Recent Tube

আয়া সোফিয়া: পোপের টুপির চেয়ে সুলতানের পাগড়িই যার বেশি পছন্দ! ৷ জিয়াউল হক।

আয়া সোফিয়া: পোপের টুপির চেয়ে           সুলতানের পাগড়িই যার বেশি পছন্দ!
     
      চতুর্দশ শতাব্দির শুরুতে ১৩০০ খৃষ্টাব্দের দিকে ওসমানিয় সাম্রাজ্য ছিল আনাতোলিয়ার উত্তর পশ্চিম অংশে ক্ষুদ্র এক জনপদকে ঘিরে ছোট্ট একটা সালতানাত মাত্র। প্রতিবেশি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য, তথা, কন্সটান্টিনেপল; আজকের ইস্তাম্বুল ছিল খৃষ্টবাদের এক ঐতিহাসিক প্রাণকেন্দ্র। পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী। খোদ রোমের চেয়েও তার গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়। 

   এই সেই নগরী যেখানে ৩২৬ খৃষ্টাব্দে সম্রাট কন্সটান্টিনের ছত্রছায়ায় একদল পাদ্রির হাতে খৃষ্টবাদ তার আজকের রুপ পেয়েছে। খৃষ্টান এ রাজ্য; বাইজান্টাইনের সাথে পার্শ্ববর্তি ক্ষুদ্র ওসমানিয়া সালতানাতের তেমন কোন বড় ধরনের সমস্যা ছিল না। নিরুপ্রদ প্রতিবেশি মাত্র। মাঝে মাঝে সীমান্তজুড়ে ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া উভয় সা¤্রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল খুবই শক্তিশালী। ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্য ও জীবনাচারের ক্ষেত্রেও অনেক মিল ছিল।

  তার আগে ত্রয়োদশ শতাব্দির একেবারে শুরুর দিকে ১২০৪ খৃষ্টাব্দে চতুর্থ ক্রুসেডের সেই বর্বর ঘৃণ্য ইতিহাস বাইজান্টাইনবাসী কি করে ভুলতে পারে? ক্রুসেডের নামে মুসলিম নিধনে উত্তর পশ্চিম ইউরোপ (ইংল্যন্ড, ফ্রান্স জার্মানি) থেকে দলে দলে খৃষ্টান বাহিনী বেরিয়ে এলেও তারা কি না শেষ পর্যন্ত স্বধর্মী বাইজান্টাইনবাসীর উপরেই হামলে পড়লো! 

     আজকের এই ইস্তাম্বুল নগরী সেই সেদিনও ছিল খৃষ্টবাদের এক পবিত্র নগরী, অথচ সেই পবিত্র নগরীটাকেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত করলো বর্বর সেই খৃৃষ্টান ক্রুসেডাররা! চার্চ, তথা, গির্জাগুলো লুট করলো, পুড়িয়ে দিলো। পাদ্রিদের হত্যা করলো চরম বর্বরতার সাথে। বাইবেলের দূর্লভ কিছু ঐতিহাসিক দলিল, পান্ডুলিপী এই আয়া সোফিয়া’সহ অন্যান্য গির্জা থেকে লুট করে নিয়ে গেল ভেনিসে! 

     এই খৃষ্টান ক্রুসেডারদেরই একটা দল স্বপ্নের ‘রোমান’ শহর কন্সটান্টিনেপল (ইস্তাম্বুল) লুট করে নিয়ে গিয়ে, সে সব ‘রোমান স্মৃতি’ দিয়েই পত্তন করে আজকের ‘রোমানিয়া’। যদিও পরবর্তিতে রোমানিয়া তার সেই প্রতিষ্ঠিত স্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে ভৌগলিক দিকে থেকে। তবে তার নামটি আজও রয়ে গেছে বটে!

     ইউরোপ থেকে যিশুখৃষ্টের নামে ধর্মযুদ্ধে যাওয়া ক্রুসেডাররা স্বধর্মী খৃষ্টানদের উপরে যে নারকীয় বর্বরতা সংঘটিত করেছে তা একটা বিষয় নিশ্চিত করেছে যে, খৃষ্টাদর্শী স্বধর্মী হলেও ইউরোপ থেকে আগত নিজ জাতির ভাইদের হাতে এশিয়ান বা পূর্বাঞ্চলীয় খৃষ্টান ও তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কোনমতেই নিরাপদ নয়।

   আরও একটা বিষয় নিশ্চিতভাবেই প্রতিষ্ঠিত করে দেখিয়েছে বিশ্বের সামনে। তা হলো; ধর্মের নামে ইউরোপ থেকে ক্রুসেডাররা বেরিয়ে আসলেও আসলে আগত ঐসব যোদ্ধা, তথা, ক্রসেডারদের মধ্যে ধর্মের বা নীতি নৈতিকতা, মানবিকতার কোন লেশমাত্র ছিল না। 

    তারা যে ধর্মীয় আবেগ দেখিয়েছে, বা দেখায়, তা মেকি। ধর্মের জন্য বা মানবিকতার জন্য তাদের এই আবেগ নয়, বরং সেই আবেগ হলো বিশেষ কোন স্বার্থকেন্দ্রিক, কেবলই রাজনৈতিক।

   এ উপলব্ধীটা কন্সটান্টিনেপল, তথা, ইস্তাম্বুলের খৃষ্টান সমাজ, বিশেষ করে, সেখানকার প্রশাসনকে বাস্তবতা বুঝে উঠতে সহায়তা করে। সেই থেকে পরবর্তি প্রতিটি ধাপে যে কোন আগ্রাসনের মুখে তারা পার্শ্ববর্তি ওসমানীয় সালতানাতের কাছে সাহায্য চেয়ে হাত বাড়িয়েছে।

    মুুসলিম সালাতানত, ওসমানিয়দের কাছে খৃষ্টান জনপদ বাইজান্টাইনীয়দের এই সাহায্য চাওয়া, তাদের সাথে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিকসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক কিংবা বাণিজ্যিক সম্পৃক্ততা প্রকারান্তরে ইউরোপীয় খৃষ্টান সমাজ, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শক্তি এবং সর্বোপরি, ভ্যাটিকানের পোপ কার্ডিনালদের আরও বিরুপ করেছে ইস্টার্ন ক্রিশ্চিয়ানিটি তথা বাইজান্টাইন ক্রিশ্চিয়ানিটির প্রতি।

    ভ্যাটিকানের পোপের প্রতি বাইজান্টাইন চার্চের ক্ষোভের সঙ্গত কারণ ছিল। ঐতিহাসিকভাবে প্রোটেস্টান্টিনিজম নিয়ে ক্যাথলিক পোপের যে বিরোধ, তা তো ছিলই। কিন্তু তা ছাড়াও খোদ পোপের নির্দেশে পুরো পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আসা হাজার হাজার খৃষ্টান ক্রুসেডার বাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হবার পরেও ভ্যাটিকান থেকে পোপ টু শব্দটিও করেননি। তাদের প্রতি বর্বরতার বিচার ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা তো দূরের কথা। বাইজান্টাইন খৃষ্টানদের মনে এ ক্ষোভ গেঁথে গেছে চীরদিনের জন্যই!

    পোপের পক্ষে আসলেই ক্রুসেডারদের দ্বারা কৃত এই ঘৃণ্য নৃশংসতা ও বর্বরতার কোন বিচার করা সম্ভবপর ছিল না। তার আসলে কোন ইচ্ছা ছিল কি না, সেটা জানা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর নয় ইতিহাসের এ পর্যায়ে এসে। কিন্তু তার পক্ষে যে সম্ভবপর ছিল না, সেটা আমরা নিশ্চিত করেই বুঝতে পারি। 

      কারণ পোপের নির্দেশে ইউরোপের আনাচে কানাচে থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসার এই সৈন্যবাহিনীর উপরেই নির্ভর করছিল পোপের স্বপ্নপূরণের বিষয়টি। তিনি এদের দ্বারাই জেরুজালেম মুক্ত করাতে সচেষ্ট ছিলেন। বারবার চেষ্টা করেও, একের পর এক ক্রুসেড অভিযান পরিচালনা করেও তিনি জেরুজালেমকে মুক্ত করতে পারছিলেন না। তাকে ভবিষ্যৎ অভিযানগুলোর জন্য সৈন্য ও রসদ জোগাড় করতে হতো সেই ইউরোপ থেকেই। সেই ইউরোপের রাজা রাজড়া ও ভূসামন্তপ্রভূদের দেয়া অর্থের উপরে ভিত্তি করেই তার সকল অভিযান পরিচালিত হতো। 

      কাজেই ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা এই সব ক্রুসেডাররা যাই করুক না কেন, যতোই বর্বরতা করুক না কেন, পোপের পক্ষে তাদের প্রতিহত করা বা বিচার করা কিংবা নিবৃত করাটা সম্ভবপর ছিল না। সমকালীন বাস্তবতাও আমাদের সামনে সে ইতিহাস সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

    এ ইতিহাস সামনে রাখলে আমাদের সামনে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে কোন প্রেক্ষাপটে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ কর্তৃক ইস্তাম্বুল বিজয়ের পরে আয়া সোফিয়ার পাদ্রি Gennadius স্বপ্রণোদিত হয়ে Better the turban of the Sultan than the hat of the Cardinal. 

  ভাবানূবাদ: ‘পোপের টুপির নীচে থাকার চেয়ে খলিফার পাগড়িতলে আশ্রয় নেয়াটাই ভালো আমাদের জন্য!’ মর্মে তার সেই ঐতিহাসিক মন্তবটি করেছিলেন!
------------------------ 
(লেখা চলমান গ্রন্থ; ‘টার্কি: দ্যা ল্যান্ড অব রাইজিং ক্রিসেন্ট; চন্দ্রোদয়ের দেশ’ থেকে সংক্ষিপ্তকৃত)
-------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও বিশ্লেষক।    


Post a Comment

0 Comments