আপনার কথা ভাবতে গেলেই চোখে আসে জল!।
হেজাজের সবচেয়ে বড়ো শহর মক্কার এক সকাল। সময়কালটা ষষ্ঠ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধেরও মাঝামাঝি কাল; ৫৭৮ খৃষ্টাব্দ। একটি মৃতদেহ নিয়ে মানুষজন জটলা করে এগিয়ে চলছে কাবার দিকে। সেই মৃতদেহের পেছনে আট বছরের একটা শিশু, গায়ে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঝোলানো একটা মাত্র কোর্তা, খালি পায়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে ছুটে চলছে। ছেলেটা অবিরত কেঁদেই চলেছে। কেঁদে চলেছে লাশের পেছনে ছুটে চলা প্রতিটি মানুষ। কিন্তু শত শত বয়স্ক মানুষের ভীড়ে ছুটে চলা ছোট্ট এই ছেলেটা বার বার পিছিয়ে পড়ছে।
প্রকৃতপক্ষেই ভীড় ছিল প্রচুর। মক্কাতো বটেই পুরো হেজাজই যেন ভেঙ্গে পড়েছে এই লাশটির পেছনে। আশে পাশে নানা গোত্রের লোকজন তো এসেছেই, খবর পেয়েই ছুটে এসেছে মরুর বেদুঈনরাও। দূর-দূরান্তে অবস্থানরত অনেকেই মৃত্যুর খবরই পায়নি।
চারশত কিলোমিটার দুরত্বের ইয়াসরিবে মৃতের মা সালমার মাতৃকূল এবং শশুর বাড়ির আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদেরও জানানো যায়নি। দুরত্বের কারণে তাদের কাছে খবরই পৌছানো যায় নি, গেলে পুরো আরবই ভেঙ্গে পড়তো পঙ্গপালের ন্যায়, তখন তো মক্কার এই বিশাল পাহাড়ি উপত্যকার বিস্তির্ণ জনপদও আগতদের জায়গা দিতে ব্যর্থ হতো।
কারণ, যে মৃতদেহের পেছনে তারা ছুটে চলেছে, সেটা আর কারো নয়, মক্কার সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তিত্ব আব্দুল মুত্তালিবে। আব্দুল মুত্তালিব কেবল কুরাইশ নেতাই ছিলেন না, ছিলেন না কাবা ঘরের মুতাওয়াল্লিও শুধু। তাঁর আরও একটা বড় পরিচয় হলো; তিনি হাশেমের পুত্র ছিলেন।
বাবা হাশেমও ছিলেন কুরাইশ নেতা। রোম সম্রাট তার অতি বিশ্বস্থ একজন হিসেবে হাশেম ও তার বাণিজ্য বহরকে অবাধে সিরিয়া, ফিলিস্তিনে বাণিজ্য করার পূর্ণনিরাপত্তা সম্বলিত লিখিত অঙ্গিকারনামাও দিয়েছিলেন।
তৎকালিন বিশ্বের একমাত্র সুপারপাওয়ার রোমান সম্রাটের পক্ষ থেকে এমন অঙ্গিকারনামা শুধু কুরাইশ বংশকেই নয়, বরং পুরো মক্কার সকল গোত্রকে সিরিয়া ফিলিস্তিনে অবাধ চলা ফেরা ও বাণিজ্যের নিশ্চয়তা দিয়েছিল।
হাশেমের মৃত্যুর পর তারই পুত্র আব্দুল মুত্তালিব বাবার মতোই অত্যন্ত দক্ষতা ও প্রাজ্ঞতার সাথে রোমান সম্রাটের সাথে সেই কুটনৈতিক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে মক্কাবাসীর নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করেছেন।
এই আব্দুল মুত্তালিব’ই ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি বন্ধ হয়ে যাওয়া জমজম কুপটাকে পূন:খনন ও সংস্কার করে মক্কাবাসীর জন্য পানির বন্দোবস্ত করেছেন। হাজীদের পানি পান করানো ও নিরাপত্তা প্রদানের সকল আয়োজনে তিনি ছিলেন মূলব্যক্তিত্ব।
আর কাবা ধ্বংস করতে আসা আবরাহার কথা তো বলাই বাহুল্য। সেদিন আর কেউ নন, এই আব্দুল মুত্তালিবই আবরাহার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মক্কাবাসীর হয়ে। আবরাহা তার কুটিল পরিকল্পনায় অবিচল থাকলে এই আব্দুল মুত্তালিবই কাবার দেয়াল ধরে আল্লাহর কাছে তার ঘর রক্ষার আবেদন জানিয়েছিলেন। আল্লাহ অপার কৌশলে সেই ঘর রক্ষা করে বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিবের সে আবেদনে সাড়াও দিয়েছিলেন।
মৃতের ব্যক্তিত্ব, গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। চীরপ্রতিদ্বন্দীশীল গোত্রনির্ভর আরব সমাজে একবার কোন একটা বিষয় নিয়ে আব্দুল মুত্তালিব আর আবু সুফিয়ান রা: এর বাবা হারব ইবনে উমাইয়্যা‘র দ্বন্দ বাধলে হজরত ওমর রা: এর দাদা নোফাইল ইবনে আব্দুল ওজ্জা তাদের মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দিলেন, সেদিন তিনি অতি সংক্ষেপে আব্দুল মুত্তালিবের যোগ্যতা ও মর্যাদা হারব ইবনে উমাইয়্যার সামনে তুলে ধরেছিলেন, বলেছিলেন;
‘বাছা তুমি অযথাই কেন সেই লোকের সাথে বিবাদে জড়াচ্ছো, যে তোমার চেয়েও লম্বা ও সুদেহী, দেখতেও তোমার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়, যার বংশমর্যাদা তোমার বংশমর্যাদার চেয়েও বেশি প্রতিষ্ঠিত, যার বুদ্ধিমত্তা তোমার বুদ্ধিমত্তার চেয়েও তীক্ষè ও ক্ষুরধার! বাছা, ভেবো না, আমি তোমাকে অবজ্ঞা বা ছোট করছি, তুমিও অত্যন্ত ভদ্র, স্বজ্জন ও সচ্চরিত্রবান। সারা আরবে তোমার সুনাম ছড়িয়ে আছে, তোমার গোত্রও তোমাকে নিয়ে গর্ব করে তা আমি জানি।’
নোফাইল ইবনে আব্দুল ওজ্জার কথায় বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি ছিল না। আব্দুল মুত্তালিব প্রকতপক্ষেই আমৃত্যু মক্কার সবেচেয়ে আকষর্ণীয়, সবচেয়ে মর্যাদাবান ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বিরাশি বছরে এসে সেই তিনিই ইন্তেকাল করলে তার মৃতদেহকে নেওয়া হচ্ছে কাবা চত্তরে, সেখানে আনুষ্ঠানিকতা সেরে লাশ নেওয়া হবে জান্নতুল মাওয়াতে কবরস্থ করতে।
নিজেরই ছিল এক বিশাল পরিবার। হাওয়াজিন, খোজা, মাখজুম ও নামির গোত্রের সাথে তিনি বিবাহ সুত্রে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। তার ছয় স্ত্রী, দশজন (ইবনে ইসহাকের মতে বারোজন) পুত্র আর ছয়জন কন্যা ছিল। অবশ্য ততোদিনে প্রথমপুত্র আল হারিস মুত্যবরণ করেছেন।
লাশ বয়ে চলেছে মৃতের সন্তান আবু লাহাব, আবু তালিব’সহ অন্যন্যরা। আত্মীয় স্বজনের বিলাপে মক্কার বাতাস ভারী। উঁচু উঁচু পাহাড়, পাথুরে প্রান্তরে মাটি তো নেই! পাথরের মধ্যে দিয়েই সরু রাস্তা, সেই রাস্তার এক পাশ দিয়ে মৃত্যের সবচেয়ে ছোট মেয়ে সাফিয়্যাহ বিলাপ করতে করতে এগুচ্ছেন ভীড়কে যথাসম্ভব এড়িয়ে। একপাশে অশ্রুসজল চোখে হাঁটছেন আর বাচ্চাটাকে চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন উম্মে আইমান!
আর ঐ পাথুরে পথেই শত শত মানুষের ভীড়ে ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে কাঁদতে কাঁদতে এগুচ্ছে। চেষ্টা করে চলেছে লাশটির সবচেয়ে কাছাকাছি থাকার জন্য। সে চেষ্টায় সে বার বার পিছিয়ে পড়ছে। কারণ, কান্নার কারণে চোখ ভরে আসায় সে কিছুই যখন দেখতে পাচ্ছে না, তখন থামতে বাধ্য হচ্ছে, একটু থেমে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখজোড়া মুছে নিয়ে আবারও লাশের কাছাকাছি যাবার প্রচেষ্টায় ছুটে চলা।
মাত্র ক’দিন আগে মা মারা গেছে। বাবাহারা এতিম ছেলেটা সেই থেকে একটা দন্ডও মৃত ব্যক্তিটির কাছ ছাড়া হয়নি। বৃদ্ধ তাকে একটা মহুর্তও দুরে সরাননি। আজ সেই তিনিই তাকে ছেড়ে গেলেন! কার কাছে থাকবে সে এখন? কে তাকে ঐ বৃদ্ধের মতো আগলে রাখবে পরম মমতায়? আজ রাতে কার কাছেইবা ঘুমুবে?
বুকভাঙ্গা ব্যথা আর বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় বিদ্ধ নীরব কান্না নিয়ে, রুক্ষ পাথরের উপর দিয়ে লাশের পেছনে হাজারো মানুষের ভীড়ে খালি পায়ে ছুটে চলা সেই বালকই আমার প্রিয় রাসুল, আমার প্রিয় নবী; মুহাম্মদ সা:
হে মুহাম্মদ সা:! আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন। আপনার কথা ভাবতে গেলেই আমার চোখজোড়া ভিজে আসে যে! (প্রকাশিতব্য গ্রন্থর ‘দ্যা চয়েস ইজ ইউরস’ থেকে)
-------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।
0 Comments