Recent Tube

সেই দুঃস্বপ্নের ২০শে নভেম্বর আজ; --শামীম আজাদ।

সেই দুঃস্বপ্নের ২০শে নভেম্বর আজ।

 মাত্র ৪০ বছর পূর্বে এই দিনে স্থম্ভিত হয়ে গিয়েছিল মুসলিম জাহান। পুরো ২ সপ্তাহ বেদখল অবস্থায় ছিল কাবাঘর। ২০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর ক্বাবাঘরে তাওয়াফ হয়নি, মসজিদুল হারামে আজান ও জামাত বন্ধ ছিল।

২০ নভেম্বর ১৯৭৯ তারিখ, ১ মুহাররম, হিজরি ১৪০০ সাল। জিল-হজ্জ মাসের হজ্জ শেষ হয়ে গেলেও তখনও অনেক হাজী মক্কায় রয়ে গেছেন। মসজিদুল হারামে জামাত অনেক বড় হচ্ছিল। ফজরের জামাতে প্রায় এক লক্ষ মুসল্লি উপস্থিত।
সেদিন জামাত শুরুর একটু আগে কয়েকটি লাশ নিয়ে আসা হলো। প্রতিদিনই লাশ আসত; তবে, ঐদিন একটু বেশি এলো। এটা নিয়ে কেউ অবশ্য সন্দিহান হয়নি। ফরজ নামাজের পরে জানাজা হবে।

ইমামতি করতে এগিয়ে গিয়েছেন শেখ মোহাম্মাদ আল-সুবাইল। কিন্তু লাশ বহনকারীরা এসে তাঁকে সরিয়ে দিল, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বের করে শূণ্যে গুলি ছুঁড়লো। একজন চিৎকার করে উঠলো, “ইমাম মাহদি আবির্ভূত হয়েছেন”। অস্ত্রধারীরা কফিনের ঢাকনা খুলে ফেলল। দেখা গেল- লাশ নয়, সেখানে ভর্তি আগ্নেয়াস্ত্র।

লাশবাহীরা অস্ত্র নিয়ে হেরেম শরিফের বিভিন্ন অংশে অবস্থান নিলো। তারা গেটগুলো শিকল দিয়ে আটকে দিলো। এতে বাঁধা দিতে গিয়ে নিরস্ত্র দুজন সৌদী পুলিশ গুলিতে নিহত হলেন। হতবিহ্বল মুসল্লিরা কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই জিম্মি হয়ে গেলেন!

ক্বাবার সামনে দাঁড়িয়ে জুহাইমান আল ওতাইবি ভাষণ দিলেন। একপর্যায়ে তিনি নিজ ভগ্নিপতিকে “ইমাম মাহ্‌দি” হিসেবে উপস্থাপন করলেন এবং সকলের সামনে তার কাছে বায়াত গ্রহণ করলেন। এরপর অস্ত্রধারীরা সমবেতভাবে তার কাছে বায়াত গ্রহন করলো এবং মুসল্লিদেরকে যোগ দিতে আহ্‌বান জানালো।
দখলদাররা হেরেম শরিফের মাইক ব্যবহার করে তাদের বক্তব্য ও দাবী দাওয়া পেশ করতে থাকে। “যেহেতু ইমাম মেহেদী আবির্ভূত হয়েছে, তাই সৌদ বংশের রাজত্ব শেষ।” মাহদীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে সৌদদের চলে যেতে হবে।

হাদিসে ইমাম মাহ্‌দির যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা ঐ ব্যক্তির সাথে মিলে গিয়েছিল। তার নাম ও পিতার নাম এবং নবী (সঃ) এর নাম ও পিতার নামে ছিল। এছাড়া, প্রতি শতাব্দির শুরুতে একজন মুজাদ্দিদ আবির্ভূত হবেন বলে বর্ণনা রয়েছে; সেই দিনটাও ছিল, হিজরি নতুন শতাব্দী শুরুর দিন!

ক্বাবা ঘর কেউ অস্ত্রের জোরে দখল করবে- এটা তখন কেউ ভাবেনি। আবার, হারাম শরীফে অস্ত্র বহন করা নিষেধ, তাই নিয়োজিত পুলিশরাও অস্ত্র ছাড়া ডিউটি করেন। মাইকে দখলকারীদের ঘোষণা শুনে পুলিশের বড় একটি দল দখলমুক্ত করতে যান, কিন্তু দখলকারীদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের তোপে তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যান।

মক্কা থেকে সবাইকে সরিয়ে দেয়া হয়, ইন্টারন্যাশনাল টেলিফোন সার্কিট অফ করে দেয়া হয় এবং ঘটনা গোপন রেখে উদ্ধার অভিযান শেষ করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু সকালেই ওয়াশিংটন থেকে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে এই ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়! সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বের দেশে দেশে মুসলিমরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।

সন্দেহের তীর ছুটে যায় আমেরিকার দিকে। ইরানের সদ্য সফল ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ্‌ খামেনি তাৎক্ষণিক রেডিও ভাষণে আমেরিকাকে সরাসরি দায়ী করেন। পাকিস্থানে যুক্তরাষ্ট্রের দুতাবাস আগুনে পুড়িয়ে, ভাঙচুর করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়। লিবিয়াতেও আমেরিকার দুতাবাস পুড়িয়ে দেয়া হয়।
এদিকে হারাম শরীফে রক্তপাত যেহেতু নিষিদ্ধ, উদ্ধার অভিযানে নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। সৌদী কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্তের জন্যে আলেমদের শরণাপন্ন হন। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আলেমদের বেগ পেতে হয়। একটি কারণ ছিল, জুহাইমান আল ওতাইবি নিজে অনেক বড় মাপের আলেম ছিলেন। তিনি ভয়ঙ্কর অন্যায় করে ফেলেছেন বটে, কিন্তু এতবড় একজন আলেম একদম না বুঝে কিছু করার কথা নয়- এই চিন্তায় সিদ্ধান্ত দিতে আলেমরা বিচলিত ছিলেন।

আলেমরা সিদ্ধান্ত দিলেন- সামরিক বিশেষজ্ঞরা অন্য উপায় বের করতে না পারলে দখলদারদেরকে আত্মসমর্পনের জন্য যথেষ্ট আহ্‌বান জানাতে হবে। তাতে কাজ না হলে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাবহার করে রক্তপাতের ঝুঁকি নেয়া যেতে পারে। তবে, কত রক্তপাতে কাজটি সারা যায়- সেদিকে জোর দিতে হবে।

তবে, সৌদী সরকারে অন্য একটি কাজ করেছিল। তাড়াহুড়া না করে সময়ক্ষেপণের করে ওদেরকে ক্ষুধায় কাতর করার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু দেখা গেল- তারা ব্যাপক পরিমাণ খেজুর নিয়ে প্রবেশ করেছিল এবং জমজম কূপ তাদের দখলেই ছিল। ফলে, এই প্রচেষ্টা ব্যার্থ হয়েছিল।

সৌদী বাহিনী কয়েকটি অভিযানও চালিয়েছিল; কিন্তু দখলকারীদের সুবিধাজনক অবস্থান, বিশেষত মিনারগুলো থেকে স্নাইপার আক্রমণে সেসব অভিযান ব্যার্থ হয়ে যায়। তাদের সুবিধা ছিল- একমাত্র গেটের ভিতরে অসংখ্য জিম্মি নিয়ে তারা অবস্থান করছিল। ফলে, তাদের উপর কনভেনশনাল অ্যাটাক করা ছিল অসম্ভব।

সরকার অতি গোপনে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে কৌশলগত সহযোগিতা চাইল। ফ্রান্সের জিআইজিএন কমান্ডো এগিয়ে এলো। কিন্তু পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তারা অভিযান চালানো থেকে বিরত থাকল। তারা সুইসাইডাল কমান্ডো দিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে মর্মে পরামর্শ দিল, যেটা তারা নিজেরা করতে পারবে না।

বিশ্বের এতগুলো মুসলিম থাকতে ক্বাবা উদ্ধারে "মরার জন্য প্রস্তুত" কমান্ডো হাজির করল একমাত্র পাকিস্থান! তারা দমকলের সাহায্যে ভিতরে প্রচুর পানি নিক্ষেপ করল এবং তাতে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে অনেককে হতাহত করে ফেলল। এরপর হারাম শরীফের অভ্যান্তরে চেতনানাশক গ্যাস ছুঁড়ে দিল। যদিও সন্ত্রাসীরা গ্যাস মাস্ক নিয়ে প্রবেশ করেছিল, তবে এতে অনেক লোক অচেতন হয়ে গেল। এরপর পাক এসএসজি কমান্ডোরা অভিযান চালিয়ে মসজিদুল হারাম দখলমুক্ত করে। ঐ কমান্ডো দলের একজন ছিলেন মেজর (পরবর্তী জেনারেল) পারভেজ মুশাররফ।

অভিযানে দখলদার মারা যায় ২৫৫ জন, আর আহত হয় ৫৬০ জন। মিলিটারি থেকে মারা যান ১২৭ জন, আর আহত হন ৪৫১ জন। কথিত ইমাম মাহদি গুলিতে নিহত হয়। মাস্টারমাইন্ড জুহাইমান ৬৭ জন ফলোয়ারসহ আরেস্ট হয়। তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

ঘটনাটি এত ছোট ও সহজ ছিল না। এত বড় ঘটনা দানা বেঁধে উঠতে অনেক কিছু ব্যাপার ছিল। আগ্রহীরা নিজ দায়িত্বে বিস্তারিত সংগ্রহ করে পড়ে নিতে পারেন।
------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments