Recent Tube

মসজিদ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় যোগ্য যারা এবং মসজিদ পরিচালনার মূলনীতি ; ৷ শামীম আজাদ।

মসজিদ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় যোগ্য যারা এবং মসজিদ পরিচালনার মূলনীতি। 
------------------------------------------------- 

  সাধারণ অর্থে মসজিদ মুসলমানের নামাজের ঘর হলেও মসজিদ শুধু নামাজের স্থান নয়, বরং মুসলমানদের সব ধরনের কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু। মসজিদ মুসলমানদের শিক্ষালয়, পরামর্শ সভাস্থল ও সমাজ-সংস্কৃতির উৎসস্থল।

সাধারণ অর্থে মসজিদ মুসলমানের নামাজের ঘর হলেও মসজিদ শুধু নামাজের স্থান নয়, বরং মুসলমানদের সব ধরনের কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু। মসজিদ মুসলমানদের শিক্ষালয়, পরামর্শ সভাস্থল ও সমাজ-সংস্কৃতির উৎসস্থল।

শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ  মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে রাষ্ট্রের সচিবালয় ছিল মসজিদে নববী। তিনি সেখানে লোকদের কুরআন শিক্ষা দিতেন, মানুষকে আধ্যাত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ করতেন, জ্ঞান শিক্ষা দিতেন, মামলা-মোকাদ্দমার বিচার করতেন। ইসলামি রাষ্ট্রের সংহতি ও সমৃদ্ধির জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরামর্শ সভা করতেন, বিয়ে পড়াতেন, এমনকি যুদ্ধের কৌশল নিয়ে সাহাবিদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদে এমন আরও অসংখ্য কাজ করেছেন বলে হাদীসে উল্লেখ আছে।

বর্তমানে আমাদের সমাজে মসজিদ আছে, মিম্বর আছে, মসজিদে নামাজও হচ্ছে। কিন্তু মসজিদের কর্মসূচিগুলো দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে গেছে। মসজিদগুলো ধীরে ধীরে প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছে। মসজিদগুলো পরিণত হয়েছে শুধু ইবাদতের জায়গায়।

ইসলামি সমাজ ও সংস্কৃতির উৎসস্থল মসজিদের সেবা ও তত্ত্বাবধানের কাজে যারা আছেন বিষয়টি নিয়ে তারা ভাবেন কিনা- বলা মুশকিল। অথচ ইসলামে মসজিদ পরিচালনাকারীদের আলাদা ফজিলতের কথা বিবৃত হয়েছে। এখন যদি মসজিদের খাদেম, কমিটি, তত্ত্বাবধায়ক কিংবা পরিচালনায় নিযুক্তরা মসজিদের কর্মসূচিতে ভিন্নতা এনে মসজিদগুলোকে আবাদের পরিবর্তে মসজিদগুলোকে প্রাণহীন করে তুলেন, তবে সেটা কী ইসলাম সম্মত হবে?

পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, ইসলামের আকিদা বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যাদের কমতি অাছে; তারা মসজিদের খেদমতের জন্য কোনোভাবেই উপযুক্ত নয়। তাহলে মসজিদের সেবা করবেন কারা?

আলোচ্য বিষয়ে পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, 

إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللّهِ مَنْ آمَنَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلاَةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلاَّ اللّهَ فَعَسَى أُوْلَـئِكَ أَن يَكُونُواْ مِنَ الْمُهْتَدِينَ
‘আল্লাহর মসজিদ আবাদকারী (তত্ত্বাবধায়ক ও খাদেম) তো সে লোকেরাই হতে পারেন, যারা আল্লাহ এবং পরকালকে বিশ্বাস করেন, নামাজ কায়েম করেন, যাকাত দেন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করেন না। তাদের সম্পর্কেই এ আশা করা যায় যে, তারা সঠিক-সোজাপথে চলবে।’ 
সূরা আত-তওবাঃ ১৮

উপরোক্ত আয়াত থেকে মসজিদ পরিচালনায় নিযুক্তদের যে অত্যাবশ্যকীয় যোগ্যতাগুলো থাকতে হবে তা নিম্নরূপ-

এক. তাদের ঈমানদার হতে হবে।

দুই. পরকালের বিশ্বাস এবং জবাবদিহিতা তীব্র অনুভূতি তাদের থাকতে হবে।

তিন. তারা নামাজ কায়েম করবে।

চার. তারা যাকাত দানে অভ্যস্ত হবে।

পাঁচ. তারা নির্ভীক হবে। সত্য উপস্থাপন করতে তারা কারো সমালোচনা বা রক্তচক্ষুকে ভয় পাবে না।

মসজিদের খাদেম বলা হয় তাদের, যারা মসজিদ প্রতিষ্ঠা, সম্প্রসারণ, পরিচালনা ও উন্নয়নের কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করেন। মসজিদের খেদমত একটি মহান কাজ। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর ফজিলত সম্পর্কে বহু বাণী উপস্থাপিত হয়েছে। আর এ কারণেই এ কাজে সম্পৃক্ত হওয়াকে মুসলমানরা সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করেন। এজন্য আমরা যারা আল্লাহর ঘরের সেবা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করব, তাদের এ গুণগুলো অর্জন করতে হবে।

কারণ এ শর্ত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আরোপিত। আর আমরা যারা মসজিদের তত্ত্বাবধায়াক নির্বাচন করব তাদেরও লোক বাছাইয়ের জন্য কুরআনের আরোপিত শর্তগুলোকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে নিছক রাজনৈতিক প্রভাব বলয় বা অন্য কোনো বৈষয়িক বিষয়কে অধিক গুরুত্ব প্রদান করলে পবিত্র কুরআনের শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হবে।

পবিত্র কুরআনে আরোপিত শর্তগুলোর প্রথমটিতে বলা হয়েছে-

যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। আল্লাহর ‘জাত’ ‘সিফাত’ (গুণ) ‘হুদুদ’ ও ‘ইখতিয়ার’ (ক্ষমতা) বিষয়ক বিশ্বাসগুলো অন্তরের সঙ্গে মেনে নেওয়া, মুখে তা প্রকাশ করা এবং জীবন ও কর্মে সেই বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোই হলো ঈমান। এ তিনটি বিষয়ের সমন্বয়কেই ঈমান বলা হয়।

দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়েছে, পরকালে বিশ্বাস করে অর্থাৎ তার মধ্যে তার কাজের ব্যাপারে শুধু মসজিদের অডিটরের কাছে জবাবদিহিতার ভয় নয় বরং পরকালে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার তীব্র অনুভূতি থাকে। এ অনুভূতি তার হিসার-নিকাশে স্বচ্ছতা নিয়ে আসে।

তৃতীয় শর্তে বলা হয়েছে, তারা নামাজ কায়েম করে। মসজিদের খাদেম তথা কমিটির একজন সদস্যকে এ ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন এবং সচেষ্ট হতে হবে। সাপ্তাহিক বা বার্ষিক মুসল্লি দিয়ে এ কাজটি চলতে পারে না।

চতুর্থ শর্তে বলা হয়েছে, তারা যাকাত প্রদান করে। অর্থাৎ অর্থলিপ্সা তাদের পেয়ে বসে না। উপার্জিত সম্পদ তারা খোদার নিয়ম অনুযায়ী ব্যয় করে। তারা কেবল ভোগই করে না, ত্যাগ করতেও জানে।

পঞ্চম শর্তে বলা হয়েছে, তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। অর্থাৎ সব কাজে তারা আল্লাহকে ভয় করে এবং সত্য প্রকাশে তারা নির্ভীক। সত্য উপস্থাপন করতে তারা নিন্দুকের সমালোচনা বা অপশক্তির রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না।

মসজিদ পরিচালনার মূলনীতিঃ

মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় জীবনে মসজিদের প্রভাব অপরিসীম। মুসলিম সমাজের জ্ঞানচর্চা, ধর্মীয় অনুশীলন থেকে শুরু করে সামাজিক ঐক্য ও সম্মিলিত কর্মকাণ্ডের অনেকটাই মসজিদের ওপর নির্ভরশীল।

মসজিদ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের উৎসভূমি। এটি মুসলমানদের আশ্রয়স্থল। মুসলমানরা দিনে পাঁচবার মসজিদে যায়। সেখানে সালাত আদায় করে। তারা মসজিদে আল্লাহর কাছে দয়া, ক্ষমা, জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রার্থনা করে। মসজিদ যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাতিঘর, তেমনি ইবাদত-বন্দেগির মিহরাব।

তাই মসজিদ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিকরণ এবং সর্বোপরি যেকোনো চাহিদা পূর্ণ করে আল্লাহর ঘরের তত্ত্বাবধান করা প্রত্যেক মুসলিম সমাজের নৈতিক দায়িত্ব।

এ ক্ষেত্রে প্রথম করণীয় হলো, যথাসম্ভব মসজিদ আবাদ রাখতে হবে। আল্লাহর ইবাদত ও দ্বিনি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা প্রাণবন্ত করে রাখতে হবে। ইসলামের সোনালি যুগে ধর্মীয় শিক্ষা থেকে শুরু করে সামাজিক বিচার ও যুদ্ধের পরামর্শ পর্যন্ত সব কাজ মসজিদে অনুষ্ঠিত হতো। মসজিদে নববী ছিল মহানবী (সা.)-এর সচিবালয়ের মতো। এ জন্য কুরআনে মসজিদের ব্যাপারে ‘আবাদ’ শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, 

إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللّهِ مَنْ آمَنَ بِاللّهِ
‘নিশ্চয়ই মসজিদ আবাদ করবে, যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে।’ 
সূরা তাওবাঃ ১৮

মসজিদ আল্লাহর ঘর। আল্লাহর ইবাদত ও দ্বিনি কাজই শুধু সেখানে অনুমোদিত। ইসলামী শরিয়তবিরোধী এবং ইবাদতের পরিবেশ নষ্ট হয় এমন কোনো কাজ মসজিদে করা যাবে না। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, 

وَأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللَّهِ أَحَدًا
‘নিশ্চয়ই মসজিদগুলো আল্লাহর জন্য। সুতরাং আল্লাহর সঙ্গে কাউকে ডেকো না।’ 
সূরা জিনঃ ১৮

মসজিদ পরিচ্ছন্ন রাখাও মুসলিম সমাজের দায়িত্ব। মসজিদে ময়লা আবর্জনা ফেলবে না এবং কোনো ময়লা চোখে পড়লে তা নিজ থেকে পরিষ্কার করা উচত। 

حَدَّثَنَا آدَمُ، قَالَ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، قَالَ حَدَّثَنَا قَتَادَةُ، قَالَ سَمِعْتُ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ، قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ الْبُزَاقُ فِي الْمَسْجِدِ خَطِيئَةٌ، وَكَفَّارَتُهَا دَفْنُهَا ‏"‏‏.‏

আনাস ইব্‌নু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ মসজিদে থুথু ফেলা গুনাহের কাজ, আর তার কাফফারাহ (প্রতিকার) হচ্ছে তা দাবিয়ে দেয়া (মুছে ফেলা)। (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৯৮, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৪০৪)
বুখারী ৪১৫

ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে মসজিদের ব্যাপারে ছয় শ্রেণির মানুষ দায়িত্বশীল। তাঁরা হলেন ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম, মক্তব-পরিচালক, কমিটি ও দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা। প্রত্যেকের ওপর নির্ধারিত কিছু দায়িত্বও রয়েছে। যেমন—ইমাম যথাযথভাবে নামাজ করবেন এবং মুসল্লিদের দ্বিনি জ্ঞান, ঈমান ও আমলের উন্নয়নের চিন্তা করবেন। মুয়াজ্জিন যথাসময়ে আজান দেবেন। ইমামকে সহযোগিতা করবেন। খাদিমরা নিজ নিজ কাজ সম্পন্ন করবেন। মক্তব-পরিচালক মুসলিম শিশুদের ফরজ শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করবেন। কমিটি ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মসজিদ ও মুসল্লিদের প্রয়োজনগুলো পূরণের চেষ্টা করবেন। মসজিদের সার্বিক পরিচালনার ক্ষেত্রে ইমামকে পরামর্শ দেবেন এবং তাঁর থেকে পরামর্শ নেবেন। (আহকামুল মাসাজিদ ফিশ-শারিয়াতিল ইসলামিয়া, পৃষ্ঠা : ৪০৫-৮)

মসজিদ নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা মুসলমানদের ঈমানি দায়িত্ব ও কর্তব্য।

মসজিদ পরিচালনাকারী মানুষগুলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কুরআনের এক আয়াত থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, 

فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَن تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ. رِجَالٌ لَّا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاء الزَّكَاةِ يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ الْقُلُوبُ وَالْأَبْصَارُ
‘আল্লাহ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে সেই সব লোক, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ কায়েম করা থেকে এবং যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না।’ 
সূরা নুরঃ ৩৬-৩৭

এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, এমন মানুষের তত্ত্বাবধানে মসজিদ পরিচালিত হওয়া জরুরি, যাদের সঙ্গে মসজিদের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন রচিত হয়েছে, যারা সুখে-দুঃখে সব সময় মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকে। ইবাদত ও আমলের মাধ্যমে মসজিদকে আবাদ রাখে।

মসজিদকে সমুন্নত রাখা আল্লাহ তাআলার নির্দেশ। মসজিদকে সমুন্নত রাখার অর্থ হলো, যে উদ্দেশ্যে মসজিদের নির্মাণ সে উদ্দেশ্য যথার্থভাবে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা। মসজিদ নির্মাণ করা, সংস্কার করা, সম্প্রসারণ করা, ইবাদত-বন্দেগির পরিবেশ সৃষ্টি করা। যোগ্য ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেম নিয়োগ দেওয়া, তাঁদের সম্মানজনক সম্মানীর ব্যবস্থা করা, মসজিদকেন্দ্রিক দ্বিনি শিক্ষার ব্যবস্থা করা, এক কথায় সুচারুরূপে মসজিদ পরিচালনা করার সব বিষয়ই মসজিদ সমুন্নত করার অন্তর্ভুক্ত।

মুসলমান মাত্রই মসজিদের নির্মাণ, পরিচালনা বা রক্ষণাবেক্ষণের যেকোনো পর্বে অংশ নিতে পারাকে সৌভাগ্যের বিষয় মনে করেন। তাই বলে সামাজিকভাবে মুসলমান দাবি করলেই কেউ মসজিদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন না। তাঁকে ন্যূনতম কিছু বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতার অধিকারী হতে হয়। ওপরে উল্লিখিত আয়াতে সেসব বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মসজিদ আবাদ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাফসির বিশারদ আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘মসজিদ আবাদের অর্থ কেবল তার চাকচিক্য ও বাহ্যিক সৌন্দর্যবর্ধনই নয়, বরং মসজিদ আবাদ করার অর্থ তাতে আল্লাহর আলোচনা করা, আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা এবং মসজিদকে সব ধরনের শিরক ও পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রাখা।’ (ইবনে কাসির : ১/২৭০)

আল্লাহর ঘর মসজিদের দেখাশোনা করা, পবিত্রতা রক্ষা করা, পরিচালনা করা এবং মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা সাওয়াবের কাজ। অন্যদিকে মসজিদ পরিচালনা করতে গিয়ে যদি কেউ অনৈসলামিক কাজ করে তার পরিণামও খুব খারাপ। তাই মসজিদ কমিটির দায়িত্ব সম্পর্কে জানা কমিটির সদস্যদের জন্য ফরজ, যেন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আল্লাহর ঘর নিয়েই তারা পাপে জড়িয়ে না যায়। সুতরাং অমুসলিমরা যেমন মসজিদ পরিচালনায় যুক্ত হতে পারে না, তেমনি ইসলামের শর্তভঙ্গকারী কোনো মুসলিমও মসজিদ কমিটির সদস্য হতে পারে না। কারো সামাজিক ক্ষমতা বা আর্থিক প্রতিপত্তি থাকলেই তাকে মসজিদ পরিচালনার যোগ্য ভাবা সংগত নয়। মসজিদের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক পেশা বা স্বভাবের কেউ মসজিদ কমিটির যোগ্য হতে পারে না।

মসজিদে বহু মত, শ্রেণি ও পেশার মানুষ আসে। সবার শিক্ষা, আচার-ব্যবহার ও কার্যকলাপ যথার্থ নাও হতে পারে। কিন্তু মসজিদের সমস্যা সমাধান করতে হবে হেকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে। কারো সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবে না যে সে মসজিদবিমুখ হয়ে পড়ে। মসজিদ পরিচালনাকারীদের নিম্নোক্ত হাদিস জানা থাকা জরুরি। 

أَنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ، قَالَ قَامَ أَعْرَابِيٌّ فَبَالَ فِي الْمَسْجِدِ فَتَنَاوَلَهُ النَّاسُ، فَقَالَ لَهُمُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ دَعُوهُ وَهَرِيقُوا عَلَى بَوْلِهِ سَجْلاً مِنْ مَاءٍ، أَوْ ذَنُوبًا مِنْ مَاءٍ، فَإِنَّمَا بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِينَ، وَلَمْ تُبْعَثُوا مُعَسِّرِينَ ‏"‏‏.‏

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেনঃ একদা জনৈক বেদুঈন দাঁড়িয়ে মসজিদে পেশাব করল। তখন লোকেরা তাকে বাধা দিতে গেলে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের বললেনঃ তোমরা তাকে ছেড়ে দাও এবং ওর পেশাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। কারণ তোমাদেরকে কোমল ও সুন্দর আচরণ করার জন্য পাঠানো হয়েছে, রূঢ় আচরণ করার জন্য পাঠানো হয়নি।

(৬১২৮) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ২১৪, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ২২০)
বুখারী ২২০

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, লোকটি প্রস্রাব শেষ করলে মহানবী (সা.) লোকটিকে ডেকে বলেন, ‘দেখো, এসব মসজিদ প্রস্রাবের জন্য বানানো হয়নি। এটাকে বানানো হয়েছে ইবাদত-বন্দেগি, তাসবিহ-তাহলিল করার জন্য।’ অতঃপর তিনি সাহাবায়ে কেরামকে এক বালতি পানি ঢালতে বলেন।

দেখুন, মহানবী (সা.) মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণে কিভাবে হেকমত অবলম্বন করেছেন। এটাই মসজিদ পরিচালনার সর্বশ্রেষ্ঠ মূলনীতি। মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।

মসজিদ প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও উন্নয়ন কাজে যারা নিয়োজিত হবেন বা যাদের নিয়োজিত করা হবে, তাদের উপরোক্ত মৌলিক গুণাবলীর পাশাপাশি কতগুলো মানবীয়, সামাজিক ও সাংগঠনিক গুণাবলী থাকতে হবে। এগুলো না থাকলে তিনি একজন ভালো ‘আবেদ’ হতে পারবেন, কিন্তু একজন সফল মসজিদ পরিচালক হতে পারবেন না । অপরিহার্য গুণাবলীর পাশাপাশি অপর গুণাবলীর আধিক্যই মসজিদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন সুনিশ্চিত করবে এবং মসজিদের আলো দ্বারা আলোকিত হবে সমাজ ও দেশ।
--------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট।            

Post a Comment

0 Comments