Recent Tube

ইসলামে ভাস্কর্য ও মূর্তি; ড. মুহাম্মদ আব্দুস সালাম আজাদী।




 
   ইসলামে ভাস্কর্যমূর্তি;

 চিত্র ও শিল্পকলা একটা নান্দনিক বিষয়। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই মানব মনের মাঝে তা চিরায়ত হয়ে আছে। এর জন্য না কোন আলাদা দেশ আছে, না কোন নির্দিষ্ট বায়ূ বিধি আছে, না কোন সময়ের সীমা আছে। 

 এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হয় আনন্দ, এবং দূরের পরিকল্পনা থাকে মানবের মাঝে বেঁচে থাকার আকাংক্ষা। কারণ মানুষ অমরতা চায়। কেও তা মনে মনে, কেও তা জনে জনে, কেও তা ইতিহাসের সুকুমার হয়ে। সেই প্রেরণার জন্যই মানব সভ্যতায় শিল্পবোধ অথবা সাংস্কৃতিক চেতনা সৃষ্টি হয়েছে। 
    এইগুলোর ঐকতায় আসে শিল্পকলার ব্যবহার। মানুষ প্রিয় জিনিষকে যেমন এঁকে জুঁকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে, তেমন প্রিয়জনকেও বিভিন্ন ভাবে স্থায়ী করে রাখার চেষ্টা করেছে। প্রিয়জনদের কিংবা সম্মানিতদের স্থায়ীভাবে ধরে রাখার একটা ঐতিহাসিক প্রবনতা আমরা মুসলিম ইতিহাসের “জীবন্ত বিশ্বকোষ” আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাসের (রা) এক বর্ণনায় পাই। তিনি বলেছেন, “নূহ (আ) এর জাতির কাছে যে সব মূর্তি ছিলো,  পরবর্তিতে আরবরাও সেগুলো ব্যবহার করে। এই জন্য আমরা “কালব” বংশের উপাস্য মূর্তি হিসেবে দেখতে পাই নূহের যুগের “উদ্দ”কে, যা দাওমাতুল জান্দালে রাখা হয়। সূওয়া’ কে পূজা করতে থাকে হুযায়লের লোকেরা। ইয়েমেনের সাবা নগরীর “জওফে” মুরাদদের পরে গাতীফ বংশের লোকেরা “ইয়াগূস”কে স্থাপন করে পূজা শুরু করে। আর হামদানদের কাছে ছিলো “ইয়াঊক্ব”। অন্যদিকে হিমইয়ারের “যিল কিলা’ এর বংশধরদের জন্য ছিলো “নাসর”। এই মূর্তিগুলো ছিলো নূহ (আ) জাতির ভালো ভালো লোকদের প্রতিকৃতি ও প্রতিমা। ঐ ভালো লোকেরা যখন মারা যান, শয়তান তার সন্তানদের মনে এই প্রেরণা দেয় যে, তারা ওদের প্রতিমা তৈরি করে সমাবেশস্থলগুলোতে রাখবে। ঐ প্রতিমাগুলোর নাম ও দেয়া হয় ঐ ব্যক্তিদের নামে। প্রথম দিকে এদের পূজা করা হতোনা, কিন্তু পরে ধীরে ধীরে শরীয়াতের জ্ঞান লোপ পেতে থাকলে ঐ মূর্তি গুলোর ইবাদাত শুরু হয়। (বুখারী, ৪৬৩৬) 

নূহ (আ) এর যুগ নিশ্চয় খৃস্টপূর্বে ছিলো। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাসের (রা) এই বর্ণনাই আমাদের বর্তমানের গবেষণার ফলাফলকে সত্যায়িত করে। আধুনিক গবেষণা বলে, মূর্তির সর্বপ্রাচীন নমূনার বয়স খৃস্টপূর্ব  ২৩০০০০ থেকে ২০০০০০ সনের মধ্যেই। (http://onushilon.org/sculpture/sclupter.htm) ঐ সময়ের পর থেকেই মূলতঃ পৃথিবীতে নানা রকম মূর্তি ছড়িয়ে পড়ে। কারণ নূহ (আ) এর পুত্রদের মাধ্যমেই মানব পরম্পরা আজ সাজানো। এই মূর্তি গুলো ই আজ “পাটলি পুত্রে”, মহেঞ্জদারোতে অথবা পৃথিবীর অন্যান্য সভ্য শহরে পরিদৃশ্যমান। 

 এই হলো মূর্তি নির্মানের গোড়ার কথা। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূর্তিগুলো যে পূজা বা ঊপাসনার জন্যই প্রথমে তৈরি হয়েছে এমন নয়। বরং তা হয় সম্মানের জন্য, না হয় স্মরণে রাখার জন্য, না হয় ঐতিহাসিকতার জন্য তাদের তৈরি হয়। পরে অবশ্য ব্রাম্মনদের হাতে, বৌদ্ধদের নির্মানে, খৃস্টানদের পৌত্তলিকতায় যে সব মূর্তি তৈরি হয় তা কিন্তু সবই পূজা বা উপাসনার নিমিত্তে তৈরি। 

  এখন এই মুর্তি যারা তৈরি করে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার। ইবনে আব্বাসের আলোচনায় আমরা দেখতে পাই মূর্তি বানানোর পেছনে "প্রেরণার উৎস" ছিলো শয়তান। মূলতঃ যে সমস্ত জ্ঞান, বিষয়, বস্তু বা স্রোত মানুষকে আল্লাহর দিকে থেকে অন্যদিকে সরায়, আল্লাহর সমপর্যায়ে নিয়ে যায়, আল্লাহকে বাদ দিয়ে ঐ গুলোকে ধর্মীয় ও নান্দনিক বা সাংস্কৃতিক জগতে একমাত্র উপজীব্য করে -তা সবই শয়তানের চক্র, এ ব্যাপারে ধর্মগুলোর মধ্যে কোন মত পার্থক্য নেই। 

  কাজেই মূর্তি তৈরির পেছনকার ব্যক্তি ও শক্তিকে ধর্মসমূহ শয়তানী চক্র মনে করতে বাধ্য। ধর্মসমূহের প্রাণপুরুষেরা চলে যাবার পরে যখন অনুসারীদের মধ্যে ঐ সব ধর্মের প্রাণপুরুষদের প্রতি ভালোবাসা উন্মাদনায় রূপ নেয়, তখন তাঁদের ছবি, ব্যবহার্য জিনিষ, জন্মস্থান, বাড়ি, খড়ম, অস্ত্র- তরবারি, লোটা- বদনা, খাটের কাট এমন কি মাথার চুল ও পূজনীয় হয়ে ওঠে। ঐ গুলো তখন বেঁচে ওঠে, মূর্ত হয়, অংকিত হয়। এমনকি সে সব মহামূল্যবান ছবি, মূর্তি, ও মূর্ত হয়ে ওঠা যে কোন জিনিষ হয়ে পড়ে আরাধ্য, পূজনীয়, প্রেমের পাত্র ও কলিজার ধন। সে হোক ব্রাম্মণদের হাতে, কিংবা বৌদ্ধদের বিহারে, খৃস্টানদের গীর্যায় কিংবা অন্য কোথাও।

  মানব জীবনের এই একটা দিক তখন হয়ে ওঠে অসম্ভব দামী জগত। যারাই এই সব জিনিষ মূর্ত করতে পারতো, এঁকে দিতে পারতো তুলিতে, বানিয়ে দিতে পারতো পাথরে খোদাই করে, কাঠের গায়ে ঠকঠকিয়ে, নানা ধাতু গলিয়ে, নানা উপাদানের সংযোগ করে শক্ত করে জমিয়ে, তৈল চিত্রের আঁকরে, চামড়ার গায়ে গায়ে, নানা জাতের দেয়ালে বা গুহায়, এমনকি প্রতিটা ধর্মশালার ভেতরে বাইরে, তাদের দাম হতো আকাশ ছোঁয়া। সে হোক লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) মিকেলাঞ্জেলিও (১৪৭৫-১৫৬৪), বার্নিনি (১৫৯৮-১৬৮০), অগাস্ট রোদিন (১৮৭৬-১৯৫৭) অথবা অন্য কেও। 
 
  যারা এই কাজগুলো করতো তারা এখন দুনিয়ার সেরা উপাধি পায়, তারা ছবি আঁকে, হাত দিয়ে মূর্তি বানায়, ছাপ তোলে, কার্ভ বা খোদাই করে। এই সবগুলোকেই “ফাইন আর্ট” এর আওতায় এনে সারা দুনিয়ায় এখন একটা বিজ্ঞান হিসাবে পড়ানো হয়। সেখানে visual arts এর দ্বিমাত্রিক শিল্পকলা যেমনঃ পেইন্টিং ও ড্রইং, মোজাইক, ক্যালিওগ্রাফি, ফটোগ্রাফি যুক্ত হয়, তেমনই যুক্ত হয় ত্রিমাত্রিক কাজগুলো। যেমন আর্কিটেকচার, পোটারি, ভাস্কর্য (sculpture), কন্সেপচুয়াল আর্টস। এর সাথে আরো যুক্ত হয় কবিতা গান, নৃত্য, থিয়েটার, ফিল্ম ইত্যাদি। 

  এই সব কাজগুলো যারা করে, তাদেরকে যেমন নানা নামে ডাকা হয়, তেমন তাদের কর্মগুলোর ও আছে নানান নাম। তবে যারা দৃশ্য-শিল্পের (visual arts) এমন একটা শাখায় কাজ করে যেখানে শক্ত উপাদানের সাহায্যে ত্রিমাত্রিক (উচ্চতা/গভীরতাx দৈর্ঘ x প্রস্ত) অবয়বকে উপস্থাপন করা হয়, তাদেরকে ভাস্কর বলে। এবং এদের কাজই হয় ভাস্কর্য। (http://onushilon.org/sculpture/sclupter.htm) 
 তারা যে শুধু ধর্মের জন্য করে এমন নয়, তাদের অনেকেই এগুলো করে আনন্দের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য, সৃষ্টিশীলতার জন্য অথবা অন্য কোন জৈবিক ও মানবিক তাড়নায় বা কামনায়। এরা যেমন মানুষের মূর্তি বানায়, বানায় প্রাণীর ও, গড়ে বিভিন্ন শৈল্পিক স্থাপনা ও পরিবেশের প্রতিকৃতি। 

  ইসলাম অধুনা “ফাইন আর্টের” অনেক বিষয়কে বুকে ধারণ করে, এবং সেগুলোতে তুলে ধরা ইসলামি মডেল আজো সারা পৃথিবির বিস্ময়েরই জন্ম দেয়। 

  তবে ইসলাম পৌত্তলিকতাকে মোটেই সহ্য করেনা। বিধায় পৌত্তলিকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে এমন কোন কাজকেও হালাল মনে করেনি, করেনা ও করবেও না ভবিষ্যতে। এ ব্যপারে কুরআনের ভাষা পড়লে, হাদীসের বক্তব্য শুনলে এবং যুগে যুগে আসা ইসলামি স্কলারদের গবেষণা ও সিদ্ধান্ত  দেখলে খুব স্পষ্ট যে মেসেজ আমাদের সামনে আসে, তা হলো, “মূর্তি সে যে উদ্দেশ্যেই হোক, মানুষের ভাস্কর্য সে যত ভালো কাজেই হোক, অথবা যত শিরক মুক্তই থাকুক, মারত্মক ভাবে পরিতাজ্য”। 

  এটা এমন বিষয় যা ইসলামি আক্বীদাহ বিশ্বাস ও ঈমানের সাথেও তা সংশ্লিষ্ট হয়ে যায়। যখন আল্লাহ বলেন, তিনিই মায়ের পেটে তাঁর ইচ্ছামত তোমাদের দেহের আকৃতি দিয়েছেন। (আল ইমরানঃ ৬)। যখন তিনি বলেনঃ আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি সৃষ্টিকারী, তিনিই উদ্ভাবনকারী, তিনি রূপদাতা। (হাশরঃ২৪)। তখন এই ব্যপারে আমাদের নবী (সা) এর বক্তব্যের সারবত্তা পাওয়া যায়। আইশা সিদ্দিকা (রা) বলেন, উম্মু হাবীবাহ ও উম্মু সালামাহ হাবাশায় দেখা কিছু গীর্জার কথা মহানবী (সা) এর সামনে উল্লেখ করেন। সেখানে অনেক প্রতিকৃতি তারা দেখেছেন। মহানবী (সা) বলেছেনঃ হাবাশার লোকগুলো তাদের কোন ভালো মানুষ মারা গেলে তার কবরের উপর মসজিদ বানাতো, এবং সেখানে তাদের প্রতিমা বা প্রতিকৃতি রেখে দিতো।বস্তুতঃ এই কাজ গুলো যারা করেছে, তারা কিয়ামতে আল্লাহর কাছে খুব নিকৃষ্ট সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হবে। (বুখারি ৪১৭, ও মুসলিম, ৫২৮)। এই হাদীসে আমরা স্পষ্ট দেখতে পারচ্ছি আমাদের নবী (সা) এই ধরণের ভাস্কর্যকে ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক যেমন বলেছেন, তেমনি এই কাজ কোন মুমিন ব্যক্তির জন্য হারাম ও করে দিয়েছেন। যখন আমাদের নবী কোন কাজে নিষেধ করেন, এবং তা করলে আযাব ও শাস্তির কথা উল্লেখ করেন, তখন নিশ্চিত ভাবে তা করা হারাম হয়ে যায়। এই জন্য ইমাম নাওয়াওয়ী এই হাদীসের ব্যাখ্যায় প্রাণ বিশিষ্ট কোন কিছুর প্রতিকৃতি করা, মূর্তি বানানো, ভাস্কর্য তৈরি কে খুব মারাত্মক ধরণের হারাম বলে উল্লেখ করেছেন। (সাহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থ, ১৪/৮১)। 

  আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ বলেন, আমি নিজে নবী (সা) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহর কাছে কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তিই সব চেয়ে বেশি আযাবের কবলে পড়বে, যে প্রতিকৃতি তৈরী করতো। (বুখারি ৫৬০৬, মুসলিম ২১০৯)। এই অনুধাবনই আমরা সাহাবায়ে কিরামের মাঝে দেখি। একবার এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাসের কাছে আসেন, লোকটি বললেন, আব্বাসের আব্বা, আমি হাতের এই কাজ গুলোকে পেশা হিসেবে নিয়েছি। আমি এই প্রতিকৃতি তৈরি করি। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস বললেন, এ ব্যাপারে তোমাকে এমন একটি সিদ্ধান্ত শুনাবো, যা আমি আল্লাহর রাসূলের কাছে শুনেছি। রাসূল(সা) বলেছেন, “যে প্রতিকৃতি বানাবে, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিবেন। এই শাস্তি ততক্ষণ চলবে, যতক্ষণ সে ঐ প্রতিকৃতিতে রূহ না দিতে পারবে। আর রূহ দেয়া তো তার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়”।  এই কথা শুনে লোকটি ভীষণ ভাবে ভীত হয়ে পড়লো, এবং মুখ হলদে  হয়ে গেলো। ইবন আব্বাস বললেন শোন, তুমি যদি এই ধরণের কাজ করতেই চাও, তাহলে এই গাছ পালা, ও যে সব বস্তুর রূহ নেই তাদের প্রতিকৃতি তৈরি করো। (বুখারি ২১১২, মুসলিম ২১১০)। এইসব হাদীস ও ফাতওয়া আমাদের আরেকটি ডাইমেনশানের দিকে নিয়ে যায়, তা হলো এই কাজ গুলো এতো মারাত্মক যে, যারা এই কাজ করে তাদেরকে জাহান্নামে যেতে হবে। অতএব এই কাজ কোন মুসলিমের জন্য সাজেনা। 

  ইসলামি সংস্কৃতির সাথে মানুষের মূর্তি, ভাস্কর্য, প্রতিকৃতি ইত্যাদি সাংঘর্ষিক। এইজন্য আমাদের নবীর (সা) হাতে ক্ষমতা এলে কাবায় ঢুকে সকল মূর্তি তিনি ধ্বংশ করে দেন। কোন একটাও অবশিষ্ট রাখেন নি।

  কোন কোন গবেষক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমাদের নবী (সা) নাকি কা'বা ঘরে ঈসা (আ) ও তাঁর মায়ের ছবি রেখে দিয়েছিলেন। আসলে এই সংক্রান্ত বিষয়ে “আখবার মাক্কাহ” নামক গ্রন্থে ইমাম আলআযরাক্বী ৪টা সনদে বলেছেন, যে আল্লাহর রাসূল (সা) ঈসা ও তাঁর মা (আ) এর ছবি ছাড়া আর সব ছবি মুছে দিয়েছিলেন। এই সনদের প্রতিটি বক্তব্যই এসেছে দূর্বল বর্ণনায়। দুনিয়ার কোন একজন আলিম ও এই বর্ণনা গুলো সঠিক তো বলেন ই নি, বরং এগুলো সত্যের অপলাপ বলে উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে এই সব বর্ণনার মূল ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবন আবী নাজীহ। তিনি এই ঘটনা তার আব্বার উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করতেন। এই আব্দুল্লাহ সম্পর্কে ইমাম যাহাবি সহ অন্যান্য রিজাল শাস্ত্রজ্ঞগণ নেতিবাচক। তিনি বিশুদ্ধ বর্ণনাকারী তো ননই, আবার তার আব্বা ও যে কা'বার ঐ দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেছেন তার কোন প্রমান সম্ভব নয়। কারণ এই দৃশ্য দেখার মত বয়স সে সময় তার হয়নি। বুঝা গেলো তিনি হয়ত কারো কাছ থেকে এই ঘটনা শুনেছেন। অথচ তার নাম কোন ইতিহাসে নেই। কাজেই তিনি কার কাছে এই কথা শুনেছেন তার কোন হদিস পাওয়া যায়না। এইজন্য এই সব বর্ণনাগুলো কোন আলিমই ধর্তব্যের মধ্যে আনেন নি। এই সব বর্ণনা ইসলামের মূল বক্তব্যের বিরোধি এক দিকে, অন্য দিকে তা হয়ে গেছে এক্কেবারে অসমর্থিত কিংবা ভীষণ দূর্বল। ফলে এই সব গাল গল্প সবার কাছে পরিতাজ্য হয়ে এসেছে। 

  সাইয়িদুনা আলী (রা) খলীফা হবার পর আবুল হায়্যাজ আলআসাদিকে বলেনঃ আমি তোমাকে কি ঐ কাজের জন্য পাঠাবো, যার জন্য আল্লাহর রাসূল আমাকে মনোনিত করতেন? মহানবী (সা) আমাকে বলে দিতেনঃ 
أن لا تدع تمثالا إلا طمسته ولا قبرا مشرفا إلا سويته وفي رواية  ولا صورة إلا طمستها  
 অর্থাৎ কোন মূর্তি দেখলেই অপসারণ করে দেবে, কোন উঁচু কবর দেখলে মাটির সাথে সমান করে দেবে, অন্য বর্ণনায় যোগ করা হয়েছে,  কোন প্রতিকৃতি দেখলে তা অপসারণ করবে। 

  এখানে এই “তিমসাল” নিয়েও আজকাল কথা শুনা যাচ্ছে। সুলায়মান (আ) নাকি জিনদের দিয়ে মূর্তি বানায়ে দেশময় সাজিয়ে ছিলেন। এটা নাকি কুরআনে আছে। তারা কুরআনের সূরা সাবা এর ১৩ নং আয়াতঃ

يَعْمَلُونَ لَهُ مَا يَشَاءُ مِن مَّحَارِيبَ وَتَمَاثِيلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُورٍ رَّاسِيَاتٍ ۚ
প্রমান স্বরূপ উত্থাপন করে বলেন, এই আয়াতের অনুবাদ মাওলানা মহিউদ্দীন খান করেছেনঃ তারা সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত। 

  “তিমসাল” এর অনুবাদ (( ভাস্কর্য )) দেখে বাংলাদেশের কিছু কিছু বুদ্ধিজীবি এর দ্বারা মানুষের প্রতিকৃতি  মনে করেছেন, এবং বলতে চেয়েছেন ভাস্কর্য জায়েয। কারণ সুলায়মান (আ) তা করাতেন। কুরআনের কোন একটা আয়াতে শব্দ একটা পেলেই, তা দিয়ে কিছু বুদ্ধিজীবি নাস্তিকতা, পৌত্তলিকতা, ধর্মহীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা অথবা ধর্মের মৌলিক কোন বিষয়ের বিপরীতে দাঁড় করান। অথচ কুরআন বুঝতে হয় প্রথমতঃ কুরআনের অন্যত্র আনা আয়াত দিয়ে, তা না পাওয়া গেলে হাদীস দিয়ে, তা না পেলে সাহাবীদের উক্তি দিয়ে এবং তারপরে ডিকশনারী।

  আরবিতে “তিমসাল” “মিসল” থেকে উদ্গত। মিসল মানে অনুরূপ। তিমসালের অর্থ তাই হয় কোন একটা জিনিষের অনুরূপ (প্রতিম) বানানো। এটা মানুষের অনুরূপ যেমন হতে পারে, তেমন হতে পারে অন্য কিছুর। হতে পারে প্রকৃতির, হতে পারে ল্যান্ডস্কেপের, হতে পারে কোন বস্তুর, বা যে কোন কিছুর। ইমাম তাবারী এই তিমসালের অর্থ ছবি বা প্রতিকৃতি বলে উল্লেখ করেছেন। ইবন কাসীর ও তার উল্লেখ করেছেন। তারা দুইজন ই তা বিভিন্ন জিনিষের যেমন কাঁচ দিয়ে, তামা দিয়ে বা মাটি দিয়ে বানানোর কথাও বলেছেন। 

   ইমাম শাওকানি এখানে দুইটা মত নিয়ে এসেছেন। প্রথম মত বর্ণনা করতে যেয়ে তিনি বলেনঃ “হতে পারে এটা বিভিন্ন নবী, ভালো মানুষ বা ফিরশতাদের ভাস্কর্য, যা ইবাদাতে বেশি অনুপ্রাণিত হতে ইবাদাতগাহে রাখা হতো। হতে পারে এটা সুলায়মান (আ) এর সময়ে বৈধ ছিলো। কিন্তু মনে রাখতে হবে নবী (সা) এর শরীয়াতে তা রহিত করে চির হারাম সাব্যস্ত হয়েছে”। দ্বিতীয় মত বলতে যেয়ে তিনি বলেনঃ “এই তিমসালের আরেক অর্থ আছে, তা হল, 

هي تماثيل أشياء ليست من الحيوان  

 (( এটা হল এমন বস্তুসমূহের প্রতিকৃতি, যাদের প্রাণ নেই ))। আমরা যখন কুরআনের কোন একটা শব্দ বুঝবো, তা বুঝতে আমাদের কুরআনের কাছেই যাওয়া দরকার। সুলায়মান (আ) এই “তামাসীল”কে মূর্তির অর্থে নিয়ে যারা এইটা বানানো জায়েয বা সমস্যা নেই মনে করেন, তার কেন কুরআনেই বর্ণিত আরেক স্থানের “তামাসীল”কে ভুলে যান বুঝিনা। আল্লাহ তাআলা সূরা আল আনবিয়া এর ৫২-৫৪ নাম্বার আয়াতে বলেনঃ 

إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا هَـٰذِهِ التَّمَاثِيلُ الَّتِي أَنتُمْ لَهَا عَاكِفُونَ ﴿٥٢﴾ قَالُوا وَجَدْنَا آبَاءَنَا لَهَا عَابِدِينَ ﴿٥٣﴾ قَالَ لَقَدْ كُنتُمْ أَنتُمْ وَآبَاؤُكُمْ فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ ﴿٥٤﴾

   যখন ইবরাহীম তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেনঃ এই  তিমসালগুলো কী, যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ। তারা বললঃ আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে এদের পুজা করতে দেখেছি। তিনি বললেনঃ তোমরা প্রকাশ্য গোমরাহীতে আছ এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও।

  এই আয়াতগুলোতে ইবরাহীম (আ) তার আব্বা ও জাতিকে “তিমসালের” সামনে বসে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে যে উত্তর পান, তা ছিলো আমাদের আজকের বাংলাদেশের কিছু বুদ্ধিজীবিদেরই উত্তরের মত। তারা বলে দেয় এই মূর্তির সামনে বসে থাকা ঐতিহ্যের পরম্পরা, এটা তাদের সংস্কৃতির অংশ। তারা মনে করে সভ্য সমাজে থাকতে হলে এইভাবেই করতে হয়, এবং এতে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু ইবরাহীম (আ) এটাকে বিভ্রান্তি বলে দিলেন। 

   ইব্রাহীম (আ) এর জবাবের মধ্যেই সুলায়মান (আ) এর “তিমসাল” কি ছিলো তা ধরে নেয়া যায়। ইবরাহীম (আ) যে জিনিষের উতপাটন করলেন, যার বিরুদ্ধে হুংকার দিলেন, তার পরবর্তি সন্তান হয়ে সুলায়মান (আ) ঐটা করবেন এটা ভাবা যায়না। কাজেই সুলায়মান (আ) মূর্তি বানিয়েছিলেন এটা সর্বৈব ভুল ধারণা। বরং ইমাম শাওকানীর বলা দ্বিতীয় অর্থ ই এখানে প্রকটিত হয়। আর যদি তিনি তা করেও থাকেন, আমাদের নবী (সা) তো স্পষ্ট কথা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, মুহাম্মাদ (সা) এর আনিত শারীয়াতে মূর্তির স্থান নেই, প্রাণীর ভাস্কর্যের স্থান নেই, আর মানুষের ভাস্কর্য বৈধ হবার কোন সুযোগ নেই। 

   ভাস্কর্য সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের মর্মাবলম্বনে যে কথাগুলো আজ স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলোঃ 
 ১- ভাস্কর্য বিষয় টা ব্যপক, দৃশ্যমান করে দুই ডাইমেনশান বা তিন ডাইমেনশানের যেকোন শিল্পকর্ম “ভাস্কর্যের” সংজ্ঞায় আসতে পারে। যাকে অবলম্বন করে ভাস্কর্য তৈরি হয়, এবং যা দিয়ে তৈরি হয় উভয়ই হয় ভাস্কর্যের উপাদান, তাই ভাস্কর্য শুধু মাত্র মানুষের হতে হবে এমন না। কোন বস্তু বা বিষয় ও এখানে আসতে পারে। কাজেই সকল ভাস্কর্যকে মূর্তি হতে হবে এমন না, বরং প্রতিটি মূর্তি ই ভাস্কর্যের অন্তর্ভূক্ত। এই দৃষ্টিকোণে সকল ভাস্কর্যই হারাম নয়। যা মনুষ্য, যা প্রাণীজ, যা পূজ্য এবং যা সম্মানার্হ কিংবা অর্ঘ্য পাওয়ার নিমিত্তে সৃষ্ট -তা সবই ইসলামে হারাম। 

 ২- ভাস্কর্যে কোন মানুষকে মূর্ত করে তুললে সেটাই মূর্তি, তাই তাকে পূজা করা হোক অথবা না হোক। ইসলাম এই কাজ যারা করে তাদের যেমন লানত করা হয় বলেছে, ঐ মূর্তি গুলোকেও সমাজে রাখা ঠিক হবেনা তা সুস্পষ্ট করেছে। এই মূর্তিগুলোর সম্মান পূজা কিংবা তাদের অর্ঘ্য দেয়াকে একদম না জায়েয করেছে। এমন কি শুধু সম্মানার্থে মূর্তির প্রচলনকে ইসলাম পূজা তথা পৌত্তলিকতার প্রথম ধাপ বলে উল্লেখ করেছে। 

 ৩- ছবি যেটা হাতে বানানো হয়, সম্মানের জন্য উপাসনালয়ে টাঙানো হয়, সৌন্দর্যের জন্য দেয়ালে, কার্টেনে, পর্দায় ইত্যাদিতে দেয়া হয়, সেগুলোকেও হারাম করা হয়েছে। অবশ্য যে সব ছবি প্রাণীর নয়, বরং প্রাণহীন বস্তু বা কোন বিষয়ের বিমূর্ত ছবি- তা টাঙানো জায়েয করেছে ইসলাম। এমনকি কোন প্রাণীর ছবিও যদি প্রাণীর মত না হয়, যেমন মাথা কাটা ইত্যাদি হয়, তাহলে তা ব্যবহার সিদ্ধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিংবা ছবি যদি এমন স্থানে রাখা হয় যাতে সম্মান তো বুঝায় না, বরং আরো অসম্মান করা হয়, তা হলে তা ব্যবহার করা যাবে বলেও ফাতওয়া আছে।
 
 ৪-  ইসলামি সভ্যতায় মূর্তি, প্রাণীর ছবি ইত্যাদিকে পূজা ও সম্মান দেয়া হারাম করা হয়েছে। এদের কে “সানাম”, মানুষের “তিমসাল” বা “সূরাত” বলে। আবার এমন কোন অপ্রাণীর মূর্তি বা ছবি ও যদি পূজা সম্মান বা উপাসনায় ব্যবহার করা হয় তাকেও হারাম করে। হোক সে গাছ, কিংবা পাথর খন্ড, অথবা অন্য কিছু। হুদায়বিয়ার “বাইয়াতুর রিদওয়ান” সঙ্ঘটিত হয়েছিলো যে গাছের নিচে, সায়্যিদুনা উমার (রা) তা কেটে ফেলেন। কারণ মানুষ সেখানে যেয়ে গাছের সম্মান করতো। কাজেই বস্তু, প্রাণহীন কোন জিনিষ বা এই ধরণের যে সব ভাস্কর্যের উপাসনা বা সম্মান করা হয় ইসলাম তাকে “ওয়াসন” ((وثَنٌ)) বলে। এই ধরণের যেসব ভাস্কর্য তৈরি করা হয়, যা পূজনীয় হয়ে ওঠে, সেটাও বানানো হারাম বলেছে ইসলাম। সাথে সাথে যেসব স্তম্ভকে মানূষ পূজা করে, অথবা তার বেদিমূলে অর্ঘ্য দেয় তাকে ইসলাম “نصب” বলে। তাকেও হারাম করা হয়েছে। যেমন হিন্দু ধর্মে শিবলিঙ্গের স্তম্ভ ও খৃস্ট ধর্মে ক্রুশের ভাস্কর্য। 

 ৫- ইসলাম কখনো কোন দেশ বা ব্যক্তির অনুসরণকে কুরআন হাদীসের মাপকাঠিতে মেপে থাকে। কোন দেশে সাদ্দামের মূর্তি থাকলে, বা আতাতূর্কের ভাস্কর্য থাকলে, বা শিবলিঙ্গ থাকলে তা বাংলাদেশের জন্য জায়েয বানাবে না। আমরা ১৯৮৯ সাঊদী আরব পড়তে যাই। তখন সে দেশের ১০০% উলামাগণের ফাতওয়া ছিলো ক্যামেরার ফটো হারাম। ফলে বাদশাহদের ছবি সরকারী অফিসে রাখার নির্দেশ থাকলেও বেসরকারী অফিসে বাধ্যতামূলক ছিলো না। কালক্রমে এখন প্রতিটি অফিসে, রাস্তায় দেয়ালে, পাহাড়ের উচ্চতায় বাদশাহগণের ছবি দেয়া হয়। এটা ইসলামি ফাতওয়ায় জায়েয বলা যাবেনা। ইসলাম চলে তার শারীয়াতের উৎস মুতাবিক, কোন জাতি গোষ্ঠির আচরিত কাজের উপর ভিত্তি করে নয়। 

 ৬- ইসলামে কিছু “শাআয়ির” বা “মাশায়ির” ((পবিত্র জিনিষ ও স্থান)) আছে। সেগুলো হাতে বানানো ভাস্কর্য নয়। যেমন হাজারে আসওয়াদ বা কালো পাথর। এটা জান্নাতের ই একটি পাথর। ইবরাহীম (আ) এর পদরেখা অঙ্কিত মাক্বামে ইবরাহীম ও কারো বানানো ভাস্কর্য নয়, এটা অলৌকিক ভাবে পড়া পাথরের উপর ইবরাহিমের (আ) পায়ের ছাপ। যমযম কূপ ও কোন ভাস্কর্য নয়, নয় সাফা মারওয়া পাহাড় ও। এই গুলো কোনটা প্রাকৃতিক, কোন কোনটা জান্নাত থেকে আসা। কোন মানুষের হাতে মূর্ত হওয়া জিনিষ নয়। কাজেই সেগুলোর উপর ভিত্তি করে বলা যাবেনা ভাস্কর্য ইসলাম বৈধ করেছে। 

 ৭- সৌন্দর্যের জন্য প্রকৃতির ছবি ও ভাস্কর্য, এমন কোন স্তম্ভ যাতে সম্মান শ্রদ্ধার্ঘ্য দেয়া হয়না, এমন কোন স্থাপত্য যা ইসলামি আক্বীদাহ, চিন্তা, দর্শন ও সভ্যতার দিক নির্দেশনার আলোকে তৈরি – এ সব ই ইসলামে বৈধ। মসজিদ নাবাওয়ী, মসজিদ কুবা দুইটাই আমাদের নবীর (সা) এর নির্দেশে তৈরি হয়, দুইটারই নির্মান কৌশল ও শৈলি ছিলো ভিন্ন। তার কোনটাই কিন্তু কা’বার মত ছিলোনা। এটাই প্রমান করে এইসব নির্মানে নানা ধরণের সৌন্দর্য আনা ইসলাম নিষেধ করেনা। এই জন্য পৃথিবির নানা রকম মসজিদ, নানা রকম স্থাপত্য, নানা রকম সৌন্দর্য সৃষ্টি মুসলিমদের হাতে হয়েছে। মনে রাখতে হবে ইসলামি সভ্যতা "মানুষ পূজক" নয়, মানুষের রব্বের ইবাদাতের আহবায়ক। 

 মানব  ইতিহাস সবিস্ময়ে স্বীকার করে যে, এই সভ্যতার জন্ম দেয়া স্তম্ভ, মিনার, মসজিদ, প্রাসাদ, ও কিল্লাগুলোর শিল্পকলা আজো বিশ্বের সেরা শিল্প হিসেবে বিবেচিত। অথচ কেওই তাকে সম্মান জানায় না, ফুলের তোহফা নিয়ে নাংগা পায়ে তার বেদিমূলে অর্ঘ্য হিসেবে দেয়না, কিংবা পূজার আসনে বসায় না। বরঞ্চ এইগুলোই হয়ে উঠেছে জড়বাদি সভ্যতার বিপরীতে ইসলামের দেয়া উন্নততর বিকল্প ও জগতসেরা ইসলামি অবদান।
--------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা আলোচক গবেষক ও দাঈ। 

Post a Comment

0 Comments