Recent Tube

শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীরঃ চেতনায় অম্লান; মীর সালমান শামিল।

শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীরঃ চেতনায় অম্লান;
 --------------------------------------
  মীর নিসার আলী তিতুমীর ১৭৮২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। অল্প বয়েসেই তিতুমীরের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। তিনি পুরো কুরআন মুখস্ত করেন। তাছাড়াও আরবী ব্যাকরণ, ফারায়েজ, হাদীস, দর্শন, তর্কশাস্ত্র, তাসাউফ, আরবী-ফারসী কাব্য ও সাহিত্যে তিনি বিশেষভাবে দক্ষতা অর্জন করে ছিলেন। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে তার বাংলা ভাষায় অসাধারণ পাণ্ডিত্য। সুফি তিতুমীর  আরবী, ফারসী, উর্দু এবং বাংলা এই চারটা ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। 

   কোলকাতায় এসে তিতুমীর মির্জা গোলাম আম্বিয়ার সাক্ষাৎ পান। উনার সংস্পর্শে যাবার পরে তিতুমীরে জীবনে আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। তিনি মির্জা গোলাম আম্বিয়ার মুরিদ হতে চান। মির্জা আম্বিয়া তিতুমীরকে জকি শাহের কাছে যেতে বলেন। 

   জকি শাহ মনোযোগ দিয়ে তিতুমীরের কথা শোনেন। শুনে বলেন হজ্জ না করা পর্যন্ত তিনি তার রুহানি পীরের সন্ধান পাবেন না। এটা শুনে তিতুমীর হজ্জ করতে মক্কা চলে যান এবং রাহবার খুঁজতে থাকেন। হজ্জে গিয়ে তিনি দেখা পান সাইয়েদ আহমেদ বেরলভীর র. এর। সাইয়েদ বেরলভীর সাথে কথা বলেই বুঝতে পারেন ইনিই তার সেই বহু প্রত্যাশিত রাহবার। তিতুমীর সাইয়েদ বেরলভীর কাছে বায়াত গ্রহন করেন (সাইয়েদ আহমদ হলেন সেই বিখ্যাত বালাকোট আন্দোলনের সাইয়েদ আহমদ। উনার জন্ম ভারতের অযোধ্যায়)। তিতুমীর চার বছর সাইয়েদ বেরলভীর কাছে শিক্ষা গ্রহন করেন। এই সময় তিনি উস্তাদের সাথে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন শহর ভ্রমন করেন।

   নিসার আলীর শিক্ষা, যোগ্যতা এবং তার আদর্শ ও আচরণে অত্যন্ত মুগ্ধ হলেন সাইয়েদ আহমদ। সাইয়েদ আহমদ নিসার আলীকে দায়িত্ব দেন বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারের এবং বাংলার শোষিত এবং লাঞ্ছিত জনগণের জাগাবার। সাইয়েদ আহমদের এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল উপমহাদেশকে ইংরেজ মুক্ত করা এবং যাবতীয় কুসংস্কার থেকে ইসলামকে হেফাজত করা। 

   বাংলাদেশে সাইয়েদ আহমেদের বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মাওলানা আবদুল বারী খাঁ (মাওলানা আকরম খার পিতা), মাওলানা মুহাম্মদ হােসেন, মাওলানা হাজী শরীয়তুল্লাহ, মাওলানা সুফি খোদাদাদ সিদ্দিকী ও মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরি। সাইয়েদ আহমেদ সবাইকেই একই দ্বায়িত্ব দেন। 

   বাগ্মিতা, সুগভীর জ্ঞান আর পর্বত সমান ব্যক্তিত্বের জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই তিতুমীর আলোড়ন তুলে ফেলেন। পলাশীর পরে রাজ্য, সম্পদ হারিয়ে, দুর্ভিক্ষে পরে বাঙালি মুসলমানদের নেতিয়ে পরা মেরুদন্ড তিতুমীরের আগমনে হঠাৎ করে সোজা হয়ে যায়। তিতুমীর তার গ্রামের গরীব কৃষকদের একত্রিত করেন এবং তাদের নিয়ে শুরু করেন জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত আন্দোলন। তিনি মুসলিম সমাজে শিরক ও বিদআতের অনুশীলন নির্মূল করা এবং মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের অনুশাসন অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। এছাড়াও তিতুমীর পুরোদস্তুর ইসলাম প্রচার শুরু করেন। সর্বস্তরের জনগণকে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। 

   এতে নরেচরে বসেন জমিদাররা। জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, গোবরা গোবিন্দপুর জমিদার দেবনাথ রায় এবং গোবর ডাঙার জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যায় এই তিনজন মিলে বানানো ষড়যন্ত্র করে তীতুমীরের বিরুদ্ধে হুকুম জারি করে,

১. যারা তিতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ওহাবী হবে, দাড়ি রাখবে, গোঁফ কাটবে তাদের ফি দাড়ির জন্য আড়াই টাকা ও ফি গোঁফের জন্যে পাঁচ সিকা করে খাজনা দিতে হবে।

 ২. মসজিদ তৈরি করতে চাইলে জমিদারকে কাঁচা মসজিদের জন্য পাঁচশো টাকা এবং পাকা মসজিদের জন্য এক হাজার টাকা করে নজরানা দিতে হবে। 
 
৩. নাম পরিবর্তন করে আরবি নাম রাখলে প্রত্যেক নামের জন্য জমিদারকে ৫০ টাকা খারিজে ফিস দিতে হবে। 

৪. গােরু হত্যা করলে তার ডান হাত কেটে দেয়া হবে। 

৫. যে তিতুমীরকে বাড়িতে স্থান দেবে তাকে ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।

   এই হুকুম জারির পর তা পালন করার জন্য অত্যাচারী কৃষ্ণদেব তার মুসলমান প্রজাদের ওপর নতুন মাত্রায় অত্যাচার আর নির্যাতন শুরু করে। শুধু কৃষ্ণদেব নয়। তার দেখা দেখি এ ধরনের হুকুম জারী করলাে আরও বেশ কয়েকজন জমিদার। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য তারাগুনিয়ার জমিদার রাম নারায়ণ, গােবরা গােবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায়, কুরগাছির জমিদারের নায়েব নাগরপুর নিবাসী গৌড় প্রসাদ চৌধুরী প্রমুখ জুলুমবাজ। 

   এটা না মানার ঘোষণা দিয়ে তিতুমীর তার মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য আমান উল্লাহকে পত্র দিয়ে পাঠান। কৃষ্ণদেব আমান উল্লাহকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। প্রতিশোধ নিতে তিতুমীরও তার মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যান এতে কৃষ্ণদেব এবং পুলিশের সম্মিলিত বাহিনীর সাথে তিতুমীরের সংর্ঘষ হয়। তিতুমীরের কাছে তারা পরাজিত হয়। 

   ১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বাসারাতের নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তিতুমীর বাঁশ এবং কাদা দিয়ে তারা দ্বি-স্তর বিশিষ্ট একটি কেল্লা নির্মাণ করেন। 

   তীতুমীরের প্রভাব দেখে জমিদাররা আতংকিত হয়ে পরে। কোলকাতায় একটা সভা করেন। তাতে উপস্থিত হন কলকাতার লাটু বাবু, গোবর ডাঙ্গার জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, গোবরা-গোবিন্দপুর দেবনাথ রায়, নূর নগরের জমিদারের ম্যানেজার, টাকীর জমিদার সদর নায়েব, রানাঘাটের জমিদারের ম্যানেজার, পোড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, বসিরহাট থানার দারোগা রাম রায় চক্রবর্তী, যদুর আটি দুর্গাচরণ চক্রবর্তী প্রমুখ। এদের সহযোগিতা করে বশীর হাটের দারোগা চক্রবর্তী। 

    এবার সকল জমিদারের সম্মিলিত বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সাথে তিতুমীরের মুজাহিদ বাহিনীর সাথে তিতুমীরের যুদ্ধ হয়। উইলিয়াম হান্টার বলেন, ঐ বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধে জমিদার বাহিনী তিতুমীরের মুজাহিদদের কাছে চরমভাবে পরাজিত হয়। 

  তিতুমীর বর্তমান চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, কুষ্টিয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয় বরণ করে। 

  ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম আইনে দাদন নিয়ে নীলচাষ না-করা আইন বিরুদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় অত্যাচার ক্রমে চরমে উঠে। এসব কথা ও বহুদিনের পঞ্জীভূত ক্ষোভ কৃষকরা ভুলতে পারেনি। তিতুমীরের মুজাহিদদেরা ব্রিটিশদের দেওয়া দাদনের কাগজপত্র নষ্ট করে কৃষকদের বাঁচাবার জন্য একের পর এক নীলকুঠি আক্রমণ করতে থাকেন। বারঘরিয়ার অভিযান তাদের সফল হয়, হুগলির নীলকুঠির তারা তছনছ করে দেয়। বারঘরিয়া ও হুগলির নীলকুঠির মালিক ছিলেন উইলিয়াম স্টর্ম। 

    ৫ নভেম্বর ১৮৩১ তীতুমীরের মুজাহিদ বাহিনী  বারঘরিয়া নীলকুঠি আক্রমণ করে। তারা কুঠির মালিক পিরোঁকে না-পেয়ে তাঁর কুঠি ও বাংলো ধ্বংস করে। বইপত্র যা পায় সব ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে। ১৬ নভেম্বর স্মিথ বারঘরিয়া পৌঁছে শুধু ধ্বংসস্তূপই দেখতে পায়। 

   স্টর্মের হুগলি কুঠির ম্যানেজার ছিলেন হেনরি ব্লন্ড। মুজাহিদরা হুগলির নীলকুঠি আক্রমণ করে এবং ব্লন্ড ও তাঁর স্ত্রী শিশুপুত্রকে ধরে নিয়ে বাঁশের কেল্লায় তিতুমীরের সামনে হাজির করে। সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও তিতুমীরের পক্ষে নীল চাষ না করার প্রতিশ্রতিতে ব্লন্ড সপরিবারে মুক্তি পায়।। 

    অবশ্য বাঁশের কেল্লা ইংরেজদের দখলে এলে এই বন্ডই তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক হলফনামা দিয়েছিলো।
   এরপর স্মিথ মোল্লাহাটি ও রুদ্রপুর, নীলকুঠির মালিক মি. এন্ড্রুজের সাহায্য নেন। তাঁর কাছে থেকে সাতটি হাতি, আশেপাশের জমিদার ও তাদের লড়াকু লোকজন সংগ্রহ করে তিনি তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযানে অগ্রসর হন। 

    ইতোমধ্যে তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তিনি গোবরডাঙ্গা ও অন্যান্য জমিদারের কাছে তাঁর নামে রাজস্ব পাঠাবার পরওয়ানা পাঠিয়ে দেন। তিনি আরও ঘোষণা করেন যে কোম্পানির রাজত্বের অবসান হয়েছে। 

    বারঘরিয়া কুঠির ম্যানেজার পিঁরো ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর তিতুমীরের শক্তিবৃদ্ধি ও নীলকুঠির উপর আক্রমণের ঘটনায় শঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংবাদ পাঠান। বারাসতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার পত্র পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। 

   ১৪ নভেম্বর আলেকজান্ডার সিপাহিসহ সদলবলে নারকেলবেড়িয়ার মাঠে যায়। তিতুমীরকে ভয় দেখানোর জন্যে বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করে। যুদ্ধ ঘোষণায় সাড়া দিয়ে তিতুমীরের বিদ্রোহী বাহিনী সেই গুলির আওয়াজ গ্রাহ্য না করে সিপাহিদের আক্রমণ করে। সেই যুদ্ধে বসিরহাটের দারোগা, জমাদারসহ বহু সিপাহি বন্দি হয়। আলেকজান্ডার  ঘোড়ায় চেপে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। 

     এবার ব্রিটিশ সরকার চরম আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হল। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর কর্নেল হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার অনুসারীদের আক্রমণ করে। সৈন্যরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিতুমীর ঘোষণা দিলেন, "ভাই সব, একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার-জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। শহীদের মর্যদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়"। 

    মুজাহিদরা সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে বেশিক্ষন দাঁড়াতে পারেন নি। ১৯ শে নভেম্বর তিতুমীর ও তার চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। তার বাহিনীর প্রধান গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

সূত্রঃ 
১. মোশাররফ হোসেন খান, সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর। 
২. কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন। 
--------------------------------- 
লেখকঃ প্রবন্ধ লেখক কলামিস্ট বিশ্লেষক ও  অনলাইন এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments