মাষ্টারমশাই !
শিক্ষক স্বামীকে পড়ার টেবিলে দেখে….
স্ত্রী: কতদিন তোমার সাথে নিরালায় বসে “সুখ-দুঃখের” গল্প করি না। আজ একটু মন খুলে গল্প করতে ইচ্ছে করছে।
স্বামী: (বই থেকে মুখ তুলে) খুবই ভালো প্রস্তাব। আমরা এই আলোচনাকে অর্থবহ করে তুলতে পারি। “সুখ-দুঃখ” শব্দটা বলতেই আমার জসীমউদ্দিনের রুপাই আর শরৎচন্দ্রের দেবদাস চরিত্রের কথা মনে পড়লো। বলতো এই দু'টি চরিত্রের অমিল কি কি?
স্ত্রী: (বিরক্ত হয়ে) সাহিত্য বাদ দিয়ে একটু বাস্তবতায় ফিরে আসো। তুমি কেন আমার মনটা বুঝতে চাওনা?
স্বামী: সেই দুঃসাহস আমার নেই। কোথায় যেন পড়েছিলাম, A woman's heart is a deep Ocean of Secrets।
আর সক্রেটিস বলেছিলেন, আমি তো বিশাল সাগর পাড়ে জ্ঞানের নুড়ি কুড়াচ্ছি মাত্র। তাঁর মতো জ্ঞানী যদি একথা বলে তাহলে আমার পক্ষে তোমার মনের মহাসমুদ্রের রহস্য উন্মোচন আজীবনেও সম্ভব না।
স্ত্রী: যে ইংরেজি বাক্যটা বললে তার অনুবাদ কী?
স্বামী: বিয়ের আগেই শুনেছিলাম তুমি ইংরেজিতে ভীষণ কাঁচা। বাক্যটা বলার আগে এটা আমার মাথায় রাখা দরকার ছিলো। আরবী অলংকার শাস্ত্র(বালাগাত) মোতাবেক শ্রোতার সক্ষমতা উপলব্ধি করে কথা বলাই সফল বক্তার বৈশিষ্ট্য।
স্ত্রী: (চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে) মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি এক রোবটের সাথে সংসার করছি।
স্বামী: তুমি মানবিকের ছাত্রী। বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলা তোমার উচিত নয়। যে বিষয়ে জ্ঞান নেই তা নিয়ে কথা না বলা ইসলামেরও নির্দেশ । তাছাড়া বৈজ্ঞানিকভাবে রোবটের সাথে মানবের বসবাস সম্ভব হলেও সংসার তো আদৌ সম্ভব নয়!
স্ত্রী: (হতাশ হয়ে) আমার জন্য তোমার মনে কি একটুও অনুভূতি নেই?
স্বামী: এটা খুবই আত্মসম্মানে লাগার মতো অভিযোগ। নারীর প্রতি পুরুষের দুর্বলতা একেবারেই স্বভাবজাত। তাছাড়া এই আকর্ষণ পুরুষত্বের প্রমাণও বৈকি।
তুমি কি আমার পুরুষত্ব নিয়ে আপত্তি করছো!?
স্ত্রী: মাঝেমধ্যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তোমার সাথে আমার আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি-না? এভাবে কি জীবন চলে!
স্বামী: আমার নিজের ঔরসজাত সন্তান তোমাকে মা ডাকে, তুমি তা সানন্দে মেনেও নাও। এটাই প্রমাণ করে তোমার সাথে আমার একটি অতি স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্ক বিদ্যমান। এবার বিশ্বাস হলো তো? হাহাহাহাহা।
স্ত্রী: তুমি “বুকে হাত দিয়ে” সত্যি করে বলতো স্ত্রী হিসেবে আমি তোমার কাছে কেমন?
স্বামী চেয়ার থেকে উঠে বুকশেলফ থেকে ‘দেবদাস’ বইটা বের করে ধুলো ঝারতে ঝারতে বললো, ঠিক যেন দেবদাসের পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর মতো।
স্ত্রী: একথাটা বলতেও কি বই বের করা লাগে, কী আজব মানুষ।
স্বামী: তুমিই আজব মানুষ। নিজেই তো বললে বুকে (Book) হাত দিয়ে বলতে! তাইতো বইটা বের করলাম।
স্ত্রী: (একরাশ হতাশা নিয়ে) আল্লাহ!
আচ্ছাহ্… ভুলটা আমারই হয়েছে, মাফ করে দাও।
এবার বলো আমাকে কেন একই সাথে পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর সাথে তুলনা করলে?
স্বামী: তোমাকে একই সাথে দুজনের সাথে তুলনা করার কারণ আছে। পার্বতীর সান্নিধ্যে পেলে দেবদাস যেমন সুখ খুঁজে পায়, তোমার সুন্দর মুখটা দেখলে আমার মনটাও তেমন আনন্দে ভরে যায়। কিন্তু পার্বতীকে জীবন থেকে হারিয়ে যে সীমাহীন কষ্ট সে পেয়েছিলো তা ভুলতে দেবদাস বারংবার চন্দ্রমুখীর কাছে গিয়েছে। তার মতো তুমিও আমার কষ্ট ভুলে যাওয়ার মহৌষধ!
স্ত্রী: (খুশিতে গদগদ হয়ে) তাই বুঝি! এটা কী তোমার মনে কথা? না-কি কোনো গল্পের ডায়লগ কপি করে বললে?
স্বামী: হাহাহাহাহা, কথাটা আমার নিজেরই। তবে আমাদের দৈনন্দিন সব ঘটনা, আবেগ, ভালোবাসা কিছুই সাহিত্যের বাইরে নয়। তার প্রমাণ হলো ছোটগল্প বিষয়ে রবি ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতা,
ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা
ছোট ছোট দুঃখকথা
নিতান্তই সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি
প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু’চারিটি অশ্রুজল।
………..।
এটি ছোটগল্পের সবচেয়ে সার্থক সংজ্ঞা। আরও সংজ্ঞা আছে, শুনবে?
স্ত্রী: এইতো আবার জ্ঞান দেওয়া শুরু হলো। এই পাগলা ঘোড়া একবার লাইনচ্যুত হলে আর থামানো যায় না।
যাইহোক, চলো না দূরে কোথাও ঘুরে আসি। আমাদের সম্পর্কটা কেন জানি একঘেয়ে হয়ে গেছে!
স্বামী: বধূ আমার, সৌন্দর্য দেখতে বহুদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন শুধু অন্যদৃষ্টির। আমাদের আনাচে-কানাচে কত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে কখনো তা দেখার চেষ্টা করেছো? এ বিষয়ে দারুণ একটা কবিতা আছে,
বহু দিন ধরে' বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি,বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।
স্ত্রী: তুমি এত নীরস কেন! মনের ভিতর কি একটুও রসবোধ নেই?
স্বামী: কখনো কি শুনেছো শীতকালে আম, কাঠাল, লিচুর মতো রসালো ফল পাকে? পাকে না। কারণ রসালো ফল পাকতে অনেক বেশি উষ্ণতার প্রয়োজন হয়। তুমি আমাকে পর্যাপ্ত প্রেম-ভালোবাসার উষ্ণতা দিতে পারোনি বলেই হয়তো আমার রসবোধ কম। তবে তোমার মেজাজের উষ্ণতা বেশ ভালো ! কিন্তু দুঃখের বিষয় এই উষ্ণতা দিয়ে তো আর রসবোধ জাগ্রত হয় না। হাহাহাহাহাহ
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার এক লাফে শিক্ষক মশাইয়ের স্ত্রী উঠে চলে যেতে লাগলো।
স্বামী: কই যাও। গল্প শেষ?! ভালোই তো লাগছিলো।
স্ত্রী: কয়েক বালতি পানি এনে তোমার সমস্ত বই চুবিয়ে রাখবো। এই বইগুলোই তোমার মাথাটা খেয়েছে, সেই সাথে আমার জীবনেও আগুন লাগিয়েছে।
স্বামী: হাহাহাহা, নারীদের রাগ ও কষ্টের সাথে পানির গভীর সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয়। একবার নাকি সক্রেটিসের স্ত্রী প্রচন্ড রাগ করে স্বামীকে বকাঝকা করেন। কিন্তু সেদিকে সক্রেটিসের একটুও ভ্রুক্ষেপ নেই। স্বামীর এই ভাবলেশহীন আচরণ ও উপেক্ষা সইতে না পেরে রাগ করে স্বামীর মাথায় পানি ঢেলে দিয়েছিলেন। এই দৃশ্য দেখে বাইরের লোকজন হাসাহাসি করায় সক্রেটিস তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “My friend! You must know that after thunder comes rain."( প্রিয় বন্ধুরা, তোমাদের জানা উচিত আকাশ গর্জনের পরেই তো বৃষ্টি নামে)।
আজ সক্রেটিসের সেই বিখ্যাত উক্তির সত্যতা আমার জীবনেও বাস্তবায়ন হলো। কোনো কথা যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষার মাধ্যমে তার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার মাঝেই জ্ঞানার্জনের সার্থকতা নিহিত। কারণ সক্রেটিস বলেছেন, “অপরীক্ষিত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা গ্লানিকর”।
স্বামীর এই জ্ঞানগর্ভ পাগলামি দেখে স্ত্রীর চোখে কান্না….
স্বামী: দেখলে তো আমার কথাই সত্যি হলো। আমি তো আগেই বলেছিলাম “নারীদের রাগ ও কষ্টের সাথে পানির গভীর সম্পর্ক আছে….”
-------------------------
Abdullah Arman
22/05/2023
0 Comments