Recent Tube

কারবালার ইতিহাসের সারসংক্ষেপ এবং এজিদের অপরাধের খতিয়ান। ৷৷ আবুল হুসাইন আলেগাজী।

কারবালার ইতিহাসের সারসংক্ষেপ এবং এজিদের অপরাধের খতিয়ান
--------------------------------------  
      খারেজী ও নাসেবী ছাড়া উম্মতে মুহাম্মদীর সকল সদস্য এ ব্যাপারে একমত যে, কারবালার মত কোনো দুঃখজনক ঘটনা Tragedy المأساة উম্মতের মাঝে আর ঘটেনি এবং ঘটবেও না৷ কারণ, কারবালাতে নিয়মিত কোনো যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়নি৷ এটি ছিল এজিদ বিন আমীর মুয়াবিয়ার ইঙ্গিতে তার পিতার একজন সহযোগী জিয়াদ বিন আবীহির ছেলে উবাইদুল্লাহর পরিকল্পনায় আহলে বাইতে রসূলের উপর সঙ্ঘটিত একটি ঠান্ডা মাথার গণহত্যা massacre مجزرة, যেখানে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে নবী সঃ পরিবারে ১৭জন সদস্যসহ প্রায় ৮০জন মুমিনকে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল৷ কারণ, তারা জালিম এজিদকে নিঃশর্ত বাইয়াত দিতে রাজি হননি৷ তারা তার সাথে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু স্বৈরাচার এজিদ তাদেরকে সেই সুযোগ দেয়নি।
এজিদের পিতা আমীর মুয়াবিয়া ইমাম হাসানের সাথে কৃত তাঁর চুক্তির কথা (চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, আমীর মুয়াবিয়া মারা গেলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন হযরত হাসান অথবা মজলিসে শূরা গঠন করে খলীফা নির্বাচন করা হবে) বিস্মৃত হয়ে নিজের ছেলে এজিদকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করার ঘোষণা দেন এবং তাঁর এ ঘোষণাকে তাঁর গুণগ্রাহীরা স্বাগত জানান৷ কিন্তু মরওয়ান যখন মসজিদে নববীতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানালেন, তখন হযরত আয়েশা, আবদুর রহমান বিন আবু বকর, আবদুল্লাহ বিন উমর, আবদুল্লাহ বিন জুবাইর ও হুসাইন বিন আলীসহ বিশিষ্ট ছাহাবীদের সকলে এ সিদ্ধান্তের সাথে একবাক্যে দ্বিমত পোষণ করেন৷ অবশেষে আমীর মুয়াবিয়া ৬০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন৷ অতঃপর এজিদ রাজা হলে ইমাম হুসাইন ও আবদুল্লাহ বিন যুবাইরের মত নেতৃত্বস্থানীয় কিছু ছাহাবী তাকে বাইয়াত দিতে অস্বীকার করেন৷ তখন মদীনাবাসী আবদুল্লাহ বিন যুবাইর ও ইমাম হুসাইনকে বললেন, আপনারা বাইয়াত না দিলে জালিম এজীদ মদীনার উপর আক্রমণ করতে পারে৷ তারা বললেন, তাহলে আমরা মক্কা চলে যাই (কোরআনের ঘোষণা মতে মক্কায় কারো উপর আক্রমণ করা হারাম)৷ এ বলে ইবনে যুবাইর ও ইমাম হুসাইন স্বপরিবারে মক্কা চলে গেলেন৷ 
সত্য হলো, ইমাম হাসানের সাথে আমীর মুয়াবিয়ার চুক্তি অনুযায়ী ইমাম হুসাইনই ছিলেন মুসলমানদের ইমাম/খলীফা হওয়ার সবচেয়ে বড় হকদার এবং সত্যবাদী মুসলিমরাও তাঁকে খলীফা হিসেবে দেখতে চেয়েছিল৷ অন্যদিকে খিলাফতে রাশেদার দ্বিতীয় রাজধানী ও হানাফী ফিকাহর উতপত্তিস্থল কূফার গভর্ণর (প্রশাসক) ছিলেন তখন নোমান বিন বশীর নামের এক জুনিয়র আনছারী ছাহাবী৷ তিনি আমীর মুয়াবিয়ার নিযুক্ত গভর্ণর হলেও এজিদ ভক্ত না হওয়ায় হযরত আলীর সাহচর্য প্রাপ্ত কূফাবাসী বেশ স্বস্তিতে ছিলেন৷ তাই তারা ইমাম হুসাইনের কাছে লোক মারফতে বিভিন্ন পত্র পাঠিয়ে তাঁর মহান পিতার কর্মস্থল কূফায় চলে গিয়ে খিলাফতের ঘোষণা দেওয়ার আহবান জানান৷ এসব পত্র পেয়ে ইমাম হুসাইন কূফার অবস্থা জানার জন্য তাঁর চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকীলকে সেখানে পাঠান৷ তখন মানুষ চলাফেরা করতো উটে চড়ে৷ এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যেতো৷ মুসলিম বিন আকীল কূফায় পৌঁছার পর দেখলেন, কূফাবাসী ইমাম হুসাইনকে গ্রহণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন৷ ফলে মুসলিম বিনৎআকীল সুদূর মক্কায় লোক পাঠিয়ে ইমাম হুসাইনকে বিষয়টি জানালেন৷ এতে তিনি তাঁর পরিবার ও স্বজনদের নিয়ে কূফা অভিমুখে রওনা হলেন৷ অন্যদিকে কূফায় খলীফা আলীপন্থীদের প্রতি নোমান বিন বশীরের নমনীয় মনোভাবের কথা সেখানকার আমীর মুয়াবিয়া পন্থীরা এজিদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়৷ ফলে এজিদ নোমানকে সাথে সাথে সরিয়ে তার জিয়াদের ছেলে উবাইদুল্লাহকে কূফায় নিয়োগ দেয়৷ সে এসে কূফাবাসীর মুসলিম বিন আকীলকে আশ্রয়দানের খবর পায় এবং ইমাম হুসাইনকে তাদের বরণ করে নেবার আয়োজনও দেখে ফেলে৷ এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে ঘাতক দিয়ে মুসলিমকে নির্মমভাবে হত্যা করায়৷ কূফীবাসী তখন আতঙ্কে নিশ্চুপ হয়ে যায়৷ মুসলিম বিন আকীলকে হত্যার এ খবর যখন ইমাম হুসাইনের কাছে পৌঁছানো হলো, তখন তিনি ছিলেন মাঝপথে৷ তারপরও তিনি মক্কা ফিরে যেতে চাইলেন৷ কিন্তু মুসলিম বিন আকীলের ছেলেরা বললো, না৷ অন্যদিকে এজিদের নির্দেশমত ইমাম হুসাইনকে মোকাবিলা করার জন্য উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদ হুর বিন ইয়াযীদ আর-রিয়াহী حر بن يزيد الرياحي নামের একজন সৈন্যের নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠিয়ে ইমাম হুসাইনকে অনুসরণ করার নির্দেশ দিল৷ হুর ইমামের সাথে মিলিত হয়ে বললেন, আপনাদেরকে আটকানোর জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে৷ তাই দয়া করে আপনি আমীরের আনুগত্য স্বীকার করে নিন৷ তখন ইমাম তাঁর সাথে কথা বলে সবকিছু পরিষ্কার করলেন৷ হুর এতে ইমামের ভক্ত হয়ে পড়েন এবং গোপনে তাঁকে বললেন, আপনার বিরুদ্ধে আরো কয়েকটি বাহিনী পাঠানো হবে৷ তাই আপনি একটি কাজ করেন, আমরা যখন রাতে ঘুমাবো, তখন আপনি আপনার আপনজনদের নিয়ে এখান থেকে চলে যাবেন। সকালে আমরা আপনাকে খোঁজ করব না ও আপনার পিছু নেব না। বরং সোজা উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের কাছে গিয়ে বলব, উনি রাতের অন্ধকারে আমাদের অজান্তে চলে গেছেন এবং উনি কোন্‌ দিকে গেছেন তার খোঁজ আমরা পাইনি। এরপর যা হওয়ার তাই হবে। ইমাম হুসাইন বললেন, ‘ঠিক আছে’।
তো যখন রাত হলো, চারিদিকে অন্ধকার ঘণীভূত হলো এবং সৈন্যরা প্রায় ঘুমিয়ে পড়লো, তখন ইমাম হুসাইন নিজের সঙ্গী সাথীদেরকে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন । সবাই বের হয়ে গেলেন। সারারাত এ কাফেলা পথ চলতে থাকল, কিন্তু ভোরে তারা তাদেরকে ঐ জায়গাতেই দেখতে পেলেন, যেখান থেকে তারা যাত্রা শুরু করেছিলে। এই অবস্থা দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে বললো, এটা কিভাবে হলো! আমরা সারারাত পথ চললাম, কিন্তু সকালে আবার একই জায়গায়। এ কেমন কথা! হুর তাঁদেরকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি যাননি ? ইমাম হুসাইন বললেন, আমরা ঠিকই চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু যাওয়ার পরওতো যেতে পারলাম না, দিকহারা হয়ে আবার একই জায়গায় ফিরে এলাম। হুর বললেন, ঠিক আছে, চিন্তার কিছু নেই। আজ আমরা পুনরায় দিনভর আলোচনা করতে থাকব এবং আমার সৈন্যদেরকে বলব, আমাদের মধ্যে এখনও কোন ফায়সালা হয়নি, আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। এখন আজ রাতেই আপনি চলে যাবেন। 
ইমাম হুসাইন দ্বিতীয় রাতেও সঙ্গীদেরকে নিয়ে বের হলেন। সারারাত তিনি ও তাঁর সফরসঙ্গীগণ পথ চললেন। ভোর যখন হলো, তখন পুনরায় উনারা নিজেদেরকে সেই একই জায়গায় পেলেন, যেখান থেকে উনারা বের হয়েছিলেন। উপর্যুপরি তিন রাত এ রকম হলো। সারারাত তারা পথ চলতেন, কিন্তু ভোর হলেই নিজেদেরকে ঐ জায়গায় পেতেন, যেখান থেকে তাঁরা বের হতেন।
চতুর্থ দিন জনৈক পথিক তাঁদের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিল, ইমাম হুসাইন তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই! যে জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেটি নাম কি? লোকটি বললো, জনাব! এই জায়গাটার নাম ‘কারবালা’। কারবালা শব্দটি শুনার সাথে সাথেই ইমাম হুসাইন আঁতকে উঠলেন এবং বললেন, 'আমার নানাজান (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঠিকই বলেছেন, "হুসাইন লাল মাটিতে শহীদ হবে।" এটাতো আমার শাহাদাতের স্থান। আমি এখান থেকে কিভাবে চলে যেতে পারি? পরপর তিন রাত প্রস্থান করার পর পুনরায় একই জায়গায় প্রত্যাবর্তন এ কথাই প্রমাণিত করে যে, এটা আমার শাহাদাতের স্থান। এখান থেকে আমি কিছুতেই বের হতে পারব না।'
প্রসঙ্গত, ইমাম হুসাইনের কারবালার লাল মাটিতে শাহাদতের ভবিষ্যদ্বাণী সম্বলিত হাদীছ মুসনদে আহমদ (৬৪৮) ও ছহীহ ইবনে হিব্বানে (৬৭৪২) ছহীহ সনদে রয়েছে৷

      অতঃপর ইমাম হুসাইন তাঁর প্রিয়জনদের বললেন, ‘সওয়ারী থেকে অবতরণ করে তাঁবু খাটাও৷' নির্দেশ মত তাঁর সঙ্গী সাথীরা সওয়ারী থেকে অবতরণ করে তাঁবু খাটাতে শুরু করলেন। 
এরপর ইমাম হুসাইনের মুকাবিলা করার জন্য আরো বড় বাহিনী নিয়ে চলে এল ওমর বিন সাদ৷ সে এসে বললো, আমীরের নির্দেশ মত আমরা এসেছি৷ আপনাকে হয়তো বাইয়াত দিতে হবে নতুবা যুদ্ধ করতে হবে৷ ইমাম হুসাইন বললেন, আমি যুদ্ধ করতে আসিনি৷ হয়তো তোমরা আমাকে মক্কায় চলে যেতে দাও, নতুবা অন্য কোনো জায়গায় যেতে দাও৷ যদি এ দুটির কোনটি করতে না পার, তাহলে আমাকে এজিদের কাছে নিয়ে চলো। আমি তার সাথে বসে আলোচনা করব। হয়তো সেখানে তার সাথে কোন সন্ধি হবে৷
ওমর বিন সাদ ইমামের এ তিনটি প্রস্তাব কূফার গভর্নর উবাইদুল্লাহর কাছে পাঠিয়ে দিল। সে এ প্রস্তাবগুলোর কথা শুনে জ্বলে উঠল এবং ওমর বিন সাদকে জানালো, 'আমি তোমাকে সালিশকার বা বিচারক বানিয়ে পাঠাইনি যে, তুমি আমার ও হুসাইনের মধ্যে সন্ধি করার ব্যবস্থা করবে৷ আমি তোমাকে পাঠিয়েছি হুসাইনকে বাইয়াত দিতে বলার জন্য কিংবা তার সাথে যুদ্ধ করে তার মস্তক আমার কাছে পাঠিয়ে দেবার জন্য। অথচ তুমি সন্ধির চিন্তা-ভাবনা করছো এবং এর জন্য বিভিন্ন তদবীর করছো। আমি তোমাকে শেষবারের মতো নির্দেশ দিচ্ছি, হুসাইন যদি বাইয়াত দিতে অস্বীকার করে, তাহলে তার সঙ্গে যুদ্ধ করো এবং তার মাথা কেটে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।' ওমর বিন সাদ যখন ইমাম হুসাইনকে তাগুত এজিদের প্রশাসক উবাইদুল্লাহ নির্দেশিত এ কথা শুনিয়ে দিল, তখন তিনি বললেন, ‘আমার পক্ষ থেকে যা প্রমাণ করার ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে এবং যা বলার ছিল তা বলা হয়েছে। এখন তোমাদের যা মর্জি তা করো। আমি এজিদকে বাইয়াত দেবো না।’ 
তখন ওমর বিন সাদ বলল, তাহলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন। ইমাম হুসাইন বললেন, ‘তোমাদের পক্ষ থেকে যা করার তোমরা কর। আমার পক্ষ থেকে যা করার আমি করব।’

    প্রসঙ্গত, উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের প্রতি স্বৈরাচার এজিদের নির্দেশ ছিল, 'বাইয়াত না দিলে হুসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে৷' এজিদ বিন মুয়াবিয়া উবাইদুল্লহ বিন জিয়াদকে কখনো এ নির্দেশ দেয়নি যে, হুসাইন বাইয়াত না দিলে তাকে ধরে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবে৷ কিন্তু নাসেবী সম্প্রদায় ও আমাদের কিছু অবিবেচক ভাইয়েরা বলছে, এজিদ নাকি ইমাম হুসাইনকে হত্যার জন্য নির্দেশ দেয়নি৷ তাই সে নিরপরাধ। বরং তাদের কেউ কেউ আরো আগে বেড়ে স্বৈরাচার এজিদকে বাইয়াত না দেওয়ার কারণে উল্টো ইমাম হুসাইনকেই দোষারোপ করছে।
এখন তাদের কাছে আমরা প্রশ্ন রাখতে পারি, তাহলে এজিদ কি উবাইদুল্লাহকে বলেছিল যে, হুসাইনকে আমার কাছ ধরে নিয়ে এসো অথবা মক্কা বা অন্যকোনো জায়গায় চলে যাবার সুযোগ দাও? যদি তাই হয়, তাহলে ইমাম হুসাইনের প্রস্তাব অনুযায়ী উবাইদুল্লাহ সেই সুযোগ কেন দিল না? প্রশাসক কি কখনো প্রেসিডেন্টের নির্দেশ অমান্য করে পার পেতে পারে? এজিদ যদি নবী সঃ পরিবারের ৯৫% সদস্যদের নির্মম হত্যাকান্ডে মুসলমানদের ক্ষোভ থেকে বাঁচার জন্য বলে 'ওরা আমাকে বাইয়াত দিলেই হয়ে যেত৷ আমিতো তাদেরকে এভাবে হত্যা করতে বলিনি', তাহলে আবারো একই প্রশ্ন আসে, সে কেন উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদকে বাইয়াত না দিলে ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বললো? যুদ্ধ মানেইতো খুনাখুনি৷ আর যদি ইবনে জিয়াদ এজিদের নির্দেশ অমান্য করে নবী সঃ এর পরিবারকে নির্মূল করে, তাহলে এজিদ কেন দায়ীদের নামেমাত্র শাস্তিও দিল না? 
যাই হোক, ইবনে জিয়াদের কড়া নির্দেশ পেয়ে এজিদ বাহিনী যখন নবী সঃ এর পরিবারের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিল, তখন ভাগ্যে জান্নাতের হূর থাকা হুর আর-রিয়াহীর অন্তরে বিপ্লব শুরু হয়ে গেল । তিনি ঘোড়ার উপর অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। তার এই অবস্থা দেখে তার এক সঙ্গী জিজ্ঞাসা করলো, হুর! কি হল? তোমার এই অবস্থা কেন? তোমাকে অস্থির দেখা যাচ্ছে কেন? আমি তোমাকে অনেক বড় বড় যুদ্ধের ময়দানে দেখেছি। কিন্তু কোন সময় তোমাকে আমি এ রকম অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখিনি। কিন্তু এখন তোমার এই অবস্থা কেন? হুর বললেন, 'কি বলবো! আমি আমার একদিকে বেহেশত দেখছি আর এক দিকে দোযখ৷ মাঝখানে অস্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছি এবং কি করব তা চিন্তা করছি। একপাশ আমাকে দোযখের দিকে টানছে আর আরেক পাশ বেহেশতের দিকে আহবান করছে৷' 

      এরপর তিনি ঘোড়াকে চাবুক মেরে এক নিমিষে এজিদ বাহিনী থেকে বের হয়ে এসে বললেন, ‘যেতে হলে বেহেশতেই যাব।’
হুর ইমাম হুসাইনের কাছে এসে বললেন, 'আপনি আমার জন্য দোয়া করুন, আল্লাহ তায়ালা যেন আমার বিগত দিনের পাপ মাফ করে দেন এবং আমার গড়িমসিকে ক্ষমা করে দেন। আমি আপনার পক্ষে জান কোরবান করার জন্য প্রস্তুত।' 

     এ বলে হুর কোমর থেকে তলোয়ার বের করে এজিদ বাহিনীর সামনে গেলেন। হুরকে দেখে এজিদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর বিন সাদ সৈন্যদেরকে বললো, 'দেখ, হুর ছিল আমাদের বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ। সে এখন আমাদের শত্রুদের হাতে হাত মিলিয়েছে। সে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে৷ তোমরা তাকে এমন শিক্ষা দাও, যেন তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে শিক্ষণীয় হয়ে থাকে।' এরপর এজিদ বাহিনী ইমাম হুসাইনের প্রায় ৮০ সদস্যের কাফেলার উপর চারিদিক থেকে আক্রমণ শুরু করলো৷ ভাগ্যবান হুরও এমন জোরে আক্রমণ শুরু করে দিলেন যে, এজিদ বাহিনীর জন্য যেন আল্লাহর গযব নাযিল হলো। শেষ পর্যন্ত তিনি ক্ষত-বিক্ষত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। যুদ্ধে ইমাম কাফেলার ৭০-৮০ জন সদস্য শাহাদত বরণ করেন৷ তাঁবুতে থাকা ইমাম হুসাইনের এক ছেলে ও নারী-শিশুরা বেঁচে যান৷ শাম্মার নামের এক অভিশপ্ত নিহত ইমামের মাথা কেটে সেটি উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের কাছে পাঠিয়ে দেয়৷ উবাইদুল্লাহ সেটি দামেস্কে এজিদের কাছে পাঠিয়ে দেয়৷ 
ইমাম সুয়ূতী 'তারীখুল খুলাফা' গ্রন্থে লিখেছেনঃ
"ولما قُتل الحسين وبنو أبيه، بعث ابن زياد برؤوسهم إلى يزيد، فسُرَّ بقتلهم أولاً، ثمَّ ندم لمَّا مقته المسلمون على ذلك، وأبغضه الناس، وحُقَّ لهم أن يُبغضوه". تاريخ الخلفاء [ص208]:
অর্থঃ "যখন হুসাইন ও তাঁর ভাইদের হত্যা করা হলো, তখন ইবনে জিয়াদ তাদের কর্তিত মাথাগুলো এজিদের কাছে পাঠিয়ে দিল৷ এজিদ তাদের হত্যাকাণ্ডে প্রথমে আনন্দিত হলো৷ পরে মুসলমানরা যখন তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করলো, তখন লজ্জিত হলো৷ মুসলমানরা তাকে ঘৃণা করে৷ আর তাকে ঘৃণা করা তাদের জন্য উচিতও বটে৷" (সূত্রঃ তারীখুল খুলাফা, পৃষ্ঠা- ২০৮)

      কারবালার পর হতভাগা এজিদ বিন মুয়াবিয়া ও তার সেনাপতি উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের দ্বিতীয় অমার্জনীয় অপরাধ হচ্ছে, ৬৩ হিজরীতে মদীনাবাসীর উপর আক্রমণ ও লাগাতার তিনদিন ব্যাপক আকারে খুন-ধর্ষণ৷ এ ব্যাপারে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী বলেছেনঃ
"وقعة الحرة التي اجمع المؤرخون على وقوعها حيث اكدوا مقتل ثمانين من اصحاب النبي ولم يبقى بدري بعد ذلكـ وكان سببها أن أهل المدينة خلعوا بيعة يزيد بن معاوية لما بلغهم ما يتعمده من الفساد".
অর্থঃ "ঐতিহাসিকগণ হাররার ঘটনার সত্যতার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন, যে ঘটনায় ৮০জন সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন। এ ঘটনার পর আর কোন বদরী ছাহাবী জীবিত থাকেননি। আর এর কারণ ছিল, ইচ্ছাকৃত ভাবে দুর্বৃত্ততায় জড়িত থাকার কারণে এজিদের প্রতি তাদের বাইয়াত প্রত্যাহার করে নেওয়া৷" (সুত্রঃ ফতহুল বারী:৮/৬৫১)

    এজিদের তৃতীয় অমার্জনীয় অপরাধ হলো, ৫০ হিজরীতে ইমাম হাসানকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা৷ 
    ভারতীয় উপমহাদেশের একজন মুহাদ্দিছ আল্লামা আজিমাবাদী তাঁর কৃত সুনানে আবু দাউদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ আউনুল মাবূদে (১১/১২৭) বিষয়টি উল্লেখ করেছেন৷

     এজিদে চতুর্থ অপরাধ ছিল হাররার ঘটনার পর তার নরাধম বাহিনীকে আবদুল্লাহ বিন যুবাইরের কাছ থেকে মক্কা দখলের জন্য প্রেরণ৷ ওই বাহিনী মক্কায় গিয়ে মক্কার পবিত্রতা লঙ্ঘন করেও সেটি দখল করতে ব্যর্থ হয়৷ পরে হঠাত এজিদের মৃত্যুর খবর এলে তার বাহিনী মক্কা ছেড়ে দামেস্কে পালিয়ে যায়৷

    প্রসঙ্গত, এজিদের জন্ম হিজরী ২৩-২৬ হিজরীতে৷ আর ইমাম হুসাইনের জন্ম চতুর্থ হিজরীতে৷ ৫৭ বছর বয়সী ইমামকে খুনের সময় এজিদের বয়স ছিল ৩৫-৩৮ বছর৷ 
তবে স্বস্তির বিষয় হলো, খুনী এজিদসহ নবী পরিবারের ঘাতকদের সকলের অকাল ও করুণ মৃত্যু হয়েছে৷ তন্মধ্যে ৬৪ হিজরীতে হার্ট এট্যাকে মারা যায় এজিদ৷ আবদুল্লাহ বিন যুবাইরের মক্কা কেন্দ্রিক খেলাফতের সময় ৬৭ হিজরীতে উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদকে খুন করেন ইব্রাহীম বিন মালিক নাখয়ী, ৬৬ হিজরীতে খারেজী দলের সাবেক সদস্য শাম্মারকে شَمر بن ذي الجوشن খুন করে মাথা আলাদা করেছিলেন তায়েফের মুখতার আছ-ছাকাফী (জুনিয়র ছাহাবী এই ছাকাফী হলেন শিয়াবাদ তথা স্বার্থপর ও অজ্ঞতাপূর্ণ আহলে বাইত ভক্তির অন্যতম জনক)৷ একই সময় ওমর বিন সাদকেও হত্যা করে মুখতার আছ-ছাকাফীর বাহিনী৷ ছহীহ মুসলিমের (২৯৬৫) একটি হাদীছে দেখা যাচ্ছে, ওমর বিন সাদের মত দুষ্ট সন্তানটির অনিষ্টতা থেকে তার পিতা হযরত সাদ বিন আবী ওয়াক্কাছ আল্লাহ্‌র কাছে পানাহ চেয়েছিলেন৷

       মহান রব আমাদেরকে নাসেবী, খারেজী ও রাফেজীসহ সকল দুষ্ট সম্প্রদায়ের অপপ্রচার ও অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করুন৷
৩০.০৮.২০২০-ইং, রবিবার। 
-------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ প্রবন্ধ লেখক ও মাওলান।  

Post a Comment

0 Comments