Recent Tube

সেদিনটাও ছিল সোমবার: জিয়াউল হক।

               

                            সেদিনটাও ছিল সোমবার;

  

    ফলে ৫৭১ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারির তৃতিয় সপ্তাহে মক্কার আকাশে আবাবিল পাখির অস্বাভাবিক আনাগোনা পুরো মক্কাবাসীকে সতর্ক করে দিয়েছে! বহর যতো বড় হবে মাথার উপরে পাখিদের সংখ্যাও ততো বড় হবে। এটাই মরুভূমিতে স্বাভাবিক। কারণ ঐ বহরে পশুদের পিঠে খাদ্যশষ্যের বস্তা, রসদ সম্ভার, যাত্রাবিরতির সময় মানুষের খাবারের উচ্ছিষ্ঠ এবং পশুদের খাদ্য ও পায়খানার মধ্যেও পাখীদের জন্য উচ্ছিষ্ঠ, খাদ্য হিসেবে এসবই তাদের লক্ষ্যবস্তু।


  মক্কার লোকজন আকাশে অগণিত পাখির আনাগোণা দেখেই বুঝতে পারলো যে, বিরাট এক বহর আসছে। বহরটা তাদের কোন বাণিজ্য বহর ছিল না, কারণ, তাদের কোন ব্যবসায়ীর বহর এ সময় আসার কথা থাকলে তারা তা অবশ্যই জানতো। 

লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ইয়েমেন থেকে আবরাহার সামরিক বাহিনী এগিয়ে আসছে কাবা ধ্বংস করতে। ইয়েমেনে বাদশাহর মোকাবেলা করার মত সাহস ও উপায়-উপকরণ তাদের ছিল না। তা ছাড়া বাহিনীটাও আচমকাই এসে উপস্থিত হয়েছে, ফলে মক্কার আরবরা পূর্ব প্রস্তুতি নেবার কোনো সুযোগই পায় নি। 

তারা গোত্র নেতা আব্দুল মুত্তালিবকে পাঠালো আবরাহার সাথে আলাপ করতে। আবরাহা আব্দুল মুত্তালিবের সকল কথা শুনলো বটে, তার সৈন্যগণ কর্তৃক ধরে নিয়ে আসা আব্দুল মুত্তালিবের উটগুলোও ফেলত দিল কিন্তু কাবা ধ্বংসের পরিকল্পনা ত্যাগ করলো না। অতএব, নিরুপায় মক্কাবাসী নিজেদের পরিবার পরিজন ও যেটুকু সম্পদ হাতে নেয়া যায় সেটুকু নিয়েই আশে পাশের পাহাড়ের উপরে গুহার ভেতরে আশ্রয় নিল। 

এবড়ো থেবড়ো উঁচু উঁচু পাহাড়ের মধ্য দিয়ে সংকীর্ণ পথে চাপাচাপি করে চলার সময় কী অদ্ভূত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল কল্পনা করুন। প্রচন্ড গরম, ষাট হাজার সৈন্য, সে সাথে তের হাজার ঘোঁড়া ও উট এবং তেরোটা হাতির সম্মিলিত পদচারণায় হৈ চৈ পরিস্থিতি! মাথার উপরে হাজার হাজার পাখি কালো মেঘের মতো ছেয়ে আছে, তারাও বৃষ্টির মতো করে পাথর বর্ষণ করছে! 

পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া মক্কাবাসীরাও পাথর ছুঁড়ে মারছে, বড় বড় পাথর গড়িয়ে দিচ্ছে বাহিনীর দিকে। সেগুলো এসে আঘাত করলে ঘোড়া, উটগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। উট যেমন হাতির নিকট অপরিচিত প্রাণী, তেমনি, হাতির নিকটও উট অপরিচিত। ভিন্ন ও ভয়ানক প্রতিকূল, শুষ্ক ও আদ্রতাবিহীন পরিবেশে উট, ঘোড়া অভ্যস্ত হলেও হাতিগুলোর জন্য তা ছিল অসম্ভব বৈরি। 

প্রকান্ড শরীরের হাতি যখন পাগল উন্মত্ত হয়ে উঠে তখন সে কী বিভৎস আচরণ করে, তা যারা উন্মত্ত হাতি দেখেছেন, তারা জানেন। শ্রীলংকা ও দক্ষিণ ভারতের রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে প্রায়ই হাতির এরকম তান্ডব দেখা যায়।

চারিদিকে রণবাদ্য, ঘোড়া ও উটের ডাক, উপর হতে ধেয়ে আসা পাথর! এরকম পরিবেশে একটা মাত্র হাতি যদি উন্মত্ত আচরণ শুরু করে তবে তার সেই উন্মত্ততা অনিবার্যভাবে ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য হাতিগুলোর মধ্যেও। আর হাতির উন্মত্ততার সামনে পড়ে উটগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। উন্মত্ত হাতি আর উটগুলোর অনিয়ন্ত্রিত দাপাদাপির কারণে ঘোড়াগুলোও তার মালিকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। 

পাহাড়ের চিপা গলিতে তেরো হাজার তেরটি  জন্তুর লাফালাফিতে ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর অনিদ্রায় ক্লান্ত আবরাহার সৈন্যরা হাতি, ঘোড়া আর উটের পায়ের নিচে পিষ্ঠ হয়েছে! দিনটি ছিল সোমবার, ৫৭১ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, প্রিয় রাসুল সা: এর জন্মের ৫৫ দিন আগেকার ঘটনা। ফলাফলটা স্বয়ং আল্লাহপাকই আল কুরআনে বর্ণনা করেছেন। 

আবরাহা নিজে’সহ হাতে গোণা মাত্র কিছু সৈন্য শেষ পর্যন্ত প্রাণ নিয়ে পালিয়ে ইয়েমেনে ফেরত যেতে পেরেছিল। ইয়েমেনের ইতিহাসে এত বড় বিপর্যয় এর আগে কিংবা পরে আর কখনও আসেনি। তৎকালীন ইয়েমেনি সমাজের কর্মক্ষম প্রায় ষাট হাজার সৈন্য, তারা প্রত্যেকেই ছিল কারো বাবা, কারো ভাই, কারো সন্তান, স্বামী-বন্ধু বা আত্মীয়। 

সমাজের কর্মক্ষম ব্যক্তি, পরিবারের একমাত্র বা প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের এভাবে মৃত্যু ঐ সমাজের সামগ্রিক পরিবেশ ও স্থিতিশীলতার উপরে কিরকম প্রভাব ফেলেছিল? সেটা উপলব্ধী করা কি কঠিন কোন কাজ? ইয়েমেনের প্রতিটি ঘরেই শোকের মাতম উঠেছিল! তারা কোন ভাষায় এই বিপর্যয়কে চিত্রিত করেছে? কাকে বা কার উপর এই বিপর্যয়ের দায়ভার চাপিয়েছে? 

আবরাহা নিজে ইয়েমেনে ফিরে তার এই ব্যর্থ অভিযানের দায়ভার কার উপরে চাপাতে চেয়েছে? কি ব্যাখা দিয়েছে সে তার সভাসদকে? সমকালীন ইয়েমেনি লেখক, গবেষক ও ঐতিহাসিকরা এ ঘটনাকে কিভাবে চিত্রিত করেছে? 

সুরা ফিল পড়ার সময় যদি এইসব প্রশ্নের উত্তর ইয়েমেনি সুত্র থেকে জানার চেষ্টা করি, তা হলে এই সুরার পটভূমি, এর শিক্ষা ও তাৎপর্য ক্রিষ্টাল ক্লিয়ার হয়ে আমাদের সামনে ধরা দেয়। কিন্তু আমরা সে দিকে যাই না। ফলে সুরার প্রকৃত শিক্ষাটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অধরা রয়ে যায় আমাদের কাছে। (সংক্ষেপকৃত)
--------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ, গ্রন্থপ্রনেতা, গীতিকার, ও বিশ্লেষক।          

Post a Comment

0 Comments