Recent Tube

আহলে কিতাবদের ন্যায় আহলে হাদীসগণও মুতাশাবিহ্ আয়াতগুলোর পেছনে লেগে থাকে, যা ভ্রষ্টতা ছাড়া কিছুই নয়ঃ- মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।

  আল্লাহ তা'আলা বলেন,
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ ۖ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ ۗ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ ۗ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا ۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ.
তিনিই তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছেন, তার মধ্যে আছে মুহকাম আয়াতসমূহ। সেগুলো কিতাবের মূল, আর অন্যগুলো মুতাশাবিহ্। ফলে যাদের অন্তরে রয়েছে সত্যবিমুখ প্রবণতা, তারা ফিতনার উদ্দেশ্যে এবং ভুল ব্যাখ্যার অনুসন্ধানে মুতাশাবিহ্ আয়াতগুলোর পেছনে লেগে থাকে। অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে পরিপক্ক, তারা বলে, আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম, সবগুলো আমাদের রবের পক্ষ থেকে। আর বিবেক সম্পন্নরাই উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা আলি ইমরানঃ৩/৭)
.
এখানে আল্লাহ তা'আলা কুরআনের সুস্পষ্ট ও অস্পষ্ট আয়াতের কথা উল্লেখ করে একটি সাধারণ মুলনীতি ও নিয়মের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যার দ্বারা অনেক আপত্তি ও বাদানুবাদের অবসান ঘটে। এর ব্যাখ্যা এরূপ, কুরআনুল কারীমে দুই প্রকার আয়াত রয়েছে। এক প্রকারকে মুহকামাত তথা সুস্পষ্ট আয়াত এবং অপর প্রকারকে মুতাশাবিহাত তথা অস্পষ্ট আয়াত বলা হয়।
.
প্রথম প্রকার আয়াতকে আল্লাহ্ তা'আলা উম্মুল কিতাব' আখ্যা দিয়েছেন। এর অর্থ এই যে, এসব আয়াতই সমগ্র শিক্ষার মূল ভিত্তি। এসব আয়াতের অর্থ যাবতীয় অস্পষ্টতা ও জটিলতামুক্ত। দ্বিতীয় প্রকার আয়াতে বক্তার উদ্দেশ্য অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট হওয়ার কারণে এগুলো সম্পর্কে বিশুদ্ধ পন্থা হল, এসব আয়াতকে প্রথম প্রকার আয়াতের আলোকে দেখা। যে আয়াতের অর্থ প্রথম প্রকার আয়াতের বিপক্ষে যায়, তাকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে বক্তার এমন উদ্দেশ্য বুঝতে হবে, যা প্রথম প্রকার আয়াতের বিপক্ষে নয়। 
উদাহরণত সরূপ দেখুন-
হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে কুরআনের সুস্পষ্ট উক্তি এরূপ-
إِنْ هُوَ إِلَّا عَبْدٌ أَنْعَمْنَا عَلَيْهِ.
"সে আমার নেয়ামত প্রাপ্ত বান্দা ছাড়া অন্য কেউ নয়।" (সূরা আয-যুখরুফঃ৪৩/৫৯) 
অন্যত্র বলা হয়েছে-
إِنَّ مَثَلَ عِيسَىٰ عِنْدَ اللَّهِ كَمَثَلِ آدَمَ ۖ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ.
নিশ্চয় আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের মত, তিনি তাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাকে বললেন, ‘হও’, ফলে সে হয়ে গেল। (সূরা আলে-ইমরানঃ৩/৫৯)
.
এসব আয়াত এবং এ ধরনের অন্যান্য আয়াত থেকে পরিস্কার বুঝা যায় যে, ঈসা (আঃ) আল্লাহ্ তা'আলার মনোনীত বান্দা এবং তার সৃষ্ট। অতএব তিনি উপাস্য, তিনি আল্লাহর পুত্র- আহলে কিতাবের গুষ্ঠি নাসারাদের এসব দাবী সম্পূর্ণ বানোয়াট। তারা যদি كلمة الله 'আল্লাহর কালেমা' বা روح منه 'তাঁর পক্ষ থেকে রূহ' শব্দদ্বয় দ্বারা দলীল নেয়ার চেষ্টা করে তখন তাদের বলতে হবে যে, পূর্বে বর্ণিত আয়াতসমূহের আলোকেই এশব্দদ্বয়কে বুঝতে হবে। সে আলোকে উপরোক্ত كلمة الله ও روح منه শব্দদ্বয় সম্পর্কে এটাই বলতে হয় যে, ঈসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে সৃষ্ট হয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে পাঠানো একটি রূহ মাত্র। 
একই ভাবে আহলে হাদীসগণ যখন বাতিল ফিরকা মুজাসসীমাদের ন্যায় আল্লাহর হাত, পা, চোখ, মুখমন্ডল ইত্যাদি অঙ্গ প্রতঙ্গ সাব্যস্ত করে আল্লাহকে মানুষের সাথে তুলনা করে তখন বুঝতে হবে যে, তাদের দাবীও বানোয়াট। কেননা, কুরআন বলছে-
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ.
তাঁর মত কিছু নেই আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। (সূরা শুরাঃ৪২/১১)
সুতরাং যারা মানুষের মত আল্লাহর হাত, পা, চোখ, মুখমন্ডল ইত্যাদি অঙ্গ প্রতঙ্গসহ 'দেহ' সাব্যস্ত করে তাদের আকিদা ভ্রান্ত ও গোমড়া।
.
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وَلَا تَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ ۘ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ ۚ لَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ.
আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহকে ডেকো না, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তাঁর وجه (সত্ত্বা) ছাড়া সব কিছুই ধ্বংসশীল। শাসন কর্তৃত্ব একমাত্র তাঁরই এবং তাঁরই দিকে তোমাদের সবাইকে ফিরে যেতে হবে। (সূরা কাসাসঃ২৮/৮৮)
.
আয়াতে উল্লিখিত وجه শব্দের শাব্দিক অর্থ চেহারা বা মুখমন্ডল। আহলে হাদীস তথা নব্য সালাফিগণ এ আয়াত দ্বারা দাবী করে আল্লাহর হাত, পা ইত্যাদি অঙ্গ প্রতঙ্গের মত আল্লাহর চেহারা বা মুখমন্ডলও আছে। (নাউযূবিল্লাহ)
তাদের এ আকিদা নিঃসন্দেহে কুফুরী। কেননা, তাদের মতবাদ মেনে নিলে, এটাও মানতে হবে যে, আল্লাহর চেহারা বা মুখমন্ডল ছাড়া আল্লাহর হাত, পা সহ সারা অঙ্গ ধ্বংস হবে। (নাউযুবিল্লাহ) আর এটা কোন মুসলিমের আকিদা হতে পারে না। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত وَجْهَهُ এর শাব্দিক অর্থ মুখমন্ডল গ্রহণ করেননি বরং এর অর্থ করেছেন আল্লাহর সত্ত্বা। অর্থাৎ আল্লাহর সত্ত্বা তথা স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই ধ্বংসশীল।
.
ইমাম বুখারী এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন,إِلَّا مُلْكَهُ তাঁর রাজত্ব তথা শাসন কর্তৃত্ব ব্যতীত সবই ধ্বংস হবে। (দেখুন- সহীহ বুখারী, কিতাবুত তাফসীরের ৪৭৭২ নাম্বার হাদীসের আলোচনা) অর্থাৎ স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা যেমন ধ্বংসশীল নয় তেমনি তাঁর শাসন কর্তৃত্বও ধ্বংসশীল নয়।
আফসোসের বিষয় হলো ইমাম বুখারীর তাফসীর আহলে হাদীসের ভ্রান্ত আকিদার বিরোধী হওয়ায় তারা এ ক্ষেত্রে ইমাম বুখারীরও বিরোধীতা করেছেন।
.
কুরআন মাজীদে বর্ণিত হয়েছে-
تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.
বরকতময় তিনি যার হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব। আর তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান। (সূরা মুলকঃ৬৭/০১)
.
এ আয়াত দিয়ে আহলে হাদীসগণ প্রমাণ দেন, দৈহিক অঙ্গ হিসাবে আল্লাহর হাত আছে। (নাউযুবিল্লাহ) অথচ এর বিশুদ্ধ তাফসীর হলো- 
মহান আল্লাহ তা'আলা গোটা বিশ্ব জাহানের ওপর রাজকীয় ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর হাতে ক্ষমতা থাকার অর্থ এটা নয় যে, দৈহিক অঙ্গ হিসেবে তাঁর কোন হাত আছে। বরং বাকরীতি অনুসারে শব্দটি অধিকার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষার মত আমাদের ভাষাতেও যখন বলি যে, সব ক্ষমতা অমুকের হাতে তখন তার অর্থ হয় সে-ই সব ক্ষমতার মালিক, অন্য কারো সেখানে কোন কর্তৃত্ব নেই। (তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন)
.
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وَالْمَلَكُ عَلَىٰ أَرْجَائِهَا ۚ وَيَحْمِلُ عَرْشَ رَبِّكَ فَوْقَهُمْ يَوْمَئِذٍ ثَمَانِيَةٌ.
ফেরেশতাগণ আসমানের বিভিন্ন প্রান্তে থাকবে। সেদিন তোমার রবের আরশ আটজন ফেরেশতা তাদের উর্ধ্বে বহন করবে। (সূরা হাক্কাহঃ৬৯/১৭)

এ আয়াত দ্বারা আহলে হাদীসগণ আল্লাহকে মানুষের মত সাব্যস্ত করে। তাদের ধারণা মানুষ যেমন পালকিতে বসে থাকে আর বেয়ারারা সেই পালকি বহন করে, আল্লাহও তেমনি আরশে বসে থাকবেন আর ফেরেশতারা সেই আরশ বহন করে নিয়ে যাবেন! (নাউযুবিল্লাহ)। 
.
আল্লামা মওদুদী রাহঃ এ আয়াতের তাফসীরে বলেন,
"আয়াতটি মুতাশাবেহাত আয়াত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এর নির্দিষ্ট কোন অর্থ বলা কঠিন। আরশ কি বস্তু আমরা জানি না। কিয়ামতের দিন আটজন ফেরেশতার আরশ বহন করার ধরন কি হবে তাও আমরা বুঝি না। তবে কোন অবস্থায়ই এ ধারণা করা যাবে না যে, আল্লাহ‌ তা’আলা আরশের ওপর উপবিষ্ট থাকবেন আর আটজন ফেরেশতা তাকে সহ আরশ বহন করবে। সেই সময় আল্লাহ‌ আরশের ওপর উপবিষ্ট থাকবেন, এমন কথা আয়াতেও বলা হয়নি। মহান আল্লাহ‌ দেহসত্তাহীন এবং দিক ও স্থানের গণ্ডি থেকে মুক্ত। এমন এক সত্তা কোন স্থানে অধিষ্ঠিত থাকবেন আর কোন মাখলুক তাকে বহন করবে এটা ভাবা যায় না। আল্লাহর মহান সত্তা সম্পর্কে কুরআন মজীদের দেয়া ধারণা আমাদেরকে এরূপ কল্পনা করতে বাধা দেয়। এ জন্য খুঁজে খুঁজে এর অর্থ বের করার প্রচেষ্টা চালানো নিজেকে গোমরাহী ও বিভ্রান্তির গহবরে নিক্ষেপ করার শামিল। তবে এ বিষয়টি বুঝা দরকার যে, আল্লাহ‌ তাআলার শাসন ও শাসন কর্তৃত্ব এবং তাঁর যাবতীয় বিষয়ের একটা ধারণা দেয়ার জন্য কুরআন মজীদে আমাদের জন্য এমন একটি চিত্র পেশ করা হয়েছে যা দুনিয়ার কোন বাদশার বাদশাহীর চিত্রের অনুরূপ। মানুষের ভাষায় রাষ্ট্র ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির জন্য যে পরিভাষা ব্যবহার করা হয় এ জন্য অনুরূপ পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ, মানুষের বুদ্ধি-বিবেক এরূপ চিত্র এবং পরিভাষার সাহায্যই গোটা বিশ্ব-সাম্রাজ্যের বিভিন্ন বিষয় কিছুটা উপলব্ধি করতে সক্ষম। বিশ্ব-জাহানের ইলাহী ব্যবস্থাপনাকে মানুষের বোধগম্যতার সীমায় নিয়ে আসাই এ ধরনের বর্ণনাভঙ্গি গ্রহণের উদ্দেশ্য। তাই এর আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করা ঠিক নয়।" (তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন)
.
সহীহ হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা আলি ইমরানের ৭ নং আয়াত তিলাওয়াত করে বললেন,
فَإِذَا رَأَيْتِ الَّذِيْنَ يَتَّبِعُوْنَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ فَأُوْلَئِكِ الَّذِيْنَ سَمَّى اللهُ فَاحْذَرُوْهُمْ.
“যখন তোমরা তাদেরকে দেখবে যারা এ সমস্ত (মুতাশাবিহ) আয়াতের পিছনে দৌড়াচ্ছে, তখন বুঝে নিবে যে, আল্লাহ এ সমস্ত লোকের কথাই পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তখন তাদের থেকে সাবধান থাকবে।" (সহীহ বুখারী হাঃ ৪৫৪৭; সহীহ মুসলিম হাঃ ২৬৬৫; মুসনাদে আহমদ হাঃ ২৬২৫৭)
আল্লাহ তা'আলা আমাদের কে তাদের ফিতনা থেেক সাবধান থাকার তওফীক দান করুক। (আমীন!)
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলান।          

Post a Comment

0 Comments