একজন "প্রভাবশালী" চেয়ারম্যান এর
"বিলাসবহুল" বাসভবনে কিছুক্ষন.......!
যে ঘরে বসে কথা বলছি এই ঘরটি একজন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এর "বিলাস বহুল" বাসবভন। যার সাথে বসে কথা বলছি তিনি একজন অত্যাধিক "প্রভাবশালী" সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান।
বিলাস বহুল এই ঘরে সবচেয়ে বিলাসিতা হলো পুরনো এক সেট সোফা, আশির দশকের কাঠের একটি সোকেছ (আঞ্চলিক ভাষায় মিছরিফ), বাশের চাটাইয়ের সিলিং আর বারান্দায় বাশের চটির বেষ্টনি (তরজা)।
কি অবাক হচ্ছেন?
নাহহ অবাক হবেন না এগুলোই এই চেয়ারম্যান এর বিলাস বহুল বাড়ির আলিশান জিনিসপত্র।
পাঠক বেশি লিখে আপনাদের ধৈর্য ভাঙ্গাবোনা। যেহেতু আমি একজন লেখক কিন্তু তার আগে আমিও একজন পাঠক। তারও আগে আমি একজন মানুষ। আমার শরীরে রক্ত মাংশ আছে, আছে আমার আবেগ অনুভূতি।
যার কথা বলছিলাম তিনি জননেতা ডাক্তার আব্দুল কুদ্দুস। সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার উপজেলা পরিষদের সাবেক নির্বাচিত চেয়ারম্যান। মাটি ও মানুষের নিখাদ ভালবাসায় প্রকৃত জননেতার উপমা যদি কেউ খোঁজতে চান তার সকল উপমা হলেন ডাক্তার আব্দুল কুদ্দুস। তিনি মেডিক্যাল পড়ুয়া এমবিবিএস ডাক্তার নন তিনি একজন পল্লি চিকিৎসক। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তিনি "ডাক্তার সাহেব" নামেই পরিচিত।
খুব সম্ভবত ২০০৪ সালে দোয়ারার পান্ডারগাও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন ডাক্তার আব্দুল কুদ্দুস। কিন্তু জটিল রাজনৈতিক সমীকরনে তারই মিত্ররা কুট কৌশলে তাকে পরাজিত করে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দোয়ারা বাজারবাসী বিপুল ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে তাকে সেই প্রতিদান দেন।
তাঁর ভূষণ ছিল সুন্দর হাসি, অমায়িক ব্যবহার, সুষম বন্টন, মানুষকে যথাযথ মূল্যায়ন, সরকারি বরাদ্দের যথাযথ সঠিক ব্যবহার, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, মা সমাবেশের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামে শিক্ষা সচেতনতা তৈরি সহ গ্রামীন জনপদে জনপদে দল মত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনতার পরম ভালবাসার মানুষে পরিনত হন ডাক্তার আব্দুল কুদ্দুস।
এমন পরিস্থিতিতে জনপ্রিয়তাই হয়ে উঠে যার অপরাধ। ২০১০ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্প পরিদর্শন শেষে ফিরে আসার পথে তার উপর ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। বিপন্ন প্রায় জীবন নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানকে ভর্তি করা হয় সিলেটের আল বান্না হাসপাতালে। মাথা পিঠ ও বুকে মারাত্মক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে ছিলেন নির্বাচিত এই উপজেলা চেয়ারম্যান।
প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে দোয়ারা বাজার।
আল বান্নায় চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে সার্বক্ষণিক ডাক্তার কুদ্দুস ভাইয়ের পাশে আমার থাকার সুযোগ হয়েছিল। তিনি সুস্থ হয়ে দোয়ারাবাজার বাসীর উদ্দ্যেশ্যে একটি লিফলেট (চিঠি) দিয়েছিলেন। সেই লিফলেটটি তাকে আমিই লিখে দিয়েছিলাম। সেই হৃদয়স্পর্শী চিঠি পড়ে চোখের জলে কোমল হৃদয়ে ডাক্তার আব্দুল কুদ্দুসকে হৃদয়ের মনি কোঠায় স্থান করে দিয়েছিল আপামর জনতা।
জনতার দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হলে তার নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব জনগণ তাদের নিজের কাধে তুলে নেন। অভূতপূর্ব গণজোয়ার তৈরি হলে রাজনৈতিক মেরুকরণের শিকার হয়ে তার বিজয় কেড়ে নেওয়া হয়।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাকে সংসদ সদস্য প্রার্থী দেখতে চান বলে এলাকাবাসী আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় তার দল ও জোটের সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হয়।
২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে তাকে আবারও চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে চাপ দেন উপজেলাবাসী। কিন্তু তিনি গোটা এলাকাবাসীকে নিয়ে বিশাল সমাবেশে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষনা দেন। তার এই ঘোষনায় গোটা মাঠ জুড়ে কান্নার রোল পড়ে যায়।
এমনকি হিন্দু ধর্মাবলম্বী সহ বিভিন্ন সংগঠন ও এলাকাবাসী নিজেরা নির্বাচনী খরচ ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে নির্বাচনে অংশ গ্রহনের অনুরোধ জানান। কিন্তু তিনি নির্বাচনে অংশ গ্রহন করেননি।
একজন ডাক্তার আব্দুল কুদ্দুস ভাইয়ের অনুপস্থিতি, তার ব্যবহার, কথার মাধুর্যতা, সততা অভাব অনুভব করেন উপজেলাবাসী। জেলা কিংবা উপজেলায় আইন শৃঙ্খলা বৈঠক, সমন্বয় বৈঠক, উন্নয়ন পর্যালোচনা বৈঠক যেকোন বৈঠকে তার অসাধারণ সাবলীল বাস্তবসম্মত যুক্তি নির্ভর বক্তব্য উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তাদের বিমোহিত করতো।
কুদ্দুস ভাইয়ের সাথে দীর্ঘ কয়েক যুগের সম্পর্কে এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম যে তিনি আমাকে ফোন করলে ফোন রাখতে চাইতেননা। বয়সের যোজন যোজন দূরত্ব থাকলেও কখনোই তিনি আমাকে নাম ধরে ডাকেননা।
তিনি পদবিধারী বড় কোন রাজনৈতিক নেতা নন কিন্তু তিনি হয়ে উঠেন গণমানুষের নেতা। একজন রাজনীতিবিদ এর মধ্যে যে সব রাজনৈতিক ও সামাজিক তীক্ষ্ম নজর বুদ্ধি থাকার প্রয়োজন আল্লাহ্ তার মাঝে সব দিয়েছেন।
মনে পড়ে ২০১৩ সালে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষে প্রচারনায় অংশ নিতে তিনি সিলেট অবস্থান করছিলেন। রুম ছিল তালতলা হোটেল হিলটাউনে।
প্রচারনা শেষে রুমে ফিরে সারাটা রাত আমার সাথে গল্প করে কাটিয়ে দেন কুদ্দুস ভাই। কত কথা কত স্মৃতি কত প্রকাশিত অপ্রকাশিত কথাই আমার সাথে শেয়ার করেন।
অসুস্থ হওয়ার আগ পযর্ন্ত প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার আমাকে ফোন করতেন। আমি আমার বউ বাচ্চা সবার খোজ খবর রাখা যেনো তার একটি রুটিন ছিলো।
প্রিয় কুদ্দুস ভাই আজ বছর খানেক হলো গুরুতর অসুস্থ। আমরা কত ব্যস্ত হয়ে উঠেছি সেই কর্মবীর কুদ্দুস ভাইকে ফোন করে খোঁজ নেওয়ার সময় আজ আমার নেই?
কিছু দিন আগে চিকিৎসা শেষে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে আমাকে ফোন করে বললেন এনাম ভাই আমি খুবই অসুস্থ। আমার জন্য দোয়া করো। সেদিন নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হচ্ছিল।
সেদিন তাকে দেখতে ছুটে যাই তার উপজেলার শ্রীপুর বাজারস্থ "বিলাসবহুল" বাসায়। ঘরের সামনে গিয়ে আমি অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ি।
বাসার ভিতরে যেতেই একটি ফতোয়া আর লুঙ্গি পরে এসে হাত মেলালেন। কতদিন পর কুদ্দুস ভাইকে দেখলাম ঠিক নেই। সাদা ধবধবে গোলগাল চেহারাটা, কালো রংয়ের দাড়ি গুলো সাদা হয়ে গেছে।
হালকা আপ্যায়ন শেষে অল্প সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাই বলছিলেন জনগণের এই প্রিয় নেতা।
বললেন আমি অসুস্থ। মাথা সব সময় ভারি হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে কথা বলতে সমস্যা হয় কথা লেগে যায়।
জানালেন তিনি জীবনের যতবার হামলার শিকার হয়েছেন ততবারই মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হয়েছেন। তবে ২০১০ এর হামলাটা আজও ভোগাচ্ছে।
কুদ্দুস ভাই জানালেন যারা তার উপর হামলা করেছিল তাদের সবাইকে তিনি মাফ করে দিয়েছেন। তাদের উপর তার কোন ক্ষোভ অভিযোগ আর নেই।
আমি বসে বসে শুধু ভাবছিলাম এ কেমন মানুষ যারা তার জীবনকে বিপন্ন করে দিয়েছে তাদের তিনি মাফ করে দিয়েছেন!
আমাকে বললেন আল্লাহর প্রতি আস্থা বিশ্বাস থাকলে দুনিয়ার সকল শক্তি এক সময় পরাজিত হতে বাধ্য। বললেন আমি ধন্য আমি মানুষের ভালবাসা পেয়েছি। যে জমিনে আমার রক্ত ঝরেছে সেই জনপদের মানুষ আমাকে কি পরিমাণ ভালবাসে তোমরা জরিপ চালালেই বুঝতে পারবে।
ঘড়ির কাটায় ফেরার তাড়া। ফিরে আসার সময় প্রিয় কুদ্দুস ভাইয়ের হাতটা চেপে ধরে হাতে একটু চুমু খেলাম। কুদ্দুস ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। আমার চোখে ঝাপসা দেখে কুদ্দুস ভাইয়ের চোখটাও ঝাপসা হয়ে আসলো।
আমার মাথায় হাত বোলালেন। বললেন আমার জন্য দোয়া করো। যারা আমাকে চেনেন জানেন আমার দ্বীনি আন্দোলনের ভাইদের কাছে আমার সালাম পৌছে দিও। সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ডাক্তার আব্দুল কুদ্দুস।
ভাল থাকুন প্রিয় কুদ্দুস ভাই। আল্লাহ্ আপনাকে সুস্থ করে আবারও জনতার কাতারে শামিল হওয়ার তৌফিক দিন।
0 Comments