Recent Tube

দ্বীনি শিক্ষা। আহমেদ আফগানী।




  

                             দ্বীনি শিক্ষা। 


কাসিম ছিল মুহাম্মদ সা.-এর বড় ছেলের নাম। একইসাথে তিনি সবচেয়ে বড় সন্তানও ছিলেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন বাঁচেননি। তার জীবনকাল ছিল ১ সপ্তাহের কাছাকাছি। এরপর রাসূল সা.-এর চার মেয়ে জন্ম নেন। আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর ১ম সন্তান কাসিমকে খুবই ভালোবাসতেন। কেউ যদি তাঁকে আবুল কাসিম বলে ডাকতেন তবে তিনি খুশি হতেন। 

   রাসূল সা. চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়্যত পেলেন। এরপর থেকে তিনি গোপনে দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিন বছর গোপন দাওয়াতের পর তিনি যখন প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন তখন তিনি মক্কার মানুষের কাছ বিশেষত আত্মীয়দের কাছ থেকে ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হলেন। আর এই বিরোধীতার মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিল আল্লাহর রাসূল সা.-এর প্রতিবেশী ও আপন চাচা 'আবু লাহাব'। 

     নবুয়্যতের ৩য় বছরে আল্লাহর রাসূল সা. ২য় পুত্র সন্তানের পিতা হন। মুহাম্মদ সা. ও খাদিজা রা. তাদের পুত্র সন্তানের নাম রাখেন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ। নবুয়্যতের ৫ম বছরে অর্থাৎ আব্দুল্লাহর বয়স যখন দুই বছর তখন একদিন তিনি ইন্তেকাল করেন। আব্দুল্লাহর ইন্তেকালে মুহাম্মদ সা. মুষড়ে পড়েন। খুবই ব্যথিত হন। 

    এদিকে প্রতিবেশী হওয়ায় চাচা 'আবু লাহাব' খবর পেয়েছে সবার আগে। সে চিৎকার করে, আনন্দ করে মক্কায় অলিতে গলিতে মৃত্যুর খবর প্রচার করতে লাগলো। মুহাম্মদের বংশ শেষ। তার একমাত্র পুত্র মারা গেছে। এটা নিয়ে ইসলামের শত্রুরা বেশ উল্লাস প্রকাশ করে। 

    বিদ্যুৎ গতিতে এই খবর মদিনায় চলে গেল। মদিনায় থাকা ইহুদিরা আল্লাহর রাসূল সা.-কে বেশ তীক্ষ্ণভাবেই অবজার্ভ করছিল। কারণ তারা ভেবেছিল এই শেষ নবী তাদের বংশ থেকে আসবে। যেহেতু আসে নি তাই তারা মুহাম্মদ সা.-এর বিরোধীতা শুরু করে এবং তাঁকে মিথ্যা দাবীদার হিসেবে অবহিত করে। 

    যাই হোক আব্দুল্লাহ'র মৃত্যুর খবর ইহুদিদের কাছে পৌঁছলে তারাও উল্লাস করে। ইহুদি গোত্র বনু নাদিরের নেতা ও কবি কা'ব বিন আশরাফ তখন খুশি হয়ে রাসূল সা.-কে অপমান করে একটি কবিতা রচনা করে। সেখানে সে মুহাম্মদ সা.-কে উদ্দেশ্য করে একটি শব্দ ব্যবহার করে যেটি হলো, 'আবতার'। আবতার শব্দ একটি বাগধারা টাইপ শব্দ, যার অর্থ লেজ কাটা, গোড়া কাটা, শেকড় কাটা, নির্বংশ, আত্মীয় থেকে বিচ্ছিন্ন ইত্যাদি বুঝায়। 

     কা'ব বিন আশরাফ তার কবিতায় বুঝাতে চেয়েছে মুহাম্মদ সা. আবতার। তার কোনো ছেলে সন্তান নেই। অবএব সে মরে গেলে তার নাম নেয়ার মতো কেউ থাকবে না। তার জন্য লড়াই করার কেউ নেই। সে আত্মীয়দের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত ও অবাঞ্ছিত।  

   আল্লাহর রাসূল সা. মদিনায় রাষ্ট্র কায়েমের পর এই কা'ব বিন আশরাফ সেই ইসলামী স্টেটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। মক্কার লোকদের সাথে চুক্তি করে সে মদিনা বিরুদ্ধে আক্রমণ করার জন্য আবু সুফিয়ানকে উস্কে দেয়। আল্লাহর রাসূল সা. এই অপরাধে ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। 

     মক্কার মুশরিকরা ইহুদি কবি কা'বের এই শব্দে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছে। তারা মুহাম্মদ সা.-কে কষ্ট দেওয়ার জন্য এই শব্দ ব্যবহার করতে লাগলো। এমন পরিস্থিতিতে আল্লাহ তায়ালা ওহি নাজিল করলেন মুহাম্মদ সা.-কে সান্তনা দিয়ে। এটি ছিল কুরআনের সবচেয়ে ছোট সূরা। সূরা কাওসার। 

 আল্লাহ তায়ালা বলেন, 
নিশ্চয় আমি তোমাকে আল-কাওসার দান করেছি। 
কাজেই তোমার রবের উদ্দেশ্যেই সালাত পড়ো এবং কুরবানী করো।
নিশ্চয়ই তোমার প্রতি শত্রুতা পোষণকারীই আবতার (নির্বংশ)।

    এই ওহি নাজিল হওয়ার পর মুসলিমরা অত্যন্ত খুশি হলো। আলী রা. এই সূরা লিখে কাবা'র দেয়ালে ঝুলিয়ে দিলেন। 

     এখানে আল্লাহ তায়ালা একটি সুসংবাদ দিলেন যে, তিনি আল্লাহর রাসূল সা.-কে কাওসার দান করলেন। কাওসার শব্দের অর্থ অনেক কল্যাণ। অনেকে কাওসার বলতে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ধরে নিলেও পরবর্তীতে অনেক হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত হয় এটি একটি প্রবাহিত নহর। যা কিয়ামতের কঠিন সময়ে আল্লাহর রাসূল সা.-এর জিম্মাদারীতে দেওয়া হবে। যারা এর পানি আল্লাহর রাসূল সা. থেকে পাবেন তারা আর কখনো পিপাসার্ত হবেন না। 

    আল্লাহর রাসূল সা. মিরাজের সময় এই কাওসারকে দেখেছেন। তিনি জিব্রাঈল আ.-কে জিজ্ঞাসা করলেন এটি কি? উত্তরে জিব্রাঈল আ. বললেন, এটি হলো সেই প্রতিশ্রুত কাওসার, যা আল্লাহ আপনাকে দান করেছেন। 

    এই কাওসারের পানি কেমন হবে তা নিয়ে অনেক হাদিস আছে। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো কারা এই পানি পাবে। আর কারা পাবে না। এই ব্যাপারে রসূলুল্লাহ সা. সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর পর থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত তোমাদের মধ্য থেকে যারাই আমার পথ থেকে সরে গিয়ে অন্য পথে চলবে এবং তার মধ্যে রদবদল (বিদআতের প্রচলন) করবে তাদেরকে এ কাওসারের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। 
 
     তিনি আরো বলেন, তখন আমি বলবো, হে আমার রব! এরা তো আমার উম্মাতের লোক। জবাবে বলা হবে, আপনি জানেন না, আপনার পরে এরা কী কী পরিবর্তন করেছিল এবং আপনার পথের উল্টো দিকে চলে গিয়েছিল। তখন আমিও তাদেরকে দূর করে দেবো এবং তাদেরকে কাওসারের ধারে কাছে ঘেঁসতে দেবো না। 

    অর্থাৎ কাওসারের পানি পেতে হলে আমাদের রাসূলের পথে চলতে হবে। মনগড়া পথ চললে হবে না। আল্লাহর রাসূল সা. যেভাবে দ্বীন কায়েমের পথে সক্রিয় ছিলেন সেভাবে আমাদের সক্রিয় থাকতে হবে। 

    ২য় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন কাজেই তোমার রবের উদ্দেশ্যেই সালাত পড়ো এবং কুরবানী করো। অর্থাৎ যখন দ্বীনের ব্যাপারে সুসংবাদ আসবে তখন সালাত ও পশু কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা সালাত ও কুরবানীর বিধান নাজিল করলেন। সালাত ও কুরবানী আগে থেকেই মক্কায় প্রচলিত ছিল। তারা আল্লাহ ছাড়াও দেব দেবীর উদ্দেশ্যে সালাত ও কুরবানী আদায় করতো। ইসলাম এসে নির্দিষ্ট করেছে সালাত ও কুরবানী আল্লাহকে উদ্দেশ্য করা ছাড়া আদায় করা যাবে না। 

   এখানে শিক্ষা হলো দুইটি। এক- খুশির প্রকাশ হবে সালাত ও পশু কুরবানীর মাধ্যমে। দুই- সালাত ও পশু কুরবানী হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। আল্লাহর রাসূল সা. যখন মদিনায় স্টেট কায়েম করেছেন তখন দুটি রাষ্ট্রীয় খুশির দিন অর্থাৎ ঈদের দিন ঘোষণা করলেন। একটি রমজানের প্রশিক্ষণের পর পুরস্কারের দিন যা ঈদুল ফিতর হিসেবে খ্যাত। অন্যটি হজ্বের সাথে মিল রেখে যা ঈদুল আযহা হিসেবে খ্যাত।

     ঈদুল আযহায় সালাতের আগে কুরবানী করলে তা আদায় হবে না। এই মাসয়ালাটি মুহাম্মদ সা. সূরা কাওসারের ২য় আয়াত থেকে নিয়েছেন। কারণ আগে সালাত ও পরে পশু কুরবানীর কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন ঈদুল আযহায় পশু কুরবানী করে তার গোশত খাওয়া দিয়ে সেই দিনের খাবার শুরু করতে। এই আদেশ শুনে একজন সাহাবী ঈদের সালাতের আগেই পশু কুরবানী করে ফেলেছেন। মুহাম্মদ সা. তাকে আবারো কুরবানী করার জন্য বলেছেন এবং আগের কুরবানী বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন। 

    যেহেতু স্টেট কায়েমের খুশির সাথে ঈদের ঘোষণা এসেছে তাই বহু ফিকহবিদ মনে করেন ঈদ উদযাপন কেবল দারুল ইসলামের মুসলিমরা করবে। যেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা নেই সেখানে ঈদ উদযাপন করা যাবে না। অনেকে বলেছেন শুধুমাত্র সেসব স্থানে ঈদ উদযাপন করা যাবে যেখানের শাসক মুসলিম। অমুসলিম শাসকের অধীনে থেকে ঈদ উদযাপন অনেকেই জরুরি মনে করেন না।    
 
   ৩য় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা.-এর সাথে শত্রুতা পোষণকারীদের আবতার বা শিকড়কাটা বলেছেন। তারা রাসূল সা. সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছে এগুলো তাদের ব্যাপারেই ফলেছে। আজকে বিদ্রূপকারীদের কেউই সম্মান করে না। কেউ তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে না। তাদের পরিচয় তাদের সন্তানরা দিতে লজ্জাবোধ করতো। শুধু তাই নয়, বিদ্রূপকারীদের সন্তানেরাই আল্লাহর রাসূল সা.-কে শ্রদ্ধাভরে সম্মান করেছেন। আজকে মুহাম্মদ সা.-এর অনেক শিষ্য। তারা শেকড়কাটা। তাদের কিছু নেই।
--------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক কলামিস্ট ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments