-------------------------------------
প্রশ্নঃ মোহতারাম,
السلام عليكم ورحمة الله
.
গণতন্ত্রকে সমর্থন দিয়ে ইসলামি রাজনীতি করা কি জায়েয?
গণতন্ত্র তো কুফরি মতবাদ এটা সমর্থন দেয়া কি ঠিক হবে?
ইসলামি খিলাফত কিভাবে কায়েম করতে হবে?
.
জবাবঃ
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته.
.
আপনার প্রশ্নগুলোর সংক্ষিপ্ত জবাব হলো:
০১. গণতন্ত্র বলতেই কুফুরি-এমন ধারনা সঠিক নয়। গণতন্ত্রের বহুরূপ রয়েছে। এর কুফুরি এবং শিরকি রূপও রয়েছে। আবার কুফর এবং শিরকবিহীন রূপও রয়েছে। অনেক দেশ নিজেদের চাহিদা মতো নিজ নিজ দেশে গণতন্ত্রের নতুন নতুন রূপায়ন করেছে।
.
০২. ইসলাম সমর্থিত গণতন্ত্র হলো, জনগণের/ইসলামি জনগণের ভোট বা মতামতের ভিত্তিতে তাদের নেতা ও প্রতিনিধিগণ নির্বাচিত হবেন। আবার তাদের সমর্থন হারালে নেতা/ প্রতিনিধিগণ পদচ্যুত হবেন। কিন্তু রাষ্ট্র বা দল পরিচালিত হবে কুরআন-সুন্নাহর মূলনীতির ভিত্তিতে। মূলনীতির ভিত্তিতে নেতা ও প্রতিনিধিগণ জনগণের পরামর্শও গ্রহণ করবেন।
.
০৩. ইসলামি রাষ্ট্র ও দলকে এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই পরিচালিত হতে হবে। তা নাহলে তা হবে স্বৈরতন্ত্র এবং জুলুমতন্ত্র। এই প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিকে কেউ গণতন্ত্র না বলে অন্য কিছুও বলতে পারে-তাতে কিছু যায় আসেনা। কিন্তু মূলনীতি, নির্বাচন পদ্ধতি এবং মতামত গ্রহণ প্রক্রিয়া থাকতে হবে।
.
০৪. এটা মনে রাখা দরকার, গণতন্ত্র বলতেই আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্র বুঝা যায়না। তাছাড়া গণতন্ত্র কোনো জড় পদার্থও নয় যে, তা পরিবর্তনযোগ্য নয়।
.
০৫. ইসলামি খিলাফত কায়েমের উত্তম পদ্ধতি হলো রসূলুল্লাহ সা. প্রদর্শিত পদ্ধতি। তাহলো:
এক. জনগণের চিন্তার পরিবর্তন (ইসলামের দিকে)।
দুই. জনগণের চরিত্রের পরিবর্তন (ইসলামের দিকে)।
তিন. নতুন (ইসলামি) সমাজের প্রবর্তন।
চার. ইসলামি খিলাফত হতে হবে এই নতুন সমাজের দাবি ও চাহিদার ভিত্তিতে।
.
তবে যে ব্যক্তি এ পদ্ধতির অধীনে নিজেকে কিংবা অন্য কাউকে এ জন্য নির্বাচিত করে যাতে করে এ আইনসভাতে ঢুকে এর বিরোধিতা করা যায়, এ পদ্ধতির বিপক্ষে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়, সাধ্যানুযায়ী অকল্যাণ ও দুর্নীতি রোধ করা যায় এবং যেন গোটা ময়দান দুর্নীতিবাজ ও নাস্তিকদের হাতে চলে না যায়, যারা জমিনে দুর্নীতি ছড়িয়ে দেয়, মানুষের দ্বীন ও দুনিয়ার সমূহ কল্যাণ নস্যাৎ করে দেয়— তবে এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য কল্যাণের দিক বিবেচনা করে ইজতিহাদ করার তথা বিবেক-বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ রয়েছে। বরং কোন কোন আলেম মনে করেন, এ ধরনের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা ফরজ।
.
শাইখ মুহাম্মদ বিন উসাইমীনকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার হুকুম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাবে বলেন:
আমি মনে করি এ নির্বাচনগুলোতে
অংশ নেয়া ফরজ। আমরা যাকে ভাল
মনে করি তাকে সহযোগিতা করা ফরজ। কারণ ভাল লোকেরা যদি ঢিলেমি করে তাহলে এ স্থানগুলো কে দখল করবে? খারাপ লোকেরাই দখল করবে কিংবা এমন লোকেরা দখল করবে যাদের কাছে না আছে ভাল; না আছে খারাপ; যারা সুবিধাবাদী। তাই আমাদের উচিত যাকে যোগ্য মনে করি তাকে নির্বাচিত করা।
.
যদি কেউ বলেন: আমরা যাকে নির্বাচিত করলাম আইনসভার অধিকাংশ সদস্য তার বিপক্ষে।
আমরা জবাবে বলব: কোন অসুবিধা নেই। এই একজনের মধ্যে আল্লাহ বরকত দিতে পারেন। তিনি যদি আইনসভার সামনে হক কথা বলতে পারেন তাহলে অবশ্যই এর প্রভাব থাকবে, প্রভাব থাকতেই হবে। তবে যে ক্ষেত্রে আমাদের কসুর হয় সেটা হচ্ছে আল্লাহর সাথে বিশ্বস্ত হওয়া। আমরা শুধু বৈষয়িক বিষয়ের উপর নির্ভর করি আল্লাহর বাণী এর দিকে তাকাই না। সুতরাং আপনি যাকে ভাল মনে করেন তাকে নির্বাচিত করুন; এরপর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করুন।
[শাইখ মুহাম্মাদ বিন উসাইমীন, লিকাআতুল বাব আল-মাফতুহ]
.
সৌদি আরবের ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির আলেমগণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:
নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দেয়া ও ভোট দেয়া জায়েয আছে কি? উল্লেখ্য, আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থা আল্লাহর নাযিলকৃত আইনে নয়।
জবাবে তাঁরা বলেন: যে সরকার আল্লাহর নাযিলকৃত আইন দিয়ে শাসন করে না, শরিয়া আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে না কোন মুসলমানের জন্য সে সরকারে যোগ দেয়ার প্রত্যাশায় নিজেকে মনোনীত করা জায়েয নয়। তাই এ সরকারের সাথে কাজ করার জন্য কোন মুসলমানের নিজেকে কিংবা অন্য কাউকে নির্বাচিত করা জায়েয নেই। তবে কোন মুসলমান যদি এ উদ্দেশ্য নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হয় কিংবা অন্যকে নির্বাচিত করে যে, এর মাধ্যমে এ শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করে ইসলামী শরিয়াভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করবে, নির্বাচনে অংশ গ্রহণকে তারা বর্তমান শাসনব্যবস্থার উপর আধিপত্য বিস্তার করার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে সেটা জায়েয। তবে, সে ক্ষেত্রেও যে ব্যক্তি প্রার্থী হবেন তিনি এমন কোন পদ গ্রহণ করতে পারবেন না যা ইসলামী শরিয়ার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
ফতোয়া দিয়েছেন-
১. শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায,
২. শাইখ আব্দুর রাজ্জাক আফিফি,
৩. শাইখ আব্দুল্লাহ গুদইয়ান,
৪. শাইখ আব্দুল্লাহ কুয়ুদ।
[স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র থেকে সংকলিত (২৩/৪০৬, ৪০৭)]
.
স্থায়ী কমিটিকে আরও জিজ্ঞেস করা হয় যে, আপনারা জানেন, আমাদের আলজেরিয়াতে “আইনসভার নির্বাচন” অনুষ্ঠিত হয়। কোন দল আছে যারা ইসলামী হুকুমত কায়েমের দিকে আহ্বান করে। আর কোন দল আছে যারা ইসলামী হুকুমত চায় না। এখন যে ব্যক্তি এমন কাউকে ভোট দেয় যে প্রার্থী ইসলামী হুকুম চায় না সে ব্যক্তির হুকুম কি হবে; তবে এ ব্যক্তি নামায আদায় করে?
জবাবে তাঁরা বলেন: যে সব দেশে ইসলামী শরিয়াভিত্তিক শাসনব্যবস্থা চালু নাই সেসব দেশের মুসলমানদের উপর ফরজ ইসলামী হুকুমত ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা নিয়োজিত করা এবং যে দল ইসলামী হুকুমত বাস্তবায়ন করবে বলে তারা ধারনা করেন সে দলকে একজোটে সবাই মিলে সহযোগিতা করা। পক্ষান্তরে, যে দল ইসলামী শরিয়া বাস্তবায়ন না করার প্রতি আহ্বান জানায় সে দলকে সহযোগিতা করা নাজায়েয। বরং এ ধরনের সহযোগিতা ব্যক্তিকে কুফরের দিকে ধাবিত করে।
দলিল হচ্ছে আল্লাহর বাণী:
.
وَأَنِ ٱحْكُم بَيْنَهُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَآءَهُمْ وَٱحْذَرْهُمْ أَن يَفْتِنُوكَ عَنۢ بَعْضِ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ إِلَيْكَۖ فَإِن تَوَلَّوْا۟ فَٱعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ أَن يُصِيبَهُم بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْۗ وَإِنَّ كَثِيرًا مِّنَ ٱلنَّاسِ لَفَٰسِقُونَ. أَفَحُكْمَ ٱلْجَٰهِلِيَّةِ يَبْغُونَۚ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ ٱللَّهِ حُكْمًا لِّقَوْمٍ يُوقِنُونَ .
.
আর তাদের মধ্যে তার মাধ্যমে ফয়সালা কর, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর তাদের থেকে সতর্ক থাক যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার কিছু থেকে তারা তোমাকে বিচ্যুত করবে। অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে জেনে রাখ যে, আল্লাহ তো কেবল তাদেরকে তাদের কিছু পাপের কারণেই আযাব দিতে চান। আর মানুষের অনেকেই ফাসিক। তারা কি জাহেলিয়াতের বিধান কামনা করে? যারা (আল্লাহর প্রতি) একীন রাখে তাদের কাছে আল্লাহর চেয়ে উত্তম বিধানদাতা কে?”
[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৪৯-৫০]
.
এ কারণে যারা ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে না আল্লাহ তাদেরকে কাফের হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَٰٓئِكَ هُمُ ٱلْكَٰفِرُونَ
.
আর যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে ফয়সালা করে না, তারাই কাফির।
(সূরা মায়িদাঃ৪৪)
তাদের সাথে সহযোগিতা করা থেকে, তাদেরকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করা থেকে সাবধান করেছেন। যদি মুমিনগণ প্রকৃত ঈমানদার হয় তাদেরকে তাকওয়া অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন:
.
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَتَّخِذُوا۟ ٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُوا۟ دِينَكُمْ هُزُوًا وَلَعِبًا مِّنَ ٱلَّذِينَ أُوتُوا۟ ٱلْكِتَٰبَ مِن قَبْلِكُمْ وَٱلْكُفَّارَ أَوْلِيَآءَۚ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
.
হে মুমিনগণ, তোমরা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যারা তোমাদের দীনকে উপহাস ও খেল-তামাশারূপে গ্রহণ করেছে, তাদের মধ্য থেকে তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে ও কাফিরদেরকে। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক।
[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৫৭]
.
আল্লাহই তাওফিকদাতা, আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর আল্লাহর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক।
.
গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি
১. শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায,
২. শাইখ আব্দুর রাজ্জাক আফিফি,
৩. শাইখ আব্দুল্লাহ গুদইয়ান
৪. শাইখ আব্দুল্লাহ কুয়ুদ।
[স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র (১/৩৭৩)]
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলানা।
0 Comments