Recent Tube

তোমরাও মুক্তি খোঁজো? তামাশা আর কারে বলে!!জিয়াউল হক।



তোমরাও মুক্তি খোঁজো? তামাশা আর কারে বলে!!
~~~~~~~~~~

ঐতিহাসিক সিল্ক রোডের কোল ঘেঁসে তাসখন্দের চারশত কুড়ি কিলোমিটার পূর্বদিকে ফারগানা শহর। এখানেই তাং (বা সাং) রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। শহরের প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে বিখ্যাত সির দরিয়া (Syr Daria)। তারই তীর ঘেঁষে ছোট্ট গ্রাম; তালাস। নদীর একপ্রান্তে আব্বাসীয় খেলাফতের সেনাপতি জিয়াদ ইবনে সালেহ’র নেতৃত্বে প্রায় তিরিশ হাজার যোদ্ধা। অপরপ্রান্তে দূর্ধষ্য চীনা সেনাপতি ঝাও সিয়াংঝি’র (Gao Xianzhi) নেতৃত্বে একলক্ষ চীনা সৈন্য ৭৫১ খৃষ্টাব্দের মে-জুলাইয়ের উত্তপ্ত গরমের মধ্যে মুখোমুখি, আব্বাসীয়দের সাথে চীনাদের যুদ্ধ। 

যুদ্ধের এক পর্যায়ে চীনা সৈন্যবাহিনীর ভাড়াটিয়া সৈন্য কারলুক তুর্কিরা (Karluk Turk) পক্ষত্যাগ করে আব্বাসিয় বাহিনীতে যোগ দেওয়ায় যুদ্ধের মোড় ঘুরে চীনারা পরাজিত হলে তাং রাজবংশের শাসনের ইতি ঘটে। সিল্করুটের উপরে আব্বাসীয়দের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিহাস এই যুদ্ধটাকেই বেটল অব তালাস (Battle of Talas) বা তালাসের যুদ্ধ হিসেবে চেনে।

আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের জন্য এটা ছিল ঐতিহাসিক মহুর্ত। অকল্পনীয় সম্পদশালী হবার পেছনে এই সিল্ক রটের উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা একটা বড় কারন। বিশ্ব ইতিহাসে ঐতিহাসিক ও অভাবনীয় ফলাফলসমৃদ্ধ এ যুদ্ধটা নিয়ে বেশি আলোচনা হয়নি। অথচ মানবসভ্যতার উপর এ যুদ্ধের  ফলাফল নিয়ে এক মহাকাব্য রচিত হতে পারে অনায়াসে।
যুদ্ধে চীনাপক্ষে তিরিশ হাজারেরও বেশি সৈন্য নিহত এবং বেশ কয়েক হাজার বন্দী হয়। ধৃত বন্দিদের মধ্যে দু’জন কাগজ তৈরিতে দক্ষ ছিল। চীনে খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দি থেকেই কাগজ তৈরি হলেও সেই প্রযুক্তি ও জ্ঞান বাইরের দুনিয়া জানতো না। চীনারা কঠোর গোপনীয়তায় কাগজ উৎপাদন করে তার ব্যবহারও কেবলমাত্র রাজবংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলো। 

মুসলিম সেনাপতি জিয়াদ ইবনে সালেহ এই দুই বন্দীর একজনকে প্রেরণ করলেন খেলাফতের অন্যতম প্রাশাসনিক কেন্দ্র হিরা’য় আর অপরজনকে সমরখন্দে। ধৃত বন্দীরা প্রাণ বাঁচাতে মুসলমানদের কাগজ তৈরির কৌশলটা শেখালো। 

ঘুরে গেল ইতিহাসের মোড়! প্রথমবারের মতো মুসলমানরা কাগজ বানানো শিখলো। যে সময়টাতেই আব্বাসীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হচ্ছে বাগদাদে, স্পেনে উমাইয়া শাসন ঠিক সে সময়েই মুসলমানরা পেলো কাগজ তৈরির জ্ঞান! ৭৯২-৭৯৫ খৃষ্টাব্দে সমরখন্দে প্রতিষ্ঠিত হলো মুসলিম বিশ্বের প্রথম কাগজের কল।

চীনারা কাগজকে ‘গু জি’ বলতো। আরবদের কাছে অপরিচিত বস্তু। এর নামও তাদের ভাষায় না থাকায় বলতো লাগলো; ‘গু জি’র মতো’। আরবি ভাষায় এই গু জি’র মতো বাক্যটির তরজমা হলো; ‘কা আল গু জি। ‘কা’ মানে ‘অনূরুপ’ বা ‘মতো’ ইংরেজিতে ‘like, as’ ইত্যাদি। 

কুরআনেও আল্লাহপাক ‘কা আল’ বাক্যটির ব্যবহার করেছেন। আল্লাহর উপরে ঈমান আনতে অস্বীকারকারীদের পশুর সাথে তুলনা করতে গিয়ে তিনি এই ‘কা আল’ বাক্যটি ব্যবহার করেছেন। (দেখুন; সুরা আ’রাফ: ১৭৯)।
উক্ত আয়াতে ‘পশুর মতন’ বুঝাতে ‘কা আল আনআম’ বলেছেন। ঠিক একইভাবে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে সমকালীন আরবরাও চীনা এ বস্তুটিকে চীনাদের নামে; ‘গু জি’র মতো’ বা ‘কা আল গুজি’ বা ‘কালগুজি’ নামে ডাকতো। এই ‘কা আল গুজি’ই পরিবর্তিত হয় ‘কালগুজি’তে। ফার্সি ভাষায় আরবি ‘আল’ শব্দটা নেই। 
বাগদাদ সমরখন্দ মুসলিম, তথা, আব্বাসীয় ইসলামি সাম্রাজ্য হলেও ৬৯০ খৃষ্টাব্দের পর থেকেই ফারসিভাষী ইরানিরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠেছে আর আরবি ভাষী আরবরাই সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।

ফলে ‘কালগুজি’ শব্দ থেকে আরবি ‘আল’ শব্দটির ব্যবহার এক সময় বাদ পড়ে যায়। এভাবে ‘কা আল  জি’ থেকে ‘কালগুজি’ এবং ফার্সি ‘আল’ শব্দটি বর্জিত হয়ে ‘কাগুজি’ হিসেবে আবির্ভূত হয়। আর সেই ‘কাগুজি’ থেকেই সর্বশেষ ‘কাগজ’ শব্দটি আজকের বাংলা বা ফরাসি’সহ উপমাহেদশীয় ভাষার অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ হিসেবে বরিত হয়েছে।

বাগদাদ, সমরখন্দ, হিরা, মসুল, সেভিল, কর্ডোভা, দামেশক ও আলেকজান্দ্রিয়া’সহ মাত্র কয়েকটি দশকের মধ্যে প্রায় তিনশত কাগজের কল দিনরাত কাগজ উৎপাদন করে গেছে। সেই সব কাগজের পাতায় ইবনে সিনা, আল জাওয়াহিরি, আল রুশদ, আল রাজি, আল জাবির, আল ফারাবি, ইবনে হায়সাম, ইমাম কুরতুবি, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, জালালুদ্দিন রুমি, গাজ্জালিরা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন জ্ঞান বিজ্ঞান আর দর্শনের বিশাল ভান্ডার। সমৃদ্ধ হয়েছে বিশ্বমানবতা!

চীনাদের মতো মুসলমানরা কাগজের ব্যবহার ও উৎপাদনকে গোপন রাখেনি। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে বিশ্বকে আলোকিত করেছে, বিজ্ঞানময় আধুনিক বিশ্বের গোড়াপত্তন করে বিশ্বকে করেছে সমৃদ্ধ আর মানবিক। আজ সেই মুসলমানরাই জ্ঞানে বিজ্ঞানে পিছিয়ে! তারাই বিশ্বের দিকে জ্ঞানের জন্য চেয়ে থাকে! কি নিদারুণ অধোপতন!

ঐাদের সামনে আল্লাহপাকই কলমের কসম কেটে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যাদেরকে স্বয়ং আল্লাহপাকই নির্দেশ দিয়েছেন; ‘পড়ো’ বলে, সেই তারাই আজ জ্ঞানচর্চায় পিছিয়েপড়া জাতি! কি লজ্জা! কি নিমর্ম পরিণতি! অপমানে মাথায় হেট হয়ে আসে। 
আজও কাগজ আছে, কলমও। আছে উম্মুল কুরা; ‘মাদার অব অল নলেজ;  আল কুরআন। আফসোস! নেই শুধু কাগজের সমঝদার কলম সৈনিক। নেই আল কুরআনের বোদ্ধা পাঠক! 

সত্যিই কি নিদারুণ দীনতা এ জাতির! এ জাতির যুবকেরা এখন বুক ফুলিয়ে হাঁটে, এখনও দিব্যি হাসে, ঘুরে ফিরে, খায় দায়, আনন্দ ফুর্তিও করে। কেবল করে না জ্ঞানর্চচা! আহা বাংলাভাষী মুসলমান; তোমরাও মুক্তি খোঁজো! তামাশা আর কারে বলে!!
------------------------- 
লেখক : ইসলামি চিন্তাবিদ, প্রবন্ধ লেখক, ইতিহাস গবেষক,ও দাঈ। 

Post a Comment

0 Comments