Recent Tube

সাধুর ইসলাম বনাম ইসলামের সাধু; জিয়াউল হক।

 


সাধুর ইসলাম 
     বনা 
ইসলামের সাধু ;
-------------------------------- 

   এ বদ্বীপে বিগত দিন এবং বর্তমানে বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতার ভেতরে পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের ছাপ দৃশ্যমান শিক্ষা ও সাংস্কৃতিতে, প্রশাসন ও রাজনীতি এবং জনপদের আপামর মানুষের চিন্তা চেতনাতেও। কোন কোন টেলিভিশন চ্যানেলের টক শো’তে তথাকথিত প্রগতিশীল ও বুদ্ধিজীবি নামধারীদের অনেককেই বলতে শুনেছি বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে। এখন নাকি সচরাচর বাঙ্গালি নারী আর দেখতেই পাওয়া যায় না বাংলার এই জনপদে! 

     এরকম ক্ষোভ ও পরোক্ষ শ্লেষ প্রকাশের হেতু হলো, বাংলাদেশী মুসলিম নারী সমাজে হিজাব ও বোরখার প্রচলন বেড়েছে বহুগুন। ষাটের দশকে শেষ দিকে এবং পুরো সত্তরের দশকজুড়ে আধুনিক ‘শিক্ষিতা নারী’ বলতেই দেখতাম কুঁচি দেওয়া শাড়ি ও হাতাকাটা (Sleeveless) বøাউজ পরিহিতা নারী। অফিস আদালত, রাস্তা ঘাট, বাজার, অফিস আদালত ও কলেজ ইউনিভার্সিটির সর্বত্রই। প্রকাশ্যে হিজাবের চল ছিল না বললেই চলে। বয়স্কা নারীরা বোরখা ব্যবহার করতেন, তবে তা কেবলই প্রোঢ়া রমণীদের জন্য নির্ধারিত ছিল অনেকটা অলিখিতভাবেই। সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে ভেতরে ভেতরে। কেউ খেয়ালই করেননি। 

   অনেকটা এমন; সারারাত নিজ ঘরে ঘুমিয়ে সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখছেন আপনার মাথার উপরে ঘরের ছাদ নেই! তথাকথিত প্রগতিশীলরা যখন এই পরিবর্তনকে খালি চোখে দেখতে পেলেন, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এ জনপদের সামাজিক মনস্তত্ব বা সোশ্যাল সাইকোলোজির (Social Psychology) ভীত ইসলামি আদর্শ ও সাস্কৃতির  উপর এতোটাই শক্তভাবে তৈরি হয়ে গেছে যে, সেই মনস্তত্তে আজ তাদের দূর্গের কেবল ছাদ’ই নয়, দেয়ালগুলোও ধ্বসে পড়তে শুরু করেছে। এমনকি, পায়ের নীচের মাটিটুকুও নড়বড়ে!

     বুদ্ধিজীবি ও চিন্তাশীল মানুষের মনস্তত্বের একটা বিশেষ দিক হলো; তারা সবসময় কোন না কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে ভালোবাসেন। তাদের ব্রেনের ফ্রন্টাল লোব অতিমাত্রায় ক্রিয়াশীল থাকে জন্ম ও বেড়ে ওঠা’সহ যে সাংস্কৃতিক আবহে তিনি বেড়ে উঠেছেন, যাদের সাহচর্যের প্রভাব তার উপরে পড়েছে সেইসব ফ্যাক্টরের উপরে ভিত্তি করে। ব্রেনের ডোপামিন (Dopamine) সেরেটোনিন (Serotonin) নামক হরমোনগুলো তাকে বা তাদেরকে স্থির হয়ে বসতেই দেয় না। তাদের ব্রেনের বাম বলয় (Left Hemisphere) ও ফ্রন্টাল লোব সদাক্রিয়াশীল।

    এর অনিবার্য ফল হলো, একজন বুদ্ধিজীব যিনি একসময় ঘোরতর ইসলাম বিরোধি ছিলেন কিংবা ইসলাম নিয়ে তার মনে ‘কিছু প্রশ্ন’ ছিল সেই তিনিও একদিন যে ইসলামকে পাত্তাই দেননি, সেই ইসলাম নিয়ে ভাবতে বসেন, বলতে বসেন। কারণ পুরো সমাজই তো ইসলাম নিয়ে ভাবছে, কথা বলছে, কিছু না কিছু লিখছে। অতএব তিনি ঐ সমাজেরই একজন হয়ে কেন বসে থাকবেন? চাইলেও তিনি তা পারবেন না। সচল তাকে হতেই হবে।

     তবে সমস্যা হলো, এতোদিন যে আদর্শকে ধ্যান জ্ঞান করে চিন্তা ও চেতনায় লালন করেছেন, বিশ্বাসের অবিভাজ্য অংশ বানিয়ে নিয়েছেন, কেবল বিশ্বাসই করেন নি, প্রফেস বা প্রচারও করেছেন, অনুসারীদের গিলিয়েছেন, সেগুলো কোথায় ফেলবেন? এ পর্যায়ে এসে তার অবচেতন মনের (Subliminal Mind) কোন এক কোণায় নিজেরই অজান্তে গড়ে উঠেছে দ্বিচারী অনুভুতি; মনস্তত্ত বা সাইকোলোজির ভাষায় এ্যম্বিভালেন্স (Ambivalence)।

     এই এ্যম্বিভালেন্সি’র কিছু প্রকাশভঙ্গি আছে, যা আচরণগত (Behavioral)। ব্যক্তি চাইলেও গোপন করতে পারে না, প্রকাশ হয়েই পড়ে। প্রকাশের নানা ভঙ্গি ও মাধ্যম আছে। যারা হিউম্যান সাইকোলোজির নানা বাঁক ও পর্যায় বুঝেন, তারা খুব ভালো করেই জানেন। এরকম একটা পর্যায়ে এসে এইসব বুদ্ধিজীবিরা কি করেন? তারা বুদ্ধি ও বিশ্বাসের জগতে যে অবস্থান হারিয়েছেন, সেই শুন্যতাকে পূরণ করতে সচেষ্ঠ হন। হিউম্যান সাইকোলোজির অভিধায় এটা কোপিং মেকানিজম; ‘কম্পেনসেট’ স্টাইলের। 

     মানসিক অস্থিরতা কাটাতে চিন্তার জগতে হারিয়ে যাওয়া অবস্থানকে এইসব বুদ্ধিজীবিরা কম্পেনসেট করতে উঠে পড়ে লাগেন। সচেষ্ঠ তাদের হতেই হবে, কোনমতেই নিশ্চুপ থাকতে পারবেন না, চাইলেও না, ব্রেনের ফ্রান্টাল লোবের অতিমাত্রায় সক্রিয়তার কারনে। ফলে তারা সেই শুন্যতাকে এমন কিছু দিয়ে পুরণ করতে চান, যে বিষয় নিয়ে অধিকাংশ সমাজবাসীর আগ্রহ জন্মেছে, যে বিষয় নিয়ে অধিকাংশ সমাজবাসী কথা বলছে।

     আধুনিক বাংলাদেশি সমাজে অধিকাংশ সমাজবাসী কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে? কোন বিষয় নিয়ে পড়াশুনা বা কথা বার্তা বলছে? উত্তর খুব সহজ; ইসলাম। এখানে সাহিত্য, সঙ্গীত, অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য ও সমাজব্যবস্থার প্রায় প্রতিটি স্তরে ইসলাম সরবে উপস্থিত। এই উপস্থিতি থেকে এইসব বুদ্ধিজীবিরা দূরে থাকতে পারেন না। অতএব তারা ইসলামের কাছে আসছেন। 

     তবে সমস্যা হলো তারা আগে থেকে ভর্তি হওয়া মাথাটাখালি করে আসেন নি। সেখানে মার্কসবাদের সামাজিক সাম্যের ধারনা যেমন রয়েছে তেমনই রয়েছে লালনের ভাবালুতা কিংবা চৈতন্যের বৈরাগ্য চেতনা। এসব মতবাদকে মাথায় ধারন করে যখন তারা কুরআন ও ইসলামকে অধ্যায় করতে যান, তখন সেখানে প্রাপ্ত সামাজিক সাম্যকে মার্কসবাদের সামাজিক সাম্য, ইসলামের সুফিবাদকে শ্রী চৈতন্যের বৈরাগ্যবাদে কিংবা লালনের ভাববাদে সাঁজাতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন।

     ঠিক এমনটাই ঘটেছে বিগত শতাব্দিতে মুসলিম বাবা মায়ের ঘরে জন্ম নেয়া অনেক প্রখ্যাত ওরিয়েন্টালিষ্টদের ক্ষেত্রে। নিজেরা বিভ্রান্ত হয়েছেন সাথে সাথে মুসলিম সমাজের একটা প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে রেখে গেছেন। আজও তারা আমাদের সমাজে রয়েছেন আধুনিক প্রজন্মের অধূনা ভার্সন হিসেবে। কেউবা ইসলামের সংস্কার করতে চান কেউবা তাকে ‘লালনাইজ’ কিংবা মোডার্নাইজ করার কাজে সচেষ্ট। তাদের আন্তরিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই না। 

      তবে সবিনয়ে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সেটা হলো; ইসলাম চীর আধুনিক। এর আধুনিকায়নের যেমন কোন প্রয়োজন নেই, তেমনই প্রয়োজন নেই কোন সংস্কারেরও। যেটা প্রয়োজন, সেটা হলো; আপনাদের মন ও মনের কোণে (Subliminal Mind)  লুকিয়ে থাকা চেতনার সংস্কার। সেই সংস্কারটা আগে প্রয়োজন। 

     আরও একটা কথা স্মরণ রাখলে ভালো করবেন; আল কুরআনের কাছে আশ্রয় নিচ্ছেন, কুরআন নিয়ে অধ্যায়ন করছেন, কুরআনের কথা বলছেন, সেটা ভালো কথা, কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার, কুরআন কেবলমাত্র তার কাছেই নিজের ভান্ডার মেলে ধরে, যে ব্যক্তি তার মন ও মগজ থেকে পূর্বপ্রসূত সকল ধারনাকে অবলীলায় বিনা বাক্যব্যায়ে বিসর্জন দিয়েছে। সেটা না করা পর্যন্ত আল কুরআন যত্ োঅধ্যায় করুন না কেন, গলার নীচে তা নামবে না, নামবে না, নামবেই না।
---------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক গবেষক ও দাঈ। 

Post a Comment

0 Comments