Recent Tube

মানবতার বন্ধু মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ {সঃ} , এই বই থেকে নেয়া।

যারা সমঝোতার বিরোধিতা করেন তাদের জন্য
বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারি নবী মুহাম্মদ {সঃ} এর জীবনী থেকে কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 

চুক্তি ও সমঝোতার শক্তিঃ-

জনগণের মধ্যে দাওয়াত ও তাবলীগের যে ব্যাপক কাজ উপরোক্ত প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয় তার সাথে আরো কিছু বড় বড় সহায়ক পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়। এগুলোর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল মদিনার রাজনৈতিক প্রভাব সম্প্রসারণ। এই প্রভাব সম্প্রসারণের কাজটা অনেকাংশে সমাধা করা হয় চুক্তি ও মৈত্রী সম্পর্কের মাধ্যমে। চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে রাসূল সা. কর্তৃক সরকারের প্রভাব বলয় সম্প্রসারণ এবং এ ব্যাপারে অস্বাভাবিক মনোযোগ দান থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি যতদূর সম্ভব, যুদ্ধবিগ্রহ এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন এবং চারদিকে শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছিলেন, যাতে করে এধরনের শান্ত পরিবেশে দাওয়াতের কাজ ভালোভাবে করা যায় এবং সামরিক উত্তেজনা মাঝখানে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। যেখানে ইসলাম, ইসলামী রাষ্ট্র ও শান্তি রক্ষার জন্য সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ অনিবার্য হয়ে পড়েছে, সেখানে তো তিনি কোন রকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেননি। কিন্তু যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে অব্যাহতি লাভ করা যদি সম্ভব হতো এবং শান্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে যদি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক রক্ষণাবেক্ষণ, স্থিতিশীলতা ইসলামের দাওয়াত দেয়ার বাধাহীন পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হতো, তাহলে তিনি সন্ধি ও সমঝোতার পথ কখনো পরিহার করেননি। খোদ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তরবারীর শক্তি দিয়ে নয়, বরং সাংবিধানিক চুক্তির জোরে সম্পন্ন হয়েছিল। তারপর রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও তার প্রভাব সম্প্রসারণের জন্য তিনি মিত্রতার সম্পর্ককে এত ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন যে, তার তুলনায় সামরিক ব্যবস্থার অনুপাত ছিল নিতান্তই কম।
চুক্তি ও মৈত্রী ভিত্তিক সম্পর্ক গড়া সহজ কাজ নয়। বিশেষত, ধর্মীয় মতভেদ ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ যখন বিদ্যমান থাকে, পরস্পর বিরোধী শক্তিগুলো মাঝখানে হস্তক্ষেপ করে এবং ব্যাপারটা যদি সাধারণভাবে একেবারেই পূর্ব পরিচয়বিহীন গোত্র ও ব্যক্তিবর্গের সাথে সম্পৃক্ত হয়, সেক্ষেত্রে এ কাজে অত্যধিক রাজনৈতিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়। শ্রোতার অবস্থা, মানসিকতা ও শক্তি সম্পর্কে জানা, সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে কোন বিশেষ সময়ে বিরাজমান শক্তির ভারসাম্যকে উপলব্ধি করা, বিরোধী জনগোষ্ঠী সমূহের প্রভাব প্রতিপত্তি পর্যবেক্ষণ করা, এমন শর্ত চিহ্নিত করা, যা কোন প্রতি পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে আলাপ আলোচনাকে প্রভাবশালী করা ইত্যাকার বহু অত্যাকশ্যকীয় শর্ত পূরণ করতে হয়। প্রকৃত পক্ষে রসূল সা. এই ক্ষেত্রে যে পর্যায়ের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, নেতাসুলভ দক্ষতা ও কূটনৈতিক যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, তার নজীর কোথাও পাওয়া যায়না। নজীর পাওয়া যায়না এ জন্য যে, রসূল সা. এত সুদূরপ্রসারী সম্পর্ক গড়ে তুলতে গিয়ে ইসলামী আদর্শের, নিজের নৈতিক মূলনীতির এবং নিজের রাজনৈতিক মর্যাদার এক বিন্দু পরিমাণও ক্ষতি হতে দেননি। নচেত কূটনৈতিক অংগনে যেমন মারাত্মকভাবে নৈতিকতার অপমৃত্যু ঘটানো হয়, তার কারণে ‘ডিপ্লোমেসী” শব্দটার দুর্নাম রটে গেছে। স্বয়ং রাজনীতি আজ একটা অবাঞ্ছিত ব্যাপারে পরিণত হয়ে গেছে। বলা হয়ে থাকে, রাজনীতির কোন চরিত্র নেই, এর কোন শেষ কথা নেই। রাজনীতি এমন এক ট্যাংক, যা যেদিকে চলে সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ পদদলিত করতে করতে চলে। কিন্তু রসূল সা. ডিপ্লোমেসি ও রাজনীতির অর্থ একেবারেই পাল্টে দিয়েছেন। এ কাজ দুটোকে শুধু নোংরামী থেকেই মুক্ত ও পবিত্র করেননি, বরং তাতে সততা ও এবাদতের প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করেছেন। ইসলামী নীতিমালা অনুসারে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো, তাতে অসাধারণ সাফল্য লাভ করা এবং এর মাধ্যমে বিক্ষিপ্ত গোত্রগুলোকে সংঘবদ্ধ করে নিজের চারপাশে সমবেত করা আজ পুস্তকাদিতে পড়ার সময় সহজ কাজ বলে মনে হয়। কিন্তু আরবের মরুভূমিতে বাস্তবে এসব কাজ যিনি করছিলেন, তিনিই জানতেন যে, তা কত কঠিন কাজ ছিল। 
চুক্তিভিত্তিক মৈত্রীর এই প্রক্রিয়ায় শুধু যে মুসলিম প্রচারকদের যাতায়াত, জনগণের সাথে অবাধ মেলামেশা এবং চুক্তিবদ্ধ গোত্রের লোকজনের মদিনার সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের অবারিত সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামের ব্যাপকতর প্রসারের পথ সুগম হয়েছিল তা নয়, বরং তা এদিক দিয়েও ইসলামী আন্দোলনের প্রভাব সম্প্রসারণে সহায়ক হয়েছিল যে, এর কারণে ইসলামী নেতৃত্বের কাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দুরদর্শিতা জনগণের আস্থা অর্জন করেছিল। সীমিত ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণার সৃষ্ট পূন্যবান মানুষদের প্রতি জনসাধারণ যতই ভক্ত ও অনুরক্ত হোক না কেন এবং তাদের পবিত্রতায় যতই আস্থাশীল হোক না কেন, সামষ্টিক জীবনের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের চাবিকাঠি কখনো তাদের হাতে অর্পণ করেনা। সামষ্টিক জীবনের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব চিরকাল সেই সব লোকের হাতেই অর্পিত হয়েছে, যাদের সম্পর্কে জনগণের ধারণা রয়েছে যে, তারা সামষ্টিক দায়িত্ব পালনে যোগ্যতা ও দক্ষতার অধিকারী। অনেক সময় এমনও হয়ে থাকে যে, জনগণ কোন দলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলে যে, তারা তো খুবই ভালো মানুষ, অনেক ভালো কাজ করে, জনসেবা করে ইত্যাদি। কিন্তু তাদের এই প্রশংসার মাধ্যমে তারা বুঝাতে চায় যে, দুনিয়ার কায়কারবারের জন্য ঐ ভালো মানুষেরা খুবই অযোগ্য। জনসাধারণের প্রশংসা শুনে এই শ্রেণীর লোকেরা প্রায়শ এরূপ ভ্রান্ত ধারণায় লিপ্ত হয় যে, আমাদের পক্ষে জনমত খুবই ভালো। তৎকালীন মুসলিম সংগঠন যদি এমন মানবীয় চরিত্র তৈরী করতো, যা ধর্মীয় দিক দিয়ে অত্যন্ত পুন্যবান ও পরহেজগার বটে, কিন্তু দুনিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাবলীতে কোন প্রকার যোগ্যতা প্রদর্শন করতে অক্ষম, তা হলে জনগণের প্রতিক্রিয়া এই হতো যে, ওরা ভালো মানুষ, ভালো ভালো কথা বলে এবং মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করে। কিন্তু তাদের দ্বারা নতুন কোন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনা ও সমাজের নেতৃত্ব দানে তারা সক্ষম হবে - এমন আশা কখনো জনগণ করতে পারতোনা। ইসলামী আন্দোলন এমন “আল্লাহ ওয়ালা” লোক তৈরী করার জন্য আসেনি, যারা ব্যক্তি হিসেবে শুধুই আল্লাহ ওয়ালা, ভালো মানুষ ও সরলমতি, কিন্তু সামষ্টিক জীবনে কর্তৃত্বশীল হবার মত রাজনৈতিক দক্ষতার অধিকারী নয়, যাদেরকে জনগণ বিকল্প ও উন্নততর নেতৃত্বের যোগ্যতাসম্পন্ন বলে গ্রহণ করেনা এবং যাদের দ্বারা কোন উজ্জ্বলতর ভবিষ্যত তৈরী হবে বলে আশা করতে পারেনা। ইসলামী আন্দোলনের সৃষ্টি করা মুসলিম নেতা ও কর্মীরা যতবেশী খোদাভক্ত ও খোদাভীরু ছিল, ততই রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দক্ষতার অধিকারীও ছিল। এ ব্যাপারে তারা নিজ নিজ কাজের মধ্যে দিয়েই নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিল। সমকালীন জনতা এভাবে পর্যায়ক্রমে রসূল সা. ও তাঁর নেতৃত্বে কর্মরত মুসলিম শক্তির নেতৃত্বসুলভ যোগ্যতা দ্বারা প্রভাবিত হতে থেকেছে, মদিনা তাদের আশার কেন্দ্রবিন্দু হতে থেকেছে এবং এর ফলে তাদের মনও ক্রমাগত ইসলামের জন্য উন্মুক্ত হতে থেকেছে। মোটকথা, দ্বীনের দাওয়াত ও রাজনৈতিক প্রভাবের সম্প্রসারণ- এই দুটো কাজ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এবং এতদোভয়ের সম্মিলিত প্রাণশক্তিই ইসলামী আন্দোলনকে গতিশীল করেছিল দুর্বার অগ্রযাত্রার দিকে। আসুন, এই মূল তত্ত্বকে মনে রেখে রসূল সা. এর প্রতিষ্ঠিত সুদূর প্রসারী চুক্তি ভিত্তিক সম্পর্কগুলোর পর্যালোচনা করি। এ সম্পর্কগুলো তিনি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে প্রতিষ্ঠিত করেন, যদিও তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল।
---------------------------------------
ফখরুল ইসলাম খাঁন।
ইসলামি চিন্তাবিদ  সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Post a Comment

0 Comments