Recent Tube

জ্বিলহাজ্জ/যুলহাজ্জ মাসে জিকির: গুরুত্ব ও ফজিলতঃ মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।








জ্বিলহাজ্জ/যুলহাজ্জ মাসে জিকির: গুরুত্ব ও ফজিলতঃ
----------------------------------
   বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, যুলহাজ্জ/জ্বিলহাজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের নেক আমল আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়। সহীহ বুখারীসহ অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম)  বলেন: 
مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيهَا أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ يَعْنِي أَيَّامَ الْعَشْرِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَلا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ قَالَ وَلا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ إِلا رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ-
“যুলহাজ্জ/জ্বিলহাজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনে নেক আমল করা আল্লাহর নিকট যত বেশি প্রিয় আর কোনো দিনের আমল তাঁর নিকট তত প্রিয় নয়। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন, হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর পথে জিহাদও কি এ দশদিনের নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর নিকট প্রিয়তর নয়? তিনি বলেন, না, আল্লাহর পথে জিহাদও প্রিয়তর নয়, তবে ঐ ব্যক্তি ছাড়া, যে ব্যক্তি নিজের প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে জিহাদে বেরিয়ে গেল এবং কোনো কিছুই আর ফিরে এলো না (সম্পদও শেষ হলো, সেও শহীদ হলো)।” (সহীহ বুখারী হাঃ ৯৬৯, তিরমিযী হাঃ ৭৫৭, আবূ দাউদ হাঃ ২৪৩৮, ইবনে মাজাহ হাঃ ১৭২৭, আহমাদ হাঃ ১৯৬৯, ৩১২৯, দারেমী হাঃ ১৭৭৩, ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ ৪/২৭৩, ইরওয়াহ হাঃ ৯৫৩)
.
   এ দিনগুলোতে বিভিন্ন নেক আমল করতে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি আল্লাহর জিকির করতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। ইমাম আহমদ, তাবারানী, বাইহাকী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস কর্তৃক সংকলিত সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী কারীম (সাঃ) বলেন,
مَا مِنْ أَيَّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللَّهِ وَلَا أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ الْعَمَلِ فِيهِنَّ مِنْ هَذِهِ الْأَيَّامِ الْعَشْرِ فَأَكْثِرُوا فِيهِنَّ مِنْ التسبيح وَالتَّحْمِيدِ وَالتَّهْلِيلِ وَالتَّكْبِيرِ- وَفي رواية فَأَكْثِرُوا فِيهِنَّ مِنْ التَّهْلِيلِ وَالتَّكْبِيرِ وَالتَّحْمِيد-
"জ্বিলহাজ্জ/যুলহাজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিনের চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাময় কোনো দিন নেই এবং নেক আমলের জন্য এগুলোর চেয়ে বেশি প্রিয় দিন আর নেই। অতএব তোমরা এ দিনগুলিতে বেশি বেশি তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ), তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করবে। অন্য বর্ণনায়: বেশি বেশি তাহলীল, তাকবীর ও তাহমীদ আদায় করবে।" (মুসনাদে আহমদ হাঃ ৫৪২৩, ৬১১৯; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ: ২/৩৯; মুনযিরী, আত-তারগীব: ২/১২৭-১২৮; সহীহুত তারগীব: ২/১৫)

     শুধু এ কয়েকটা দিনেই নয়, বরং দুনিয়া ও আখিরাত জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য যাবতীয় ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি সুন্নাহ পন্থায় সকাল সন্ধ্যাসহ যে কোনো সময় বেশি বেশি 'আল্লাহর জিকির' করার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, 
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا. وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا.
"হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর। আর সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা কর কর।" (সূরা আহযাবঃ ৩৩/৪১-৪২) তিনি আরো বলেন,
وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ.
"আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।" (সূরা জুমুআহ ৬২/১০)
 মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) বলেন,
مَا شَيْءٌ أَنْجَى مِنْ عَذَابِ اللَّهِ مِنْ ذِكْرِ اللَّهِ-
"আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহর জিকিরের চেয়ে উত্তম কোন আমল নেই।" (জামে তিরমিযী হাঃ ৩৩৭৭, সুনান ইবনে মাজাহ হাঃ ৩৭৯০, মুসনাদে আহমদ হাঃ ২১১৯৫, ২১৫৭৪, মুয়াত্তা মালিক হাঃ ৪৯০, মুস্তাদরাক হাকীম ১/৬৭৩, সহীহুত তারগীব ২/৯৬)

   জিকির' ذكر অর্থ: স্মরণ করা বা করানো। যে কোন প্রকারে মনে, মুখে, অন্তরে, কর্মের মাধ্যমে, আদেশ পালন ও নিষেধ মান্য করার মাধ্যমে আল্লাহর নাম, গুণাবলী, বিধিবিধান, তাঁর পুরুষ্কার, শাস্তি ইত্যাদি স্মরণ করা বা এ সকল বিষয়ে আহ্বান (দাওয়াহ) বা আলোচনা করে অন্যকে স্মরণ করানো সবই আল্লাহর জিকির। তবে কুরআন ও হাদীসে বিশেষ ইবাদত হিসাবে জিকিরের পারিভাষিক অর্থ হলো রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর শেখানো আল্লাহর মর্যাদা জ্ঞাপক বিশেষ বাক্যাদি মুখে উচ্চারণ ও জপ করাকে আল্লাহর জিকির বলে। আমি এখানে এ জিকির সম্পর্কেই আলোচনা করছি। সামুরা ইবনে জুনদুব (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন,
َ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحَبُّ الْكَلَامِ إِلَى اللَّهِ أَرْبَعٌ سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ.
  রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় চারটি বাক্য: সুবহানাল্লাহ ওয়াল-হামদুলিল্লাহ্ ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার। (আল্লাহ অতীব পবিত্র, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ)। (সহীহ মুসলিম হাঃ ২১৩৭, মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৯৬০৯, ১৯৭৩২)

   আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, 
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَأَنْ أَقُولَ سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا طَلَعَتْ عَلَيْهِ الشَّمْسُ.
 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “সুবহানাল্লাহ ওয়াল-হামদুলিল্লাহ্ ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার” (আল্লাহ অতীব পবিত্র, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আল্লাহ ছাড়া কোন মা'বূদ নেই, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ) বলা আমার কাছে যে সকল জিনিসের উপর সূর্য উদিত হয় তা (অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবীর সব কিছু) হতে বেশি পছন্দনীয়। (সহীহ মুসলিম হাঃ ২৬৯৫, জামে তিরমিযী হাঃ ৩৫৯৭, রিয়াযুস স্বালিহীন হাঃ ১৪১৭)
.
      সুতরাং সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, জিকিরের জন্য আল্লাহ তা'য়ালা ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর নিকট সবচেয়ে প্রিয় বাক্য হচ্ছে سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ. এ বাক্যগুলোর শ্রেষ্ঠত্বের উপর আরো অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। (উদাহরণসরূপ দেখুনঃ- সহীহ বুখারী হাঃ ৭৫৬৩, সহীহ মুসলিম হাঃ ২১৩৭, ২৬৯৫ জামে তিরমিযী হাঃ ৩৫০৯, নাসায়ী হাঃ ৯২৪, আবূ দাউদ হাঃ ৮৩২, ইবনে মাজাহ হাঃ ১৩৮৬, আহমদ হাঃ ৭৯৫২, ৮০৩২, ১০৯১১, ১০৯৩৪, ১৫০৭৭, মুয়াত্তা মালিক হাঃ ৪৮৯, দারেমী হাঃ ১০০০, ২৬৮৭) এছাড়াও মাসনূন জিকিরের অন্যান্য বাক্যের মধ্যে রয়েছে, "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু, ওয়া লাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর, লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ ইত্যাদি।

      কোনো কোনো দ্বীনদার মানুষ জিকির'কে অবহেলা করেন, গুরুত্ব দেন না। অথচ তাকওয়া অর্জনের জন্য, বাতিলশক্তির বিরুদ্ধে ঈমানী শক্তি মজবুত করার জন্য, দুনিয়ার বহুমুখী প্রলোভন থেকে আত্মশক্তি অর্জনের জন্য ও সর্বোপরি আল্লাহর নৈকট্য ও মুহাব্বত অর্জনের জন্য সুন্নাত পদ্ধতিতে আল্লাহর জিকির করা সহজতম ও শ্রেষ্ঠতম ইবাদত। মুমিনদের সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো- ওযু সহ, ওযু ছাড়া, গোসল সহ, গোসল ছাড়া, পোশাক পড়ে, খালি গায়ে, শুয়ে, বসে, দাড়িয়ে, হাটতে, চলতে, বাজারে, মাঠে ঘাটে, দোকানে, অফিসে, বাড়িতে সর্বাবস্থায় জিকির করা যায় এবং তা সুন্নাত। জামায়াত শিবিরের সিলেবাস ভুক্ত 'চরিত্র গঠনে মৌলিক উপাদান' বইয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য ফরজ ইবাদত, কুরআন হাদীস অধ্যায়ন ও নফল ইবাদত করার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক বেশি বেশি আল্লাহ জিকির করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। আমরা অযথা অলস চিন্তা ও গল্প করে সময় অপচয় করি। অথচ এ সময়ে জিকিরের বাক্যগুলো কয়েকবার পাঠ করলেও আমাদের আমলনামায় সাওয়াব জমা হতো, গুনাহ মাফ হতো। 

        অন্যদিকে আরেক ধরণের দ্বীনদার জিকির করতে ভালোবাসেন কিন্তু তাদের জিকির রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবাগণের জিকিরের সাথে মেলে না। জিকিরের শব্দ পদ্ধতি বানোয়াট। এ ক্ষেত্রে তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রদর্শিত তরিকা বর্জন করে বিভিন্ন যুক্তি তর্ক দিয়ে তাদের পীরের বানোয়াট তরিকায় (লাফাঝাপা করে) জিকির করেন। যেমন, হা, হু বা ইল্লাল্লাহ ইত্যাদি। এভাবে তারা যুক্তি তর্কের ছুরি দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাত জবাই করে।

     সুন্নাত থাকতে যুক্তি তর্কের দরকার কী? তাই আসুন! সকল যুক্তি তর্ক বাদ দিয়ে সুন্নাতের পরিপূর্ণ অনুসরণ করে আল্লাহর নৈকট্য করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন!।
---------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা আলোচক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments