'ইলাহ'র অর্থ শুধু কি উপাস্য নাকি বিধানদাতা-ওঃ
---------------------------------------
ঈমানের মূল ভিত্তি হলো-
لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ.
"আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই।"
(সূরা সাফফাতঃ৩৭/৩৫; সূরা মুহাম্মদঃ৪৭/১৯; বুখারী ১/২৯, ৪৫, ৩৯৭ ৪/১৫৮৮, ৫/২০২৩; মুসলিম ১/৪৭, ৫৫, ৫৭, ৬০, ৪৫৫; মুসতাদরাক হাকীম ৪/২৭৯; ইবনে খুযাইমা ১/৩২; ইবনে হিব্বান ১৪/৫১৮; মাযমাউয যাওয়াইদ ৬/২১; আল ইসাবা: ৬/৪৬৩, জামে সাহীর, হাঃ ৪১৮৬; মু’জামে কাবীর লিত তবারানী হাঃ ৪১৮৮; মু’জামে আওসাত লিত তবারানী হাঃ ২১৯; মু’জামে ছগীর লিত তবারানী হাঃ ৯৪৮, ৯৯২; মু’জামে আওসাত লিত তবারানী হাঃ ৫৯৯৬ ও ৬৫০২; মুসনাদে বাযযার হাঃ ৪০৬৫; মু’জামে কাবীর হাঃ ১১০৯৩; সহীহুল জামি ২/১০৮৩)
প্রত্যেক নবী এ বিষয়ে তাঁর উম্মাতকে আহ্বান করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
(হে রাসূল!) তোমার পূর্বে এমন কোন রাসূল আমি পাঠাইনি যার প্রতি আমি এই ওহী নাযিল করিনি যে, ‘আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই; সুতরাং তোমরা আমার ইবাদাত কর।’ (সূরা আম্বিয়াঃ২১/২৫)
সুতরাং প্রত্যেক নবীর দাওয়াত ছিল:
يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهَُ
‘হে আমার কওম, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই। (সূরা আ'রাফঃ৭/৫৯, ৬৫, ৭৩, ৮৫; সূরা হুদঃ১১/৫০, ৬১, ৮৪; সূরা মু'মিনুনঃ২৩/২৩, ৩২)
বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এরও দাওয়াত ছিল:
يا أيها الناس قولوا لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ تفلحوا
'হে লোক সকল! তোমরা বল আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তাহল তোমরা সফলকাম হবে'। (সহীহ ইবনে খুযাইমা ১/৩২; সহীহ ইবনে হিব্বান ১৪/৫১৮; মাযমাউয যাওয়াইদ ৬/২১)
যেহেতু لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার নাম ঈমান সুতরাং 'ইলাহ' এর মর্মার্থ ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করে বুঝে নেয়া আবশ্যক।
'ইলাহ'র একাধিক অর্থ থাকলেও প্রধান অর্থ দুইটি।
১. উপাস্য অর্থাৎ যার উপাসনা, আরাধণা, পূঁজা-অর্চনা করা হয়, সেই ইলাহ'র মর্যাদা পায়। (এ অর্থ আমাদের সমাজে প্রচলিত, তাই দলিল পেশ করার প্রয়োজন নেই।)
২. স্বয়ংসম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত বিধানদাতা, আইনদাতা অর্থাৎ যার নির্দেশ, বিধান বা আইনকে অন্যান্য সকল বিধান ও আইনের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়, যার আইনকেই চূড়ান্ত আইন বলে মেনে নেওয়া হয় তাকেও 'ইলাহ'র আসনে বসানো হয়।
মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ.
আপনি কি তাকে লক্ষ্য করেছন, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? (সূরা জাসিয়াঃ৪৫/২৩)
أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلًا.
আপনি কি তাকে দেখেননি, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহরূপে গ্রহণ করেছে? তবুও কি আপনি তার যিম্মাদার হবেন? (সূরা ফুরকান২৫/৪৩)
হাওয়া অর্থ হলো নফস, প্রবৃত্তি, কামনা-বাসনা বা মনের আকাঙ্খা। নফস মানুষকে সাধারণত মন্দ কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকে। কুরআনের ভাষায়-
إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ
নিশ্চয় নাফ্স মন্দ কজের নির্দেশ দিয়ে থাকে। (সূরা ইউসুফঃ১২/৫৩)
প্রবৃত্তি বা মনের আকাঙ্খাকে ইলাহ বানানোর তৎপর্য হলো, নিজের মনের বা নফসের গোলামী করা, নফস যা হুকুম করে সে অনুযায়ী চলা অর্থাৎ নফসের আইন মানা। কোন ব্যক্তি নফসের হুকুম বা আইনকে (আল্লাহর আইনের উপর প্রাধান্য দিয়ে) মানলে আল্লাহর ভাষায়, প্রকৃতপক্ষে সে নফসকে 'ইলাহ' বানায়।
অতএব যদি কেউ আল্লাহর আইন পরিত্যাগ করে কোন রাজা, বাদশা, রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের হুকুম বা আইন মানে তাহলে সে আল্লাহর পরিবর্তে ঐ রাজা, বাদশা, রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীকেই ইলাহ বানায়। কুরআনের অকাট্য দলিল দ্বারা তাই প্রমাণ হয়। এমনি ভাবে কেউ যদি আল্লাহর হুকুম, আইন ও বিধানের তোয়াক্কা না করে, অপর কোন মানুষের হুকুম মান্য করে, সে হুকুম রাষ্ট্রের হোক বা দলের বা নেতার বা পীরের কিংবা শাইখের, যারই হোক যার হুকুম মানবে প্রকৃতপক্ষে সে-ই তার 'ইলাহ' হবে। তাকে মুখে 'ইলাহ' বলে স্বীকার করুক বা না করুক।
হযরত মূসা (আ) ফিরআউনের নিকট لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ. এর দাওয়াত নিয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে ফিরআউন ক্ষিপ্ত হয়ে জাতীয় পরিষদের নিকট যে কথা বললো আল্লাহ সে কথা কুরআনে উল্লেখ করেছেন-
وَقَالَ فِرْعَوْنُ يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِنْ إِلَٰهٍ غَيْرِي.
ফির‘আউন বলল, ‘হে পরিষদবর্গ, আমি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ আছে বলে আমি জানি না। (সূরা কাসাসঃ২৮/৩৮)
অতঃপর হযরত মূসা (আ) কে হুমকি দিয়ে-
قَالَ لَئِنِ اتَّخَذْتَ إِلَٰهًا غَيْرِي لَأَجْعَلَنَّكَ مِنَ الْمَسْجُونِينَ.
ফির‘আউন বলল, ‘যদি তুমি আমাকে ছাড়া কাউকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাকে জেলে বন্ধী করব’। (সূরা শুআরাঃ২৬/২৯)
ফিরআউন নিজেকে দ্বিতীয় অর্থে অর্থাৎ চূড়ান্ত আইনদাতা হিসাবে 'ইলাহ'র দাবী করেছে, তার পূঁজা বা উপাসনা করার জন্য নয়। উপাসনা বা পূঁজা করার ব্যাপারে ফিরআউন নিজেও মন্দিরের মূর্তিকেই 'ইলাহ' মনে করতো। দেখুন-
وَقَالَ الْمَلَأُ مِنْ قَوْمِ فِرْعَوْنَ أَتَذَرُ مُوسَىٰ وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ.
আর ফির‘আউনের কওমের সভাসদগণ বলল, ‘আপনি কি মূসা ও তার কওমকে ছেড়ে দেবেন যাতে তারা (আপনার আইন না মেনে) জমিনে ফাসাদ করে এবং আপনাকে ও আপনার ইলাহ তথা উপাস্যগুলোকে বর্জন করে?’ (সূরা আ'রাফঃ৭/১২৭)
মক্কার মুশরিকদের বিষয়ে আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ ۚ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ ۗ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ.
তাদের কি (আল্লাহর উলুহিয়্যাতের) এমন কিছু শরীক বানিয়ে নিয়েছে, যারা তাদের জন্য দ্বীনের বিধান দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? আর ফয়সালার ঘোষণা না থাকলে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েই যেত। আর নিশ্চয় যালিমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। (সূরা শুরাঃ৪২/২১)
উপরোক্ত আলোচনা ও আয়াতগুলো থেকে এটা পরিষ্কার যে, কোন মুসলিম لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ. এর মাধ্যমে আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ মানার ঘোষণা দিয়েছেন বা দিবেন, তিনি যেমন আল্লাহ ছাড়া কারো পূঁজা উপাসনা করতে পারেন না, তেমনিভাবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মানুষের বা মানব রচিত আইনের আনুগত্য ও অনুসরণ করতে পারেন না।
আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
وَهُوَ اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ لَهُ الْحَمْدُ فِي الْأُولَىٰ وَالْآخِرَةِ ۖ وَلَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ.
আর তিনিই আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। দুনিয়া ও আখিরাতে সমস্ত প্রশংসা তাঁরই; বিধানও (মানতে হবে) তাঁরই। আর তাঁর কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। (সূরা কাসাসঃ২৮/৭০)।
-----------------------------------------
লেখক: প্রবন্ধ লেখক কলামিস্ট ইতিহাস গবেষক অনলাইন একটিভিস্ট ও শিক্ষক।
0 Comments