Recent Tube

মিসওয়াক। আব্দুল্লাহ আরমান।




                 
                      মিসয়াক। 



    রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সমস্ত সুন্নাহর মাঝে এই একটিমাত্র সুন্নাহ যা আমাকে সবচেয়ে বিস্মিত করে। অবাক হওয়ার কারণ নিম্নোক্ত হাদীসঃ عَنِ الْمِقْدَامِ بْنِ شُرَيْحٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ سَأَلْتُ عَائِشَةَ قُلْتُ بِأَىِّ شَىْءٍ كَانَ يَبْدَأُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا دَخَلَ بَيْتَهُ قَالَتْ بِالسِّوَاكِ ‏
অর্থঃ মিক্বদাম-এর পিতা শুরায়হ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ: তিনি বলেন, আমি ‘আয়িশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, রসূলুল্লাহ(সাঃ) তাঁর ঘরে ঢুকে সর্বপ্রথম কোন্‌ কাজটি করতেন? তিনি বললেন, “সর্বপ্রথম মিসওয়াক করতেন”। (মুসলিমঃ৪৭৮)।

    ছোট্ট ও সাদামাটা এই হাদীসটির মাঝে গভীর চিন্তার খোরাক রয়েছে। মুহাম্মাদ (সাঃ) ছিলেন একাধারে একজন রাষ্ট্রপতি, সমরনায়ক, প্রধান কূটনীতিক, সকল সচিবালয় ও মন্ত্রণালয়ের প্রধান, প্রধান আইনজ্ঞ ও বিচারপতি, নতুন ধারার অর্থনীতির প্রবক্তা ও তত্বাবধায়ক , ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার একমাত্র শিক্ষক, প্রধান জনপ্রশাসক ও জনপ্রতিনিধি……সর্বোপরি তিনি রিসালাতের কঠিন ও মহান দায়িত্বপ্রাপ্ত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। তাঁর ঘরের পাশে অবস্থিত মসজিদে নববীই ছিলো উপরোল্লিখিত সবকিছুর হেডকোয়ার্টার।
উপরোক্ত পরিচয়ের বাইরে তার আরেকটি পরিচয় আছে, তিনি স্বীয় স্ত্রীদের নিকট একজন শ্রেষ্ঠ ‘স্বামী’। 

    রাষ্ট্রের যাবতীয় দায়িত্ব, বিপদ-আপদ, আক্রমণ-প্রতিরক্ষা, ষড়যন্ত্র মোকাবিলা, জনকল্যাণ ইত্যাদি ছাড়াও ব্যক্তি জীবনের দুর্বিষহ অভাব অনটনের বোঝা তাঁর একক মস্তিষ্কে বহন করতে হয়েছে সারাটি ক্ষণ। মানসিকভাবে বহুমুখী অস্থিরতা স্বত্বেও একজন স্বামী হিসেবে তিনি যখন ঘরে ফিরতেন তখন স্ত্রীর নিকট নিজেকে পরিপাটি করে উপস্থাপন করতে কখনোই ভুলতেন না!! ঘরে ঢুকেই তিনি প্রথম মিসওয়াক হাতে নিতেন অথচ কিছুক্ষণ আগে মসজিদে যাওয়ার সময় তিনি মিসওয়াক করেই ঘর থেকে বের হয়েছেন। স্ত্রীর ভালোলাগা ও নিজের ব্যক্তিত্ব রক্ষায় তিনি কতোটা তৎপর ছিলেন এ থেকে সহজেই অনুমেয়। হিসাব করলে দেখা যায় অন্যান্য সময় ব্যতিরেকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে মসজিদে যাওয়ার সময় এবং ফিরে এসে তিনি মোট ১০ বার মিসওয়াক করতেন! আবারও বলছি ১০ বার!!! এত্তো ব্যস্ততা স্বত্বেও রুটিনমাফিক এই ছোট্ট কাজটি করতে যিনি কখনোই ভুলতেন না, ভাবতে পারেন তিনি কতোটা সচেতন ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ এবং স্মার্ট স্বামী ছিলেন!

     নারীরাও এই মানবীয় ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য অধিকাংশ নারী এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন নয়। স্ত্রীদের সৌন্দর্য ও পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সৃষ্টিগতভাবে পুরুষরা একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের। তাই স্বামীর মনোরঞ্জন, ভালোবাসা ও নৈকট্য অর্জনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিম উম্মাহর বিদুষী জননী আয়েশা (রাঃ) তাঁর নিজ ঘরে মিসওয়াক করতেন।(বুখারীঃ৪২৫৩)

      মুখগহ্বরের সুস্থতা দাম্পত্য জীবনের ঘনিষ্ঠতায় বিশেষ প্রভাব ফেলে। তাছাড়া সামাজিকভাবেও নিজের ব্যক্তিত্ব ও আত্মবিশ্বাস বজায় রাখতে এটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আলেমসমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ  রাসূলের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ আমলের ব্যাপারে বড়োই উদাসীন। অথচ রাসূল (সাঃ) মিসওয়াক করাকে এতোটাই গুরুত্বারোপ যা অন কোনো সুন্নাতের ক্ষেত্রে কখনও করেননি। তিনি বলেনঃ   لَوْلَا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي أَوْ عَلَى النَّاسِ لَأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ مَعَ كُلِّ صَلاَةٍ.
  অর্থঃ “আমার উম্মাতের জন্য বা তিনি বলেছেন, লোকদের জন্য যদি কঠিন মনে না করতাম, তাহলে প্রত্যেক সালাতের সাথে তাদের মিস্‌ওয়াক করার হুকুম করতাম”। (বুখারীঃ৮৮৭)

     সবচেয়ে অবাক করা বিষয় মৃত্যুর কিছুক্ষণ পূর্বে রাসূল (সাঃ) মিসওয়াক করেই তাঁর রবের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। গল্পটা আয়েশা রাঃ এর মুখেই শুনুনঃ 
“আবদুর রহমান ইবনু আবূ বকর (রাঃ) নবী (সঃ)-এর কাছে এলেন। তখন আমি নবী (সাঃ) কে আমার বুকে হেলান দেয়া অবস্থায় রেখেছিলাম এবং আবদুর রহমানের হাতে তাজা মিসওয়াকের ডাল ছিল যা দিয়ে সে দাঁত পরিষ্কার করছিলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার দিকে (মিসওয়াক পাওয়ার আশায়) তাকালেন। আমি মিসওয়াকটি নিলাম এবং তা চিবিয়ে নরম করলাম। তারপর তা নবী (সাঃ)-কে দিলাম। তখন নবী  (সাঃ) তা দিয়ে দাঁত মর্দন করলেন। আমি তাঁকে এর পূর্বে এত সুন্দরভাবে মিসওয়াক করতে আর কখনও দেখিনি। মিসওয়াক শেষ করেই রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর উভয় হাত অথবা আঙ্গুল উপরে উঠিয়ে তিনবার বললেন, উচ্চে সমাসীন বন্ধুর সঙ্গে ( অর্থাৎ আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই)। তারপর তিনি  ইন্তিকাল করলেন…”। (বুখারীঃ৪৪৩৮)

     আল্লাহর নিকট মুখের পরিচ্ছন্নতা কতটা কতটা প্রিয় তা জানতেন বলেই  মৃত্যুর সীমাহীন কষ্ট সহ্য করেও তিনি মিসওয়াক করেছেন!! এই হাদীসটির মর্ম উপলব্ধি করতে গভীর চিন্তাশীল হওয়ার প্রয়োজন নেই!

    প্রতিটি মানুষের মুখে বিভিন্ন ধরণের জীবাণু থাকে। মুখ গহ্বরের থুথু, দাঁত, দাঁতে আটকে থাকা প্লাকে এসব জীবাণু বাস করে। জনগোষ্ঠী ও তাদের খাদ্যাভ্যাসের ভিন্নতার উপর ভিত্তি করে মুখে বিভিন্ন প্রকার ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। গবেষণায় কয়েকটি ভিন্ন জনগোষ্ঠীর ১০০ জন মানুষের মুখে ৪০০ প্রকার ব্যাকটেরিয়ায় অস্তিত্ব পাওয়া গেছে!! মানুষ রাতে ব্রাশ না করলে সে ২৫০ প্রকারের ব্যাকটেরিয়া নিয়ে ঘুমাতে যায়! অপর এক গবেষণায় বলা হয়েছে পৃথিবীর ৩৫-৪৫% মানুষের মুখ থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। এজন্য আমেরিকায় প্রতি বছর কেবলমাত্র মুখ গহ্বরের ফ্রেশনেসের জন্য ১০ বিলিয়ন ডলারের প্রসাধনী বিক্রি হয়। এছাড়াও মুখ গহ্বরের অপরিচ্ছন্নতা মুখের ও দাঁতের বহু রোগের অন্যতম প্রধান কারণ।

    প্রাকটিসিং মুসলিমের সংখ্যা বর্তমানে নিতান্তই কম। যারা আবার প্রাকটিসিং তাদের খুবই কম সংখ্যক মানুষ এই গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহটি আমল করে। তাই আসুন ব্রাশ-পেস্ট ব্যবহারের পাশাপাশি প্রিয় রাসূলের প্রিয় এই সুন্নাহটি পুনরুজ্জীবিত করি এবং সুস্থ থাকি।
---------------------------------
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক প্রবন্ধ লেখক অনলাইন এক্টিভিস্ট ও শিক্ষক। 

Post a Comment

0 Comments