Recent Tube

মাছির চোখ ও বই পড়া। জিয়াউল হক।

   
              মাছির চোখ ও বই পড়া।

      মাছির চোখ বলে কথা! মাছি উপরে, নিচে, ডানে, বামে, একই সাথে সবদিকে সে দেখতে পায়। তার চোখ সৃষ্টির এক অপার বিস্ময়! মাছির চোখ হলো Compound Eye 'কম্পাউন্ড আই'। একটি মাছির কয়টি চোখ থাকে? বা কয় জোড়া? আমরা অনেকেই হয়তো কল্পনাও করতে পারি না যে, একটি মাছির প্রায় চার হাজার চোখ থাকে, বা তার চোখের চার হাজার স্বতন্ত্র অংশ রয়েছে, এগুলো এক একটিকে বলা হয় Ommatidia। এর প্রতিটিই একটি করে স্বতন্ত্র চোখ।

      দৃশ্যমান বস্তু দেখার পরে তার প্রতি সাড়া দেবার একটা প্রবণতা প্রতিটি প্রাণীরই থাকে। আমরা মানুষও তাই করি। মানুষের চোখের চেয়ে মাছির চোখ পাঁচগুণ বেশি দ্রুত মুভ করতে পারে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের প্রাণীকুলের মধ্যে মাছিই সবচেয়ে দ্রুত তার দৃষ্টিগোচর হওয়া বস্তুর প্রতি সাড়া দেয় (Fastest Visual response)।

    এ কারণেই মাছিকে ধরা মুশকিল। আপনি তাকে ধরতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আপনার শরীরের প্রতিটি মুভমেন্ট মাছি দেখতে পাচ্ছে, সময়মত সাবধান হচ্ছে এবং উড়াল দিচ্ছে। তার পরেও কিন্তু মাছিকে ধরা সম্ভব। মাছি পরাস্থ হয় গতির কাছে। সে টের পেয়ে উড়াল দিচ্ছে, তা সত্তেও আপনি যদি তার গতির চেয়ে বেশি গতিতে হাত চালিয়ে তাকে ধরতে চান, তা হলে পারবেন। মাছি নিয়ে কড়চা আপাতত এখানে থাকুক। আসুন, আমরা ভিন্ন একটা বিষয়ে দু'কথা বলি।

     কোন একজন পশ্চিমা পন্ডিত খুব মূল্যবান কথা বলেছিলেন একবার, বই পড়া নিয়ে। তিনি এক একটি বইকে এক একটি চোখের সাথে তুলনা করে বলেছিলেন; আপনি যদি একটা বই পড়েন তার মানে হলো আপনি নতুন একটা চোখ সংযোজন করে নিচ্ছেন নিজের জন্য। আপনার দৃষ্টিভংগী ও দৃষ্টিশক্তি প্রখর হবে, তীক্ষ্ন হবে। আপনি অনেক দূর দেখতে পাবেন, অনেক কিছু দেখতে পাবেন।

   'অনেক কিছু' আর 'অনেক দূর' দুটো আপেক্ষিক বাক্য, অতি গভীর অর্থবোধক বাক্য। এর অর্থ ও ভাব পুরোটা উপলব্ধী করা দরকার।

   'অনেক কিছু' বলতে আমরা বলতে চাচ্ছি, আপনি আপনার সামনে ঘটমান ঘটনাসমূহ যা আর দশজন দেখছেন, যেভাবে দেখছেন, তা'র চেয়েও বেশি কিছু দেখতে পাবেন, যেভাবে ঘটছে, তার বাইরেও ঐ একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা দেখতে পাবেন। এর রেশ, পরিণতি ও ভবিষ্যৎটাও দেখতে পাবেন। আপনার ইতিহাস জ্ঞান, দর্শনের জ্ঞান, সমাজ নিয়ে চেতনাবোধ আপনাকে প্রতিটি ঘটনার দৃশমান রুপের বাইরেও বা তার আড়ালে রয়ে যাওয়া ঘটনা ও তার রেশ বা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখতে বা উপলব্ধী করতে সাহায্য করবে। সেরকম সক্ষমতা ও শক্তি আপনাকে জোগান দেবে।

     ঠিক একইভাবে 'অনেক দূর' বলতে আমরা প্রকৃত অর্থে ফুট, গজ বা মাইলের দুরত্ব বুঝাচ্ছি না, বরং ভবিষ্যত কাল বা সময়ের দূরত্ব বোঝাচ্ছি। নিকট অতিতের ইতিহাস থেকে একটা উদাহারণ দেই।

      একদল ইউরোপীয় ইহুদি ১৯০৭ সালে প্রথমবারের মত জেরুজালেম সফর এবং সেখানে Palestine Land Development Company নামে একটি ব্যবসায়িক কোম্পানী প্রতিষ্ঠ করে। এই কোম্পানীটি ইংল্যন্ড, আমেরিকা, জেনেভা, সুইজারল্যন্ড সহ বিশ্বের অনেক দেশেই ধনাঢ্য ইহুদিদের দেয়া অর্থে বাজার দরের চেয়ে অনেক উচ্চমুল্য দিয়ে প্যালেস্টাইনে গরীব ফিলিস্তিনি আরবদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে সেই সব জমিতে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার মাধ্যমে 'কৃষিপ্রকল্প' গ্রহণ করে। র্বতমান তেলআবিবের একটি পাহাড় একইভাবে কিনে নিয়ে সেখানেই গড়ে তোলা হয় 'আধুনিক কৃষিখামার'!

       জেরুজালেমের তখনকার গ্রান্ড মুফতি আমিন আল হুসাইনি আমেরিকান, ব্রিটিশ, রাশিয়ান ও ইউরোপিয়ান ইহুদিদের এ ধরনের তৎপরতার পেছনে অশুভ ষড়যন্ত্রটা উপলব্ধী করেন। তিনি তাদের পরিকল্পনা আঁচ করে ফিলিস্তিনের আরব অধিবাসীদের কাছে বার বার মিনতি করেন, তারা যেন ইউরোপীয় ইহুদিদের কাছে জমি বিক্রি না করে, তারা যতই চড়া দাম দিক না কেন। সাধারণ ফিলিস্তিনি আরবদের একটা বড় অংশই তার এ কথায় কান দেয়নি। দুই গুন, কখনও কখনও তিনগুন বেশি দাম পেয়ে তারা জমি বিক্রি করে দেয় ইহুদিদের কাছে। সেই সব জমিতে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদিরা এসে বসতি স্থাপন করে।

   এর পরিণতি কি হয়েছে সেটা আজ আর কাউকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। সেদিনকার সেই 'কৃষিখামার'ই আজ ইসরাইলের রাজধানী; তেলআবিব!

   মুফতি হুসাইনি তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর দূরদর্শীতার কারণে সেই সেদিনই ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বুঝে উঠতে পেরেছিলেন, আর সেটাই বুঝতে ব্যার্থ হয়েছে আপামর ফিলিস্তিনি আরব জনতা।

   এই যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর দূরদর্শীতা, এগুলো হলো আপনার সেই চোখ, অন্তরের চোখ অন্তর্দৃষ্টি, যা মাছির চার হাজার চোখের চেয়েও ক্ষমতাসম্পন্ন ও শক্তিশালী। আপনার নিজের ভেতরে এই জ্ঞান, এই প্রজ্ঞা আর দূরদর্শীতা সৃষ্টি করবার একটা মাত্র উপায় হলো, জ্ঞান চর্চা করা।

        এর জন্য বইু পড়ুন। সিরিয়াস বই, প্রেমের রোমান্টিক বই পড়তে চাইলে তাও পড়তে পারেন। তবে নিজের ভেতরে সমাজ ও বিশ্বকে প্রভাবিত করার মত জ্ঞান, সেই মানের প্রজ্ঞা, দূরদর্শীতা জন্মাতে চাইলে ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ, আত্মজীবনী এরকম সিরিয়াস বই পড়তে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।

    একটি বই পড়বেন, তার মানে হলো, আপনার ভেতরে আরও একটি চোখ সংযোজিত হলো; আপনার জ্ঞান যেমন বাড়লো, তেমনি আপনার ভেতরে অনেক দূর অতিত ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে অনাগত ভবিষ্যৎকে দেখার যোগ্যতাও সৃষ্টি হলো।

   কেবল তাই নয়। বেশি বেশি সিরিয়াস বই পড়ার কারণে আপনার ভেতরে যে জ্ঞান সৃষ্টি হচ্ছে, তার উপরে ভিত্তি করেই তৈরি হবে প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা হলো; যথাসময়ে জ্ঞানের যথাযথ ব্যবহারে ব্যক্তির কৌশল ও দক্ষতা।

  অর্থাৎ ত্বরিৎগতিতে যথাযথ স্বিদ্ধান্ত নিতে পারা। এটা একটা দূর্লভ গুণ। জ্ঞান থাকলেই এই গুনটা ব্যক্তির ভেতরে থাকবে তেমনটা নয়, তবে যথাযথ জ্ঞানের যথাযথ চর্চা ও নিরন্তর ভাবনায় প্রজ্ঞার জন্ম নিতে পারে। জ্ঞানের সাথে সাথে আপনার ভেতরে চিন্তার গতি; প্রতূৎপন্নমতীতা যদি থাকে, তবে আপনি অনেকটাই অজেয়।

 নিজের জীবন নিজের, পরিবার ও সমাজ এবং এই দেশকে প্রজ্ঞাময় নেতৃত্ব দিতে আপনাকে দরকার। একজন দক্ষ নেতা হয়ে গড়ে উঠুন, অতএব বেশি বেশি বই পড়ুন, আপনার অন্তর্দূষ্টিকে প্রখর করুন, দিগন্তজুড়ে প্রসারিত করুন।
-------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ, গ্রন্থপ্রনেতা কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।   

Post a Comment

0 Comments