Recent Tube

ইসলামে শিষ্টাচারের মহান পাঠ: *সূরা হুজুরাত (৪৯:২)-এর আলোকে* *আদব, আইন ও আধ্যাত্মিকতা:


 ইসলামে শিষ্টাচারের মহান পাঠ:*
*সূরা হুজুরাত (৪৯:২)-এর আলোকে* 
*আদব, আইন ও আধ্যাত্মিকতা:

সূরা হুজুরাত, আয়াত ২:_ হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের কণ্ঠস্বর নবী (মুহাম্মাদ ﷺ)-এর কণ্ঠস্বরের উপর উঁচু করো না, এবং তাঁর সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে তোমরা একে অপরকে যেভাবে উচ্চস্বরে কথা বলো, সে রকম করো না; অন্যথায় তোমাদের আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তোমরা তা টেরও পাবে না।”

*১. নাযিলের প্রেক্ষাপট ( আসবাবুন নুযুল):* 

এই আয়াতটি নাযিল হয় দুইটি বিশেষ ঘটনার পটভূমিতে, 

_(ক) আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.)-এর ঘটনার পেক্ষাপটে:_ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সামনে বনী তামীম গোত্রের নেতা নির্বাচন নিয়ে আলোচনা চলছিল। তখন আবু বকর (রা.) একটি প্রস্তাব দিলেন, আর উমর (রা.) আরেকটি প্রস্তাব দিলেন। এতে দুজনের মধ্যে আলোচনার এক পর্যায়ে দু’জনের কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে যায়। এ সময় আল্লাহ তৎক্ষণাৎ এই আয়াত নাযিল করলেন। উমর (রা.) পরে বলেন, "এই আয়াত নাযিলের পর আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে এত নিচু স্বরে কথা বলতাম যে তিনি প্রায় শুনতেই পেতেন না।"

_(খ) বেদুঈনদের রূঢ় আচরণ:_ কিছু বেদুঈন (বদু) এসে নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে তাঁর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ডাকতে থাকে, “হে মুহাম্মাদ! আমাদের জন্য বের হও!” তাদের রূঢ় আচরণের সংশোধন করার জন্যও এই আয়াত ও পরবর্তী আয়াতসমূহ নাযিল হয়।

*৩️. ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ:*

_(ক). নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মর্যাদার প্রতি সর্বোচ্চ আদব:_ এই আয়াতের মূল বার্তা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে উচ্চস্বরে কথা বলা ইসলামের আদব-শিষ্টতার পরিপন্থী, যা এত বড় অপরাধ যে, এতে আমল নষ্ট হয়ে যেতে পারে; মানুষ নিজেই বুঝতে পারবে না যে সে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। এটি নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও বিনয় প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়।

_(খ). নৈতিক শৃঙ্খলার প্রশিক্ষণ:_ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সামনে রূঢ় ভাষা, গলা উঁচু করা, অসৌজন্যমূলক ব্যবহার, এসবকে আল্লাহ বড় পাপের শামিল করেছেন। এতে বোঝা যায়: ভদ্রতা, নম্রতা, নীরব শ্রবণশীলতা এবং নিয়ন্ত্রিত বক্তব্য, এসব ইসলামের মৌলিক নৈতিকতা।

_(গ). সামাজিক আচরণের মানদণ্ড:_ আলাপ-আলোচনা, বিতর্ক, মিটিং এসব জায়গায় কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণের আদবও এখান থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়।

*৪️. আইন, নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দর্শনের আলোকে:*

_(ক). আইন (Legal Principle):_ এই আয়াত নির্দেশ করে যে ধর্মীয় নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের সামনে শৃঙ্খলা বজায় রাখা বাধ্যতামূলক। এখান থেকে ফিকহে শাসনব্যবস্থায় একটি নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়, “উচ্চপদস্থ কর্তৃপক্ষের সামনে শৃঙ্খলা ও আচরণবিধি মানা ওয়াজিব।”

_(খ) নীতি (Policy Principle):_ সামাজিক সংগঠন, রাষ্ট্র, মজলিস, বৈঠক—যেখানে নেতৃত্ব আছে, সেখানে আদব, শিষ্টাচার ও পেশাদারিত্ব অপরিহার্য।

_(গ) নৈতিকতা (Ethics):_ ইসলামী নৈতিকতার মূল বিষয়গুলো এই আয়াতে প্রকাশ পায় বিনয়, নম্রতা, শ্রদ্ধা, সংযম, দায়িত্বশীলতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ।

_(ঘ). মূল্যবোধ (Values):_ নেতৃত্বের প্রতি সম্মান; সমাজে কথাবার্তার সংস্কৃতি; মতবিরোধেও ভদ্রতা; শৃঙ্খলা ও পরিমিতি; অহংকার বিমোচন।

_(ঙ). দর্শন (Philosophy):_ ইসলাম শুধু বাহ্যিক আচরণ নয়, আধাত্মিক ও আখলাকি সৌন্দর্যও সৃষ্টি করে। কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ, এটি মানব চরিত্রের একটি গভীর ফিলোসফি: যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যার ভদ্রতা আছে, তার মধ্যে তাকওয়ার আলো থাকে।

*৫️. শিক্ষা ও হিকমাহ:*

(ক). নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান ঈমানের শর্ত; মানুষ যত বেশি আদব শিখবে, তার ঈমান তত বেশি পরিপূর্ণ হবে।

(খ). কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ ইসলামী চরিত্রের অংশ; বলা হয়, "আদব পূর্বে, ইলম পরে"।

(গ). আমল নষ্ট হওয়ায় সতর্কতা: একটি ছোট অসৌজন্য আচরণ পর্যন্ত আমল বরবাদ করে দিতে পারে, এটি আমাদের আত্মসমালোচনা শেখায়।

(ঘ). নেতৃত্বের প্রতি শৃঙ্খলা: নেতৃত্বের মর্যাদা ও আদব বজায় রাখা সমাজে স্থিতিশীলতা আনে।

(ঙ). সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠা: উচ্চস্বরে তর্ক, ঝগড়া, রূঢ়তা, এসব আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়।

(চ). আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ: নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সামনে কণ্ঠ নিচু করা হলো হৃদয়ের তাকওয়া; আজ তা প্রযোজ্য, মসজিদে, আলেমদের সামনে, শিক্ষকদের সামনে, পিতা-মাতা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের সামনে।

*৬. রাসূল্লাহর (ﷺ)-এর রাওজা মুবারকের সামনে আদব: আয়াতের বাস্তব প্রয়োগ:*

আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব দিক হলো, এই আয়াতটি আজও মদিনার মসজিদে নববীর সাথে রাসূলুল্লহ (ﷺ)-এর রওজা মোবারকের সম্মুখভাগে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। এটি নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রতি আদব, সম্মান, নীরবতা ও বিনয়ের চূড়ান্ত নির্দেশনার স্মারক হিসেবে সর্বদা লক্ষণীয়।

মুসলিমরা যখন রাওজা মোবারকে সামনে দাঁড়িয়ে রাসূলূল্লাহ (ﷺ)-কে সালাম পেশ করেন, তখন এখানে কঠোরভাবে মানা হয়, কেউ যেন উচ্চস্বরে সালাম না দেয়, রাওজা মোবারকের আশেপাশে উঁচু গলায় কথা না বলে, এবং আবেগে ভেসে জোরে কান্নাকাটি না করে।

কারণ, এই সমস্ত আচরণ সূরা হুজুরাতের এই আয়াতের সরাসরি লঙ্ঘন। রাসূলুল্লাহ  (ﷺ)-এর সামনে কণ্ঠস্বর নিম্ন করা শুধু অতীতের ঘটনা নয়, বর্তমানেও এটি ঈমান, তাকওয়া, আদব ও আধ্যাত্মিক পরিপক্বতার জীবন্ত নিদর্শন।

*৭. উপসংহার:*

সূরা হুজুরাত ২ নম্বর আয়াত আমাদের শিখায় যে, ইসলামে আদব ও চরিত্র গঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূলূল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি বিনয় ও শিষ্টাচার শুধু আচরণগত নয়, এটি ঈমানের অঙ্গ।

এ আয়াতে একটি সভ্য, শান্ত, শৃঙ্খলাপূর্ণ ইসলামী সমাজের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে নেতৃত্ব সম্মানিত, ভাষা নিয়ন্ত্রিত, এবং আচরণ বিনয়পূর্ণ। এটি এমন একটি আয়াত যা ব্যক্তিগত আচরণ থেকে রাষ্ট্রীয় নীতি, উভয়কেই উন্নত করে।

*আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ'লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ'লামীন*। (মূসা: ০৮-১২-২৫)

Post a Comment

0 Comments