Recent Tube

ইসলামের দৃষ্টিতে কদমবুছি/ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা কি জায়েয? শামীম আজাদ

ইসলামের দৃষ্টিতে কদমবুছি/ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা কি জায়েয?

   আমরা অনেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিয়ে, বিদায় বা মিলনের সময় গুরুজন এবং মুরুব্বীদের পা ছুঁয়ে সালাম করি। উপমহাদেশে বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশেই মূলত: পাঁ ছুঁয়ে সালাম করার একটা সংস্কৃতি বা রেওয়াজ চালু রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবশ্য মেয়েরাই পা ছুঁয়ে সালাম করেন। হিন্দু সমাজে বেদের শিক্ষক তথা পুরোহিত থেকে শুরু করে গুরুজনেরা মূলত: ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের হয়।

   আর হিন্দু ধর্ম মতে ব্রাহ্মণরা বিশেষ করে ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে তারা সাধারণ হিন্দুদের কাছে পূজনীয় হিসেবে বিবেচিত হয়।

    মনুসংহিতাতে বেদের ছাত্রদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, বেদ শিক্ষার প্রতিটি পাঠের শুরুতে ও শেষে একজন ছাত্র অবশ্যই তার গুরুর দুই পা ছুঁয়ে আলিঙ্গন করবে। এই পা ছুঁয়ে আলিঙ্গন করাকে ব্রহ্মঞ্জলী বলা হয়।

ইসলাম ধর্ম কী বলে?

     ইসলাম ধর্মে পা ছুঁয়ে সালাম করা নিষেধ। কেননা পা ছুঁয়ে সালাম করতে গেলে আরেকজনের সামনে মাথা নত করতে হয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও সামনে মাথা নত করা নিষেধ। তাই যে কাউকে পা ছুঁয়ে সালাম করা ইসলামে নিষিদ্ধ।

    ইসলামে একজন মুসলিম আর একজন মুসলিমকে দেখলে সালাম দিবে একে অন্যের সাথে হাত মিলাবে।

আরব দেশগুলোতে কপালে চুম্বনের একটি রীতি রয়েছে। রসূল সা: যখন ইন্তেকাল করলেন তখন আবুবকর রা: তাঁর কপালে চুম্বন করেছিলেন। সে হিসেবে এটি সাহাবীদের একটি সূন্নত যা পালন করা যায়। মানুষ মানুষের প্রতি ভালবাসতে গিয়ে অতিরঞ্জিত করে ফেলে। প্রতিটি ইবাদত হতে হবে আল্লাহর নির্দেশিত ও রসূল সা: এর অনুসরণে। রসূল সা: যা করেছেন ও করতে বলেছেন সেভাবেই হবে উম্মতের ইবাদত।

হাদীসে এসেছে যে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللهِ الرَّجُلُ مِنَّا يَلْقَى أَخَاهُ أَوْ صَدِيقَهُ أَيَنْحَنِي لَهُ؟ قَالَ: لاَ، قَالَ: أَفَيَلْتَزِمُهُ وَيُقَبِّلُهُ؟ قَالَ: لاَ، قَالَ: أَفَيَأْخُذُ بِيَدِهِ وَيُصَافِحُهُ؟ قَالَ: نَعَمْ.
هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ.

   হযরত আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কারো যদি তার ভাই বা তার বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ হয়, তবে কি সে তার অভিবাদন এর জন্য মাথা ঝুঁকাবে? তিনি বললেন, না। লোকটি বলল, তাহলে কি তাকে লেপ্টে ধরবে এবং চুমু খাবে? তিনি বললেন, না। তাহলে কি তার হাত ধরবে এবং তার সাথে মুসাফাহা করবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ।

   ইমাম তিরমিজী রহঃ বলেন, হাদীসটি হাসান। 
সুনানে তিরমিজীঃ ২৭২৮, বাংলা ২৭২৯, মুসনাদে আহমাদঃ ১৩০৪৪

   এ হাদীসে রাসূল সাঃ মাথা নুয়াতে এবং চুমু খাওয়াতে নিষেধ করেছেন।

   পা ছুঁয়ে সালাম করা, কদমবুছি করা বা পায়ে চুমু খাওয়া, পদধূলি নেওয়া – এ সবগুলো হচ্ছে মুশরিক জাতি হিন্দুদের অনুকরণে নিকৃষ্ট বিদআ’ত। মূলত কবর মাযার পূজারী আর ভন্ড পীর পূজারীরা মুসলমানদের মাঝে এই কুপ্রথা ঢুকিয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, এই বেদাতীরা কবর মাযার ও তাদের পীর বুজুর্গদেরকে সেজদাহ পর্যন্ত করে (নাউযুবিল্লাহ), সুতরাং পা ছুঁয়ে সালাম করা এদের কাছে কোন ব্যপারই না। আফসোস ! আজ পর্যন্ত কোনো হিন্দু বা কাফেরকে দেখতে পেলাম না মুসলমানদের কোনো কিছু অনুকরণ করতে। মুসলমান জাতি কেনো হিন্দুয়ানি কালচার ফলো করার জন্য এতো দিওয়ানা হবে? বিঃ দ্রঃ পা ছুঁয়ে সালাম করতে গেলে মাথা কোনো মানুষের সামনে ঝুঁকানো হয়, যা শিরক। মুসলমানদের মাথা শুধুমাত্র এক আল্লাহর সামনেই নত হয় – নামাযের রুকু ও সিজদাতে, অন্য কারো জন্য না। দেখা-সাক্ষাৎ এবং বড়দের সম্মান করার সুন্নতি পদ্ধতি রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণিত। তাই উক্ত পদ্ধতি রেখে কোন বিধর্মীর পদ্ধতি অবলম্বন করা জায়েজ নয়। কারো সাথে দেখা হলে সালাম দেয়া। দীর্ঘদিন পর কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা আত্মীয়ের সাথে দেখা হলে সালাম দেয়ার পর মুসাফাহা করা বা এবং সর্বোচ্চ কোলাকুলি করা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কদমবুছি করা প্রমাণিত নয়। বরং এটি হিন্দুয়ানী রুসুম। যা অবশ্যই পরিত্যাজ। কদমবুচি করার দ্বারা শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে দুটি খারাবী লাযেম হয়।

যথা-
১-গায়রুল্লাহের সামনে মাথাকে অবনত করা হয়। যা হারাম।

২-বিধর্মী তথা হিন্দুয়ানী রুসুম পালন করা হয়। বিধর্মীদের আদর্শ অনুসরণও হারাম।

عَنْ قَتَادَةَ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِذَا دَخَلْتُمْ بَيْتًا فَسَلِّمُوا عَلَى أَهْلِهِ، وَإِذَا خَرَجْتُمْ فَأَوْدِعُوا أَهْلَهُ السَّلَامَ»

  হযরত কাতাদা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যখন তোমাদের কেউ ঘরে প্রবেশ করে সে যেন উক্ত গৃহবাসীকে সালাম দেয়। আর গৃহ হতে বের হওয়ার সময় গৃহবাসীকে সালাম দিয়ে বিদায় গ্রহণ করবে। 
জামে মামার বিন রাশেদঃ ১৯৪৫০, শুয়াবুল ঈমানঃ ৮৪৫৯, শরহুস সুন্নাহ লিলবাগাবীঃ ৩৩২৮

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: قَالَ لِي رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا بُنَيَّ إِذَا دَخَلْتَ عَلَى أَهْلِكَ فَسَلِّمْ يَكُونُ بَرَكَةً
عَلَيْكَ وَعَلَى أَهْلِ بَيْتِكَ.

  হযরত আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ আমাদের লক্ষ্য করে বললেন, হে বৎস! তুমি গৃহে পরিবার-পরিজনের কাছে প্রবেশকালে সকলকে সালাম করবে। এতে তোমার এবং তোমার গৃহের সকলের জন্য কল্যাণ হবে। 
সুনানে তিরমিজীঃ ২৬৯৮, আলমুজামুল আওসাতঃ ৫৯৯১

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا، لاَ تَشَبَّهُوا بِاليَهُودِ وَلاَ بِالنَّصَارَى، فَإِنَّ تَسْلِيمَ اليَهُودِ الإِشَارَةُ بِالأَصَابِعِ، وَتَسْلِيمَ النَّصَارَى الإِشَارَةُ بِالأَكُفِّ.

   হযরত আমর বিন শুয়াইব তার পিতার সূত্রে তার দাদা হতে বর্ণনা করেন, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের ছাড়া অন্য কোন সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য রেখে চলে, যে আমাদের দলের নয়। তোমরা ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের সাথে সাদৃশ্য স্থাপন করো না। ইহুদীরা সালাম করে আঙ্গুলির ইশারা দ্বারা আর খৃষ্টানরা সালাম করে হাতের তালুর ইশারা দ্বারা। 
সুনানে তিরমিজীঃ ২৬৯৫, শুয়াবুল ঈমানঃ ৮৫২০, সুনানে কুবরা লিননাসায়ীঃ ১০১০০, শরহুস সুন্নাহঃ ৩৩০৮, আলমুজামুল আওসাতঃ ৭৩৮০, মুসনাদুশ শামীনঃ ৫০৩, মুসনাদুশ শিহাবঃ ১১৯১

عَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا مِنْ مُسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ، فَيُصَافِحَانِ إِلا غُفِرَ لَهُمَا قَبْلَ أَنْ يَتَفَرَّقَا»

  হযরত বারা বিন আযেব রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যখন দুজন মুসলিমের মাঝে পরস্পর সাক্ষাৎ হয়, তারপর তারা পরস্পর মুসাফাহা করে, তাহলে তারা পরস্পর থেকে পৃথক হওয়ার আগেই তাদের গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। শরহুস সুন্নাহ লিলবাগাবীঃ ৩৩২৬, মুসনাদে আহমাদঃ ১৮৫৪৭, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩৭০৩, সুনানে আবু দাউদঃ ৫২১২, সুনানে তিরমিজীঃ ২৭২৭

عَنْ عَائِشَةَ، رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ: قَدِمَ زَيْدُ بْنُ حَارِثَةَ الْمَدِينَةَ , وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي بَيْتِي , فَأَتَاهُ , فَقَرَعَ الْبَابَ , فَقَامَ إِلَيْهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عُرْيَانًا , وَاللهِ مَا رَأَيْتُهُ عُرْيَانًا قَبْلَهُ ,فَاعْتَنَقَهُ وَقَبَّلَهُ “

হযরত আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত জায়েদ বিন হারেসা রাঃ মদীনায় এলেন। তখন রাসূল সাঃ আমার গৃহে ছিলেন। হযরত জায়েদ এসে রাসূল সাঃ এর দরজায় কড়া নাড়লেন। রাসূল সাঃ তখন বেরিয়ে গেলেন খালি গায়েই। আল্লাহর কসম আমি এর আগে কখনো রাসূল সাঃ কে খালি গায়ে দেখিনি। তারপর তিনি তার সাথে মুআনাকা করলেন এবং তাকে চুমু খেলেন। 
তাহাবী শরীফঃ ৬৯০৫, সুনানে তিরমিজীঃ ২৭৩২, শরহুস সুন্নাহঃ ৩৩২৭

وَمِنْ آيَاتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ ۚ لَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ [٤١:٣٧]

  তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে দিবস, রজনী, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সেজদা করো না, চন্দ্রকেও না; আল্লাহকে সেজদা কর, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা নিষ্ঠার সাথে শুধুমাত্র তাঁরই এবাদত কর। 
সূরা হা-মীম সাজদাঃ ৩৭

عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ»

   হযরত ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত। 
সুনানে আবু দাউদঃ ৪০৩১, মুসনাদুল বাজ্জারঃ ২৯৬৬, মুসনাদুশ শিহাবঃ ৩৯০, মুসনাদুশ শামীনঃ ১৮৬২, আলমুজামুল আওসাতঃ ৮৩২৭, মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাঃ ৩৩০১৬

  এ মাসআলাটি নিয়ে বিজ্ঞ ফুক্বাহায়ে কেরাম এবং মুহাদ্দিসীনে কেরামের মাঝে মতভেদ রয়েছে।

  একদল বলেছেন সম্মানার্থে জায়েজ আছে পদচুম্বন করা। কিন্তু তারা সাথে সাথে এ শর্তারোপ করেছেন যে, যেন চুমু খেতে গিয়ে রুকুর সূরত বা সেজদার সূরত না হয়ে যায়। যদি রুকু বা সেজদার সূরত হয়ে যায়, তাহলে তা জায়েজ হবে না। {আলমুজতাবা-৪/২০৫, আলমুহীতুল বুরহানী-৮/১১৮, ফাতাওয়া আলমগীরী-৫/৩৬৯}

   আরেক দল ফক্বীহ ও মুহাক্কিকীনদের মতে তা জায়েজ নয়। কারণ বর্তমান প্রচলিত কদমবুছিতে রুকুর হালাত এবং সেজদার হালাত হওয়া স্পষ্ট। সেই সাথে এটি বিধর্মীদের প্রতীক। তাই তা হারাম।

   দ্বিতীয় মতটিই শক্তিশালি। কারণ কদমবুছি করা এ উপমহাদেশে মৌলিকভাবে হিন্দুদের রুসুম। আর কদমবুচি করতে গিয়ে রুকু বা সেজদার হালাত তৈরী হয়েই যায়। আর যারাও কদমবুছিকে জায়েজ বলেছেন তাদের মতেও রুকু সেজদার হালাত হয়ে গেলে কদমবুচি করা জায়েজ নয়।

   উপরোক্ত কারণে আমরা বর্তমান প্রচলিত কদমবুছিকে নাজায়েজ বলেছি দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে।

   আল্লাহ তাআলা আমাদের এই অজ্ঞতার হাত থেকে মুসলিম উম্মাহের ঈমান আমলকে হিফাযত করুন।
-----------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments