দলছুট নেতাদের গঠিত এবি পার্টির উত্থানে জামায়াতে ইসলামী কি ইমেজ সংকটে পড়তে যাচ্ছে?
........................................
ঘটনাটি ২০১৪ সালের। 'ইসলামী আন্দোলনে হীনমন্যতার সুযোগ নেই' শিরোনামে আবু নকীব কর্তৃক একটি কলাম জামায়াত ঘরানার পত্রিকা গুলিতে প্রকাশিত হয়।
প্রথমে জেনে নিই এই আবু নকীব ব্যক্তিটি কে? বুঝতেই পারছেন যিনি লিখেছেন তিনি নকীবের বাবা। তো নকীব কার নাম? একজন নেতা আছেন যাঁর কয়েকজন ছেলের মধ্যে একজনের নাম নকীবুর রহমান! সেই নকীবের বাবা আর কেউ নন। তিনি হলেন সাবেক কৃষি ও শিল্প মন্ত্রী জনাব মতিউর রহমান নিজামী! যিনি তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রিয় আমির ছিলেন। উক্ত শিরোনামের ভিতরের কথাগুলি পরিবর্তে একাধিক কলাম ও পত্রিকায় জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগের সেক্রেটারী ও নিজামীর স্ত্রী জনাবা সামসুন্নাহার নিজামী লেখেন।
এবার আসি সেই কলামের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনায়। প্রেক্ষাপট ছিল জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারী জনাব কামারুজ্জামান কর্তৃক ৭১ এর দাগ মোচনে কথিত জমায়াত সংস্কার প্রস্তাবনার (যদিও তার লেখা কিনা তা প্রমানিত না) প্রেক্ষিতে নেতা কর্মীদের বিভ্রান্ত এড়াতে থিংক ট্যাংক হিসেবে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা ও পরামর্শ।
সেখানে বলা হয়েছিল, ইসলামী আন্দোলন করতে গেলে ও ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে নানা অজুহাতে, অপবাদে দমিয়ে রাখার সকল প্রকার সর্বোচ্চতম চেষ্টা করা হবে। নবি রাসূলদের যুগের ইতিহাস, খেলাফত, দেশে দেশে অতীত ও বর্তমানের ইসলামী মুভমেন্টগুলির ক্ষেত্রেও এমনটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেকোন ভাবে হউক স্পর্শ কাতর দোষ বের করে জনবিচ্ছিন্ন সহ কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে শাসক গোষ্ঠির দ্বারা।
নিজেরা বাঁচতে চেয়ে পূর্ব থেকে যতোই কোন কৌশল প্রয়োগ করা হউক, লেবাস পরিবর্তন করা হউক, লক্ষ-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী-কর্ম কৌশলে সেকুলার আনা হউক রেহাই মিলবে না। বরং চুড়ান্ত বাঁধা আসার আগেই নিজেরা নিজেদের আত্নরক্ষার সকল পথ বন্ধ করা হলো!
তিনি উক্ত কলামে আরও বলেছেন, কাঙ্খিত লক্ষে পৌছাতে একমাত্র অবলম্বন নয় বরং একটি নষ্ট করে দেয়া হলে দশটি পথ তৈরী করার যোগ্যতা ও সামর্থ তৈরী করতে হবে ইসলামী আন্দোলনের নেতা কর্মীদের। তবুও পূর্ব থেকে ইসলামী আন্দোলনে হীনমন্যতার সুযোগ নেই।
গত বছরের 'জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ' যা গত কাল গঠিত 'আমার বাংলাদেশ পার্টি' মূলত গঠিত হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর আদর্শে টিকে থাকতে না পারা, সরকারের নির্যাতনে হার মানা, দুনিয়াবী স্বার্থের অনুসন্ধানী ও প্রাচুর্যের মোহে পড়া কতিপয় নেতা ও কর্মীর দ্বারা। এ পর্যন্ত তারা ২২২ জন ব্যক্তিকে বাগে আনতে পেরেছে। তার মধ্যে প্রায় সবাই জামায়াত ছুট! তারা হয়তো মনে করতেছে জামায়াত ট্যাগ আওতা মুক্ত থাকলে ধুমিয়ে কাজ করা যাবে, তার্কি এদোগানের একে পার্টির মতো দ্রুত উঠে আসা যাবে! ক্ষমতার মাসনদে বসা যাবে! মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্ম নিয়ে বিতর্কের উদ্ধে উঠে আমরা রাজনীতি করবো। জনগন দলে দলে আমাদের দলে নাম লিখাবে! জনসংখ্যা জনশক্তিতে রুপান্তরিত হবে এবং তা একটি শক্তি রুপে আত্নপ্রকাশ করবে আর এই শক্তি কাজে লাগিয়ে আমরা দেশে এগিয়ে নিতে গবেষণা করবো, নীতি তৈরী করবো, লোক তৈরী করো, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় এসে কল্যানকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবো। একবার ক্ষমতা পাইলে জনগন মজা পাবে এরপর বার বার ক্ষমতা পাবো আর একই ব্যক্তি যেনো বার বার নেতাগীরী না করে সেজন্য তিনি সর্বোচ্চ ২ বার নেতা হতে পারবেন। ক্ষমতার ভাগাভাগি আগে থেকেই! এতো পরিমান আত্নবিশ্বাস!
যাই হউক, একারনে কি জামায়াত ইমেজ সংকটে পড়তেছে? আমি বলবো অবশ্যই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ তার ইতিহাস ও ঐতিয্যে হীনমন্যতার দাগ বয়ে নিচ্ছে! একটি দলের একজন হলেও কোন নেতা আদর্শচুত্য হলে সেটা দলের জন্য ক্ষতিকর। নেগেটিভ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। দলের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। জনমনে নতুন প্রশ্নের জম্ন দেয়।
জামায়াতের একটি অন্যতম নীতি হলো তারা ইসলামী আদর্শে অটল ও অনড়। এ পর্যন্ত হামলা, মামলা, রিমান্ড, পঙ্গুত্ব, গুলি, জেল, গুম, ফাঁসি, অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করা, নেতা-কর্মীদের শিক্ষা, চাকুরীতে, ব্যবসাতে, কৃষিতে, বাড়িতে কোনও ধরনের অত্যাচার তাদের নেতা কর্মীদের দমাতে পারে নি, আদর্শ চুত্য করতে পারে নি, রিক্রুটিং হার কমাতে পারেনি। চিন্তা করা যায়- দলের প্রথম সারির সকল নেতাকে হারিয়েছে যে দলটি সেটি এখনও মাথা উচু করে দাড়িয়ে দেশবাসিকে জানান দিচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী দল হিসেবে, সকল দলের মধ্যে সংখ্যায় ৩য় নাম্বার দল হিসেবে, শৃংখলা ও নৈতিকতায় ১ নাম্বার দল হিসেবে।
তবে জনাব মন্জু, জনাব সোলায়মান ও জনাব রাজ্জাকেদের মতো লোকদের চলে যাওয়ার কারনে জামায়াতের যতোটা না ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হতে পারে এবি পার্টি গঠনের কারনে জামায়াত বিরোধীদের সমালোচনায়।
যারা জামায়াত করে না কিংবা জামায়াতের ধবংস চায় তারা মনে করছে জামায়াতে ইসলামী উপর্যপুরী আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন, তছনছ ও জীর্ণ শীর্ণ হয়ে পিছু হটতে শুরু করেছে। অস্তিত্ব টিকে রাখতে মরন কামর হিসেবে টিকে থাকতে খোলস বদলাচ্ছে, আদর্শ চুত্য হচ্ছে, দলে ইসলামী নীতির অনুসৃতির চর্চা থেকে সরে আসতেছে! নিজেরা আপোষ মেনে ৭১ এর বিষয়ে অনুতপ্ত এবং অতীত কর্মকান্ডে লজ্জিত। আর তার প্রকাশ জামায়াত নামক বোতলের মদ এবি পার্টি নামক বোতলে ভরানো, জামায়াত নামক সাপ খোলস পাল্টিয়ে এবি পার্টি নামক খোলস নিয়ে বের হওয়া। তারা জনগনকে এবং জামায়াত কর্মী ও সমর্থক দের বিভ্রান্ত করতে জানাতে চাইতেছে, জামায়াত আসলেই ৭১ এ দোষ করেছে, তাদের দলীয় নীতি এদেশে অচল, ইসলামী লেবাস ছিল তাদের মূলত কপতটা, এযাবৎ তারা ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতির ব্যবসা করেছে, দেশে ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছে, টাকা কামাইছে, বড় বড় অর্থনৈতিক ব্যবসা করেছে! সরকার ও বাম রাম রা আরও প্রমান করতে চাইতেছে যে, জামায়াত নির্মূলের অভিযান ও নেতাদের হত্যা করা তাদের সঠিক কাজ ছিল।
বাস্তব সত্য হচ্ছে সাধারন মানুষ ও কিছু জামায়াত কর্মী সমর্থক এতে বিভ্রান্ত হচ্ছে। কতিপয় ব্যক্তি রাজনীতিতে পরোকিয়ার ধারা চালু অব্যহত রাখছে, কেউ কেউ নিজেকে প্লে-বয় হিসেবে তৈরী করছে! অন্যদিকে জামায়াত বিরোধীরা নিজেদেরকে সফল মনে করে বিজয়ের মজা নিবে এবং তাদের মধ্যে যারা ইসলাম সচেতন ও সাঈদী প্রেমিক ছিল তাদেরকে তারা বুঝাতে সক্ষম হবে যে, জামায়াত আসলেই ভন্ড ও ধর্ম ব্যবসায়ী! যারা বিশ্বাস করতো না সাঈদী রাজাকার তারা নিজেদের অবিশ্বাসী মনে করতে থাকবে। যারা মনে করতো ৭১ এ জামায়াতে ইসলামী খুন, ধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগে মতো ঘটনা ঘটার সাথে জড়িত নয় তারাও সন্দেহ করতে থাকবে।
--- কথা তো ঠিক নাহলে জামায়াত হীনমন্যতা দেখিয়ে পিছু হটলো কেন? দোষ না থাকলে কি এমনে খোলস পাল্টায়? হার মানে? নিষিদ্ধ করার আগেই নাম পরিবর্তন করে? আদর্শ ও ইসলামী নীতি থেকে সরে সেক্যুলার হয়? নিজেদের নেতা কর্মীদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি ৭১ এর দোষ স্বীকার করে/ সমালোচনা করে সংবাদ সম্মেলন করে, টকশো করে, কলাম লেখে, নিউজে আসে? যারা নেতাদের বাঁচাতে আইনজীবী হিসেবে ও মিডিয়া দিয়ে লড়েছে তারাই আজ মৃত্যু নেতাদের সমালোচনা করতেছে! নতুন দল বানাচ্ছে!
এরকম হাজারো প্রশ্ন থেকে উত্তরন ঘটাতে জামায়াতের উচিত নিজেদের ঐতিয্যের অস্তিত্ব জানান দেয়া, সকল জল্পনা, কল্পনার অবসান ঘটাতে সবকিছু ক্লিয়ার করে স্টেটমেন্ট দেয়া। নেতা, কর্মী, সমর্থক ও দেশবাসীকে সতর্ক করে ও বিভ্রান্ত না হতে ও বিভ্রান্তকারীতের মুখোস উন্নোচনের উদ্দের্শে জনসভা, সেমিনার, সংবাদ সম্মেলন, প্রেসনোট, লিফলেট বিতরন, শিক্ষাশিবির ও শিক্ষা বৈঠক করা।
অতীতেও জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের সোনালী ঐতির্য্যে কলঙ্ক দিতে কিছু প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। মাওলানা আব্দুর রহীম যিনি বাংলাদেশে জামায়াত গঠনে বেশি ভূমিকা রেখেছেন ও ৭১ পরবর্তী জামায়াতের নেতৃত্বদান করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিলেন তিনিও দল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। জামায়াত ধবংস হয়নি বরং তখনকার অবশিষ্টদের বুদ্ধি ও নিরলস পরিশ্রমে জামায়াত আজকের এতো বড়! শিবিরের একজন কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন আহমেদ আব্দুল কাদের বাচ্চু। তিনিও অনেক আলোচিত ভাবে জামায়াত শিবিরকে নাস্তানাবুদ করার উপকরন বিরোধীদের যুগিয়ে চলে গিয়েছিলেন। জামায়াত শিবির সামলে নিতে পেরেছে। বিএনপির প্রথমবার শাসনামলে জামায়াতের ঘরে আরও একবার মনোমালিন্য হয়। কিছু ব্যক্তি চলে যায়। জামায়াতের কিছুই হয় নি! ২০০৯ সালে শিবিরে বড় ধরনের একটি মনোমালিন্য হয়। কিন্তু জামায়াত শিবির তা সামলে নেয় এবং পরিপূর্ণ ইসলামিক আদর্শ লালন করে চারিত্রিক শক্তি ও ঐক্যের শক্তির বলে বলিয়ান হয়ে সরকার, রাম বাম দের মোকাবেলা করেছে এবং একই সাথে নিজেদের জনশক্তি প্রায় দ্বিগুন মাত্রায় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে!
জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্ব পারবে এবি পার্টির জম্নতে যে ইমজের সংকট তৈরী হয়েছে তা কৌশল ও বুদ্ধিভিত্তিক উপায়ে মোকাবেলা করতে। অবশিষ্ট নেতা কর্মীদের সেকুলার হওয়া থেকে বিরত রেখে 'দ্বীন হচ্ছে জীবন উদ্দেশ্য' তা রি-সেটআপ করতে কর্মসূচী হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়ণ করতে। কিন্তু চ্যালেন্জ হচ্ছে এতোদিন সবাই মিলে বাহিরের শত্রুকে মোকাবেলা করেছে কিন্তু এখন বাহিরের শক্রুর পাশাপাশি ঘরের শক্রুও মোকাবেলায় নজর দিতে হবে।
--------------------------------------------------
লেখক: এস এ মওদূদী,
প্রকৌশলী ও সমাজকর্মী
তাং: ০৩.০৫.২০২০ ইং।
0 Comments