Recent Tube

আহা মহামতি আকবর! জিয়াউল হক।


      আহা মহামতি আকবর!


   সম্রাট আকবরের দাঈ’মা ছিলেন যে নারী, তার নাম ছিল মাহাম আগা। আকবরের উপরে তার প্রভাব ছিল খুব বেশি। আকবরও সম্মান করতেন। মাহাম আগা ছিলেন উচচাভিলাসী নারী। কিন্তু আকবর তো আকবরই। চরম নারী লোলুপ নৃশংস আর গোঁয়ার আকবর ভিন্ন ধাঁচে গড়া, মাহাম আগা তার দাঈ মা হয়েও সেটা বুঝতে পারেনি, সেটাই বড় বিষ্ময়ের ব্যাপার। মাহাম আগা’র এক ছেলে ছিল, ছেলেটার নাম আদম খাঁন, আকবরের বয়সী ও তার দুধ ভাই। ছোটকালে দু’জনে একত্রে খেলে বেড়িয়েছেন আপন ভাইয়ের মতোই। উভয়ের মধ্যে সখ্যতাও বেশ।
ষষ্টদশ শতাব্দির মধ্যভাগ; ১৫৬২ সালের মে মাসের ঘটনা। খাওয়া দাওয়ার পর আকবর এক দুপুরে হেরেমে বিশ্রামরত। পাশের বারান্দায় তারই বিশ্বস্থ ও নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী আতকাহ খাঁন বসে বসে দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত। এমন সময় আকবরের দুধ বাই, মাহাম আগা’র সেই ছেলে আদম খান কিছু সহচর’সহ হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো।
টার্গেট ঠিক ছিল, তারাও যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিয়েই ঢুকেছিল। মাত্র সাতমাসের প্রধানমন্ত্রী আতকাহ খাঁনকে সামনে পেয়েই কোনরকম সুযোগ না দিয়েই তলোয়ার চালিয়ে দিলে তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করলেন। দৃষ্কৃতিকারীরা হেরেমের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই হৈ চৈ শুনে প্রাসাদের প্রহরীরা হেরেমের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিলে তারা ভেতরে ঢুকতে ব্যার্থ হয়।
ওদিকে হৈ চৈ শুনে আকবরও বাইরে বেরিয়ে এসে আতকাহ খাঁনকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে বুঝে ফেলেন প্রাসাদ ক্যু হচ্ছে, তিনি ঝুঁকির মুখে! এদিক ওদিকে চোখ তাকিয়ে খুঁজতে থাকেন কারা এ কান্ড ঘটালো?ঠিক এমন সময় পর্দার আড়াল থেকে আচমকা বেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো আদম খাঁন। দেরি না করে সে আকবরের একটা হাত ধরে ফেললো। আকবর একবারমাত্র চোখ তুলে দেখলেন তার হাতটা কে ধরলো না, তিনি ভুল দেখছেন না ।
তারই খেলার সাথী, ছোটবেলার বন্ধু, দুধ ভাই আদম খাঁন! একটা পলক মাত্র, স্বিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে দেরি করলে তার মাশুল গুনতে হবে জীবন দিয়ে। গোঁয়ার আকবর এ কাজে খুব পটু, ত্বরিৎ করণীয় স্থির করতে তিনি বরাবরই পারঙ্গম। তা না হলে কি দাদা বাবর ও বাবা হুমাইউনের রেখে যাওয়া দূর্বল এ সাম্রাজ্যকে এভাবে ধরে রাখতে পারতেন?
বেশি ভাববার সময় আকবরের নেই, তিনি তার সবল বাহু তুলে ঝড়ের গতিতে আদম খাঁনের মুখ বরাবর একটা ঘুঁষি চালিয়ে দিলেন। বেশি না, মাত্র একটা। উনিশ বৎসর বয়সী তাগড়া যুবক আকবরের গায়ে কতটা শক্তি ছিল সেটা আদম খাঁন টের পেলো বটে কিন্তু তা বলার মত জ্ঞান থাকলো না, অজ্ঞান হয়ে ছিটকে গিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকলো।
চারিদকি থেকে ততক্ষণে প্রহরীরা দৌড়ে এসেছে। রাগে, ক্ষোভে আর বিষ্ময়ে আকবর ফুঁসছেন। প্রহরীদের নির্দেশ দিলেন, জ্ঞান হারা আদম খাঁনের শরীরটাকে তিন তলার বেলকনি থেকে নীচে ছুঁড়ে ফেলতে। হুকুম তামিল করা হলো। কই মাছের প্রাণ আদম খাঁন মরলো না, তুলে এনে আবারও ছুঁড়ে ফেলা হলো তিন তলা থেকে। এবারে অবশ্য কাজটা পুরোপুরিই সমাধা হলো।
বিশ্বাসঘাতক ছেলে আদম খাঁন যে এতদূর এগিয়ে স্বয়ং সম্রাটকেই হত্যা করতে এসেছে, সেটা কি মা মাহাম আগা জানেন না? অবশ্যই জানেন। মাহাম আগা'র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইশারা ছাড়া তার রাজমহলে কোন কাজ হয় না। পেটের সন্তান আদম খাঁনের এ পরিকল্পনা তিনি জানেন না, সেটা আকবর বিশ্বাস করেন না।
হেরেমের ভেতরের এ ঘটনা মাহাম আগা ইতোমধ্যেই কি শুনেছেন? আমরা জানি না।  আকবর মাথা ঠান্ডা রাখলেন। দাঈ মা মাহাম আগাকে তার সাথে খাবারের আমন্ত্রণ জানালেন। খাবার টেবিলে বসে খেতে খেতে স্বয়ং আকবরই দুধ মাকে খুব শান্ত কন্ঠে, যেন তেমন বিশেষ কিছুই ঘটেনি, এমন ভঙ্গিতে আদাম খাঁনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার খবরটি দেন। ঐ যে, শিকার করে এসে বাঘ কিংবা হরিন শিকারের গল্প যেভাবে করতেন, ঠিক সেভাবে!
পেটের সন্তনের নির্মম মৃত্যুর খবরটা মা মাহাম আগা চুপ চাপ শুনলেন, কিন্তু মায়ের মন বলে কথা! নীরবে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন একটু পরেই।সন্তানের এ শোচনীয় পরিণতির পরে অবশ্য হতভাগিনী আর বেশিদিন বাঁচেন নি। মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই তিনি অসুখে পড়েন এবং মারা যান।
কুতুব মিনারের পাশে, লাল কেল্লার দক্ষিণ দিকে সম্রাট আকবর নিজ হাতে খুঁন করা তার দুধ ভাই আদম খাঁনের স্মৃতিতে একটা সমাধি বানিয়ে দেন। আজও সে সমাধি সেখানে রয়ে গেছে। আহা মহামতি আকবর!
------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।            

Post a Comment

0 Comments