Recent Tube

ইবাদত ‎(ﺍﻟﻌﺒﺎﺩﺓ) ‏এর মর্মার্থ ‎: ‏‏মুহাম্মদ ‎তানজিল ‎ইসলাম ‎।

        ইবাদাত শব্দের শব্দমূল বা ধাতু হচ্ছে ﻋﺒﺪ । এ শব্দটি আরবী ভাষায় ‘স্বাধীন’ শব্দের বিপরীত শব্দ হিসেবে ‘দাস’ বা ‘ক্রীতদাস’ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। এ অর্থের দিক দিয়ে ‘ইবাদাত’ শব্দের মধ্যে দু’টি অর্থ সৃষ্টি হয়েছে। 
১. একটি অর্থ হচ্ছে পূজা-অর্চনা। আরবী ভাষার বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ আছে ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ অর্থাৎ ﺍﻟﺘﻨﺴﻚ , ﻭﺍﻟﺘﻌﺒﺪ , ﺗﺄﻟﻪ ﻟﻪ । 
২. আরেকটি অর্থ হচ্ছে সবিনয় আনুগত্য এবং সন্তুষ্টি ও সাগ্রহ বিধি-বিধান ও আইন-কানুন পালন। যেমন “লিসানুল আরবে” বলা হয়েছেঃ 
ﺍﻟﻄﺎﻋﺔ – ﺍﻟﻌﺒﺎﺩﺓ 
ﻭﻣﻌﻨﻰ ﺍﻟﻌﺒﺎﺩﺓِ ﻓﻲ ﺍﻟﻠﻐﺔ ﺍﻟﻄﺎﻋﺔُ ﻣﻊ ﺍﻟﺨُﻀُﻮﻉِ - ﻭﻛﻞُّ ﻣﻦ ﺩﺍﻥَ ﻟﻤﻠﻚ ﻓﻬﻮ ﻋﺎﺑﺪ ﻟﻪ ‏( ﻭﻗﻮﻣﻬﻤﺎ ﻟﻨﺎ ﻋﺎﺑﺪﻭﻥ ‏) ﻭﺍﻟﻌﺎﺑﺪ , ﺍﻟﺨﺎﺿﻊ ﻟﺮﺑﻪ ﺍﻟﻤﺴﺘﺴﻠﻢ ﺍﻟﻤُﻨْﻘﺎﺩ ﻷَﻣﺮﻩ - ﻋﺒﺪَ ﺍﻟﻄﺎﻏﻮﺕَ , ﺃَﻃﺎﻋﻪ ﻳﻌﻨﻲ ﺍﻟﺸﻴﻄﺎﻥَ ﻓﻴﻤﺎ ﺳَﻮّﻝَ ﻟﻪ ﻭﺃَﻏﻮﺍﻩ - ﺇِﻳﺎﻙ ﻧﻌﺒﺪ , ﺃَﻱ ﻧُﻄِﻴﻊُ ﺍﻟﻄﺎﻋﺔَ ﺍﻟﺘﻲ ﻳُﺨْﻀَﻊُ ﻣﻌﻬﺎ - ﺍﻋﺒﺪﻭﺍ ﺭﺑﻜﻢ , ﺃَﻃﻴﻌﻮﺍ ﺭﺑﻜﻢ - 
সুতরাং অভিধানের এসব নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা অনুসারে আল্লাহর ইবাদাত করা অর্থ শুধু তাঁর পূজা-অর্চনার দাবী করাই নয়, বরং বিনা বাক্যে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন, তাঁর শরয়ী আইন-কানুন সন্তুষ্ট চিত্তে সাগ্রহে মেনে চলা এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মনে প্রাণে অনুসরণ করার দাবীও বুঝায়। 
(তাফহীমুল কুরআন, সূরা যুমারঃ৩৯/২ এর তাফসীর দ্রঃ) 
.
      হযরত মূসা (আ) ও হারুন (আ) কে আল্লাহ তা'য়ালা ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের নিটক দাওয়াত দেওয়ার জন্য পাঠালে- 
ﻓَﻘَﺎﻟُﻮٓﺍ۟ ﺃَﻧُﺆْﻣِﻦُ ﻟِﺒَﺸَﺮَﻳْﻦِ ﻣِﺜْﻠِﻨَﺎ ﻭَﻗَﻮْﻣُﻬُﻤَﺎ ﻟَﻨَﺎ ﻋَٰﺒِﺪُﻭﻥَ 
তারা বলল, ‘আমরা কি আমাদেরই মত দু’জন লোকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব? অথচ তাদের সম্প্রদায় আমাদের ইবাদতকারী (দাসত্বকারী)। 
(সূরা মু'মিনীনঃ২৩/৪৭) 
এখান ﻋَٰﺒِﺪُﻭﻥَ বলতে পূঁজা বা উপাসনাকে বুঝানো হয়নি বরং আনুগত্য করাকে বুঝানো হয়েছে। কেননা, মূসা (আ) এর সম্প্রদায়ের লোকজন ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের ফুল-জল দিয়ে পূঁজা-উপাসনা করত না বরং তারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আনুগত্য করতো, আইন পালন করত, যে আনুগত্য ইবাদতে পরিণত হয়েছিল। যার কারণে আল্লাহ ﻋَٰﺒِﺪُﻭﻥَ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। 
মুবাররাদ বলেন, ‘আবেদ’ বলে অনুগত ও মান্যকারী বোঝানো হয়ে থাকে। আবু উবাইদা বলেন, যারাই কোন কর্তৃত্বের অধীনতা গ্ৰহণ করে আরবরা তাদেরকে তার ‘আবেদ’ বা ইবাদতকারী বলে। (ফাতহুল কাদীর) অর্থাৎ ফিরআউন ও তাঁর পরিষদবর্গ বলল, আমরা কি করে আমাদের মত দুজন মানুষের প্রতি ঈমান এনে আল্লাহর ইবাদত করি অথচ তাদের কাওম আমাদের ইবাদতকারী। 
এ থেকে “ইবাদাত” শব্দটির অর্থের ওপর এবং একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করার ও তাঁর ছাড়া বাকি সবার ইবাদাত পরিত্যাগ করার যে আদেশ নবীগণ তাদের দাওয়াতের মধ্যে দিতেন তার পূর্ণ অর্থ কি ছিল তার ওপর বড়ই গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত হয়। তাঁদের কাছে “ইবাদাত” নিছুক “পূজা অনুষ্ঠান” ছিল না। তাঁরা এ দাওয়াত দিতেন না যে, তোমরা আল্লাহর উপাসনা করো এবং গাইরুল্লাহর আনুগত্য করতে থাকো, আইন পালন করতে থাকো। বরং তাঁরা মানুষকে আল্লাহর পূজারী করতে চাইতেন এবং একই সঙ্গে তাঁর বিধানও মেনে চলতে বলতেন। আর এ উভয় অর্থের দৃষ্টিতে অন্য কারো ইবাদাত করাকে পথভ্রষ্টতা গণ্য করতেন। (তাফহীমুল কুরআন) 
.
    কোন বাছ-বিচার না করে, নিঃশর্তে এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আনুগত্য- এটি একটি ইবাদত। আর এই আনুগত্য একমাত্র মহান আল্লাহরই নিমিত্ত। অন্য কাউকে এরূপ আনুগত্য করলে শিরক বলে গণ্য হবে। মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ 
ﻭَﻟَﺎ ﺗَﺄْﻛُﻠُﻮﺍ۟ ﻣِﻤَّﺎ ﻟَﻢْ ﻳُﺬْﻛَﺮِ ﭐﺳْﻢُ ﭐﻟﻠَّﻪِ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺇِﻧَّﻪُۥ ﻟَﻔِﺴْﻖٌۗ ﻭَﺇِﻥَّ ﭐﻟﺸَّﻴَٰﻄِﻴﻦَ ﻟَﻴُﻮﺣُﻮﻥَ ﺇِﻟَﻰٰٓ ﺃَﻭْﻟِﻴَﺎٓﺋِﻬِﻢ ْ ﻟِﻴُﺠَٰﺪِﻟُﻮﻛُﻢ ْۖ ﻭَﺇِﻥْ ﺃَﻃَﻌْﺘُﻤُﻮﻫُﻢْ ﺇِﻧَّﻜُﻢْ ﻟَﻤُﺸْﺮِﻛُﻮﻥَ 
যাতে (যবহ করার সময়) আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি তা তোমরা মোটেই খাবে না, তা হচ্ছে পাপাচার, শয়তান তার বন্ধুদেরকে তোমাদের সঙ্গে বিবাদ করার জন্য প্ররোচিত করে; যদি তোমরা তাদের কথা মান্য করে চল তাহলে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হয়ে যাবে। (সূরা আনআমঃ৬/১২১) 
এখানে কাফেরদের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আনুগত্য করাকে তথা আইন পালন করাকে শিরক বলা হয়েছে। 
.
আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ 
ﺃَﻟَﻢْ ﺃَﻋْﻬَﺪْ ﺇِﻟَﻴْﻜُﻢْ ﻳَﺎ ﺑَﻨِﻲ ﺁﺩَﻡَ ﺃَﻥْ ﻟَﺎ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭﺍ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥَ ۖ ﺇِﻧَّﻪُ ﻟَﻜُﻢْ ﻋَﺪُﻭٌّ ﻣُﺒِﻴﻦ ﻭَﺃَﻥِ ﺍﻋْﺒُﺪُﻭﻧِﻲ ۚ ﻫَٰﺬَﺍ ﺻِﺮَﺍﻁٌ ﻣُﺴْﺘَﻘِﻴﻢٌ 
হে বনী আদম, আমি কি তোমাদেরকে এ মর্মে নির্দেশ দেইনি যে, ‘তোমরা শয়তানের ইবাদত করো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’? আর আমারই ইবাদাত কর। এটিই সরল পথ। (সূরা ইয়াসীনঃ৬০-৬১) 
.
      এখানে আল্লাহ “ইবাদত” কে আনুগত্য অর্থে ব্যবহার করেছেন। প্রত্যেক কাজে ও প্রত্যেক অবস্থায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কারও আনুগত্য করার নামই ইবাদত। শয়তানকে নিছক সিজদা করাই নিষিদ্ধ নয় বরং তার আনুগত্য করা এবং তার হুকুম মেনে চলাও নিষিদ্ধ। কাজেই আনুগত্য হচ্ছে ইবাদাত। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি কিংবা অসন্তুষ্টির তোয়াক্কা না করে অর্থের মহব্বতে এমনসব কাজ করে, যাদ্বারা অর্থ বৃদ্ধি পায় এবং স্ত্রীর মহব্বতে এমনসব কাজ করে যাদ্বারা স্ত্রী সন্তুষ্ট হয়, হাদীসে তাদেরকে অর্থের দাস ও স্ত্রীর দাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (দেখুন: সহীহ বুখারী হাঃ ২৮৮৬, জামে তিরমিয়ী হাঃ ২৩৭৫) 
.
     অত্র আয়াত দুটির তাফসীরে বিংশশতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুফাচ্ছির আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ 
এখানে আবার আল্লাহ “ইবাদাত”কে আনুগত্য অর্থে ব্যবহার করেছেন। ইতিপূর্বে তাফহীমুল কুরআনে আমি বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছি। (দেখুন আল বাকারাহ, ১৭০; আন নিসা, ১৪৫; আল আনআম, ৮৭ ও ১০৭; আত তাওবা, ৩১ ; ইবরাহীম ৩২ ; আল কাহফ, ৫০; মারয়াম, ২৭; আল কাসাস, ৮৬ এবং সাবা, ৬৩ টীকা) এ প্রসঙ্গে এ আয়াতটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম রাযী তাঁর তাফসীরে কবীরে যে চমৎকার আলোচনা করেছেন তাও প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন,- ﻟَﺎ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭﺍ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥ -মানে হচ্ছে ﻻﺗﻄﻌﻴﻮﻩ (তার আনুগত্য করো না)। এর সপক্ষে যুক্তি হচ্ছে, তাকে নিছক সিজদা করাই নিষিদ্ধ নয় বরং তার আনুগত্য করা এবং তার হুকুম মেনে চলাও নিষিদ্ধ। কাজেই আনুগত্য হচ্ছে ইবাদত। এরপর ইমাম সাহেব এ প্রশ্ন করেছেন যদি ইবাদতের অর্থ হয় আনুগত্য তাহলে, ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁﻣَﻨُﻮﺍ ﺃَﻃِﻴﻌُﻮﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﺃَﻃِﻴﻌُﻮﺍ ﺍﻟﺮَّﺳُﻮﻝَ ﻭَﺃُﻭﻟِﻲ ﺍﻟْﺄَﻣْﺮِ ﻣِﻨْﻜُﻢْ (নিসাঃ৪/৫৯) আয়াতে আমাদের কি রসূল (সা) কর্তৃত্বশীলদের ইবাদাত করার হুকুম দেয়া হয়েছে? তারপর এ প্রশ্নের জবাব তিনি এভাবে দিয়েছেনঃ “তাঁদের আনুগত্য যখন আল্লাহর হুকুমে করা হয় তখন তা আল্লাহরই ইবাদাত এবং তাঁরই আনুগত্য হবে। দেখছেন না, ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুমে আদমকে সিজদা করলো এবং এটি আল্লাহর ছাড়া আর কারো ইবাদাত ছিল না। কর্তৃত্বশীলদের আনুগত্য একমাত্র তখনই তাদের ইবাদাত হতে পারে যখন এমন ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করা হবে যে ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করার হুকুম আল্লাহ দেননি।” তারপর বলেন, “তোমার সামনে যদি কোন লোক আসে এবং তোমাকে কোন জিনিসের হুকুম দেয় তাহলে দেখো তার এ হুকুম আল্লাহর হুকুমের অনুসারী কিনা। অনুসারী না হলে শয়তান সে লোকদের সহযোগী হয়েছে। যদি এ অবস্থায় তুমি তার আনুগত্য করো তাহলে তুমি তার ও তার শয়তানের ইবাদাত করলে। অনুরূপভাবে তোমার নিজের প্রবৃত্তি যদি তোমাকে কোন কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে তাহলে এক্ষেত্রে শরীয়াতের দৃষ্টিতে সে কাজটি করার অনুমতি আছে কিনা দেখো। অনুমতি না থাকলে তোমার প্রবৃত্তি নিজেই শয়তান হয়ে গেছে অথবা শয়তান তার সহযোগী হয়েছে এ অবস্থায় যদি তুমি তার আনুগত্য করো তাহলে তুমি তার ইবাদাত করলে।” সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে তিনি আবার বলছেন, “কিন্তু শয়তানের ইবাদাত করার বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। কখনো এমন হয়, মানুষ একটি কাজ করে এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সাথে তার কণ্ঠও তার সহযোগী হয় এবং মনও তার সাথে অংশ গ্রহণ করে। আবার কখনো এমনও হয়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে মানুষ একটি কাজ করে কিন্তু অন্তর ও কণ্ঠ সে কাজে তার সহযোগী হয় না। কেউ কেউ এমন অবস্থায় একটি গোনাহ করে, যখন তার অন্তর তাতে সায় দেয় না এবং তার কণ্ঠ সেজন্য আল্লাহর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয়, এ অবস্থায় সে স্বীকার করে আমি এ খারাপ কাজ করেছি। এ হচ্ছে নিছক বাইরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে শয়তানের ইবাদাত। আবার এমন কিছু লোকও আছে যারা ঠাণ্ডা মাথায় অপরাধ করে এবং মুখেও নিজেদের এ কাজে আনন্দ ও সন্তোষ প্রকাশ করে। …এরা ভিতরে বাইরে উভয় পর্যায়ে শয়তানের ইবাদাতকারী।”(তাফসীরে কবীর, ৭ খণ্ড, ১০৩-১০৪ পৃষ্ঠা; তাফহীমুল কুরআন, ১৩/২৯-৩০)।
-------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ, লেখক ও মাওলান।     

Post a Comment

0 Comments