ওহী'র মানদণ্ডে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সাহাবী: সংজ্ঞা ও তাদের শ্রেণিবিন্যাসঃ
-----------------------------------------------------------------
সাহাবীদের সংজ্ঞা ও তাদের শ্রেণিবিন্যাস জানার আগে তাদের কুরআনের কয়েকটি আয়াত ও সহীহ হাদীস দেখে নেই।
০১. আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
لَا يَسْتَوِي مِنْكُمْ مَنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ ۚ أُولَٰئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِنَ الَّذِينَ أَنْفَقُوا مِنْ بَعْدُ وَقَاتَلُوا ۚ وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَىٰ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ.
তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে এবং যুদ্ধ করেছে তারা সমান নয়। তারা মর্যাদায় তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যারা পরে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। তবে আল্লাহ প্রত্যেকের (নেক আমলের) জন্যই কল্যাণের ওয়াদা করেছেন। আর তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবগত। (সূরা হাদীদ ৫৭/১০)
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, মক্কা বিজয়ের পূর্বে ঈমান এনে যারা আল্লাহর রাস্তা ব্যয় করেছেন এবং জিহাদ করেছেন তাদের মর্যাদা মক্কা বিজয়ের পরে ঈমান এনে যারা জিহাদ করেছেন সেসব সাহাবীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
০২. আল্লাহ তা'য়ালা আরো বলেন,
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ.
আর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে। এটাই মহাসাফল্য। (সূরা তাওবা ০৯/১০০)
এ আয়াত থেকে জানা যায়, অগ্রগামী মুহাজির ও আনসার সাহাবী ও যারা তাদেরকে সুন্দরভাবে অনুসরণ করেছেন (তারা সাহাবী হোক বা না হোক) তাদের প্রতি আল্লাহ তা'য়ালা সন্তুষ্ট। কিন্তু যারা অগ্রগামী মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের অনুসরণ করেননি বরং বিরোধিতা করেছে তাদের প্রতি আল্লাহ তা'য়ালা সন্তুষ্ট নন।
০৩. আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ مُنَافِقُونَ ۖ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ ۖ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ لَا تَعْلَمُهُمْ ۖ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ ۚ سَنُعَذِّبُهُمْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلَىٰ عَذَابٍ عَظِيمٍ
আর তোমাদের আশপাশের মরুবাসীদের মধ্যে কিছু লোক মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কিছু লোক অতিমাত্রায় মুনাফিকীতে লিপ্ত আছে। তুমি তাদেরকে জান না। আমি তাদেরকে জানি। অচিরে আমি তাদেরকে দু’বার আযাব দেব তারপর তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে মহা আযাবের দিকে। (সূরা তাওবা ৯/১০১)
০৪. অন্য আয়াতে আল্লাহ তা'য়ালা আরো বলেন,
وَلَوْ نَشَاءُ لَأَرَيْنَاكَهُمْ فَلَعَرَفْتَهُمْ بِسِيمَاهُمْ ۚ وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ فِي لَحْنِ الْقَوْلِ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ أَعْمَالَكُمْ.
আর যদি আমি চাইতাম তবে আমি তোমাকে এদের দেখিয়ে দিতে পারতাম। ফলে লক্ষণ দেখেই তুমি তাদের চিনতে পারতে। তবে তুমি অবশ্যই কথার ভঙ্গিতে তাদের চিনতে পারবে। আল্লাহ তোমাদের আমলসমূহ জানেন। (সূরা মুহাম্মদ ৪৭/৩০)
০৫. আল্লামা ইবনে কাসীর রাহঃ বলেন, এ উক্তি (সূরা মুহাম্মদ ৪৭/৩০) এর মধ্যে (সূরা তাওবা ৯/১০১ এর সাথে) কোন বৈপরীত্য নেই। কেননা, এটা এই প্রকারের জিনিস যে, এর মাধ্যমে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য পেশ করা হয়েছে, যেন তাদের চেনা যায়। এর অর্থ এটা নয় যে, নবী (সাঃ) নির্দিষ্টভাবে সমস্ত মুনাফিকদের চিনতেন। তিনি মদীনাবাসীদের মধ্যে শুধুমাত্র ঐ কতিপয় মুনাফিকদের চিনতেন, যারা রাত দিন তাঁর সাথে ওঠা বসা করতো এবং সকাল সন্ধ্যায় তিনি তাদের দেখতেন। ইমাম আহমদ সনদসহ জুবায়ের ইবনে মুতঈম (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন.. রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আমার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে গোপনীয় ভাবে বললেন, "আমার সাহাবীদের মধ্যে কিছু মুনাফিকও আছে।" আল্লামা ইবনে কাসীর (রাহঃ) আরো বলেন,
أنه صلى الله عليه وسلم أعلم حذيفة بأعيان أربعة عشر أو خمسة عشر منافقا وهذا تخصيص لا يقتضي أنه اطلع على أسمائهم وأعيانهم كلهم والله أعلم
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হুযইফা (রাঃ) কে ১৪/১৫ জনের নাম জানিয়েছেন, যারা প্রকৃতপক্ষে মুনাফিক ছিল। এই বিশিষ্টকরণ এটা দাবী করে না যে, তিনি সমস্ত মুনাফিকদেরই নাম জানতেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'য়ালাই সবচেয়ে ভালো জানেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর; সূরা তাওবাঃ ৯/১০১)
০৬. ইমাম আবু জাফর তাবারী ও ইবনে কাসীর (রাহঃ) কাতাদা ও সাঈদ (রাহঃ) এর বরাতে বলেন, "কোনো লোকের মৃত্যু হলে হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর মনে যদি সন্দেহ দেখা দিত সেই লোক মুনাফিকদের একজন কিনা, তাহলে তিনি হযরত হুযাইফা (রাঃ) এর দিকে লক্ষ্য করতেন। তিনি তার জানাজা পড়লে উমার রাঃ তার জানাজা পড়তেন। অন্যথায় তাকে ত্যাগ করতেন। আমাদের কাছে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ওমর (রাঃ) হযরত হুযাইফা (রাঃ) কে একবার কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, বলুনতো আমিও কি মুনাফিকদের অন্তর্ভুক্ত? হুজাইফা (রাঃ) বলেন, لا ولا أومن منها أحدا بعدك না, আপনি তাদের অন্তর্ভুক্ত নন। তবে আপনার পরে আমি আর কারো ব্যাপারে জিম্মাদারি নিচ্ছি না।" (তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা তাওবাঃ ৯/১০১; তাফসীরে তাবারী, সূরা তাওবাঃ ৯/১০১; হাঃ ১৭১২৯)
০৭. বিখ্যাত তাবেয়ী কায়েস ইবনু উবাদ রাহঃ বলেন,
قُلْتُ لِعَمَّارٍ أَرَأَيْتُمْ صَنِيعَكُمْ هَذَا الَّذِي صَنَعْتُمْ فِي أَمْرِ عَلِيٍّ أَرَأْيًا رَأَيْتُمُوهُ أَوْ شَيْئًا عَهِدَهُ إِلَيْكُمْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ مَا عَهِدَ إِلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ شَيْئًا لَمْ يَعْهَدْهُ إِلَى النَّاسِ كَافَّةً وَلَكِنْ حُذَيْفَةُ أَخْبَرَنِي عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي أَصْحَابِي اثْنَا عَشَرَ مُنَافِقًا فِيهِمْ ثَمَانِيَةٌ (لَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ) ثَمَانِيَةٌ مِنْهُمْ تَكْفِيكَهُمُ الدُّبَيْلَةُ.
আমরা হযরত আম্মার (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা যে খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী (রাঃ) পক্ষ নিয়ে (হযরত মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে) লড়াই করছেন, তা কি আপনাদের নিজস্ব মতের ভিত্তিতে? নাকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে বিশেষভাবে আপনাদের নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন? তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বসাধারণকে যে নির্দেশ দেননি, এমন কেনো নির্দেশ তিনি বিশেষ ভাবে আমাদেরও দেননি। তবে আমাকে হুযাইফা (রাঃ) জানিয়েছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, আমার সাহাবীদের মধ্যে বার জন মুনাফিক হবে। তাদের জান্নাতে প্রবেশ এমনই অসম্ভব ব্যাপার যেমন সূঁচের ছিদ্রে উট প্রবেশ করানো অসম্ভব। তাদের মধ্যে আট জন মারা যাবে দুবাইলা (কাঁধ ও বুক দুর্বলকারী এক ধরনের বিষফোঁড়া) রোগে আক্রান্ত হয়ে। (সহীহ মুসলিম হাঃ ২৭৭৯; আরো দেখুন মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৮৯০৫, ২২৮০৮; বাইহাকী, দালায়েলুন নুবুওয়াহ ৫/২৬১)
০৮. জুবায়ের ইবনে মুতঈম (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন..
فَأَصْغَى إِلَيَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِرَأْسِهِ فَقَالَ إِنَّ فِي أَصْحَابِي مُنَافِقِينَ.
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আমার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে গোপনীয় ভাবে বললেন, "আমার সাহাবীদের মধ্যে কিছু মুনাফিকও আছে।" (মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৬৩২৩)
০৯. হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«يَرِدُ عَلَيَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَهْطٌ مِنْ أَصْحَابِي فَيُحَلَّئُونَ عَن الْحَوْضِ فَأَقُولُ يَا رَبِّ أَصْحَابِي فَيَقُولُ إِنَّكَ لَا عِلْمَ لَكَ بِمَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ ، إِنَّهُمْ ارْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِهِمْ الْقَهْقَرَى»
কিয়ামতের দিন আমার সাহাবীদের একটি দল আমার কাছে আসবে। তখন তাদেরকে হাউজে কাউছার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হবে। তখন আমি বলবো, ইয়া রব, এরাতো আমার সাহাবা। তিনি বলবেন, আপনার পরে এরা কি অপরাধ করেছে, তাতো আপনি জানেন না। এরা আপনার পরে সামনে না এসে পিছনে চলে গিয়েছিল।” (সহীহ বুখারী হাঃ ৬৫৮৫, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন হাঃ ৬১৩৪)
১০. আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
أَنَا فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ وَلَيُرْفَعَنَّ مَعِي رِجَالٌ مِنْكُمْ ثُمَّ لَيُخْتَلَجُنَّ دُونِي فَأَقُولُ يَا رَبِّ أَصْحَابِي فَيُقَالُ إِنَّكَ لاَ تَدْرِي مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ.
আমি তোমাদের আগে হাউয-এর কাছে গিয়ে হাজির হব। আর (ঐ সময়) তোমাদের কতগুলো লোককে অবশ্যই আমার সামনে উঠানো হবে। আবার আমার সামনে থেকে তাদেরকে আলাদা করে নেয়া হবে। তখন আমি বলব, হে রব! এরা তো আমার সাহাবা। তখন বলা হবে, আপনার পরে এরা কী অপরাধ করেছে তাতো আপনি জানেন না। (সহীহ বুখারী হাঃ ৬৫৭৬; সহীহ মুসলিম হাঃ ২২৯৭, মুসনাদে আহমাদ হাঃ ৩৬৩২, ৩৮০২, ৩৮১২, ৪০৩২, ৪১৬৯, ৪৩৪৮)
১১. আনাস (রাঃ) সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ
لَيَرِدَنَّ عَلَيَّ نَاسٌ مِنْ أَصْحَابِي الْحَوْضَ حَتَّى عَرَفْتُهُمْ اخْتُلِجُوا دُونِي فَأَقُولُ أَصْحَابِي فَيَقُولُ لاَ تَدْرِي مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ
আমার সামনে আমার উম্মাতের কতক লোক হাউযের কাছে আসবে। তাদেরকে আমি চিনতে পারব। আমার সামনে থেকে তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আমি বলব, এরা আমার সাহাবা। তখন আল্লাহ্ বলবেন, আপনি জানেন না আপনার পরে এরা কী সব নতুন নতুন মত ও পথ বের করেছিল। (সহীহ বুখারী হাঃ ৬৫৮২, সহীহ মুসলিম হাঃ ২৩০৪, মুসনাদে আহমাদ হাঃ ১৩৫৭৯, ১৩৯৯৩)
১২. সা‘ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব (রহ.) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহাবীদের থেকে বর্ণনা করেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
يَرِدُ عَلَى الْحَوْضِ رِجَالٌ مِنْ أَصْحَابِي فَيُحَلَّئُونَ عَنْهُ فَأَقُولُ يَا رَبِّ أَصْحَابِي فَيَقُولُ إِنَّكَ لاَ عِلْمَ لَكَ بِمَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ إِنَّهُمْ ارْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِهِمْ.
আমার উম্মাতের কিছু লোক আমার সামনে হাউযে কাউসারে হাজির হবে। তারপর তাদেরকে সেখান থেকে আলাদা করে নেয়া হবে। তখন আমি বলব, হে রব! এরা আমার সাহাবী। তিনি বলবেন, আপনার পরে এরা দ্বীনের মধ্যে কী বিষয় সৃষ্টি করেছে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনার জানা নেই। নিঃসন্দেহে এরা পিছনের দিকে ফিরে গিয়েছিল। (সহীহ বুখারী হাঃ ৬৫৮৬, আধুনিক প্রকাশনী হাঃ ৬১২৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন হাঃ ৬১৩৫; মুসনাদে আহমদ হাঃ ২২৯৮৬)
সাহাবীদের সংজ্ঞাঃ
অনেকেই বলে থাকেন, “সাহাবী হলেন সেসব লোকজন, যারা ঈমানের হালতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে দেখেছেন এবং ঈমানের হালতে মারা গেছেন।” কিন্তু এ সংজ্ঞা বাস্তব সম্মত নয়। কারণ নবী (সাঃ) এর যুগের মুসলমানদের কার মাঝে ঈমান ছিল ও কার মাঝে ঈমান ছিল না, তা বুঝবেন কি দিয়ে? ঈমানতো হৃদয়ের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, বাহ্যিক বিষয় নয়। ১৪০০ বছর আগের সাহাবা সমাজেও আমাদের সমাজের মত নানা ধরণের মুসলিম ছিল। তন্মধ্যে ঈমানওয়ালাদের স্তরও যেমন অনেক ছিল, তদ্রুপ বেঈমান বা ফাসিক, মুনাফিকদের স্তরও অনেক ছিল। যা উপরে বর্ণিত কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কতিপয় সাহাবীর দ্বারা চুরি করা, মদ্যপান করা, যিনা করা ও ধর্ষণের মত কবীরাহ সংঘটিত হয়েছিল (সহীহ বুখারী হাঃ ৬৩৯৫, ৬৪১৫; সহীহ মুসলিম হাঃ ১১৪, ১৬৯২,১৭০৫; জামে তিরমিযী হাঃ ১৪৫৪; সুনান নাসায়ী হাঃ ৪৯০৯, ৫৪১২; আবু দাউদ হাঃ ৪৩৭৯, ৪৪৩৭, ৪৪৬৬; মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৩৪০)। তবে সত্য হলো খন্দকের যুদ্ধ ও মক্কা বিজয়ের পর আরব উপদ্বীপের যেসব মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাদের মাঝেই মুনাফিক তথা সোশ্যাল মুসলিমদের সংখ্যা বেশী ছিল। এ জন্যই তাদের কেউ কেউ রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে বেয়াদবি করে পরবর্তীকালের খারেজীদের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। আবার তাদের অনেকে নবীজি (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর জাকাতের বিধিবিধানসহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ইতিহাসে মুরতাদ হিসেবে পরিচিত হয়েছিল (তারা আনুষ্ঠানিক ভাবে ইসলাম ত্যাগ করেনি)। তো এই ধরণের নামধারী সাহাবীসহ সর্বযুগের সকল মুনাফিক ও ফাসিকদের সমস্যা হলো, তারা গাইবের প্রতি ঈমান আনতে পারে না। তারা ঈমান আনে মুখে এবং তা শুধুমাত্র পরিবেশ ও পরিস্থিতির টান-চাপে।
এবার আসুন সাহাবীর সংজ্ঞা সম্পর্কে যুক্তিপূর্ণ কথায়। আরবী সাহাবা صحابة শব্দের অর্থ সাহচর্য, সান্নিধ্য, সান্নিধ্য প্রাপ্ত লোকজন। এটির একবচন সাহাবী। ইমাম বুখারী (রাহঃ) বলেন,
وَمَنْ صَحِبَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْ رَآهُ مِنْ الْمُسْلِمِيْنَ فَهُوَ مِنْ أَصْحَابِهِ.
মুসলিমদের মধ্য হতে যিনি নাবী (ﷺ) এর সঙ্গ লাভ করেছেন অথবা তাঁকে যিনি দেখেছেন তিনি তাঁর সহাবী। (সহীহ বুখারী, কিতাবু ফাযায়িলিস সাহাবা হাঃ ৩৬৪৯)
শায়েখ আবুল হুসাইন আলেগাজী (হাফিঃ) বলেন,
ইসলামী পরিভাষায় সাহাবা বলা হয় সেসব মুসলিমকে, যারা মুসলিম অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে দেখেছেন। তবে ১৪০০ বছর আগের কোনো মুসলিমের নবীজি (ﷺ) কে দেখার অর্থ কখনো এই না যে, লোকটি খাঁটি মুমিন বা আল্লাহর ওলী হয়ে গেছে। কারণ, নবীজি (ﷺ) এর জীবদ্দশায় তাঁকে দর্শনকারী অনেক মুসলিম আমাদের সমাজের মুসলিমদের ন্যায় নানা অন্যায় ও কপটতামূলক কাজ করেছেন। বিশেষত জিহাদ ও ও মুসলিমদের কল্যাণ কামনার প্রশ্নে সবসময় সুবিধাবাদী পথ অবলম্বন করেছেন। এর বিবরণ সূরা তাওবা, সূরা আহযাব, সূরা বাকারা, সুরা আলে ইমরান, সূরা নিসা ও সূরা মুনাফিকূনসহ বিভিন্ন সূরায় রয়েছে।
সাহাবীদের শ্রেণিবিন্যাসঃ
শায়েখ আবুল হুসাইন আলেগাজী (হাফিঃ) বলেন,
সাহাবা সমাজে ভেজাল মুমিন থাকার কারণে বলতে হয় যে, বাহ্যিক হালত বিবেচনায় সাহাবীগণ তিন প্রকার। যথাঃ ১. মুবাশ্বারুন (সুসংবাদ প্রাপ্ত), ২. মুযাম্মামুন (নিন্দিত) ও ৩. মসকূত আনহুম (ভালো-মন্দ কিছুই জানা যায়নি)।
এক. মুবাশ্বারুন। তারা হলেন সেসব সাহাবী, যাদের ঈমানদার বা জান্নাতী হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য কোনো বর্ণনা রয়েছে। এরকম শতশত সাহাবীর নাম হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে রয়েছে।
দুই. মুযাম্মামুন। তারা হলো সেসব সাহাবী, যাদের ফাসিক বা মুনাফিক হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য কোনো বর্ণনা রয়েছে। আহলে হাদীসের আলেম শাযেখ ওহিদুজ্জামান তার 'নুজুলুল আবরার' কিতাবে লিখেনঃআল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
ﻳَٰٓﺄَﻳُّﻬَﺎ ﭐﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺀَﺍﻣَﻨُﻮٓﺍ۟ ﺇِﻥ ﺟَﺎٓﺀَﻛُﻢْ ﻓَﺎﺳِﻖٌۢ ﺑِﻨَﺒَﺈٍ ﻓَﺘَﺒَﻴَّﻨُﻮٓﺍ۟ .
হে মু’মিনগণ! কোন ফাসিক ব্যক্তি যদি তোমাদের কাছে কোন খবর নিয়ে আসে, তাহলে তার সত্যতা যাচাই করে নাও। (সূরা হুজুরাতঃ ৬)আয়াতটি ওলীদ ইবনে ওকরা সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় কিছু সাহাবী ফাসিক ছিলেন। যেমন, ওলীদ। এভাবে হযরত মুয়াবিয়া, আমর ইবনে আস, মুগীরা ইবনে শুবা, সামুরা ইবনে জুন্দুব ফাসিক ছিলেন।"(নুজুলুল আবরার, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৯৪)
তিন. মসকূত আনহুম। যাদের ব্যাপারে ভালো-মন্দ কোনো কথা পাওয়া যায় না। এরকম হাজারো সাহাবীর নাম হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে রয়েছে।
সুতরাং কুরআন ও সহীহ হাদীস তথা ওহীর মানদণ্ডে প্রমাণিত যে, সাহাবী বলতে সকলেই দ্বীনদার ও পরহেজগার ছিলেন না, বরং তাদের মাঝে কিছু ফাসিক, ফাজির ও মুনাফিকও ছিল। তন্মধ্যে দ্বীনদার ও পরহেজগার সাহাবীগণই ছিল প্রকৃত অর্থে ফযিলতে সাহাবী, যাদের প্রতি মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট। বাকিরা উরফ তথা পারিভাষিক অর্থে সাহাবী। তবে সাহাবা সমাজে প্রকৃত দ্বীনদার ও পরহেজগার মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সহীহ বুৃঝ দান করুন।

0 Comments