরামর্শ গুলো আমি ফলো করেছিলাম তা আমার জীবনের বড় শিক্ষা। বিয়ের পর ফ্যামিলি ম্যনেজমেন্ট নিজের চলাফেরা সহ অনেক বিষয়ে খোলামেলা পরামর্শ দিতেন। যা আমার বাস্তব জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি।
আমার ওয়ালিমা অনুষ্ঠানে অনেক ব্যস্ততার মাঝেও সিলেট থেকে ছাতকে গিয়ে আমাকে ঋণি করেছিলেন মতিউর ভাই। সেদিন ফেরার আগ মুহূর্তে একটা গিফট বক্স আমার হাতে দিয়ে বললেন এটা তোমাদের জন্য আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে।
আশ্চর্যজনক ভাবে আমার বিয়ের সময় তিনি আমাকে এক মাসের ছুটি দিয়ে দেন যা দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। কিন্ত ৭/৮ দিন যাওয়ার পর হঠাৎ মতিউর ভাইয়ের ফোন। তোমাকে ছাড়া পত্রিকা অফিসটা বেমানান লাগছে। চলে আস চলে আস..... হা হা হা।
আমিও যথারীতি চলে আসলাম। মতিউর ভাইয়ের কথাগুলো ফেলা যেতোনা বিবেক বাধা দিতো। তিনি এতটাই ব্যক্তিত্ব ধারণা করতেন।
আমার সাপ্তাহিক ছুটি ছিল শুক্রবার। বৃহস্পতিবার ডিউটি করে রাতেই বাড়ি যেতে হবে। তিনি নিজে থেকেই নির্বাহী সম্পাদক কাদের ভাইকে বলতেন বৃহস্পতিবার এনামকে একটু আগেই ছেড়ে দিবেন।
কতটা দায়িত্বশীল কত ঘনিষ্ঠ অভিভাবক হলে নিজের সহকর্মীদের প্রতি এতো ক্ষীন দৃষ্টি রাখা যায় মুক্তিযোদ্ধা মতিউর ভাইয়ের সংস্পর্শে না গেলে হয় তো বুঝতে পারতামনা।
মতিউর ভাই সব সময় বলতেন আমি নিজে সাংবাদিক না হলেও আমি কিন্তু সাংবাদিক পরিবারের সদস্য। মতিউর ভাইয়ের আপন ভাই বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক সমকালের সম্পাদক সিলেটের কৃতী সন্তান বিশিষ্ট সাংবাদিক মোস্তাফিজ শফি।
আমি কোন কারনে দৈনিক জালালাবাদ থেকে চলে আসি এরপর প্রিয় মতিউর ভাই চলে যান আমেরিকায়। এরপর আর কোন যোগাযোগ নেই।
আমি মন ভরে দোয়া করি প্রিয় মতিউর ভাইকে আল্লাহ্ সুস্থতার সাথে নেক হায়াত দান করুন। যেখানেই যে অবস্থায় থাকুন সব সময় ভাল থাকুন শ্রদ্ধা আর ভালবাসার মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান।
দায়িত্বশীল অনেকেই হয় কিন্তু অভিভাবক হতে পারে ক'জন!
---------------------------------
লেখকঃ এনামুল হক গণমাধ্যমকর্মী, প্রবন্ধ লেখক, ও অনলাইন এক্টিভিস্ট।
0 Comments