--------------------------------
সাওবান (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
يُوشِكُ أَنْ تَدَاعَى عَلَيْكُمُ الأُمَمُ مِنْ كُلِّ أُفُقٍ كَمَا تَدَاعَى الأَكَلَةُ إِلَى قَصْعَتِهَا . قِيلَ يَا رَسُولَ الله : فَمِنْ قِلَّةٍ يَوْمَئِذٍ ؟ قَالَ لاَ ، وَلكِنَّكُمْ غُثَاءٌ كَغُثَاءِ السَّيْلِ يُجْعَلُ الْوَهْنُ في قُلُوبِكُمْ وَيُنْزَعُ الرُّعْبُ مِنْ قُلُوبِ عَدُوِّكُمْ لِحُبِّكُمُ الدُّنْيَا وَكَرَاهِيَتِكُمُ المَوْتَ.
“এমন একটি সময় আসবে যখন (অমুসলিম) জাতি একে অপরকে প্রতিটি অঞ্চল থেকে তোমাদের উপর আক্রমণ করার জন্য আহ্বান করতে থাকবে, যেভাবে একই পাত্রে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য একে অপরকে আহ্বান করা হয়ে থাকে। একজন জিজ্ঞাসা করলেন যে, ‘এটা কি এই কারণে হবে যে আমরা তখন সংখ্যায় কম হবো?’ তিনি বললেন- ‘না, (তোমরা সংখ্যায় তখন অনেক থাকবে কিন্তু) তোমরা হবে বন্যার পানির উপর ভেসে যাওয়া ময়লার মতো। আল্লাহ তোমাদের অন্তরের মধ্যে ‘ওয়াহন’ ঢুকিয়ে দেবেন এবং তোমাদের শত্র“দের অন্তর থেকে তোমাদের প্রভাব ও ভয়কে উঠিয়ে নিবেন।’ জিজ্ঞাসা করা হল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! ‘ওয়াহন’ কি?’ তিনি বললেন, ‘দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা আর (আল্লাহর পথে) মৃত্যুকে ঘৃণা করা।” (সুনান আবু দাউদ হাঃ ৪২৯৭, মুসনাদে আহমদ হাঃ ২২৪৫ উত্তম সনদে ‘কিত্বালের প্রতি ঘৃণা’- এই শব্দ সহকারে, বায়হাকী হাঃ ১০৩৭২)
.
প্রিয়নবী সা. এর উপরোক্ত হাদীসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আজ মুসলিম উম্মাহ্ বিশ্বজুড়ে কি ভীষণ দূরাবস্থার মধ্য দিয়ে বর্তমান সময় অতিক্রম করছে তা সচেতন আর বিদগ্ধ জ্ঞানী মহল ভালো করেই জানেন এবং উপলব্ধি করছেন। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে প্রতিদিন মুসলিমরা জুলুম আর নির্যাতনের ষ্টিমরোলারে পিষ্ট হচ্ছে। ইরাক, আফগান, ফিলিস্তিন, বসনিয়া, চেচনিয়া, সোমালিয়া, আরাকান, কাশ্মীর, লেবানন, পাকিস্তান, ভারত সহ মুসলি ভূখন্ড গুলোতে আজ মুসলিমদের লাশের স্তুপ পরে আছে।
.
লাখো লাখো মুসলিমের আর্তনাদে প্রতি মুহূর্ত ভারী হয়ে উঠছে, কিন্তু তাদেরকে এই দূরাবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য বিশ্বের কোন প্রান্ত থেকেই আজ আর কেউ এগিয়ে আসছে না। একেকটি ভূখন্ডে আগ্রাসন শুরু হওয়ার সময় মুসলিমদের সারি সারি লাশ, ছিন্ন-ভিন্ন দেহ আর রক্তস্রোত দেখে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা মৌন কিছু প্রতিবাদ জানাই, কিন্তু দু’দিন পর মিডিয়ায় আর তাদের খবর আসা বন্ধ হয়ে গেলে আমরাও নিরব হয়ে যাই। ইস্যু শেষ মনে করে আমরা আবার ঘুমিয়ে পরি গাফলতীর গভীর ঘুমে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী কুফুরী শক্তির আগ্রাসন মিডিয়ার আড়ালে চলতে থাকে নিজ অব্যাহত গতিতে। খানিক ব্যবধানে তা বিস্তৃত হয় আরেক ভূখন্ডে। আবার প্রথম কয়েকদিন মুসলিম বিশ্বে খানিকটা বিক্ষোভ এরপর নিরব।
এভাবে চলছে গত অর্ধ শতাব্দীরও অধিক সময় ধরে। মুসলিম উম্মাহ আজ বিশ্বজুড়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত এবং নিষ্পেষিত কিন্তু কেন? তাদের কি সম্পদের অভাব? না, বরং গ্যাস সম্পদের ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বের ৪৫% এককভাবে তাদের হাতে, তেলের ক্ষেত্রে পৃথিবীর ৭৫% তেল মুসলিম ভূমি থেকে উত্তোলন হয়, দেশ হিসেবে মুসলমানদের ৫৭ টি ভুখন্ড আছে, জনসংখ্যার দিক থেকে প্রায় ২০০ কোটি। মুসলিম ভূখন্ডগুলো খনিজ সম্পদের উপর ভাসমান।
.
এতো এতো কিছু আছে মুসলিমদের কিন্তু নেই শুধু একটি ইসলামিক রাষ্ট্র। নেই একজন মুসলিম খলীফা বা আমিরুল মু’মিনীন। যার ফলে আদর্শিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অভিভাবকহীন মুসলিম উম্মাহ আজ বিশ্বজুড়ে পরিগণিত হচ্ছে ‘গণীমতের’ মাল হিসেবে। মুসলিমদের তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ কাফিররা লুটে নিচ্ছে। মুসলিমরা আজ দুনিয়ার প্রতি অধিক ভালোবাসার কারণে ভুলে গেছে জিহাদকে। তাই এই উম্মাহর শ্রেষ্ঠ সন্তান, নবীন-যুবকেরা আজ আর ভাবে না তার অপর মুসলিম ভাইয়ের কথা, নির্যাতিত বোনকে কাফিরদের হাত থেকে মুক্ত করার কথা চিন্তাও করে না।
.
যে জাতির কান্ডারীরা একজন উসমান হত্যার বদলা নেয়ার জন্য ১৪০০ লোক প্রিয় রাসূলের হাতে হাত রেখে বাইআত নিয়েছিলো, আমরণ জিহাদের দৃপ্ত শপথ করেছিলো, প্রয়োজনে মৃত্যু বরণ করে নিতে চেয়েছিলো; আজ কি হলো সেই জাতির?
.
যে জাতির একজন সদস্য বোন ফাতেমার আর্তনাদে সাড়া দেয়ার জন্য সূদুর আরব থেকে সিন্ধুনদের অববাহিকায় ছুটে এসেছিলেন মুহাম্মাদ ইবনে কাসিম, সে জাতির হাজারো বোন, হাজারো ফাতেমা আর আফিয়া সিদ্দিকী আজ কাফিরদের কারাগারে নিজেদের সম্ভ্রম হারাচ্ছে, প্রতিদিন অসংখ্য বার নির্যাতিত হচ্ছে; জেল থেকে রক্তমাখা পত্র পাঠাচ্ছে উম্মাহর নবীনদের কাছে, মুহাম্মাদ বিন কাসিম আর সালাহউদ্দীন আইয়ূবীর উত্তরসূরীদের কাছে, কিন্তু তাদের ডাকে সাড়া দেয়ার কথা কেউ চিন্তাও করছে না। একজন উসমানের শাহাদাত বরণের সংবাদে যে জাতির ১৪০০ শত সাহাবীর খাওয়া-ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিলো, সেই জাতির লক্ষ লক্ষ উসমান আজ নির্মমভাবে নিহত হচ্ছে; মুসলিম শিশুদের সারি সারি রক্তাক্ত লাশের মিছিল যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের গভীর নিদ্রার কোন ব্যাঘাত ঘটছে না।
.
আজ মুসলিমদের ৫৭ টি ভুখন্ড আছে, কিন্তু একটি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা নেই। অনেক শাসক আছে, কিন্তু একজন খলীফা বা ইমাম নেই। ৭০ লক্ষের অধিক প্রশিক্ষিত এবং নিয়মিত মুসলিম সেনাবাহিনী আছে, কিন্তু মুসলিমদের নিরাপত্তা নেই। কারণ মুসলিম সেনাবাহিনীকে জালিম কাফিরদের বিরুদ্ধে মার্চ করার নির্দেশ দেয়ার কেউ নেই। তাইতো রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন,
وَاِنَّمَا الاِمَامُ جُنَّةٌ يَقا تَلُ مِنْ وراءه وَيُتقى بِهِ –
“ইমাম (খলীফা) হলো ঢাল। তার অধিনে যুদ্ধ পরিচালিত হবে এবং তার মাধ্যমেই আত্মরক্ষা হবে।” (সহীহ বুখারী – কিতাবুল জিহাদ, ইমামের নেতৃত্বে জিহাদ অধ্যায়, হাঃ ২৯৫৭, সহীহ মুসলিম হাঃ ১৮৪১, সুনান নাসায়ী হাঃ ৪১৯৩, সুনান আবু দাউদ হাঃ ২৭৫৭ মুসনাদে আহমদ হাঃ ১০৩৯৮)
.
আজ পীর-মুরিদীর বাইআত আছে, কিন্তু খিলাফতের বাইআত নেই। অনেক ধরণের সংগ্রাম আছে, কিন্তু জিহাদ নেই। উপরন্তু মুসলিমদেরকে নিরাপত্তাদানকারী আদর্শিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ইমাম হিসেবে মুসলিমদের অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণকারী খলীফা না থাকার কারণে মুসলমানদের এই সকল সম্পদ আর সম্ভাবনা ‘হরিনের দেহের মূল্যবান মাংসের’ মতোই হায়েনাদের কাছে মুখরোচক ‘গণীমতের মাল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মুসলিম উম্মাহর এতো সম্পদ, এতো সেনাবাহিনী সঞ্চালক বিহীন থাকার ফলে জমাট বাধা রক্তে পরিণত হয়েছে। যা দেহে প্রাণ সঞ্চালন করতো, তাই আজ মৃত্যুর ক্রিয়া করছে। মুসলমানদের সেনাবাহিনী আজ মুসলমানদের বিরুদ্ধেই কাফিরদের ইচ্ছে মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। ইরাক, আফগান, ভারত, পাকিস্তান যার জ্বলন্ত উদাহরণ।
.
এ জাতির কাছে এখনও বিরাট সুযোগ আছে। এদেশেই ৫০ হাজার মাদ্রাসা মকতব দীনের দূর্গ হিসেবে এখনও মাথা উচু করে আছে। ৫ লক্ষ মসজিদের মিনার আর মিম্বার আছে। যদি তারা আজ আবারও ঘুরে দাঁড়ায়, নিজের অতীতের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে উম্মাহকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য উদ্যোগ হয়, আভ্যন্তরীন বিবাদ আর বিভক্তিতে নিজেদের শক্তি বিনষ্ট না করে নতুন শতাব্দীর বিশ্ব নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে একে অপরের সাথে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে এক ঐশী ভ্রাতৃত্ব বন্ধন রচনা করে, কোটি কোটি মুসলিম জনতা যদি তাদের আকীদা বিশ্বাসের ভিত্তিতে একটি আদর্শিক রাষ্ট্রব্যবস্থার লক্ষ্যে রাজপথে নেমে আসে, তবে রবের শপথ করে বলতে পারি, ইসলামের পুনর্জাগরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর এই জাগরণের মাধ্যমে শুধু এই বঙ্গভূমিতেই নয়, বরং পুরো এশিয়া এবং পুরো বিশ্বজুড়েই পরিবর্তনের ঢেউ জাগতে পারে। তবে এজন্য সবার আগে প্রয়োজন হলো নিজের মধ্যে আর বিভক্তি না বাড়িয়ে বৃহত্তর ঐক্যের লক্ষ্যে কাজ করা। নিজেদের চিন্তার জগতকে শানিত করা। ইসলামকে সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান হিসেবে যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে জাতির সামনে তুলে ধরা। আধুনিক প্রযুক্তি ও মিডিয়ার মাধ্যমে জাতিকে পরিস্কারভাবে জানিয়ে দেয়া যে, তাদের দৈনন্দিন জাতীয় ও আন্তর্জার্তিক সকল সমস্যার সমাধান পাওয়ার জন্য ইসলামের খিলাফত বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই।
---------------------------------------------------
Tanzil Islam ইসলামি চিন্তাবিদ, গ্রন্থপ্রনেতা, ও মাওলানা
0 Comments