Recent Tube

বিশ্ব জানুক আমার সৌভাগ্যের কথা- জিয়াউল হক।

       বিশ্ব জানুক আমার সৌভাগ্যের কথা-
     

     দিনটি  ১১ ই জুলাই। ১৯৯৯ সাল। রাত সাড়ে আটটা। কুয়েতের আবহাওয়া প্রচন্ড উত্তপ্ত। সূর্য ডুবে গেছে কিন্তু  বাতাসে আগুনের হল্কা, মনে হয় চামড়া পুড়িয়ে দেবে!  সাথে  শামসু ভাই। গাড়ীটা রেখে  হাঁটতে হাঁটতে মোল্লাহ সালেহ মসজিদের কাছাকাছি পৌছুতেই এশার আজান,  বললাম ‘চলুন নামাজ শেষে বাজারে ঢুকি, নইলে জামাতটাই মিস হবে।’  

    এখানেই রয়েছে  বিখ্যাত  ‘আইপিসি’ বা ‘ইসলাম প্রেজেন্টেশন কমিটি’র অফিস। ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে নিয়মিত আলোচনানুষ্ঠান হয়। মরহুম আহমেদ দীদাত,জগলুল নাজ্জার এবং  ডা: জাকির নায়েক’সহ অনেকেই  আলোচনা করেছেন। কুয়েতে অবস্থানরত আমেরিকান কিংবা ইউরোপীয় সৈন্যরাও  উপস্থিত হয়। নিজেও কোন কোন লেকচারে উপস্থিত থেকেছি। 

     বিশ্বের সত্তরটি দেশের অুমসলিমদের  বাস কুয়েতে। এ ছাড়াও রয়েছে হাজার হাজার আমেরিকান ও ন্যাটো সৈন্য, তাদের পরিবার পরিজন। প্রতিদিনই কোন না কোন অমুসলিম ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হচ্ছে। কখনও কখনও দল বেঁধেও অনেকে মুসলমান হয়। 

     এখানেই পরিচয় হয়েছিল খৃষ্টান পাদ্রী থেকে ধর্মান্তরীত দা’য়ী  ইলাল্লাহ, ফিলিপিনো নওমুসলিম মরহুম আব্দুল্লাহ স্পিরিটো’র সাথে। নিজের এক দাওয়াতি টার্গেটের কারণে আব্দুল্লাহর কাছে ঘন ঘন আসতাম। এখনও সময় পেলেই আসি। 

   নামাজ শেষে  ‘আইপিসি’র ইউরোপ ও পাশ্চাত্য বিভাগের প্রধান ড: ইউসুফ এসে ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন। ইমামই প্রথমে মুখ খুললেন, আল্লাহর হামদ ও রাসুলুল্লাহ (স:) এর উপরে দরুদ শেষে; ‘সম্মানীত মুসল­ীবৃন্দ, আল্লাহ যাকে খুশি হেদায়েত দান করেন, দান করেন ইসলামের মত অমুল্য নিয়’ামত। এখন এমনই একজনকে উপস্থাপন করছি, যাঁকে আল্লাহ তাঁর অপার অনুগ্রহে ধন্য করতে যাচ্ছেন। 
 
       ড: ইউসুফ দরজার দিকে ঈশারা করতেই দেখলাম  কুয়েতি যুবকের সাথে এগিয়ে আসছে পরিপাটি বেশভূষায় সজ্জিত প্রায় সাত ফুট উচ্চতার ইউরোপীয় ব্যক্তি। লাল টুক টুকে রং, সাদা রেশমি চুল, বিনম্র ভঙ্গিতে ইমামের পাশে দাঁড়ালেন। 

       ইমাম কলেমা পড়ালেন। তিনিও অনভ্যন্ত উচ্চারণে তা পড়লেন। মুসল্লিরা ত্বাকবির ধ্বনী দিল। তিনি মুসলমান হলেন। ইমাম সাহেব এবং ড: ইউসুফ কোলাকুলি করলেন। এরপরে মুসল্লিদের পালা। একসময় আমিও কোলাকুলি করলাম, বললাম; Welcome to the world of eternal peace তিনি বললেন; Thank you।
 
        সুন্নত শেষে দেখি তখনও কোলাকুলি চললেও ভীড় অনেকটা কম। এক কোণায় ড: ইউসুফ দাঁড়িয়ে একা। পূর্ব পরিচয় থাকার সুবাদে ড: ইউসুফকে ধরলাম ‘তোমার ব্যস্ততা না থাকলে নওমুসলিমের সাথে একটু কথা বলতে চাই’। তিনি সানন্দে রাজী হয়ে বললেন ‘চল আমার অফিসে গিয়ে বসি, সেখানেই কথা হবে’।

     বেসমেন্টে  অফিসে মোট চারজন মুখোমুখি বসলাম। নওমুসলিমের পাশে আমি, আমার পাশে সামসুল হক আর ড: ইউসুফ আমাদের মুখোমুখি সোফায়। ‘এই প্রথম জানলাম তার নাম, মিশেল। 

     অভিনন্দন জানালাম নতুন জীবনের জন্য ‘কংগ্রাচুলেশন, এই মহুর্তে তোমার আবেগটুকু বুঝি, বুঝি মানসিক অবস্থাটাও। এরপরেও  আমাদের সময় দেবার জন্য  ধন্যবাদ। 

     ভদ্রলোক  জানালেন, দক্ষিণ ফ্রান্সে জন্ম, নাম মিশেল, বয়স বিয়াল্লি¬শ বৎসর, পেশায় ইন্টেরিয়ার ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন।  আট বৎসর কুয়েতে চাকুরিরত এবং এই প্রথম কোন আরব দেশে বসবাস করছেন। বৎসর পাঁচেক ছিলেন রাশিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের সবক’টি দেশ ঘুরেছেন নেশা, পেশা, কিংবা শখের বশে। স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে, দুই কন্যা ফ্রান্সে পড়াশোনা করছে।

     একটু থামলেন। ক’টি মহুর্ত নীরবে কেটে গেল।সম্ভবত  একজন স্নেহপরায়ণ পিতার চোখে ভাঁসছিল পারিবারিক ছায়াবঞ্চিত দুই কন্যার মুখচ্ছবি! একজন পিতার জন্য বড়ই দূর্বল জায়গা, কিন্তু আমার’তো চলছে না থেমে থাকলে! তাই আবার নীরবতা ভেংগে জানতে চাইলাম; ‘তুমি মুসলমান হলে। পূর্বপরিকল্পনামত কাজটি করলে? না, কোন আবেগতাড়িত স্বিদ্ধান্ত!

     সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে বললেন; ‘দেখ, দীর্ঘ আট বৎসর আরবদের মাঝে বাস করছি, ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি। বিগত পাঁচ বৎসর বইপত্র ও কুরআনের তরজমার মাধ্যমে ইসলামক জানছি,  আরবি ভাষা শিখছি কুরআনকে ভালোমত বোঝার জন্য। যা করেছি, বুঝে শুনে, ভেবে চিন্তেই করেছি।

‘ইসলামের কোন বিষয়টি তোমাকে বেশি আকৃষ্ঠ করেছে’? জানতে চাইলাম।

     ‘তোমাদের মুসলিম সমাজে স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, এঁদের মধ্যে যে অসম্ভব রকম অটুট বন্ধন, সহমর্মিতা ও ভালোবাসা, এটা এ বিশ্বে একমাত্র মুসলিম সমাজ ছাড়া আর কোথাও দেখতে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার! আমরা পশ্চিমের বাসিন্দারা এগুলো হতে যোজন যোজন দুরে! এগুলো কল্পনাও করতে পারি না! তাই যখন এই ধরনের সম্পর্ক বাস্তবে দেখলাম, তখন অবাকই হলাম! বুক ভরা হাহাকার কিন্তু অন্তর জুড়িয়ে গেল তা দেখে!

 ড: ইউসুফ জানতে চাইলেন, ‘তুমি কি জানো এর পেছনে মুল কারণটা কি’?

        ‘হাঁ, গভীরভাবে ভেবেছি,  অটুট পারিবারিক ও মানবিক বন্ধন, বৃহত্তর ভাতৃত্ববোধের চেতনা। আমার যে কোন প্রয়োজনে, সমস্যায় প্রথম যারা এগিয়েছেন, তারা মুসলমান, অথচ সেই একই ক্ষেত্রে স্বজাতি পরিচিত বন্ধুদের ভূমিকা প্রশ্নাতিত নয় বরং দু:খজনক! 

      কুরআন পড়েছি, এখনও পড়ছি, আমার অবসরই কাটে কুরআন পড়ে। এর ছত্রে ছত্রে ভালবাসা ক্ষমা, ঔদার্য আর ভাতৃত্বের আহŸান! সকল প্রশ্নের উত্তরই কুরআন নীরবে আমাকে দিয়ে গেছে! এরপরেই স্বিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন আমি মুসলমান। আলহামদুলিল্ল¬াহ’।

     ‘তোমার কন্যাদের জানিয়েছ?‘ জানতে চাইলাম। ‘হ্যাঁ জানিয়েছি, আমার সহকর্মী, বন্ধু বান্ধবদের জানিয়েছি। জীবনের শ্রেষ্ঠতম কাজটি গোপনে করতে চাইনি। চেয়েছি সারা বিশ্ব জানুক আমার সৌভাগ্যের কথা, আমার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা, আমি মুসলমান। আমি মুহাম্মদুর রাসুলুল¬াহ স: এঁর উম্মত!

      কথায় কথায় রাত হয়েছে। নওমুসলিম এবং ড: ইউসুফকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠলাম। আসার সময় নওমুসলিম হাতটি চেপে ধরলেন, সরাসরি চোখে চোখ রেখে বললেন; ‘আমার জন্য দোওয়া করো’। 

         হৃদয়ের গভীরে পৌছুলো  কথাগুলো। সালাম জানিয়ে পা বাড়ালাম।
এয়ারপোর্ট রোড ধরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম ফোর্থ রিং রোড পানে। রাস্তায় অসংখ্য গাড়ী, গাড়ীর স্টিয়ারিং এর উপরে হাত, দৃষ্টি সামনে। কিন্তু মনের কোণে ভেঁসে উঠছিল  মিশেলের কথাগুলো ‘ আল্লাহ আমাকে মুসলমান বানিয়েছেন, বিশ্ব জানুক আমার সৌভাগ্যের কথা! আলহামুদলিল্লাহ, আমি রাসুলুল¬াহ স: এঁর উম্মত!

        আহা, আমরা যারা নিজেদেরকে ‘আশেকে রাসুল’ তাঁর ‘খাঁটি উম্মত’ বলে নিত্য ঘোষণা দেই, জ্বেহাদের মেকি উত্তাপে মুসলমান হয়ে মুসলমানের গলা কাটি, তাঁরা যদি একটাবার বুক ফুলিয়ে বলতে পারতাম ‘বিশ্ব জানুক আমার সৌভাগ্যের কথা, আল্লাহ আমাকে মুসলমান বানিয়েছেন, আলহামুদলিল্লাহ, আমি রাসুলুল্লাহ স: এঁর উম্মত!’ (সংক্ষেপকৃত)

Post a Comment

0 Comments