তা-লি-বা নে'র ওপর গুপ্তচরবৃত্তি : এক আমেরিকান অফিসারের স্বীকারোক্তি।
এই নির্মোহ নির্মম বাস্তব গল্পটি আপনাকে আপনার কল্পনার জগৎ ছেড়ে ভিন্ন ও অজানা এক রাজ্যে নিয়ে যাবে।যে রাজ্য আপনার জন্য অপরিচিত এবং প্রতিটি দৃশ্য ও মুহূর্ত টানটান উত্তেজনা এবং উৎকন্ঠার আর দারুন ইস্টারেস্টিং।
চলুন তাহলে শুনা যাক
(মূল : ইয়ান ফ্রেটজ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা। তালেবান যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাবৃত্তি করেছেন। তিনি তার কার্যক্রম বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন যে কিভাবে তিনি তালেবান যোদ্ধাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন, একইসাথে তাদের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা ও হাস্যকর কথাবার্তা শুনতেন, লড়াইয়ে তাদের যে বীরত্ব ও উদ্দীপনা দেখেছেন। এবং আফগানিস্তানের পাহাড়ে দীর্ঘদিন লড়াইয়ের পর তিনি যে ভবিষ্যত দেখছেন সেটা এই প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন।)
যখন আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে, তুমি আফগানিস্তানে কী করেছ? তখন তাকে বলি, আমি বিমানে চড়ে গোয়েন্দাবৃত্তি করেছি এবং তালেবানের কথোপকথন আড়ি পেতে শুনেছি। আমার দায়িত্ব ছিল ন্যাটো সৈন্যদের সতর্ক সংকেত প্রেরণ করা।
তাই আমি তালেবান যোদ্ধাদের পরিকল্পনা জানার উদ্দেশ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের কথোপকথন শুনতাম। দায়িত্ব গ্রহণের আগে আমাকে কেউ কেউ এই বলে সতর্ক করেছে যে তোমাকে হয়তো অপছন্দনীয় ও ভয়ঙ্কর কথাবার্তা শুনতে হবে। বাস্তবেও এরকম কথা আমার শুনতে হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, যখন আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কারো কথাবার্তা আড়ি পেতে শুনবেন তখন অনেক দৈনন্দিন কথাও কানে আসবে, যদিও তারা আপনার শত্রু হয় এবং আপনাদের হত্যা করতে উদ্যত হয়। আমি মাঝে মধ্যে তাদের কিছু কথা শুনে হাসতে বাধ্য হতাম।
এক শীতের রাতে উত্তর আফগানিস্তনে ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০০০ মিটার উপরে ডিউটি করছিলাম। সেখানে তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের নিচে। তখন দুই তালেবান যোদ্ধার মাঝে এ কথোপকথনটি শুনেছিলাম।
১ম জন : এখানে বোমাটা ফিট করো, তাহলে চোখে পড়বে না।
২য় জন : সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করি, তখন ফিট করব।
১ম জন : না,না, সকালে সম্ভব নয়, কারণ আমেরিকানরা ভোরেই চলে আসবে। এখানে বোমা বসাতে পারলে বেশি সৈন্য হতাহত করা সম্ভব।
২য় জন : আমি অপেক্ষা করতে চাই।
১ম জন: না, দেরি করা যাবে না, যাও, ফিট করো।
২য় জন : আরে! এখনই করতে হবে নাকি?
১ম জন : হ্যাঁ যাও, হুকুম তামিল করো।
২য় জন : আমি এখন ফিট করতে চাচ্ছি না।
১ম জন: কেন চাচ্ছো না? আমাদের উপর জিহাদ ওয়াজিব।
২য় জন : হে ভাই! জিহাদের জন্য পরিবেশটা প্রচণ্ড ঠান্ডা।
এতক্ষণে আসল কথাটা বলল। তারা এমন লোকদের হত্যা করার পরিকল্পনা করছিল যাদেরকে রক্ষা করাই আমার দায়িত্ব।
লোকটি আসলে ভুল বলেনি। কারণ ওই সময় প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছিল। আমরা বিমানের ভেতরে প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র গায়ে দিয়েও শীতে কাঁপছিলাম। ওই সময়টা আসলেই যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত ছিল না।
আমি যে মিশনে ছিলাম সে ধরনের মিশনের জন্য ২০১১ সালে মাত্র ২০ জন প্রশিক্ষক ছিল। আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পার্সোনাল ছিল মাত্র দুজন।
আমি আফগানিস্তানের মৌলিক দুটি ভাষা পশতু ও দারি ভাষা রপ্ত করলাম। এরপর আমেরিকান এয়ার ফোর্সের বিশেষ অপারেশন পরিচালনাকারী বাহিনীর বিমানে চড়ে আড়ি পাতার দায়িত্ব পালন করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলাম।
এই শাখায় ১২টি বিমান ছিল। আমি অবশ্য কেবল ভারী অস্ত্রে সজ্জিত বিমানেই চড়তাম। এগুলোর কোনোটি কেবল একটি গাড়ি ধ্বংস করতে পারত, আবার কোনোটি পুরো ভবন ধসিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখতো।
এই ধ্বংসাত্মক অস্ত্রগুলো আমরা আফগানিস্তানের মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছি। রাখঢাক না করে সংক্ষেপে এটাই ছিল আফগানিস্তানে আমার দায়িত্ব।
আমি ৯৯টি অপারেশনে মোট ৬০০ ঘন্টা আকাশে উড়েছি। এর মধ্যে ২০টি অপারেশনে (তার দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ ঘণ্টা) প্রচণ্ড লড়াই হয়েছে।
আর ১০০ ঘন্টার মতো গোয়েন্দা কার্যক্রমে ব্যয় হয়েছে। এ সময়ে শক্রদের পরিকল্পনা-পর্যালোচনা আড়ি পেতে শুনেছি।
আর বাকি সময় সাধারণ কথাবার্তা শুনে পার হয়েছে। যেমন খাবার রান্নার তালিকা করা, হাসি-ঠাট্টা, গল্প-গুজব, আমেরিকা চলে গেলে তাদের পরিকল্পনা ও স্বপ্ন। ঝগড়া বিবাদ, কথা কাটাকাটি ইত্যাদিও শোনা যেত।
সেখানে 'কালিমা' নামে এক ব্যক্তি ছিল। তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার জন্য সে নানা আজব যুক্তি দিত। এই অভ্যাস অন্য আফগানদের মাঝেও পেয়েছি। যাই হোক, সুনির্দিষ্ট করে তাকে চিনতে পারিনি। তবে মনে হলো– সে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয়।
তবে একবার একজনকে ওয়ারলেসে তার নাম ধরে বারবার ডাকতে শুনলাম। নানাভাবে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারল না। আমি শেষ পর্যন্ত শুনলাম। কিন্তু 'কালিমা'-এর পক্ষ থেকে কোনো প্রতিউত্তর এলো না। হয়তো তার ওয়ারলেস সেটের চার্জ ফুরিয়ে গিয়েছিল নতুবা তিনি কথা বলতে চাচ্ছিলেন না বা তিনি মারা গিয়েছিলেন আমাদেরই হাতে।
তালেবান যোদ্ধাদের একধরনের বিরল প্রতিভা রয়েছে। আর তা হলো– উদ্দীপনাময় স্লোগান। আমি তাদের মতো উদ্দীপনাময় তেজোদীপ্ত স্লোগান অন্য কোথাও দেখিনি। প্রতিটি যুদ্ধের শুরুতে, বা শেষে তাদের উদ্দীপ্ত স্লোগান শোনা যেত। হয়তো বা এটা তাদের একটি যুদ্ধ কৌশল। অথবা তাদের মজবুত ঈমান ও পবিত্র যুদ্ধের বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ।
আমি যতই শুনেছি ততই এই ধারণা পোক্ত হয়েছে যে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য এই শ্লোগানগুলো টনিক হিসেবে কাজ করে।
বিপুল জযবা ও উদ্দীপনা ছাড়া তাদের পক্ষে এমন ভয়াবহ শক্রর মোকাবেলা করা সম্ভব হতো না, যারা তাদের উপর বোমা বিস্ফোরণ করে ভবন ধসিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।
এটা মোটেই অতিশয়োক্তি নয়। আমার ২২তম জন্মদিনের দু'এক দিন আগের ঘটনা। একটি যুদ্ধবিমান ২০০ কেজি ওজনের একটি বোমা নিক্ষেপ করলে মুহূর্তেই ২০ তালেবান মাটির সাথে মিশে গেল। দূরবীণ দিয়ে দেখলাম, তারা যেখানে ছিল সেখানে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ভাবলাম– তাদের যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
কিন্তু যখনই সেখানে দুটি হেলিকপ্টার গেল তখন তালেবান সৈন্যরা চিৎকার করে বলতে লাগল ফায়ারিং শুরু করো! তাদেরকে তাড়িয়ে দাও। হে ভাইয়েরা! আমরাই বিজয় লাভ করব।
হঠাৎ দেখি আমাদের ছয়জন আমেরিকান সৈন্য নিহত হলো। আর তারা আল্লাহু আকবার শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল।
তারা যে অত্যাধুনিক সব বিমান হেলিকপ্টার ও অস্ত্রশস্ত্রের মোকাবেলায় ৩০ বছরের পুরোনো কালাশনিকভ রাইফেল নিয়ে লড়াই করছে সেটা নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা ছিল না।
এমনকি দিনে কখনো শতাধিক যোদ্ধার মৃত্যু ঘটছে সেদিকেও কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না।
চারিদিকে গুলি-বোমার আওয়াজ, সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার দৃশ্য তাদের আকাশচুম্বী মনোবলে বিন্দুমাত্র চিড় ধরাতে পারেনি।
বরং তারা একে অপরকে সাহস যোগায় এবং এই বিশ্বাসে অটল থাকে যে তারা অবশ্যই বিজয় লাভ করবে এবং আমাদের হাত থেকে আফগানিস্তানের দখল ফিরিয়ে নেবে।
সেটা ছিল আফগানিস্তানে আমার প্রথম অপারেশন। সময়ের সাথে সাথে আমি গোপন সঙ্কেতগুলোর অর্থ বুঝতে শিখলাম। গোলাবৃষ্টির মাঝেও তালেবান যোদ্ধাদের কথাবার্তা আলাদা করে বোঝার মতো সক্ষমতা অর্জন হলো। খুব কম সময়ে তালেবানের অনেক গোপন তথ্য হস্তগত করলাম।
২০১১ সালে স্পেশাল ফোর্সের একটি দলকে সহায়তার জন্য আমাদেরকে পাঠানো হলো। তারা উত্তর আফগানিস্তানের একটি গ্রামে হামলার শিকার হয়েছিল। আমাদেরকে নজরদারির দায়িত্ব দেয়া হলো। আকাশ থেকে সেখানকার বাসিন্দা ও আনাগোনাকারীদের পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম ও তাদের কথাবার্তা শুনতে লাগলাম।
পর্যবেক্ষণে দেখলাম, কিছু লোক জমিতে কৃষিকাজ করছে, অন্তত আমাদের কাছে এমনটিই মনে হয়েছিল। আমরা যখন ভূমিতে অবস্থিত কন্ট্রোল রুমকে জানালাম, তখন তারা বলল যে এরা কৃষক নয় বরং হামলাকারী। সেখানে কোনো কিছু চাষ করছে না বরং তাদের অস্ত্রগুলো লুকাচ্ছে।
সাথে সাথে আমরা তাদের উপর গোলাবর্ষণ করলাম। তিনজনের একজন ভূপাতিত হলো। আরেকজন তার পা হারালো। আর তৃতীয়জনের শরীর গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলে আমরা মনে করলাম সে মারা গেছে।
কিন্তু সে উঠে হেঁচড়াতে লাগল। এমনকি তার বন্ধুরা এসে তাকে হস্তচালিত বাহনে উঠিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। আমাদের মনে হলো সে পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তাদের ফিরে আসার আশঙ্কাও ছিল। কন্ট্রোল রুম থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে তারা হয়তো বড় কোনো সৈন্যদল নিয়ে এর প্রতিশোধ নেবে।
তবে আমরা আড়ি পেতে তাদের কথাবার্তা শুনছিলাম। তাতে তারা প্রতিশোধের জন্য আবার ফিরে আসবে বলে মনে হচ্ছিল না।
তারা বলাবলি করছিল, 'তাড়াতাড়ি আসো, আব্দুল আহত হয়েছেন, আমরা তাকে নিয়ে আসছি।' তারা তাদের বন্ধুকে কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু তাদের অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি করে এবং পথেই তিনি মারা যাযন। এরপর হামলার কোনো আশঙ্কা না থাকায় আমরা তাদেরকে সে অবস্থায় রেখে চলে আসি।
সেখানে দায়িত্ব পালনকালে প্রতিবারই আমাদের তুলনায় তাদের হতাহতের সংখ্যা বেশি হতো, তাদের এলাকা হাতছাড়া হতে হতো, প্রতিটা লড়াইয়ে আমরা জয়লাভ করতাম।
এটা এমনই কমন হয়ে গিয়েছিল যে সবগুলো অভিযান একইরকম মনে হতো। সেখানে দায়িত্ব পালনকারী অন্যদের অভিজ্ঞতাও এর ব্যতিক্রম নয়। দিনের পর দিন একই ডিউটি, একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটত। একই দায়িত্ব পালনের জন্য উড়ে যেতাম। একই জায়গায়, কখনো একই এলাকা পুনরুদ্ধার করতাম। আড়ি পেতে একই কথা, একই ধরনের পরিকল্পনা শুনতাম। কখনো হুবহু এক ব্যক্তিরই আওয়াজ শুনতে পেতাম যার কথা পূর্বেও শুনেছি।
এক অপারেশনে আমার দায়িত্ব ছিল পাইলটকে পাহারা দেয়া। তিনি একটি ছোট গ্রামে গেছেন পরিদর্শন ও সেখানে একটি গভীর নলকূপ স্থাপনের ব্যাপারে নেতৃত্বস্থানীয়দের সাথে মত বিনিময়ের জন্য।
আমরা কয়েক ঘন্টা ধরে তাদের মাথার উপর চক্কর দিলাম। তবে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। কেউ সন্দেহজনক আচরণ করল না, এবং ওয়ারলেসে লড়াইয়ের ব্যাপারে কোনো আলোচনাও শুনতে পেলাম না। সুন্দরভাবেই বৈঠকটি সম্পন্ন হলো।
যখনই তিনি হেলিকপ্টারে ফিরে আসতে লাগলেন, হঠাৎ করে তালেবান যোদ্ধারা তার ওপর আক্রমণ করে বসল। আমরা বললাম : দ্রুত উঠে পড়ুন, তারা পূর্বদিক দিয়ে দৌড়িয়ে আসছে। কিন্ত তিনি মাটিতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। হঠাৎ তিনি বললেন, তারা কী করছে? ধ্যাৎ! গুলি খেলাম। তালেবান যোদ্ধারা বুঝতে পারল যে তারা পাইলটকে গুলিবিদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।
আমি তাদের কথোপকথন ও আল্লাহু আকবার স্লোগান শুনে বুঝতে পারলাম। তারা বলছিল, হে ভাই! একজনের গুলি লেগেছে, লড়াই চালিয়ে যাও। আমরা আরো হতাহত করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
হঠাৎ করেই তাদের উৎসব থেমে গেল। কারণ আমাদের বিমান তাদের উপর হামলা করেছে। ওই দিনটি আমার জন্য সবচেয়ে খারাপ দিন ছিল। গুলি, চিৎকার বা মৃত্যুর কারণে নয়। কারণ এগুলোতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। বরং ওই দিন আমি এমন একটি বিষয় বুঝতে পেরেছিলাম, তালেবান যোদ্ধারা দীর্ঘ সময় ধরে আমাকে যেটা বোঝানোর চেষ্টা করছিল।
প্রতিটা অপারেশনে আমি তাদের উপর চক্কর লাগাতাম, তাদের কথাবার্তা আড়ি পেতে শুনতাম। তারাও জানত যে আমরা আড়ি পেতে তাদের কথাবার্তা শুনছি। তারা নিহত আমেরিকান সৈন্যদের সংখ্যা নিয়ে গর্ব করত, তারা যে সকল অস্ত্র লাভ করেছে সেগুলো নিয়ে গর্ব করত। এমনকি কোন কোন জায়গায় বোমা স্থাপন করেছে বা করবে সেগুলোও বলে ফেলত।
তবে এর মধ্যেও যে বিষয়টি আমার আগেই জানা উচিত ছিল তখনো সেটি জানা হয়নি।
এই যে তারা বিভিন্ন ধরনের গালাগালি ও কৌতুক করত, সেটা কেবল ঠাট্টার জন্য নয় বরং এগুলোর মাধ্যমে তারা যুদ্ধের ক্লান্তি ও বিরক্তি দূর করত।
যুদ্ধ শেষে তালেবান যোদ্ধারা কয়েক কিলোমিটার দূরে পার্শ্ববর্তী গ্রামে তাদের বাড়িতে চলে যেত। আর সেই কৃষকরা হয়তো আসলেই নিছক কৃষিজীবী ছিল অথবা তারা তাদের অপরাধ লুকাতে চাচ্ছিল। কিন্তু বিষয়টি যেটাই হোক না কেন আমাদের নিক্ষিপ্ত গোলাবারুদ এই বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করে গেছে যে ভবিষ্যতে এই গ্রামের ছেলেরা তালেবানের সাথে যোগ দেবে।
ওই উদ্দীপ্ত ভাষণগুলোর কথা আর কী বলব? সেগুলো নিছক ফাঁপা বুলি ছিল না। বরং সেগুলো ছিল এমন প্রতিশ্রুতি বাণী যা অনাগত ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন হয়েছিল।
পরিবেশ যখন লড়াইয়ের জন্য প্রচণ্ড ঠান্ডা ছিল তখনো বোমা পাতা হয়েছে। বিলিয়ন ডলারের অত্যাধুনিক বিমানের মোকাবেলায় তারা যখন ৩০ বছরের পুরোনো কালাশনিকভ রাইফেল নিয়ে ময়দানে এসেছে তখনো তারা বুক চিতিয়ে লড়াই করেছে। যখনই কোনো গ্রাম ছেড়ে এসেছি তখনই তারা সেটা পুনর্দখলে নিয়ে নিয়েছে।
আমরা যত কিছুই করি, যেখানেই করি,তাদের হতাহতের সংখ্যা যতই হোক না কেন তারা নতুন করে ফিরে আসে।
আমার দায়িত্ব পালনের ১০ বছর পর ও পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ও আধুনিক সেনাবাহিনীর সাথে ২০ বছর লড়াইয়ের পর তালেবান আফগানিস্তান পুনর্দখল করল।
আফগান সেনাবাহিনী যখন মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে তালেবানের কাছে পরাজিত হলো তখন 'তালেবান আফগানিস্তান দখল করতে পারবে না বা এত সময়ের মধ্যে পারবে না' ইত্যাদি যে ধারণাগুলো করা হয়েছিল সেগুলো মুহূর্তেই অবাস্তব পরিণত হলো।
আর আমরা নারী অধিকার শিক্ষা ও দারিদ্র্য বিমোচনে যে ক্ষুদ্র অবদান রেখেছিলাম তার ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকার। দেশে শান্তি কেবল তখনই ফিরে আসবে যখন তালেবান বাকি সমস্ত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে দমন করতে পারবে।
আমাদেরকে বা অন্তত আমাকে তালেবান এ সবকিছু বলে গেছে। তালেবান যোদ্ধারা আমাকে তাদের পরিকল্পনা, স্বপ্ন ও আশার কথা শুনিয়েছে। তারা আমাকে বিস্তারিতভাবে জানিয়েছে যে ভবিষ্যতে তারা কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, কিভাবে তাদের লক্ষ্য অর্জন করবে।
তারা এটাও বলেছে, তাদেরকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। তারা বিশ্বাস করে মরে গেলেও তাদের সহযোদ্ধারা এই অসম্পূর্ণ দায়িত্ব সম্পন্ন করবে।
আর আমিও এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে তারা অনন্তকাল এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে।
তারা আমাকে জানিয়েছিল যে কিভাবে আমেরিকানদের হত্যা করবে, কোন অস্ত্র দিয়ে কোন জায়গায়, এবং কতজনকে।
অনেক সময় তারা লড়াইরত অবস্থায় এসব কথা বলত। 'অচিরেই আল্লাহর ইচ্ছায় পৃথিবী তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলবে'- এটা তারা প্রায়ই বলত।
তারা আমাকে এমন কথা শুনিয়েছে বেশির ভাগ মানুষই যেটা শুনতে চায় না। তবে পরিশেষে আমি এটাই উপলব্ধি করছি যে আফগানিস্তান তাদেরই হবে।
আল জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন : জাহিদ জাওয়াদ,সূত্র ডেইলি নয়া দিগন্ত।
---------------------------------
0 Comments