Recent Tube

লুৎফুর রহমান ফরায়েজীর জবাব: মাওলানা মওদূদী (রাহঃ) কি হাদীস অস্বিকারকারী? মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।

লুৎফুর রহমান ফরায়েজীর জবাব: মাওলানা মওদূদী (রাহঃ) কি হাদীস অস্বিকারকারী?

    আল্লামা মওদূদী (রাহঃ) তাঁর তাফসীর গ্রন্থ ‘তাফহীমুল কুরআন’ এ লিখেনঃ
"একদিন হযরত সুলাইমান (আঃ) কসম খান, আজ রাতে আমি সত্তরজন স্ত্রীর কাছে যাবো এবং প্রত্যেক গর্ভে একজন করে আল্লাহর পথের মুজাহিদ জন্ম দেব। কিন্তু একথা বলতে গিয়ে তিনি ইনশাআল্লাহ বলেননি। এর ফলে মাত্র একজন স্ত্রী গর্ভবতী হয় এবং তাঁর গর্ভেও একটি অসমাপ্ত ও অপরিপক্ব শিশুর জন্ম হয়। দাই শিশুটিকে এনে হযরত সুলাইমানের আসনের ওপর ফেলে দেয়। এ হাদীসটি হযরত আবু হুরাইরা (রা.) নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করেছেন। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন রাবীর মাধ্যমে এটি উদ্ধৃত করেছেন। বুখারী শরীফেই এ হাদীসটি যেসব রাবীর মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে তার কোনটিতে স্ত্রীদের সংখ্যা বলা হয়েছে ৬০, কোনটিতে ৭০, কোনটিতে ৯০, কোনটিতে ৯৯, আবার কোনটিতে ১০০ও বলা হয়েছে। সনদের দিক দিয়ে এর মধ্য থেকে অধিকাংশই শক্তিশালী এবং রেওয়ায়াত হিসেবে এগুলোর নির্ভুলতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা যেতে পারে না। কিন্তু এ হাদীসের বিষয়বস্তু সুস্পষ্টভাবে সাধারণ বিবেক-বুদ্ধির বিরোধী। এর ভাষা বলছে, একথা নবী ﷺ কখনো এভাবে বলেননি যেভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। বরং তিনি সম্ভবত ইহুদীদের মিথ্যা ও অপবাদমূলক কিচ্ছা-কাহিনীর কথা উল্লেখ করতে গিয়ে কোন পর্যায়ে একে এভাবে উদাহরণস্বরূপ বর্ণনা করে থাকবেন এবং শ্রোতার মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়ে থাকবে যে, নবী করীম (সাঃ) নিজেই এ ঘটনা বর্ণনা করছেন। এ ধরনের রেওয়ায়াতকে নিছক জোরে লোকদের হজম করাবার চেষ্টা করানো দ্বীনকে হাস্যাস্পদ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই হিসেব কষে দেখতে পারেন, শীতের দীর্ঘতম রাত ও এশা থেকে নিয়ে ফজর পর্যন্ত দশ এগারো ঘণ্টার বেশী সময় হয় না। যদি স্ত্রীদের সংখ্যা কমপক্ষে ৬০ জন বলে মেনে নেয়া যায়, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়, সেই রাতে হযরত সুলাইমান আলাইহি সালাম কোন প্রকার বিশ্রাম না নিয়েই অবিরাম ১০ বা ১১ ঘণ্টা ধরে প্রতি ঘণ্টায় ৬ জন স্ত্রীর সাথে (আর ১০০ জন বলে মেনে নিলে প্রতি ঘণ্টায় ১০ জন স্ত্রীর সাথে) সহবাস করতে থেকেছেন। কার্যত এটা কি সম্ভব? আর একথাও কি আশা করা যেতে পারে যে, নবী করীম (সাঃ) বাস্তব ঘটনা হিসেবে একথাটি বর্ণনা করে থাকবেন? তারপর হাদীসে কোথাও একথা বলা হয়নি যে, কুরআন মজীদে হযরত সুলাইমানের আসনের ওপর যে দেহাবয়বটি ফেলে রাখার কথা বলা হয়েছে সেটি হচ্ছে এ অপরিণত শিশু। তাই নবী করীম ﷺ এ ঘটনাটি এ আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন তা বলা যায় না।" [তাফহীমুল কুরআন বাংলা, সূরা সা’দ, টিকা নং ৩৬, খণ্ড-১৩, পৃষ্ঠা-১০৯, আধুনিক প্রকাশনী]

    লুৎফুর রহমান ফরায়েজী আংশিক বক্তব্য তুলে ধরে এবং নিজের ইচ্ছামত ব্যাখ্যা পেশ করে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, 
"তাহলে তিনি আসলেই আহলে সুন্নাতের অনুসারী নাকি ‘মুনকিরীনে হাদীস’ তথা হাদীস অস্বিকারকারী দলেরই একজন একনিষ্ট কর্মী? জাতির কাছে এ প্রশ্ন রইল।"

(১) ফারায়েজী সাহেবের প্রশ্নের জবাবে প্রিয়ভাই মুহতারাম Aslam Hossain (হাফিঃ) বলেন, 'রিওয়ায়াত ও দিরায়াত সম্পর্ক আপনি মূর্খতা বলবো না। আপনি জেনে শুনেই হিংসার বশবর্তী হয়ে এমন অহেতুক অভিযোগ তুলছেন। অজ্ঞতাবশত এটার উত্তর জাতির কাছে জানতে না চেয়ে মাওলানা মওদুদীর লেখা "সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা" বইটি পড়ুন। উনি মুনকিরুল হাদীস কিনা জানতে পারবেন।
আপনাদের মতো মানুষ যখন স্টাডি না
করে জাতির কাছে অন্যের আকীদার
সার্টিফিকেট চায় তখন দীয়ানতদারীর
করুন দশা দেখে আফসোস করা ছাড়া
আমাদের আর কিছুই করার থাকেনা।'
তিনি আরও বলেন, '(হাদীসের) উসূল সম্পর্কে যার সামান্য জ্ঞান আছে সেও জানে সনদ শুদ্ধ হলেই মতন শুদ্ধ হওয়া শর্ত নয়। মতন নিয়ে প্রশ্ন তুললে সে হাদীস অস্বীকারকারী হয়ে যায় না। আল্লামা ইবনে আব্দুল বার (রাহঃ) একটা সহীহ হাদীসের সমালোচনা করে বলেছিলেন,
ﺣﺪﻳﺚ ﺍﺑﻦ ﻋﻤﺮ ﻭﻫﻢ ﻭﻏﻠﻂ ﻭﺃﻧﻪ ﻻ ﻳﺼﺢ ﻣﻌﻨﺎﻩ ﻭﺇﻥ ﻛﺎﻥ ﺍﺳﻨﺎﺩﻩ ﺻﺤﻴﺤﺎ-
"ইবনে ওমরের বর্ণিত হাদীস উদ্ভট কল্পনা প্রসূত ও ভ্রান্ত। এর বক্তব্য সঠিক নয় যদিও তার সনদ নির্ভুল।" (আল ইস্তিয়াব: ৩/১১১৬)
  এরকম অনেক হাদীস পাওয়া যায় যেগুলো হাদীসবেত্তাগণের কাছে সনদের দিক থেকে সহীহ রূপে স্বীকৃত কিন্তু হাদীসের বিষয় বস্তু অকাট্য উক্তি কিংবা মুক্ত জ্ঞানের বিরোধী হওয়ার কারণে হাদীস বিশারদগণ সেগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
আজকাল কেবল হিংসার বশবর্তী হয়ে কিছু মৌলভীরা সত্য গোপন রাখে কিংবা অজ্ঞতাবশত মাওলানা মওদুদীকে ঘায়েল করার চেষ্টা করতেছেন।'
এখানে মুহতারাম Aslam Hossain ভাইয়ের জবাবই যথেষ্ট। তারপরও Yeasir Arafat নামে এক ভাই এ বিষয়ে আমার পক্ষ থেকে জবাব দিতে অনুরোধ করেছেন। ব্যস্ত থাকায় দেরিতে হলেও আসলাম ভাইয়ের জবাবের সমর্থনে আরো কিছু কথা যুক্ত করছি।

(২) আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ.
নিশ্চয় তোমাদের রব আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আ'রাফ : ৭/৫৪)
এ অায়াতের তাফসীরে সুপ্রসিদ্ধ মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক ইমাম ইবনে কাসীর (রাহঃ) বলেন, "এখানে আল্লাহ তা'য়ালা সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি আসমান ও যমীনের সৃষ্টিকর্তা। আসমান ও যমীনকে তিনি ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। যার বর্ণনা কুরআনুল কারীমের কয়েক জায়গায় এসেছে।" একটু এগিয়ে তারপর বলেন,
আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (একদা) আমার হাত ধরে বললেন, 
«خَلَقَ اللهُ التُّرْبَةَ يَومَ السَّبْتِ، وَخَلَقَ فِيهَا الجِبَالَ يَومَ الأَحَدِ، وَخَلَقَ الشَّجَرَ يَومَ الاِثْنَينِ، وَخَلَقَ المَكْرُوهَ يَومَ الثُّلاَثَاءِ، وَخَلَقَ النُّورَ يَوْمَ الأَربِعَاءِ، وَبَثَّ فِيهَا الدَّوابَّ يَومَ الخَمِيسِ، وَخَلَقَ آدَمَ عليه السلام، بَعْدَ العَصْرِ مِنْ يَومِ الجُمُعَةِ في آخِرِ الخَلْقِ فِي آخِرِ سَاعَةٍ مِنَ النَّهَارِ فِيمَا بَيْنَ العَصْرِ إِلَى اللَّيْلِ». 
"আল্লাহ তা‘আলা শনিবার জমিন সৃষ্টি করেছেন, রবিবার তার মধ্যে পর্বতমালা সৃষ্টি করেছেন। সোমবার সৃষ্টি করেছেন গাছ-পালা। মঙ্গলবার মন্দ বস্তু সৃষ্টি করেছেন। বুধবার আলো সৃষ্টি করেছেন। তাতে (জমিনে) জীবজন্তু ছড়িয়েছেন বৃহস্পতিবার। আর সমস্ত জিনিস সৃষ্টি করার পর পরিশেষে জুমার দিন আসরের পর দিনের শেষভাগে আসর ও রাতের মাঝামাঝি সময়ে (আদি পিতা) আদম-কে সৃষ্টি করেছেন।" (সহীহ মুসলিম হাঃ ২৭৮৯; মুসনাদে আহমাদ হাঃ ৮১৪১; রিয়াযুস স্বালিহীন হাঃ ১৮৬৩)
"এ হাদীসে সপ্তম দিনেও (সৃষ্টির কাজে) ব্যস্ত থাকার কথা সাব্যস্ত হচ্ছে। অথচ আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন, ব্যস্ততার দিনের সংখ্যা ছিল ছয়। এ জন্য ইমাম বুখারী (রাহঃ) সহ প্রমুখ মনীষী এ হাদীসের সঠিকতার ব্যাপারে সমালোচনা করেছেন এবং সম্ভাবত আবূ হুরায়রা (রা) কা'ব আহবার থেকেই শুনে বলেছেন (রাসূলুল্লাহ সাঃ থেকে নয়)।" (তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা আ'রাফ : ৭/৫৪ তাফসীর দ্রষ্টব্য) 

    সনদগত ভাবে হাদীসটি সহীহ। ইমাম আহমদ, মুসলিম (রাহঃ) সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তারপরও ইমাম ইবনে কাসীর এ হাদীসের মতনের সমালোচনা করেছেন এবং তা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বাণী নয় বলে ইমাম বুখারী (রাহঃ) সহ প্রমুখ মুহাদ্দিসের বরাতে মন্তব্য করেছেন। এখন ইমাম বুখারী ও ইবনে কাসীর (রাহঃ) সহ যারা উক্ত সহীহ হাদীস রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বাণী নয় বলে মন্তব্য করেছেন আসলেই তারা কি আহলে সুন্নাতের অনুসারী নাকি ‘মুনকিরীনে হাদীস’ তথা হাদীস অস্বিকারকারী দলেরই একনিষ্ট কর্মী? ফারায়েজী সাহেব ও তার মুকাল্লিদের কাছে এ প্রশ্ন রইল।

(৩) মাওলানা মুহাম্মাদ আমীন সফদর ওকাড়বী নামে এক দেওবন্দী আলেমের 'রফউল ইয়াদাঈন নিয়ে কথিত আহলে হাদীসের ধোঁকাবাজি' নামে লেখা অনুবাদ করেছেন লুৎফর রহমান ফারায়েজী। এখানে ফারায়েজী সাহেব নিজেই বুখারী মুসলিমের একাধিক সহীহ হাদীসের সমালোচনা করেছেন এবং তা অস্বীকার করারও পায়তারা করেছেন। যেমন তিনি অনুবাদে লিখেন, 
   "যে সকল হাদীসকে হানাফী মাযহাবের ইমামগণ তারজীহ দিয়ে আমল করেছেন এবং সাধারণের মাঝে আমল হিসাবে মুতাওয়াতির হয়েছে, আমরা সেগুলোকর রাজেহ হিসাবে আমল করি। আর বাকিঁগুলোকে মারজুহ মনে করে ছেড়ে দেই।" ফারায়েজী সাহেব এ মূলনীতির মাধ্যমে কি শত শত সহীহ হাদীস কে অস্বীকার করছেন না? তিনি আরো লিখেন, 
"আমাদের একত্ববাদের বিশ্বাস হল যে, আল্লাহ তা'য়ালা এক বিশ্বাস করা এবং বাঁকি সকলকে অস্বীকার করা। এমনি ভাবে আমাদের রফউল ইয়াদঈন এক স্থানে প্রমাণিত, বাঁকি সকল স্থানের (হাদীস) অস্বীকার।"

     লক্ষ্য করুন, কিভােব ফারায়েজী সাহেব বুখারী মুসলিমের সহীহ হাদীসকে অস্বীকার করছেন। কেননা, একাধিক স্থানে রফউল ইয়াদানের হাদীস সহীহ সনদে ইমাম বুখারী ও মুসলিমসহ প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। তারপরও তিনি রফউল ইয়াদঈন এক স্থানে প্রমাণিত বলে, বাঁকি সকল স্থানে রফউল ইয়াদঈনের সহীহ হাদীস অস্বীকার করেছেন। 
আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) যদি হাদীসের একটি মতনের সমালোচনা করার কারণে ফারায়েজী সাহেবের মতে হাদীস অস্বীকারকারী বলে গণ্য হয়ে থাকে 
তাহলে ফারায়েজী সাহেবের নিকট আমাদের প্রশ্ন হল- বুখারী মুসলিম সহ শত শত সহীহ হাদীস প্রত্যাখ্যান করার মূলনীতি পেশ করার কারণে এবং কার্যত সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীস অস্বীকার করার ফলে আপনি আসলেই আহলে সুন্নাতের অনুসারী নাকি ‘মুনকিরীনে হাদীস’ তথা হাদীস অস্বিকারকারী দলেরই একজন একনিষ্ট কর্মী? জাতির তা জানতে চাই এবং জানা জরুর।  
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলানা।         

Post a Comment

0 Comments