Recent Tube

মুসলিম উম্মাহর ঐক্য: পথ ও পদ্ধতিঃ, মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।

     মুসলিম উম্মাহর ঐক্য: পথ ও পদ্ধতিঃ

   ইসলামের মূলভিত্তি অর্থাৎ যে বিষয়গুলোতে বিশ্বাস এবং কর্মগুলো না করলে একজন ব্যক্তি মুসলমান থাকেন না সে বিষয়গুলো ব্যতীত অন্যান্য সকল বিষয়ের মতানৈক্য বজায় রেখেও মুসলমানদের পক্ষে ব্যাপকভাবে
ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব।


এক্ষেত্রে আরব, অনারব, মাজহাবপন্থী-
মাজহাব বিরোধী, দেওবন্দী, ব্রেহলবী, জামাআতে ইসলামী, আহলে হাদীস,
কেয়ামী, বেকেয়ামী, পীরবাদী-পীরবিরোধী,
সুফীবাদী-সুফীবাদবিরোধী, তাবলিগী-তাবলীগবিরোধী, কট্টর শরীয়তপন্থী–কট্টর
মারেফতপন্থী, মৌলবাদী-মৌলবাদবিরোধী ইত্যাদি পরিচয়ের সঙ্গে যে অমৌলিক বিরোধের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে তা বজায় রেখেও মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। ব্যক্তি ও গৌষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে ইসলাম ও
মুসলমানদের স্বার্থ বিবেচনা করা হলেও
উপর্যুক্ত প্রশ্নে মতপার্থক্য কমিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্যের সততাই
একান্তভাবে প্রয়োজন।


মুসলমানদেরকে স্মরণ রাখতে হবে যে,

চিন্তা ও কর্মক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ঐক্য অর্জন কখনো সম্ভব হবে না। এটি মানুষের সহজাত
প্রবণতা বিরোধী এবং এ কারণে তা কাম্যও হতে পারেনা। মুসলমানদের লক্ষ্য হবে একটি working unity অর্জন– যা দ্বারা তারা নিজেদের মধ্যকার অপ্রয়োজনীয়
মতভেদ দূর করতে সক্ষম
হবেন।


অত্যন্ত পরিতাপের
বিষয় হলো, মুসলিম
জনগণের সেই
অংশের মধ্যে
অনৈক্য তত বেশি,
ধর্মশাস্ত্র বিষয়ে
যারা যত বেশি
শিক্ষিত।


বাংলাদেশের
আলেমদের অনৈক্য ও
দলাদলিতে হতাশা
ব্যক্ত করে একজন
খ্যাতনামা ধর্মীয়
নেতৃত্ব একসময় মন্তব্য
করেছিলেন:
‘বাংলাদেশের
আলেমরা একটি
বিষয়েই কেবল
ঐক্যমত্য পোষণ করেন।
সেটি হচ্ছে তারা
কখনো ঐক্যবদ্ধ হবেন
না।’

 ইসলামের
ইতিহাস
পর্যালোচনা করলে
দেখা যাবে,
সাধারণ মুসলিমরা
কখনো অনৈক্যের
কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি।
সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম
বিষয়ে মুসলিম
পণ্ডিতরাই প্রথমে
বিভক্ত হয়েছেন। এসব
পণ্ডিতগণ
পরবর্তীকালে
সাধারণ মুসলমানদের
একটি অংশকে
নিজের মতানুসারী
করে মুসলমানদেরকে
নানা মত, পথ ও
ফেরকায় বিভক্ত
করেছেন। গড়ে
তুলেছেন বিভিন্ন
সংগঠন। এসব বিশেষ
মত ও পথের প্রবক্তা
এবং সংগঠনের
নেতৃত্বকে অনুধাবন
করা দরকার, তারা
যে মত, পথ ও কর্মসূচি
অনুসরণ করছেন সেটি
ইসলাম ও মুসলমানদের
কল্যাণের লক্ষ্যে
পরিচালিত আরো
অনেক মত, পথ ও
সংগঠনের মতোই
একটি মাত্র; একমাত্র
বা পূর্ণাঙ্গ নয়। আরো
অনেকে একই লক্ষ্যে
কাজ করছেন। সব
ইসলামী সংগঠন এবং
তার নেতৃত্ব এ বোধে
চালিত হলে মুসলিম
ঐক্য প্রতিষ্ঠা অনেক
সহজতর হবে।


ইসলামের গভীর
বিষয়গুলোতে খুব
বেশি জ্ঞাত না
হয়েও সাধারণ
মুসলমানরা কেবল
ইসলাম ও মুসলমানের
নামে ব্যাপক
কোরবানী দিতেও
দ্বিধা করেনি।
খেলাফত আন্দোলন,
ফিলিস্তিনের মুক্তি
আন্দোলন, কাশ্মীর,
বসনিয়া, চেচনিয়া,
রুশ আধিপত্যবাদবিরোধী
আফগানদের সংগ্রাম,
ইরাকের বিরুদ্ধে
মার্কিন আগ্রাসন
ইত্যাদি ঘটনার দলমত
নির্বিশেষে
সাধারণ মুসলমানরা
ব্যাপক ঐক্যের পরিচয়
দিয়েছেন।


মুসলিম ধর্মশাস্ত্র
বিশেষজ্ঞ ও নানা
পর্যায়ের ধর্মীয়
নেতৃত্বকে আর একটি
বিষয়ে সচেতন হওয়া
প্রয়োজন। ইসলামের
অনেক বিষয় বোঝার
জন্যে গভীর
অন্তর্দৃষ্টি ও দার্শনিক
জ্ঞান থাকা
প্রয়োজন। ইলমে
মারেফাতের জটিল
বিষয়সমূহ সাধারণ
মুসলামনদের জ্ঞাত
হওয়ার প্রয়োজনও
নেই। এ বিষয়গুলো
কেবলমাত্র জ্ঞানী
লোকদের
একাডেমিক
আলোচনার বিষয়
হওয়া উচিৎ। সাধারণ
আলোচনায় এসব বিষয়
এনে মুসলিম ঐক্যকে
ক্ষতিগ্রস্ত করা সঙ্গত
কাজ হবে না।


ইতিহাস প্রমাণ করে
যে, সাধারণ
মুসলমানরা সাধারণত
ঐক্যবদ্ধ থাকে।
অসাধারণ মুসলমানরা
ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল,
মত ইত্যাদির নামে
সাধারণ
মুসলমানদেরকে
বিভক্ত করে। এ
জাতীয় অসাধারণ
মুসলমানরা অর্থাৎ
নানা ক্ষেত্রের
মুসলিম নেতৃত্ব যদি
ইসলাম ও মুসলমানদের
স্বার্থের প্রশ্নে সৎ
হন, শিক্ষিত হন,
প্রশিক্ষিত হন, আধুনিক
হন, পরমত সহিষ্ণু হন,
দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হন
তাহলে ব্যাপক
মুসলিম ঐক্য
সময়সাপেক্ষ ও
কষ্টসাধ্য হলেও
অসাধ্য নয়। মুসলিম
নেতৃত্বের দায়িত্ব
হচ্ছে মুসলমানদের
যোগ্য শিক্ষায়
শিক্ষিত ও
প্রশিক্ষিত করে
তোলা। যাতে
তারা ইহকালীন
জীবনেও যে কোনো
প্রতিযোগীতায়
বিজয়ী হতে পারে।
এক্ষেত্রে মুসলিম
মানবসম্পদ উন্নয়নেরে
আর কোনো বিকল্প
নেই।


উপরিউক্ত বিষয়াবলী
ছাড়াও মুসলিম ঐক্য
প্রতিষ্ঠার
পাশাপাশি পরিবেশ
সৃষ্টি এবং কার্যকর
ঐক্য গড়ে তোলার
লক্ষ্যে নিম্নোক্ত
ব্যবস্থাবলী গ্রহণ করা
যেতে পারে:


১) মুসলিম ধর্মীয়
নেতৃত্ব ও
ধর্মশাস্ত্র বিষয়ক
পণ্ডিতগণ এ
বিষয়ে ওয়াদাবদ্ধ
হবেন যে, কোনো
অবস্থাতেই
তারা
মুসলমানদের ঐক্য
ক্ষতিগ্রস্ত হবে
এমন কোনো বিষয়
সাধারণ্যে
প্রকাশ করবেন না,
প্রকাশ্য
আলোচনায়
আনবেন না।


২) বিতর্কের
ঊর্ধ্বে নয়, কিন্তু
মুসলমানদের
ধর্মীয় ও জাগতিক
জীবনকে
প্রভাবিত করবে
এমন বিষয় সম্পর্কে
আলোচনা ও
সিদ্ধান্তে
উপনীত হওয়ার
জন্যে বিভিন্ন
দেশের আলেম ও
জ্ঞানী ব্যক্তিগণ
স্ব স্ব দেশে প্রতি
বছর অন্তত একবার
সম্মেলনে
মিলিত হবেন। এ
সম্মেলনে
কোরআন, হাদীস ও
অন্যান্য
ইসলামসম্মত পদ্ধতি
অনুসরণ করে এবং
বাস্তব অবস্থাকে
বিশেষ
বিবেচনায় এনে
বিতর্কিত
বিষয়সমূহে
সিদ্ধান্তে
উপনীত হওয়ার
প্রয়াস চালানো
হবে।

৩) পালাক্রমে
একই উদ্দেশ্যে
বিভিন্ন মুসলিম
দেশে মুসলিম
পণ্ডিতদের
আন্তার্জাতিক
সম্মেলন
আয়োজিত হবে।


৪) ইসলাম ও মুসলিম
বিশ্বকে
বিশ্ববাসীর
সামনে
যৌক্তিকভাবে
উপস্থাপনের
জন্যে ওআইসি বা
এ জাতীয় কোনো
সংস্থার
উদ্যোগে একটি
শক্তিশালী
স্যাটেলাইট
মিডিয়া
সেন্টার এবং
সংবাদ সংস্থা
প্রতিষ্ঠার
ব্যবস্থা করতে
হবে।

৫) জ্ঞান-
বিজ্ঞানের
নানা শাখায়
মুসলিম
গবেষকদেরকে
ইসলামী
পরিবেশে
স্বাধীনভাবে
গবেষণা করার
সুযোগ দানের
জন্যে ওআইসি’র
উদ্যোগে
বিভিন্ন মুসলিম
দেশে গবেষণা
কেন্দ্র স্থাপন
করতে হবে।


৬) মুসলিম
দেশসমূহের মধ্যে
শিক্ষা,
সংস্কৃতি, ব্যবসা-
বাণিজ্যসহ সকল
বিষয়ে
যোগাযোগ
সহজতর এবং বৃদ্ধি
করতে হবে।

৭) মুসলিম
দেশসমূহের
মধ্যকার
পারস্পরিক
বিরোধ
নিরসনকল্পে
রাষ্ট্রীয়
প্রচেষ্টার
বাইরে মুসলিম
পণ্ডিতগণেরও
প্রয়াস চালানোর
ব্যবস্থা নিতে
হবে।

৮) মুসলিম ঐক্য
প্রতিষ্ঠায়
কার্যকর ভূমিকা
পালনকারী
ব্যক্তিত্বদেরকে
জাতীয় ও
আন্তর্জাতিকভাবে
স্বীকৃতি দেয়ার
কার্যকর পদক্ষেপ
নিতে হবে।
বাংলাদেশ একটি
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ
রাষ্ট্র। বিশ্বের অন্য
যে কোনো
মুসলিমপ্রধান
রাষ্ট্রের তুলনায়
বাংলাদেশের
মুসলমানদের পক্ষে
কার্যকরভাবে ঐক্যবদ্ধ
হওয়া সহজতর।
এখানকার মুসলিম
সংখ্যাগরিষ্ঠ
অংশের মধ্যে ধর্মের
মৌলিক প্রশ্নে
কোনো বিরোধ নেই।
বেশিরভাগ মুসলিম
একই ভাষা, সংস্কৃতি,
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের
উত্তরাধিকারী।

বাংলাদেশের
ধর্মীয় নেতৃত্ব সৎ ও
আন্তরিক হলে
এখানকার
মুসলমানদের মধ্যে
কেয়ামী-
বেকেয়ামী,
মাজারপন্থী-মাজার
বিরোধী, ইসলামী
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার
সমর্থক ও কট্টর
বিরোধী− এ সকল
পক্ষের মধ্যে
মতপার্থক্য
অনেকখানি কমিয়ে
এনে ব্যাপক ঐক্য
প্রতিষ্ঠা মম্ভব।
এক্ষেত্রে উদারতা ও
পরমত সহিষ্ণুতা হবে
প্রধান পাথেয়।
বাংলাদেশসহ সমগ্র
মুসলিম জাহানের
বিভিন্ন মত, পথ ও
পর্যায়ের নেতৃত্বকে
অনুধাবন করতে হবে
যে, ইসলাম ও
মুসলমানরা আজ
বিশ্বব্যাপী ব্যাপক,
নির্যাতন, অবিচার ও
ষড়যন্ত্র শিকার। এ
অবস্থা থেকে
পরিত্রাণের লক্ষ্যে
নিজেদের
গুণগতভাবে সমৃদ্ধ
করতে হবে। হতে হবে
ব্যাপকভাবে ঐক্যবদ্ধ।

ঐক্য প্রতিষ্ঠার
বিষয়ে একজন সৎ ও
আন্তরিক মুসলমান এ
কারণেই প্রত্যয়ী হতে
পারেন যে, ধর্মের
মৌল বিষয়ে অন্তত
সংখ্যাগরিষ্ঠ
মুসলমানদের মধ্যে
কোনো ব্যাপক
বিরোধ নেই। মুসলিম
ধর্মীয় নেতৃত্ব ও
ধর্মশাস্ত্র
বিশেষজ্ঞগণ সৎ ও
নিষ্ঠাবান হলে গৌণ
বিষয়াবলীর বিরোধ
পরিপূর্ণভাবে দূরীভূত
করা সম্ভব না হলেও
হ্রাস করতে অবশ্যই
সক্ষম হবেন। এক্ষেত্রে
বিভিন্ন মতের ঐক্য
(Unity in Diversity)
নীতি গ্রহণীয় হতে
পারে। মুসলমানরা
নিষ্ঠা ও
আন্তরিকতার সঙ্গে
ঐক্যবদ্ধ হতে চাইলে
আল্লাহর সাহায্যও
অবশ্যই লাভ করবে।
কারণ:

َِّۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا۟ مَا بِأَنفُسِهِمُْۗ 

 “আল্লাহ
তায়ালা কখনো
কোনো জাতির
অবস্থার পরিবর্তন
করেন না, যতক্ষণ না
তারা নিজেরা
নিজেদের অবস্থা
পরিবর্তন করে।” (আল
কোরআন: ১৩:১১)।
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলানা।         

Post a Comment

0 Comments