Recent Tube

ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ এর তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ'র ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণঃ মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।



 
 ড.খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ এর তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ'র ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণঃ
---------------------------------------------

ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ কর্তৃক রচিত 'ইসলামী আকীদা' একটি উপকারী গ্রন্থ। কিন্তু মানব রচিত কোনো গ্রন্থ ভুলভ্রান্তি, বৈপরীত্য ও অসঙ্গতি থেকে মুক্ত নয় (সূরা নিসাঃ ৪/৮২)। অসংখ্য উপকারী ও বিশুদ্ধ বক্তব্যের পাশাপাশি উক্ত গ্রন্থে এমন কিছু দিক রয়েছে যা ভুল, অসঙ্গতি, বিশুদ্ধ নয় বরং পর্যালোচনাযোগ্য। তার একটি বিষয় হলো তাওহীদ। তার মতে, তাওহীদের বিভাজন তিন প্রকার। কাফেররা রবূবিয়্যাহ তাওহীদে বিশ্বাসী। যেমন, তিনি 'তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ' সম্পর্কে বলেন, অধিকাংশ কাফির এ পর্যায়ে তাওহীদ বিশ্বাস করত। (ইসলামী আকীদা, পৃঃ ৮৭) তিনি আরো বলেন, তাওহীদ অর্থ এক করা, এক বানানো, একত্রে বিশ্বাস করা। কুরআন কারীমের অগণিত বর্ণনা থেকে জানতে পারি যে, মহান আল্লাহকে এক মানা ও তাঁর একত্রে ঘোষণা দেওয়ার দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথমত রব্ব হিসাবে আল্লাহকে এক মানা। একে আরবীতে তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ বলা হয়। দ্বিতীয়ত ইলাহ হিসাবে আল্লাহকে এক মানা। একে আরবীতে তাওহীদুল  উলূহিয়্যাহ বলা হয়। আরবের কাফিরগণ প্রথম পর্যায়টি (অর্থাৎ তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ) বিশ্বাস করত কিন্তু দ্বিতীয়টি অবিশ্বাস করত না। (খুতবাতুল ইসলাম, পৃঃ ৪০) আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার আরো বলেন, "আরবের কাফিরগণ এবং অন্যান্য কাফির মুশরিকগণ মহান আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র প্রতিপালক ও সার্বভৌম সর্বশক্তিমান মালিক বা 'রাব্ব' বলে মানত, অথচ তাকে একমাত্র ইলাহ বলে মানত না।" (ইসলামী আকীদা, পৃঃ ৯৯)
মহান আল্লাহ বলেন, 
قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمَّنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ ۚ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ ۚ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ.
বল, ‘আসমান ও যমীন থেকে কে তোমাদের রিয্ক দেন? অথবা কে (তোমাদের) শ্রবণ ও দৃষ্টিসমূহের মালিক? আর কে মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন আর জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন? কে সব বিষয় পরিচালনা করেন’? তখন তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’। সুতরাং, তুমি বল, ‘তারপরও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না’? (সূরা ইউনুসঃ ১০/৩১)
স্যার পবিত্র কুরআন থেকে এ আয়াত সহ এ সংক্রান্ত আয়াতগুলো পেশ করেন। যেমন, ইউনুসঃ ১০/৩৪; মু'মিনুনঃ ২৩/৮৪-৮৯; আনকাবুতঃ ২৯/৬১-৬৩; লুকমানঃ ৩১/২৫; যুখরুফঃ ৪৩/০৯, ৮৭; যুমারঃ ৩৯/৩৮)
.
পর্যালোচনা: 
০১. এই কিতাবের প্রধানতম বিচ্যুতির একটি হলো তাওহীদের প্রকারভেদ নিয়ে মাসলাকী বক্তব্য। লেখক দাবি করেছেন, মক্কার কাফেররা সহ পৃথিবীর বহু কাফের তাওহীদুর রবূবিয়্যাহতে বিশ্বাসী।  এটাকে তিনি 'হানাফী আকীদা' প্রমাণের জন্য ইবনে আবিল ইযয এর রেফারেন্স এনে তাকে ' 'হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম'  হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। অথচ ইবনে আবিল ইযয আকীদার ক্ষেত্রে হানাফী কিনা তা নিয়ে বিতর্ক। যাইহোক কাফিরদেরকে রবূবিয়্যাহতে বিশ্বাসী বলা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর বক্তব্য। তারা তাওহীদের সঙ্গে সদৃশ কিছু বিশ্বাস রাখে, তাই বলে তাদেরকে তাওহীদবাদী বলা যায়? এমন করলে দুনিয়ার কেউ তাওহীদের বাইরে থাকে না। 

এখানে কয়েকটি বিচ্যুতি এসেছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, কেবল স্রষ্টা আছেন, তিনি জীবন মৃত্যুর মালিক, রিযিকদাতা, পালনকর্তা মনে করাকে রবূবিয়্যাহ আখ্যা দেয়া। এটা রবূবিয়্যাতের অর্থের বিকৃতি। রবূবিয়্যাত আল্লাহর বিশাল সংখ্যক সিফাতের সমষ্টি। ফলে কাফের-মুশরিকদের কেউ আল্লাহর রবূবিয়্যাত সদৃশ দুয়েকটা গুণের স্বীকৃতি দিলেই মুওয়াহহিদ হয়ে যাবে না। আর যদি মনে করা হয় যে, মক্কার কাফিরগণ তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ' তথা আল্লাহকে রব হিসাবে মেনে নিয়েছে, তাহলে তাদের কাফির বা জাহান্নামি বলার সুযোগ নেই বরং জান্নাতি বলতে হবে। দেখুন আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, 
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ.
নিশ্চয় যারা বলে, ‘আল্লাহই আমাদের রব’ অতঃপর অবিচল থাকে, ফেরেশতারা তাদের কাছে নাযিল হয় (এবং বলে,) ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, দুশ্চিন্তা করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর তোমাদেরকে যার ওয়াদা দেয়া হয়েছিল’। (সূরা হা মীম সাজদাহঃ ৪১/৩০)
আল্লাহ তা'য়ালা আরো বলেন, 
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ. أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ.
নিশ্চয় যারা বলে, ‘আমাদের রব আল্লাহ’ অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না। তারাই জান্নাতের অধিবাসী, তাতে তারা স্থায়ীভাবে থাকবে, তারা যা আমল করত তার পুরস্কারস্বরূপ। (সূরা আহকাফঃ ৪৬/১৩-১৪)

বস্তুতঃ রব এমন একটি আরবী শব্দ, যা অন্য ভাষায় এক শব্দে যথাযথ অনুবাদ করা সম্ভব নয়। সাধারণত রব অর্থ করা হয় প্রতিপালক, যিনি সবকিছুর স্রষ্টা ও লালনপালনকারী, কিন্তু এর দ্বারা রবের প্রকৃত অর্থ প্রকাশ পায় না। আঃ জাহাঙ্গীর স্যারও এ অর্থ করে ধারণা করে বসেছেন যে, মক্কার কাফিরসহ অধিকাংশ কাফিরদের 'তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ' এর প্রতি ঈমান ছিল। (নাউজুবিল্লাহ) প্রকৃতপক্ষে 'রব' হচ্ছেন ঐ মহান সত্তা- যিনি সমগ্র সৃষ্টি জগতের সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, পালনকর্তা, বিধানদাতা ও ইবাদত-দাসত্ব পাওয়ার একমাত্র হকদার। মহান আল্লাহ রব্বুল আ'লামীন বলেন, 
إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ يَطْلُبُهُ حَثِيثًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرَاتٍ بِأَمْرِهِ ۗ أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ ۗ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ.
নিশ্চয় তোমাদের রব আসমানসমূহ ও জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন। তিনি রাত দ্বারা দিনকে ঢেকে দেন। প্রত্যেকটি একে অপরকে দ্রুত অনুসরণ করে। আর (সৃষ্টি করেছেন) সূর্য, চাঁদ ও তারকারাজী, যা তাঁরই হুকুমের অনুগত। জেনে রাখ, সৃষ্টি যাঁর বিধানও (মানতে হবে) তাঁর। মহান আল্লাহ তা'য়ালা বিশ্বজগতের রব। (সূরা আ'রাফঃ ০৭/৫৪)
আয়াতের মর্মার্থ এই যে, সৃষ্টিকর্তা হওয়া এবং বিধানদাতা হওয়া আল্লাহ রব্বুল আ'লামীনের জন্যই নির্দিষ্ট। যেমনিভাবে তিনিই আসমান জমিনের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন তেমনিভাবে বিধান দানের অধিকারও তাঁর। অতএব যারা আল্লাহকে স্রষ্টা হিসাবে বিশ্বাস করে কিন্তু বিধানদাতা হিসাবে তাঁর বিধান সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিয়ে আল্লাহর দাসত্ব করে না বরং আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে অন্য কারো বিধান সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করে তার দাসত্ব করে তারা আল্লাহর রবূবিয়্যাতের প্রতি বিশ্বাসী নয় বরং মুশরিক। সুতরাং মক্কার কাফিররা 'তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ' এর প্রতি বিশ্বাসী ছিল না বরং মুশরিক ছিল, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু তাই নয় বরং আল্লাহকে রব হিসাবে মেনে নেওয়ার কারণে মক্কার কাফিরগণ নবী (সাঃ) এর সাহাবীদের উপর অন্যায় অত্যাচার করে বাড়ী-ঘর ছাড়া করেছিলেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, 
الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ. 
যাদেরকে তাদের নিজ বাড়ী-ঘর থেকে অন্যায়ভাবে শুধু এ কারণে বের করে দেয়া হয়েছে যে, তারা বলে, ‘আমাদের রব আল্লাহ’। (সূরা হাজঃ ২২/৪০)
.
০২. ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ এর মতে, কাফিরগণ তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ এর প্রতি বিশ্বাসী ছিল। ফলে তিনি 'তাওহীদুর রবূবিয়্যা' এর যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারেননি বরং এ কে গুরুত্বহীন ভাবে পেশ করেছেন। অথচ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'য়ালা বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন, যার ফলে তিনি কুরআনে ৯৮০ বার শুধু 'রব' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। পবিত্র কুরআনের সর্বপ্রথম যে আয়াত (সূরা আলাকের ১ম ৫ আয়াত) নাযিল করা হয়েছে, সেখানে রবের কথা রয়েছে। কুরআনে সর্বশেষে যে সূরা (নাসর) নাযিল করা হয়েছে, সেখানেও রবের কথা রয়েছে। পবিত্র কুরআনের সর্বপ্রথম সূরা ফাতিহা এবং সর্বশেষ সূরা নাসেও তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ এর কথা বর্ণিত হয়েছে। এক কথায় কুরআনে অগণিত আয়াতে তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ এর কথা বর্ণনা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের পৃথিবীতে পাঠানোর পূর্বে তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ এর অঙ্গিকার নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন,
أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ ۖ قَالُوا بَلَىٰ ۛ شَهِدْنَا ۛ أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَٰذَا غَافِلِينَ.
'আমি কি তোমাদের রব নই’? তারা বলল, ‘হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিলাম।’ যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা বলতে না পার যে, নিশ্চয় আমরা এ বিষয়ে অনবহিত ছিলাম। (সূরা আ'রাফঃ ০৭/১৭২)

আবার মৃত্যুর পর কবরে সর্বপ্রথম যে প্রশ্ন করা হবে, সেটাও তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ সম্পর্কে। বলা হবে من ربك তোমার রব কে? এ প্রশ্নের জবাব যারা দিতে পারবে তারা কবরে আরামে থাকবে। আর যারা দিতে পারবে না তারা শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। (সুনান আবু দাউদ হাঃ ৪৭৫৩; মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৮০৬৩; মিশকাত হাঃ ১৩১) এসব থেকে সহজেই বুঝা যাচ্ছে, তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ এর গুরুত্ব কত। সুতরাং একে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 
ذَاقَ طَعْمَ الْإِيمَانِ مَنْ رَضِيَ بِاللَّهِ رَبًّا وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا.
সেই ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ লাভ করেছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন (জীবন বিধান) হিসেবে এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) কে রাসুল হিসেবে খুশী মনে মেনে নিয়েছে। (সহীহ মুসলিম, হাঃ ৩৪, জামে তিরমিযী হাঃ ২৬২৩; মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৭৮১, ১৭৮২)
.
০৩. ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ বলেন, তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ অর্থ এ কথা বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহ এ বিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, পরিচালক, রিযিকদাতা, পালন কর্তা, নিয়ন্ত্রক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। (ইসলামী আকীদা, পৃঃ ৮৭) এখানে তিনি তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ কে অসম্পূর্ণ ও সংকীর্ণ অর্থে গ্রহণ করেছেন। 'রব' এর একাধিক অর্থ রয়েছে। তবে প্রধান অর্থ দুইটি। (১) সকল সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা, রিযিকদাতা, প্রতিপালক, জীবন-মৃত্য দানকারী, নিয়ন্ত্রক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। (২) স্বয়ংসম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত আইন প্রণয়নকারী ও বিধানদাতা; সকল বিধানের উপর যার বিধানকে প্রাধান্য দিয়ে আনুগত্য ও দাসত্ব করা হয়। আঃ জাহাঙ্গীর স্যার শুধু প্রথম অর্থ নিয়ে মক্কার কাফিরদের 'তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ' এর প্রতি বিশ্বাসী বলে দাবী করেছেন। তিনি দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করেননি, যার ফলে বিভ্রান্তির স্বীকার হয়েছেন।

কাফিরগণ প্রথম অর্থে আল্লাহকে একমাত্র 'রব' হিসাবে মানলেও দ্বিতীয় অর্থে একমাত্র আল্লাহকে 'রব' হিসাবে মানে না বরং এ ক্ষেত্রে তারা মহান আল্লাহর সাথে শিরক করে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
ﭐﺗَّﺨَﺬُﻭٓﺍ۟ ﺃَﺣْﺒَﺎﺭَﻫُﻢْ ﻭَﺭُﻫْﺒَٰﻨَﻬُﻢْ ﺃَﺭْﺑَﺎﺑًﺎ ﻣِّﻦ ﺩُﻭﻥِ ﭐﻟﻠَّﻪِ ﻭَﭐﻟْﻤَﺴِﻴﺢَ ﭐﺑْﻦَ ﻣَﺮْﻳَﻢَ ﻭَﻣَﺎٓ ﺃُﻣِﺮُﻭٓﺍ۟ ﺇِﻟَّﺎ ﻟِﻴَﻌْﺒُﺪُﻭٓﺍ۟ ﺇِﻟَٰﻬًﺎ ﻭَٰﺣِﺪًﺍۖ ﻟَّﺎٓ ﺇِﻟَٰﻪَ ﺇِﻟَّﺎ ﻫُﻮَۚ ﺳُﺒْﺤَٰﻨَﻪُۥ ﻋَﻤَّﺎ ﻳُﺸْﺮِﻛُﻮﻥَ
তারা (আহলে কিতাবরা) আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের পন্ডিত ও ধর্মনেতাদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে এবং মারইয়ামের পুত্র মসীহকেও। অথচ তাদের প্রতি শুধু এই আদেশ করা হয়েছে যে, তারা শুধুমাত্র এক ইলাহর ইবাদাত করবে যিনি ব্যতীত ইলাহ হওয়ার যোগ্য কেহই নয়। তিনি তাদের অংশী স্থির করা হতে পবিত্র। (সূরা তওবাঃ ০৯/৩১)

সাহাবী আদী ইবনু হাতিম (রা) বলেনঃ আমি যখন রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে পৌঁছি তখন তিনি সূরা বারআর আয়াত ﭐﺗَّﺨَﺬُﻭٓﺍ۟ ﺃَﺣْﺒَﺎﺭَﻫُﻢْ ﻭَﺭُﻫْﺒَٰﻨَﻬُﻢْ ﺃَﺭْﺑَﺎﺑًﺎ ﻣِّﻦ ﺩُﻭﻥِ ﭐﻟﻠَّﻪ তিলওয়াত করছিলেন। আমি বললাম:
ﻗﻠﺖ ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻧﺎ ﻟﺴﻨﺎ ﻧﻌﺒﺪﻫﻢ ﻓﻘﺎﻝ ﺃﻟﻴﺲ ﻳﺤﺮﻣﻮﻥ ﻣﺎ ﺃﺣﻞ ﺍﻟﻠﻪ ﻓﺘﺤﺮﻣﻮﻧﻪ ﻭﻳﺤﻠﻮﻥ ﻣﺎ ﺣﺮﻡ ﺍﻟﻠﻪ ﻓﺘﺤﻠﻮﻧﻪ؟ ﻗﺎﻝ ﻗﻠﺖ ﺑﻠﻲ ﻗﺎﻝ ﻓﺘﻠﻚ ﻋﺒﺎﺩﺗﻬﻢ .
হে আল্লাহর রাসূল (সা), আমরা তো তাদের ইবাদত করি না! তিনি বলেন, আল্লাহ যা হালাল (বৈধ) করেছেন তারা তা তোমাদের জন্য হারাম (নিষিদ্ধ) করলে তোমরা কি তা হারাম বলে গ্রহণ কর না? আর আল্লাহ যা হারাম (নিষিদ্ধ) করেছেন তারা তা হালাল (বৈধ) করলে তোমরা কি তা হালাল বলে মেনে নাও না? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বলেন, এই হলো তাদের ইবাদত করা। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী হাঃ ৩০৯৫; বায়হাকী হাঃ ২৬১, ২০৩৫; সহীহ তিরমিযী আলবানী হাঃ ২৪৭১; সহীহাহ হাঃ ৩২৯৩ , তাফসীরে তাবারী, সূরা তওবাহঃ ৯/৩১, হাঃ ১৬৬৩১) অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের উপর তাদের হুকুমকে প্রাধান্য দিয়ে মেনে চলতো। আর এভাবে তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের 'রব' এর আসনে বসিয়ে ছিল।

ফিরআউন বলেছিল,
أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَىٰ.
‘আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ রব’। (সূরা নাজিয়াতঃ ৭৯/২৪) ফিরাউনের কথার এ অর্থ ছিল না এবং এ অর্থ হতেও পারে না যে, সে-ই এই বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা এবং এ পৃথিবীটাও সে সৃষ্টি করেছে। সেই ফল-ফসল থেকে রিযিকের ব্যবস্থা করে দেয়, দিন রাত, চাঁদ সূর্য তারই নিয়ন্ত্রণে চলে। বরং দ্বিতীয় (বিধানদাতা) অর্থে নিজেকে প্রধান বর হিসেবে পেশ করতো। অর্থাৎ এর অর্থ ছিল, আমি হচ্ছি প্রধান কর্তৃত্বের মালিক। আমি ছাড়া আর কেউ আমার রাজ্যে হুকুম চালাবার অধিকার রাখে না। আর আমার ওপর আর কোন উচ্চতর ক্ষমতাধরও নেই, যার আইন এখানে জারী হতে পারে। একই ভাবে যারা আল্লাহর আইন না মেনে উল্টা নিজেরাই আইন রচনা করে দেশে জারী করে তারাও ফিরআউনের মত নিজেদের 'রব' এর আসনে বসিয়েছে। তবে ফিরআউন হলো স্বঘোষিত 'রব' আর তারা হলো অঘোষিত 'রব'। আর যারা আল্লাহর আইন বর্জন করে তাদের আইনই মেনে নেয় তারা তাদের 'রব' হয়ে যায়। এটি মুখে স্বীকার করুক বা না করুক তাতে কিছুই যায় আসে না।
.
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত যে, "আরবের কাফিরগণ এবং অন্যান্য কাফির মুশরিকগণ মহান আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র প্রতিপালক ও সার্বভৌম সর্বশক্তিমান মালিক বা 'রাব্ব' বলে মানত।" (ইসলামী আকীদা, পৃঃ ৯৯) - ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের এ দাবী কুরআন সুন্নাহ বিরোধী ও বিভ্রান্তিকর। কেননা, কেউ একমাত্র আল্লাহ তা'য়ালাকে রব বলে মেনে নিলে সে কাফির নয় বরং মু'মিন বলে গণ্য হবে (সহীহ মুসলিম, হাঃ ৩৪, জামে তিরমিযী হাঃ ২৬২৩; মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৭৮১, ১৭৮২), কবরের আযাব থেকে মুক্তি পাবে (সুনান আবু দাউদ হাঃ ৪৭৫৩; মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৮০৬৩; মিশকাত হাঃ ১৩১) এবং তার জন্য জান্নাত অবধারিত হবে (সূরা হা মীম সাজদাহঃ ৪১/৩০; সূরা আহকাফঃ ৪৬/১৩-১৪)। আমার ভুল হলে আল্লাহ ক্ষমা করে দিন। আর ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (র.) ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করে আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান দিন।
----------------------- 
লেখক ঃঃ ইসলামি চিন্তাবিদ প্রবন্ধ লেখক গ্রন্থপ্রণেতা ও দাঈ।

Post a Comment

0 Comments