Recent Tube

আমাদের আচার আচরণের প্রকট সংকট; ওহিদুল ইসলাম।


 


   আমাদের আচার আচরণের প্রকট সংকট;


     আমাদের আচার আচরণের এমন অনেক নিন্দনীয় দিক আছে যা দেশে থাকতে কখনোই চোখে পড়েনি। এসব দুষণীয় আচার আচরণে আমরা এমনভাবে অভ্যস্ত যে এগুলোকে আমরা স্বাভাবিক জীবনাচার মনে করি। এগুলো যে লজ্জাকর বা তিরস্কারযোগ্য তা আমরা অনুভবই করি না। এসব আচার আচরণ কমবেশী নিজ চরিত্রে ধারণ করেই দেশ ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমাই। প্রবাস জীবনে প্রতিনিয়ত অন্যান্যদের আচার আচরণ ও জীবনধারার সাথে তুলনা করে নিজেদের লালিত ও অভ্যস্ত অনেক বেখাপ্পা আচার আচরণ আবিষ্কার করি। অতিমাত্রায় লক্ষণীয় আমাদের এসব আচার আচরণকে অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠির আচার আচরণের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে সত্যিই চরমভাবে ব্যথিত হই। ভাবি, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনপদের মানুষ হিসেবে আমাদের আচার আচরণ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার শিক্ষা ও রাসুল (সঃ) এর প্রশিক্ষনের ধারায় হবে মার্জিত, পরিশীলিত, ভদ্রজনোচিত, প্রশংসনীয় ও অন্যান্যদের জন্য অনুকরণীয়। কিন্তু এমন হলো কেনো, কিভাবে? কেনো আমাদের আচার আচরণের এমন প্রকট সংকট?

     আমি বড়ো কোনো উদাহরণ টানছি না। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উঁচুতলার-নীচুতলার, পেশাজীবি-দিনমজুর, শহুরে কিংবা গ্রামের – সর্বস্তরের মানুষের সাথে পরিচিত ও বোধগম্য আটপৌরে জীবনের অতি খুঁটিনাটি কিছু বিষয় এখানে সবার সামনে আনতে চাই। আমার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছুটা তুলনামূলক বিশ্লেষণ পেশ করতে চাই। যেটাকে আমি আমাদের আচার আচরণের চরম সংকট বলছি তা পাল্টে মানানসই কাংখিত আচার আচরণে অভ্যস্ত হতে আমাদের কোনো প্রকার অর্থ, সময় বা শ্রম ব্যয় হবে না। সভ্য ও মননশীল হওয়ার ইচ্ছেটাই যথেষ্ট। আসুন আমরা এমন কয়েকটা অসংলগ্ন আচার আচরণ সম্পর্কে জেনে নিইঃ

   ১. আপনি কোনো আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিত মানুষের মুখোমুখি হলেন। অপরজন আপনাকে অনেক আবেগ ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ভাই কেমন আছেন? আপনি ভাবলেশহীন ভাষা ও ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, ভালো, অথবা ভালো আছি। আপনার কুশলাদি জানার জন্য তাকে ধন্যবাদ দেয়ার প্রয়োজন্টুকু আপনি একেবারেই অনুভব করলেন না। এমনকি তিনি যতোটুকু আপনার কুশলাদি জানতে চেয়েছেন আপনি তার সম্পর্কে অন্ততঃ ততোটুকু জানার আগ্রহ প্রকাশ করার মতো ন্যায়পরায়ণতা দেখালেন না। আপনার কথাবার্তার মধ্যে আবেগানুভূতির অভিব্যক্তির কথা বাদই দিলাম। একজন বিদেশীকে আপনি এমন কুশলাদি জানতে চায়লে তিনি প্রত্যুত্তরে অবশ্যই ন্যুনতম এতোটুকু বলবেন – I’m well. Thank you very much for asking. And how are you doing? Great to see you.

   ২. আপনি রিক্সায় উঠলেন। গন্তব্যে পৌঁছে বললেন, এই রিক্সা এখানে থামো। রিক্সা সঙ্গে সঙ্গে আপনার কথা মতো থেমে গেলো। আপনি তাকে কখনোই ধন্যবাদ জানানোর কথা ভাবতেই পারেন না। কারণ সে তো আপনার দাস, হুকুমের গোলাম। সে আপনার ভাড়া খাটছে। আপনি থামতে বলেছেন সে থেমেছে, আপনার হুকুম তামিল করেছে। এখানে ধন্যবাদ জানানোর কি আছে? প্রবাসের অভিজ্ঞতাটা একটু ভিন্ন। যাত্রী স্বভাবসুলভ ট্যাক্সী ড্রাইভারকে Thank you বলতেই অভ্যস্ত। 

   ৩. আপনার রিক্সার ভাড়া ৫০ টাকা। আপনি রিক্সা থেকে নেমে একশো টাকার একটা নোট রিক্সাওয়ালার দিকে এগিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, ভাংতি নেই স্যার। আপনি তাকে ধমক দিয়ে বললেন, ভাংতি থাকে না কেনো? রাস্তায় রিক্সা নামানোর আগে হাতে ভাংতি রাখার কথা মনে থাকে না? এর বিপরীতে এমনও হতে পারে যে রিক্সাওয়ালার হাতে ভাংতি নেই বলে আপনি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, ফেরত দেয়া লাগবে না। পুরোটাই রেখে দাও। রিক্সাওয়ালা মনে মনে নিশ্চয়ই অনেক খুশী হলেন। কিন্তু একটি বারও মনে করলেন না যে আপনাকে একটু ধন্যবাদ জানানোর দরকার আছে। তিনি একশো টাকা পকেটে ঢুকিয়ে রিক্সার প্যাডেলে পা রেখে নীরবে উধাও হয়ে গেলেন। প্রবাসে ট্যাক্সিওয়ালা অবশ্যই বলতেন, Are you sure you do not want the money back? That’s so kind of you. Thank you very much.

  ৪. আপনি কোনো এক বহুতল ভবনের লিফটে আছেন। আপনার হাত খালী। পরবর্তী ফ্লোর থেকে আরেকজন লিফটে উঠলেন। আপনি দেখছেন তার দুই হাত ভরা বই-পুস্তক বা ফাইলপত্র। আপনি আপনার মতো করে নীরবে দাঁড়িয়েই আছেন। ভাবতেই পারছেন না যে তার জন্য আপনার কিছু করার আছে। প্রবাসে এমন পরিস্থিতিতে আপনি অভ্যাসবশতঃ ও স্বভাবসুলভ তিনি কোন ফ্লোরে নামবেন তা জেনে নিয়ে তার জন্য সেই ফ্লোরের সুইচটা টিপে দিতেন। কিন্তু দেশে আমরা সচরাচর অনুরোধ না করলে স্বপ্রনোদিত হয়ে এই কাজটুকু করিনা। কেউ আপনার লিফটে ঢোকার আগে দরজাটা হাত দিয়ে খুলে রাখলো অথবা আপনার জন্য আপনার কাংখিত ফ্লোরের বাটন টিপে দিলো। আপনি ঘুণাক্ষরেও তাকে ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন না। প্রবাস জীবনে কখনোই এমন দেখিনি। যেখানেই সাহায্য সেখানেই ধন্যবাদ। যেখানেই বদান্যতা সেখানেই কৃতজ্ঞতা। 

  ৫. আপনি কোথাও দরজা খুলে ঢুকলেন বা বের হলেন এরপর দরজা ছেড়ে দিলেন।  প্রবাসে এমন কখনোই হতে দেখিনি। বিদেশীরা দরজা খুলে নিজে ঢোকার পর সঙ্গে সঙ্গে দরজা ছেড়ে দেয়না। বরং দরজা হাতে ধরে খুলে রেখে পেছনে তাকিয়ে দেখে আর কেউ আছে কিনা। পেছনের সবগুলো মানুষ বের হওয়ার বা ঢোকার পরে অথবা পিছনের অন্য কেউ আপনার স্থলাভিসিক্ত হয়ে দরজা বাকীদের জন্য খুলে রাখার দায়িত্ব নিলেই আপনি দরজা ছেড়ে সামনে অগ্রসর হবেন। আপনি যতোক্ষণ অন্যান্যদের জন্য দরজা ধরে রাখবেন ততোক্ষণ প্রত্যেকেই আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে বা বের হবে। এর ব্যতিক্রম আমি দেখিনি। এর ব্যতিক্রম দেখি শুধু আমার দেশে। আর এ ব্যতিক্রমই আমার দেশে স্বাভাবিক নিয়ম। 

  ৬. দেশের কোনো এক ব্যক্তি আমার নাম উল্লেখ করে এবং নামের আগে একটি বিশেষণ যুক্ত করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। আমি পোস্টটি দেখে বিশেষণটির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে ওটা ডিলিট করার অনুরোধ জানিয়েছি। দুইবার অনুরোধ করার পরও দেখি ওটা ডিলিট করা হয়নি। আমি তৃতীয়বার অনুরোধ করলাম, এখনো কিন্ত আমার নামের আগে বিশেষণটি বহাল আছে। ওটা ডিলিট করে আমাকে জানাবে। কয়েক ঘন্টা পরে তার মেসেজ পেলাম, জি ডিলিট করে দিয়েছি। এটি প্রবাসে হলে মেসেজটি এমন হতো – I’m extremely sorry for this mistake. Please accept my sincere apology and forgive me. I have deleted it now and it will never happen again. এর বিপরীতে ভুল-ত্রুটিকে ভুল-ত্রুটি হিসেবে স্বীকার করা, সেজন্য অনুশোচনা করা এবং ক্ষমা চাওয়া সম্পূর্ণই আমাদের স্বভাব চরিত্রের সাথে সাংঘর্ষিক। এটা যে কতো বড়ো অসভ্য, ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও বেপরোয়া আচরণ তা আমরা অনুভবই করিনা। কারও শ্রেষ্ঠত্ব তার সৃষ্টিগত দৈহিক উপাদানে নয় বরং তার আচরণে। আগুনের তৈরী আযাযিল ভুলের জন্য অনুশোচনা না করে বরং দাম্ভিকতাপূর্ণ আচরণের কারণে কিয়ামত পর্যন্ত ইবলিস শয়তান বনে গেলো। পক্ষান্তরে মাটির তৈরী আদম (আঃ) অকপটে নিজের ভুল স্বীকার ও অনুশোচনা করে ক্ষমা চায়লেন। তাতে তার মান ক্ষুন্ন হয়নি। আল্লাহ তায়ালা আরও বেশী খুশী হয়ে তার মর্যাদা বাড়িয়ে দিলেন। তিনি ভুল স্বীকার, অনুশোচনা ও ক্ষমাপ্রার্থনা করে নমনীয় স্বভাবের বদৌলতে আশারাফুল মাখলুকাত বনে গেলেন। 

      এমন আরও অনেক উদাহরণ আছে যা আমাদের আচার আচরণের ক্ষেত্রে চরম সংকটকে চিত্রিত করে। অথচ সেসব আচার আচরণ এখন আমাদের স্বভাব চরিত্রেরই অবিচ্ছেদ্য ভূষণে রূপ নিয়েছে। এসব আচার আচরণের ক্ষেত্রে আমরা বিনা বিনিয়োগে অনায়াসেই সংশোধিত, মার্জিত, পরিশীলিত ও সভ্য হয়ে উঠতে পারি। ব্যক্তি ও জাতি হিসেবে আমরা কতো উন্নত ও মর্যাদাবান তা নির্ধারন করে আমাদের এই সব আচার আচরণ।

Post a Comment

0 Comments