Recent Tube

ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রহঃ অনুবাদঃ আবদুস শহীদ নাসিম। সম্পাদনা: শামীম আজাদ।


 ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা 
সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রহঃ 
অনুবাদঃ আবদুস শহীদ নাসিম। 

আমাদের কথা।

  পুস্তিকাটি আধুনিক ইসলামী জগতের অনন্য সাধারণ চিন্তাবিদ এবং ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রহ. (১৯০৩ - ১৯৭৯) এর একটি ভাষণ ।

  পবিত্র মক্কার মসজিদে দেহলবীতে ১৩৮২ হিজরীর যিলহজ্জ মাসে (১৯৬২ খৃষ্টাব্দ) তিনি এক যুব সমাবেশে এ ভাষণ প্রদান করেন। বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত যুবকেরা বিশেষ করে বিপুল সংখ্যক আরব যুবক এ সমাবেশে উপস্থিত হয়। মাওলানা তাদের উদ্দেশ্যে আরবি ভাষায় এ ভাষণ প্রদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৩ ঈসায়ী সালের জুন সংখ্যা তর্জমানুল কুরআন’ জর্নালে ভাষণটির উর্দু অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এ ভাষণে মাওলানা মুসলিম বিশ্বের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেন। বিজাতীয় শাসনের কুফল এবং পাশ্চাত্যপন্থী মুসলিম শাসকদের ভ্রান্ত কর্মনীতি তুলে ধরেন।

   তিনি বলেন, এতােসব সত্ত্বেও ইসলামী বিশ্বের আসল পূজি সাধারণ জনগণ সব সময় ধ্যান ধারনার দিক থেকে ইসলামের উপর অবিচল ছিলাে এবং আছে।

   এমতাবস্থায় ইসলামী জনতাকে যােগ্যতার সাথে নেতৃত্ব প্রদানের জন্যে মুসলিম যুব সমাজ কোন প্রক্রিয়ায় নিজেদের তৈরি করবে এবং কোন পদ্ধতিতে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে আন্দোলন করবে মাওলানা সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।

    সশস্ত্র গােপন আন্দোলনের পথ পরিহার করে ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সাথে ইসলামের পক্ষে জনমত সৃষ্টি এবং জনগণকে সংগঠিত করার কাজ করে যাওয়াকেই মাওলানা ইসলামী আন্দোলনের সঠিক এবং একমাত্র কর্মপন্থা বলে উল্লেখ করেন।

আবদুস শহীদ নাসিম
পরিচালক
সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রিসার্চ একাডেমী ঢাকা

সূচিপত্র

ইসলামী বিশ্বের অবস্থা
১. ইসলামী বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত
২. স্বাধীন মুসলিম দেশগুলাের বর্তমান অবস্থা
৩. পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শাসন কি দিয়ে গেছে?
৪. কয়েকটি সুস্পষ্ট বিষয়
৫. শাসক ও জনগণের সংঘাতের পরিণাম
৬. আশার আলাে।

ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা

এক : ইসলামের যথার্থ জ্ঞান লাভ করুন
দুই : নিজেদের নৈতিক মাননান্নয়ন করুন
তিন : পাশ্চাত্য কালচার ও দর্শনের মুখােশ উন্মােচন করুন
চার : মজবুত সংগঠন গড়ে তুলুন
পাঁচ : সাধারণ দাওয়াত সম্প্রসারণ করুণ
ছয় : ধৈর্য ও বিজ্ঞতার সাথে অগ্রসর হােন
সাত : সশস্ত্র ও গােপন আন্দোলন থেকে দূরে থাকুন।

ইসলামী বিশ্বের অবস্থা

সৌভাগ্যের বিষয়, ইসলামের কেন্দ্রভূমিতে হজ্জের বিশ্ব সম্মেলন উপলক্ষে ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন অংশ থেকে আগত বিপুল সংখ্যক সত্যানুসারী মুমিনদের সম্বােধন করার সুযােগ পেলাম। সুযােগে সত্যাশ্রয়ী মুমিনদের বিশেষ করে তাদের শিক্ষিত যুব সমাজের আসল কর্তব্য সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেবার সুযােগ পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ। আমি এ মহামূল্যবান সুযােগটির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে চাই। এ ধরনের সুযােগ হয়তাে আমার জীবনে আর নাও আসতে পারে। তাই আমি হৃদয় উজাড় করে আমার মনের কথাগুলাে আপনাদের সামনে রেখে যেতে চাই। এর ফলে ইসলামী বিশ্বের বর্তমান অবস্থার সঠিক চিত্র আপনাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে। এ অবস্থা সৃষ্টির কারণগুলােও আপনারা অনুধাবন করতে পারবেন। সেই সাথে এ অবস্থার সংশােধনের জন্য আমার মতে যথার্থ বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার সাথে যেসব কর্মকৌশল ও উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা একান্ত প্রয়ােজন সেগুলাে আপনারা সঠিকভাবে জানার সুযােগ পাবেন। কাজেই যারা উপস্থিত আছেন, তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার কথাগুলাে পৌঁছাবার দায়িত্ব গ্রহণ করুন।

১. ইসলামী বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত।

সবার আগে এ বাস্তব কথাটি হৃদয়ংগম করুন, বর্তমানে ইসলামী বিশ্ব দুটি বড়
বড় অংশে বিভক্ত হয়ে রয়েছে। এর একটি অংশে মুসলমানরা সংখ্যালঘূ এবং সেখানে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব রয়েছে অমুসলিমদের হাতে। দ্বিতীয় অংশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্বের আসনেও তারাই সমাসীন। এ দুটি অংশের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় অংশ বেশি গুরুত্বের অধিকারী। ইসলামী উম্মাহর ভবিষ্যত অনেকাংশে নির্ভর করছে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রগুলির গৃহীত দৃষ্টিভংগি ও পদক্ষেপের উপর। অবশ্য প্রথম অংশটির গুরুত্বও কম নয়। প্রথম অংশটিও নিজের অবস্থানে অত্যাধিক গুরুত্বের অধিকারী। কারণ বিশ্বের সব অংশ ও সব অঞ্চলে একটি জীবন-দর্শন, আকীদা-বিশ্বাস ও মতাদর্শের লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি অনুসারীর বর্তমান থাকা ঐ মতাদর্শ ও আকীদা-বিশ্বাসের পতাকাবাহীদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধির সহায়ক।

কিন্তু সেই মতাদর্শটি যদি তার নিজের ঘরেই পরাভূত ও পরাজিত হয়ে থাকে, তাহলে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা তার অনুসারীরা যারা আগে থেকেই ছিলাে সর্বত্র পরাজিত, নিজেদের অবস্থানে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনা। তাই বলা যায়, আপাত দৃষ্টিতে ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে মরক্কো-নাইজেরিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলিম রাষ্ট্রগুলাের উপরই ইসলামী বিশ্বের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। আল্লাহ তা'আলার কুদরত ও হিকমত যদি ভিন্ন কোনাে অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে দেয় তবে তা ভিন্ন কথা। তবে সেটার বাহ্যিক কোনাে আলামত আমাদের নজরে পড়েনা। তিনি চাইলে প্রস্তরখন্ডের বুক চিরেও ঝরণাধারা প্রবাহিত করতে পারে। তাঁর একটি মাত্র ইশারায় মরুভূমিও সবুজ শ্যামল উদ্যানে রূপান্তরিত হতে পারে ।

২. স্বাধীন মুসলিম দেশগুলাের বর্তমান অবস্থা

আমরা যদি ধরে নিই, ইসলামী বিশ্বের ভবিষ্যত মুসলিম দেশগুলাের সাথে সম্পৃক্ত, তবে এ সিদ্বান্তটির ভিত্তিতে এখন মুসলিম দেশগুলাের বর্তমান অবস্থা এবং তাদের সেই অবস্থার কারণগুলাে বিশ্লেষণ করা যাক।

আপনারা অবগত আছেন, সুদীর্ঘকাল চিন্তার স্থবিরতা, বুদ্ধিবৃত্তিক জড়তা, অধ:পতন, নৈতিক অবক্ষয়, বস্তুগত পশ্চাদপদতার মধ্যে অবস্থান করার পর অধিকাংশ মুসলিম দেশ পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের শিকারে পরিণত হয়েছিল। ঈসায়ী আঠারাে শতক থেকে এ অবস্থার সূচনা হয় এবং উনিশ শতকের সূচনা পর্বেই তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ সময় মাত্র হাতে গােনা দু-চারটি মুসলিম দেশ সরাসরি পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক গােলামি থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছিল। কিন্তু একের পর এক পরাজয়ের কারণে তাদের অবস্থা পরাধীন দেশগুলাের চাইতেও নিকৃষ্ট হয়ে পড়ে। যেসব মুসলিম দেশ নিজেদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলেছিল, তথাকথিত এই স্বাধীন মুসলিম দেশগুলাে তাদের চাইতেও সন্ত্রস্ত ও পর্যদুস্ত হয়ে পড়েছিল।

৩. পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শাসন কি দিয়ে গেছে?

পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য থেকে আমরা সবচাইতে ধ্বংসকর যে পরিণতি
লাভ করেছি সেটি হচ্ছে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পরাজয় আর নৈতিক অধপতন এই সাম্রাজ্যবাদীরা যদি আমাদের ধন-সম্পদ লুট করেও আমাদের ফতুর করে
দিতাে এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আমাদের বংশ বিনাশ করে দিতাে, তাহলেও হয়তাে আমাদের ততােটা সর্বনাশ হতাে না, যতােটা তারা নিজেদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অনৈতিক বিষ ছড়িয়ে আমাদের সর্বনাশ সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। যেসব মুসলিম দেশের উপর তাদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে, সেসব দেশে তারা সবাই একটি সম্মিলিত নীতির মাধ্যমে আমাদের স্বাধীন শিক্ষা ব্যবস্থা খতম করে দিয়েছে। আর যেখানে পুরােপুরি খতম করতে পারেনি, সেখানে অন্তত ঐ মুসলিম শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের জন্যে সমাজ জীবনে কোনাে কর্মক্ষেত্র না রাখার ব্যবস্থা করে গেছে।

  একইভাবে তারা কজা করা জাতিগুলাের নিজেদের ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও
সরকারি ভাষা হিসেবে চালু রাখতে দেয়নি। এটাও ছিলাে তাদের নীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংগ। এর পরিবর্তে তারা বিজয়ী ও শাসক জাতির ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমে পরিণত করে এবং তাকেই সরকারি ভাষা গণ্য করে। পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সব মুসলিম ভূখন্ডে ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি ইতালীয় নির্বিশেষে সকল পাশ্চাত্য বিজয়ী জাতি একযােগে এ নীতি অবলম্বন করে। এ পদ্ধতি অবলম্বন করে সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের দেশে এমন একটি শ্রেণীর উদ্ভব ঘটায়, যারা একদিকে ইসলাম ও ইসলামের শিক্ষা সর্ম্পকে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, ইসলামী আকীদা ও জীবন পদ্ধতির সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন এবং তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি বিমুখ। অপরদিকে তাদের মন-মস্তিষ্ক, চিন্তা-ধারা ও দৃষ্টিভংগি সম্পূর্ণরূপে
পাশ্চাত্য ছাঁচে গড়ে ওঠে।

অতপর এই শ্রেণীর পরেও অনবরত এমন সব শ্রেণীর উদ্ভব ঘটানাে হতে থাকে যারা ইসলাম থেকে আরাে বেশি দূরে সরে যায় এবং পাশ্চাত্য জীবন দর্শন ও সভ্যতা-সংস্কৃতিতে অনেক বেশি ডুবে যেতে থাকে। নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলা তাদের কাছে অত্যন্ত লজ্জাকর এবং বিজয়ী শাসকদের ভাষায় কথা বলা

    গর্বের বিষয়ে পরিণত হয়। পশ্চিমা শাসক শ্রেণী খৃষ্টবাদের ব্যাপারে যতােই
গোঁড়ামির পরিচয় দিক না কেন, আমাদের এই ফিরিংগি পূজারী গােলামদের কিন্তু নিজেদের মুসলমানিত্বের জন্য লজ্জাবােধ জেগে উঠে। এ জন্যে তারা সগর্বে নিজেদের ইসলামদ্রোহিতার ঘােষণা দেয়।

    পাশ্চাত্য শাসকরা তাদের পুরাতন আমলের বস্তাপঁচা জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি
যতােই সম্মান প্রদর্শন করুক না কেন, আমাদের এই গােলাম শ্রেণী নিজেদের
জাতীয় ঐতিহ্যকে হেয় প্রতিপন্ন করাকেই নিজেদের মর্যাদা লাভের উপায় মনে
করতে থাকে।

পশ্চিমা শাসকরা দীর্ঘকাল মুসলিম দেশে অবস্থান করার পরও কোনাে দিন
মুসলমানদের লেবাস ও জীবন যাপন প্রণালী অবলম্বন করেনি। কিন্তু এই
গােলামের দল নিজেদের দেশে অবস্থান করেও ঐ বিজয়ী শাসকদের লেবাস-
পােশাক, তাদের সামাজিক পদ্ধতি, তাদের পানাহারের রীতিনীতি, তাদের
সাংস্কৃতিক রীতি-পদ্ধতি, এমনকি তাদের উঠা-বসা, চলাফেরা ও নড়াচড়া করার
প্রত্যেকটি কায়দা-কানুন পর্যন্ত নকল করতে থাকে এবং নিজের জাতির
প্রত্যেকটি জিনিসই তাদের কাছে তুচ্ছ ও অর্থহীন হয়ে পড়ে।

এর পর পশ্চিমা শাসকদের অনুকরণে এরা বস্তুবাদিতা, নাস্তিক্যবাদ, জাহিলিয়াত পূজা, জাতীয়তাবাদ, চারিত্রিক নৈরাজ্য এবং নৈতিক চরিত্রহীনতার বিষ-রস আকণ্ঠ পান করে বসে। তাদের মন-মগজে এ কথা বসে যায় যে, পশ্চিম থেকে যা কিছু আসে তা পুরােপুরি সত্য ছাড়া আর কিছুই নয়। তাকে
নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে নেয়াই হচ্ছে প্রগতি। তাকে গ্রহণ না করাটা রক্ষণশীলতা
এবং পশ্চাদপদতা ছাড়া কিছুই নয়।

পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের এটা স্থায়ী নীতি ছিলাে যে, তাদের রঙ্গে যারা যতাে বেশি
রঞ্জিত হবে এবং ইসলামী প্রভাব থেকে যতাে বেশি মুক্ত হবে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে
তাদের ততাে বেশি উন্নত মর্যাদা দান করা হবে। এই নীতির অনিবার্য ফল স্বরূপ দেশের শাসন কর্তৃত্বের উচ্চতম আসন এই রঙ বদলকারীদের দখলে চলে যায়। সাম্রাজ্যবাদীদের প্রধান সামরিক ও বেসামরিক পদে এরাই নিযুক্ত হয়।
রাজনীতিতে এরাই গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদার আসন লাভ করে। এরাই হয় রাজনৈতিক
আন্দোলনগুলাের নেতা। এরাই পার্লামেন্টে জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে প্রবেশ
করে। মুসলিম দেশগুলাের অর্থনৈতিক জীবনে এরাই ছায়া বিস্তার করে।

পরবর্তীতে মুসলিম দেশগুলােতে যখন স্বাধীনতা আন্দোলন জন্ম নিতে থাকে
তখন সেগুলাের নেতৃত্বও অনিবার্যভাবে এইসব লােকের হাতেই এসে পড়ে।
কারণ এরাই শাসকদের ভাষায় কথা বলতে পারতাে। এরাই তাদের মেজাজ-
স্বভাব-প্রকৃতি জানতাে, আর এরাই ছিলাে তাদের সবচেয়ে কাছের লােক।
একইভাবে যখন মুসলিম দেশগুলাে স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে, তখন দেশের
স্বাধীনতা পরবর্তী কর্তৃত্বও এদেরই হাতে চলে আসে। সাম্রাজ্যবাদীদের
উত্তরাধিকার এরাই লাভ করে। কারণ সাম্রাজ্যবাদীদের আওতাধীনে এরাই লাভ
করেছিল রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি। এরাই পরিচালনা করেছিল বেসামরিক
সরকার। সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বেও এরাই ছিলাে সমাসীন।

৪. কয়েকটি সুস্পষ্ট বিষয়

সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সূচনাকাল থেকে স্বাধীনতা লাভের সূচনাকাল পর্যন্তকার
ইতিহাসের কয়েকটি সুস্পষ্ট বিষয় দৃষ্টির সামনে রাখা একান্ত প্রয়ােজন। এ
বিষয়গুলাে বাদ দিয়ে বর্তমান অবস্থার যথার্থ চিত্র অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

এক : প্রথম কথা হচ্ছে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের গােটা সাম্রাজ্যবাদী
শাসনামলে কোথাও সাধারণ মুসলমানদের ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়নি। নিঃসন্দেহে তারা জাহিলিয়াতের প্রসার ঘটিয়েছে, মুসলিম জনগণের মধ্যে অনেক চারিত্রিক বিকৃতিরও জন্ম দিয়েছে এবং ইসলামী আইন- কানুনের পরিবর্তে নিজেদের আইন জারি করে মুসলমানদের অমুসলিমের জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে তুলেছে। কিন্তু কোনাে দেশের মুসলিম জনগােষ্ঠী একটি জনগােষ্ঠী হিসাবে সাম্রাজ্যবাদীদের প্রভাবাধীনে বসবাস করেও ইসলামের প্রতি বিদ্রোহী মনােভাবাপন্ন হয়ে যায়নি। বিশ্বের প্রতিটি দেশে সাধারণ মুসলমানরা ঠিক তেমনি ইসলামের প্রতি বিশ্বস্ত রয়ে গেছে, যেমনি ছিলাে এর আগে। তারা হয়তাে ইসলাম সম্পর্কে সঠিকভাবে জানে না, কিন্তু তাকে মেনে চলে, তার প্রতি গভীর ভক্ত অনুরক্ত এবং ইসলাম ছাড়া আর কোনাে কিছুতেই তারা সন্তুষ্ট নয়। তাদের নৈতিক চরিত্র মারাত্নকভাবে বিকৃত হয়ে গেছে এবং তাদের আচার-আচরণ ও অভ্যাসে অধপতন এসেছে। এরপরেও তাদের মূল্যবােধের পরিবর্তন হয়নি এবং তাদের মানদন্ডসমূহ সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। তারা সুদ, যিনা ও মদ্যপানে আসক্ত হতে পারে এবং হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ফিরিংগি সভ্যতার পূজারী ক্ষুদ্র একটি গােষ্ঠী ছাড়া সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে একজনও এমন পাওয়া যাবে না, যে এসব কাজকে হারাম মনে করে না। তারা নাচ, গান ও অন্যান্য নৈতিকতা বিগর্হিত কাজের মজা ত্যাগ করতে হয়তাে পারছে না, কিন্তু ক্ষুদ্র একটি পাশ্চাত্য পূজারী গােষ্ঠী ছাড়া সাধারণ মুসলমানরা কোনােক্রমেই একে যথার্থ সংস্কৃতি বলে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। অনুরূপভাবে তারা কয়েক পুরুষ পাশ্চাত্য আইনের আওতায় জীবন যাপন করছে, কিন্তু এ আইনটি যথার্থ সত্য এবং ইসলামের আইন বাসি হয়ে গেছে- এরূপ ধারণা তাদের মগজে ঢুকানাে আজো কোনােক্রমেই সম্ভব হয়নি। পাশ্চাত্যবাদী ক্ষুদ্রতম সংখ্যালঘু শ্ৰেণীটি যতােই পশ্চিমা আইনের প্রতি আস্থাশীল থাকুক না কেন সাধারণ মুসলমানদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ট অংশ চিরকালের মতাে আজও একমাত্র ইসলামের আইনকেই সত্য বলে মনে করে এবং তার প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ন চায়।

দুই : উলামায়ে কিরাম সর্বত্র জনগণের কাছেই অবস্থান করছেন। তারা জনগণের ভাষায় কথা বলেন এবং জনগণের আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তা পদ্ধতির প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু দেশের কর্তৃত্ব ক্ষমতা তাদের নাগালের সম্পূর্ণ বাইরে। তাছাড়া দীর্ঘকাল থেকে পার্থিব বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন থাকার কারণে মুসলমানদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেবার এবং শাসন কর্তৃত্ব হাতে নিয়ে কোনাে দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করার যােগ্যতাও তারা হারিয়ে ফেলেছেন। এ কারণে কোনাে একটি মুসলিম দেশেও তারা স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারেননি। কোথাও স্বাধীনতা লাভের পর শাসন কর্তৃত্বে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আমাদের সামাজিক জীবনাঙ্গণে দীর্ঘকাল থেকে তারা কেবল এমন এক দায়িত্ব পালন করে চলেছেন যাকে গাড়ির ব্রেকের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। পাশ্চাত্যবাদী শ্রেণী হচ্ছে ড্রাইভার আর উলামায়ে কেরাম হচ্ছেন গাড়ির ব্রেক। এই ব্রেক গাড়ির গতির দ্রুততাকে কিছু না কিছু নিয়ন্ত্রিত করে যাচ্ছে। কিন্তু কোনাে কোনাে দেশে এই ব্রেক ভেঙ্গে গেছে এবং গাড়ি অতি দ্রুত নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। অবশ্য গাড়ির চালকরা এই ভ্রান্ত ধারণা করেই চলছে যে, তাদের গাড়ি উপরের দিকেই উঠছে।

তিন : বিশ্বের যেখানেই স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার নেতৃত্বের আসনে পাশ্চাত্যবাদী লােকেরা সমাসীন থাকলেও কোথাও ধর্মীয় আবেদন ছাড়া সাধারণ মুসলমানদের নাড়া দেয়া যায়নি এবং ত্যাগ স্বীকারেও উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। সকল দেশে ইসলামের নামেই জনগণকে আহ্বান করতে হয়েছে। সব জায়গায় আল্লাহ, রসূল ও কুরআনের নামে তাদের আবেদন করতে হয়েছে। সর্বত্রই স্বাধীনতা আন্দোলনকে ইসলাম ও কুফরের লড়াই গণ্য করতে হয়েছে। এসব ছাড়া কোথাও নিজেদের জাতিকে তারা নিজেদের পেছনে এনে দাঁড় করাতে পারেনি। কিন্তু বিশ্ব ইতিহাসের সবচাইতে বড় ও নজীরবিহীন বিশ্বাসঘাতকতা আমরা দেখতে পাচ্ছি, সর্বত্রই স্বাধীনতা হাসিলের পর জাতীয় নেতারা নিজেদের সমস্ত ওয়াদা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং তাদের প্রথম শিকার হয়েছে সেই ইসলাম যার সাহায্যে তারা স্বাধীনতার লড়াইয়ে জয়লাভ করেছিল।

চার : সর্বশেষ উল্লেখযােগ্য কথাটি হচ্ছে, এসব লােকের নেতৃত্বে মুসলিম দেশগুলাে কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতাই লাভ করেছে। নতুবা পূর্বের গােলামি আর বর্তমানের স্বাধীনতার মধ্যে তফাত কেবল এতটুকুই যে, পূর্বে শাসন কর্তৃত্ব ছিল বাইরের লােকদের হাতে আর বর্তমানে তা চলে এসেছে ঘরের লােকদের হাতে। কিন্তু যে ধরনের মনমানসিকতা সম্পন্ন লােকেরা যেসব নীতি ও নিয়মের সাহায্যে পূর্বে শাসন কর্তৃত্ব চালিয়ে আসছিল সেই ধরনের
মানসিকতার অধিকারী লােকেরাই সেই একই ধরনের নীতিতেই এখনাে শাসন
কর্তৃত্ব চালাচ্ছে। এ দৃষ্টিতে দেখলে তাদের আর এদের মধ্যে কোনাে পার্থক্যই নেই। সাম্রাজ্যবাদীরা যে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করেছিল তা এখনাে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত রয়েছে। তাদের প্রবর্তিত আইন এখনাে প্রচলিত রয়েছে। পরবর্তী আইন প্রণয়নের কাজও চলছে তাদের নির্ধারিত পথেই। বরং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা কখনাে মুসলমানদের ব্যক্তি সংক্রান্ত আইনে (Personal Law) হস্তক্ষেপ করার সাহস করেনি, কিন্তু স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রগুলােতে আজ তা করা হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদীরা সভ্যতা সংস্কৃতি ও নৈতিকতা সম্পর্কিত যেসব মতবাদ ও আদর্শ দিয়ে গেছে তার মধ্যে তাদের চাইতেও বেশি করে ডুবিয়ে দেবার এবং ঐ মতাদর্শগুলাে অনুযায়ী জাতীয় জীবনকে বিকৃত করার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদী মতবাদ ছাড়া সমাজ জীবনের অন্য কোনাে নকশা তারা কল্পনাই করতে পারে না। ঐ নকশা অনুযায়ী তারা মুসলিম রাষ্ট্রগুলাের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করছে। এ কারণেই বিভিন্ন দেশের মুসলমানদেরকে তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে দিয়েছে। তাদের মন মস্তিষ্কে নাস্তিক্যবাদও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

যেখানেই তারা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হচ্ছে, সেখানেই মুসলিম যুব কিশোের সমাজকে এতদূর নষ্ট করে ফেলেছে যার ফলে তারা আল্লাহ, রসূল ও আখিরাতের প্রতি বিদ্রুপ বাণ নিক্ষেপ করতে শুরু করেছে। ধর্মহীনতার মধ্যে তারা নিজেরা ডুবে গেছে এবং তাদের নেতৃত্ব সর্বত্র মুসলমানদের মধ্যে দীন, নৈতিকতা বিরােধী কার্যকলাপ, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা ছড়িয়ে চলছে। সত্য বলতে কি, এরা মুখে নিজেদেরকে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের যতােই বিরােধী বলুক না কেন, বাস্তবে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের প্রত্যেকটা কাজের প্রশংসায় এরা পঞ্চমুখ। তাদের প্রত্যেকটা কথাকে এরা সত্যের মানদন্ড মনে করে। এরা তাদের প্রত্যেকটা কাজের অনুকরণ করে। তাদের ও এদের মধ্যে শুধু পার্থক্য এতটুকু যে, তারা হচ্ছে মুজতাহিদ (উদ্ভাবক) আর এরা হচ্ছে নিছক মুকাল্লিদ (অন্ধ অনুসারী)। তাদের বাঁধানাে পথ থেকে এক ইঞ্চি সরে গিয়ে নতুন কোনাে পথ তৈরি করার ক্ষমতা এদের নেই। 

এই চারটি সুস্পষ্ট সত্যের ভিত্তিতে বর্তমান বিশ্বের স্বাধীন মুসলিম জাতিগুলাের অবস্থা পর্যালােচনা করলে বর্তমানের সমগ্র পরিস্থিতি আপনাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠবে। বিশ্বের সবগুলাে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র বর্তমানে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে। কারণ সর্বত্র তারা নিজেদের জাতির বিবেকের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তাদের জাতি ইসলামের দিকে ফিরে আসতে চায়, কিন্তু তারা জোরপূর্বক তাদের পাশ্চাত্যবাদীতার পথে টেনে নিয়ে যাচেছ। ফলে কোথাও মুসলিম জাতির হৃদয় তাদের সরকারের সাথে নেই। সরকার তখনই মজবুত হয় যখন সরকার পরিচালনাকারীদের হাত এবং জাতির হৃদয় পরিপূর্ণ ঐক্যের ভিত্তিতে একযােগে জাতীয় বিনির্মাণের কাজে আত্ননিয়ােগ করে। পক্ষান্তরে যেখানে হৃদয় ও হাত পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থাকে, সেখানে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সংঘাতে সর্বশক্তি বিনষ্ট হয়ে যায়। সেখানে জাতি গঠন ও জাতীয় উন্নতির পথে এক কদমও অগ্রগতি হয় না ।

৫. শাসক ও জনগণের সংঘাতের পরিণাম
এই ধরণের অবস্থার স্বাভাবিক পরিণতিতে মুসলিম দেশ সমূহে একের পর এক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। পাশ্চাত্যবাদী ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু শ্ৰেণীটি, যারা সাম্রাজীবাদীদের প্রতিনিধিত্ব লাভ করেছে, তারা ভালভাবেই জানে, সরকার যদি জনগণের ভােটে নির্বাচিত হয়, তবে দেশের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা তাদের হাতে থাকবেনা। বরং দ্রুত হােক বা ধীরে তা অনিবার্যভাবে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে এমন সব লোেকদের হাতে, যারা জনগণের আবেগ-অনুভূতি, আশা-আকাংখা ও ঈমান-আকীদা অনুযায়ী দেশ চালাতে সক্ষম। এ কারণে তারা কোনাে একটি দেশেও গণতন্ত্রকে সাফল্যের সাথে টিকে থাকতে দিচ্ছে না। বরং সর্বত্র স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে। তবে ধোঁকা দেবার জন্য তারা স্বৈরতন্ত্রের পিঠে গণতন্ত্রের লেবেল এঁটে নিয়েছে।

প্রথম প্রথম কিছুদিন দেশের নেতৃত্ব এই গােষ্ঠীর রাজনৈতিক নেতাদের হাতে থাকে এবং বেসামরিক কর্মচারীরা মুসলিম দেশগুলাের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করতে থাকে। কিন্তু এই অবস্থার স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে মুসলিম দেশগুলাের সেনাবাহিনীতে শীঘ্রই এ অনুভূতি জন্মলাভ করে যে, স্বৈরতন্ত্র তাে আসলে তাদের শক্তির উপরই নির্ভর করে চলছে। এ অনুভূতি সামরিক অফিসাদের দ্রুত রাজনৈতিক ময়দানে টেনে আনে। তখন তারা গােপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকারের আসন উলটিয়ে দিয়ে নিজেদের সামরিক স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে শুরু করে।
এই অবস্থায় মুসলিম দেশগুলাের জন্য তাদের সেনাবাহিনী একটি আপদে পরিণত হয়েছে। বাইরের দুশমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ রক্ষার দায়িত্ব পালন করা এখন আর তাদের আসল কাজ নয়। বরং এখন তাদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজেদের দেশের লোেকদের জয় করা এবং জনগণ নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য তাদের হাতে যে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল তার সাহায্যে জনগণকেই তাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা।

মুসলিম দেশগুলাের ভাগ্যের ফয়সালা এখন আর পার্লামেন্টে নয়, সেনাবাহিনীর ব্যারাকে নির্ধারিত হয়। আবার এই সৈন্যরাও কোনাে একটি নেতৃত্বের উপর একমত নয়। বরং একেকজন সামরিক অফিসার নতুন কোনাে চক্রান্তের মাধ্যমে অন্যকে হত্যা করে নিজে তার জায়গায় ক্ষমতা দখলের জন্য সুযােগের অপেক্ষায় থাকে। তাদের প্রত্যেকেই আসার সময় সংস্কার ও বিপ্লবের পতাকাবাহী হয়ে আসে এবং বিদায় নেয় আত্নসাকারী আর বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত বেশির ভাগ মুসলিম জাতি এখন নিছক দর্শকের ভূমিকায় অবস্থান করছে। তাদের দেশ ও সরকার চালাবার ব্যাপারে এখন আর তাদের মতামত ও সন্তোষ-অসন্তোষের কোনাে তােয়াক্কা করা হয় না।

তাদের অজান্তেই অন্ধকারে বিপ্লবের মালমসল্লা তৈরি হয়ে যায় এবং কোনাে একদিন হঠাৎ তাদের মাথার উপর সেগুলাে ঢেলে দেয়া হয়। তবে একটি ব্যাপারে এইসব পরস্পর সংঘর্ষরত বিপ্লবী নেতারা একমত। সেটি হচ্ছে, তাদের মধ্য থেকে যে-ই সামনে আসে, সে-ই পূর্ববর্তীর ন্যায় পাশ্চাত্যের মানসিক দাস আর ধর্মহীনতা, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার পতাকাবাহী হয়ে আসে।

৬. আশার আলাে
এই অন্ধকাররাশির মধ্যেও আশার একটা আলাে বিদ্যমান রয়েছে। আমার দৃষ্টিতে তাতে রয়েছে দুটি সুস্পষ্ট বাস্তবতা।

এক : আল্লাহ তা'আলা এই ধর্মহীন সীমালংঘনকারীদের পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত করে দিয়েছেন এবং তারা একজন অন্যজনের শিকড় কাটছে। খােদা না খাস্তা তারা ঐক্যবদ্ধ থাকলে ভয়াবহ বিপদ দেখা দিতাে। কিন্তু তাদের পথপ্রদর্শক হচ্ছে শয়তান। আর শয়তানের চাল হয়ে থাকে সব সময়ই দুর্বল।

দুই : দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতাটি আমি দেখতে পাচ্ছি তা হলাে, মুসলিম মিল্লাতের হৃদয় এদের প্রভাব থেকে সর্বত্র সম্পূর্ণ সংরক্ষিত ও নিরাপদ রয়ে গেছে। তারা ঐসব তথাকথিত বিপ্লবী নেতাদের প্রতি সন্তুষ্ট নয়। সৎ ও যােগ্য ব্যক্তিদের কোনাে একটি দল যদি চিন্তার দিক থেকে মুসলিম এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে নেতৃত্ব দানের যােগ্যতা সম্পন্ন হয়, তবে তারাই বিজয়ী হবে এবং মুসলিম জাতিসমূহ এই ধর্মদ্রোহী ও ফাসিক নেতৃত্বের হাত থেকে মুক্তি লাভ
করবে। এর পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। #

ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা
পরিবেশ পরিস্থিতি প্রেক্ষিতে এ সময় কাজের আসল সুযােগ রয়েছে এমন লােকদের জন্যে, যারা একদিকে পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষা লাভ করেছেন এবং অন্যদিকে নিজেদের অন্তরে আল্লাহ, রসূল, কুরআন ও আখিরাতের প্রতি ঈমানকে সংরক্ষিত রেখেছেন। প্রাচীন পদ্ধতির দীনি শিক্ষা লাভকারী লােকেরা নৈতিক ও আধ্যাত্নিক দিক থেকে এবং ইলমে দীনের ব্যাপারে তাদের সর্বোত্তম সাহায্যকারী হতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে নেতৃত্ব দান এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে যে ধরনের যােগ্যতার প্রয়ােজন তা তাদের নেই। এ যােগ্যতাগুলাে বর্তমানে কেবল প্রথমােক্ত লােকদের মধ্যেই অধিক হারে রয়েছে। এ
লােকদেরই টেকসই ইসলামী সমাজ গড়ার কাজে এগিয়ে আসার বেশি প্রয়ােজন। তাদের প্রতি আমার পরামর্শ হলাে :

এক: ইসলামের যথার্থ জ্ঞান লাভ করুন
আধুনিক শিক্ষিত যুবকদের কাছে আমার প্রথম পরামর্শ হলাে, তাদেরকে ইসলামের নির্ভুল ও যথার্থ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এভাবে তাদের অন্তর যেমন মুসলিম আছে, তেমনি মস্তিষ্কও মুসলমান হয়ে যাবে। এতে করে সামাজিক ও জাতীয় বিষয়াদি ইসলামের মূলনীতি ও বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করার যােগ্যতা তারা অর্জন করবে।

দুই : নিজেদের নৈতিক মানােন্নয়ন করুন
মুসলিম যুবকদের নিজেদের নৈতিক ও চারিত্রিক মানােন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। এভাবে তাদের নৈতিক জীবনধারা কার্যত সেই ইসলামের অনুগামী হবে যাকে তারা বিশ্বাসের দিক থেকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। মনে রাখবেন, কথা ও কাজের বৈপরীত্য মানুষের মধ্যে মােনাফেকী প্রবণতা সৃষ্টি করে এবং বাইরের জগতে তার প্রতি আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়। আপনার সাফল্য পুরােপুরি নির্ভর করছে নিষ্ঠা, সততা ও সত্যপন্থী হবার উপর। যে ব্যক্তি বলে একটা, করে অন্যটা, সে কখনাে নিষ্ঠাবান হতে পারে না। তাকে আন্তরিক বলে মেনে নেয়াও যেতে পারে না। আপনার নিজের জীবনে বৈপরীত্য থাকলে অন্যরা আপনাকে বিশ্বাস করবে না। আপনার অন্তরেই নিজের উপর সুদৃঢ় আস্থা সৃষ্টি হতে পারবে না। তাই ইসলামী দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়ােগকারী প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি আমার আন্তরিক উপদেশ, যেসব বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবেন, ইসলাম এগুলাে করার হুকুম দিয়েছে সেগুলাে করে যান, আর যেগুলাে সম্পর্কে জানতে পারবেন, ইসলাম এগুলাে নিষেধ করেছে সেগুলাে থেকে দূরে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান।

তিন: পাশ্চাত্য কালচার ও দর্শনের মুখােশ উন্মোচন করুন আপনাদের মস্তিষ্কের পুরাে যােগ্যতা এবং সমগ্র লেখনী ও বাকশক্তিকে পাশ্চাত্য কালচার ও জীবন দর্শনের সমালােচনায় নিয়ােজিত করা উচিত। জাহিলিয়াতের এই মূর্তিটিকে, যাকে আজ বিশ্বব্যাপী পূজা করা হচ্ছে, ভেঙ্গে চুর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া উচিত। পক্ষান্তরে শানিত যুক্তি প্রমাণ দিয়ে ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস,
মূলনীতি, জীবনপদ্ধতি ও জীবন যাপনের জন্য প্রয়ােজনীয় আইন-কানুনের ব্যাখ্যা প্রদান এবং সেগুলি পূনর্বিন্যাস করতে হবে। যাতে করে নতুন বংশধরদের মনে সেগুলির নির্ভুলতার ব্যাপারে পূর্ণ বিশ্বাস জন্মে। তাদের মনে যেনাে এই আস্থার সৃষ্টি হয় যে, আধুনিক যুগে একটি জাতি ঐ আকীদা-বিশ্বাস, মূলনীতি ও আইন-কানুন গ্রহণ করে কেবল উন্নতিই করতে সক্ষম নয়, বরং অন্যদের চাইতে অগ্রসর হতেও পুরােপুরি সক্ষম। এ কাজটি যতাে নির্ভুল পদ্ধতিতে এবং যততা ব্যাপক পর্যায়ে হতে থাকবে ততােই ইসলামী দাওয়াতের জন্য আপনারা চৌকস সৈনিক দল লাভ করতে থাকবেন। জীবনের সব বিভাগ থেকে সৈনিকরা বের হয়ে আসতে থাকবে। 

দীর্ঘকাল পর্যন্ত এ কাজটির সিলসিলা জারি থাকা উচিত। তাহলে একটি দেশের সমগ্র ব্যবস্থাপনা ইসলামী নীতির ভিত্তিতে পরিচালনা করার মতাে বিপুল সংখ্যক লােক গড়ে তােলা সম্ভবপর হবে। এ কাজটি ক্রমান্বয়ে একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে না পৌঁছা পর্যন্ত আপনি কোনাে ইসলামী বিপ্লব সাধনের আশা করতে পারেন না। আর যদি কোনাে কৃত্রিম পদ্ধতিতে এই বিপ্লব সাধিত হয়েও যায়
তবে তা স্থিতিশীল হবেনা।

চার : মজবুত সংগঠন গড়ে তুলুন
ইসলামী দাওয়াতের মাধ্যমে যেসব লোেক প্রভাবিত হতে থাকবে তাদের সুসংগঠিত করতে হবে। তাদের কোনাে ঢিলেঢালা সংগঠন হলে চলবে না। কারণ, মজবুত সাংগঠনিক নিয়ম-শৃঙ্খলা আনুগত্য ব্যবস্থা ছাড়া নিছক একদল সমমনা লােকের বিক্ষিপ্ত সমাবেশ সংগ্রহ দ্বারা তেমন কোনাে শক্তি সৃষ্টি হতে পারে না।

পাঁচ : সাধারণ দাওয়াত সম্প্রসারণ করুন
এই নতুন সমাজ গড়ার উদ্দেশ্যে যারা কাজ করবেন, তাদেরকে জনগণের মধ্যে ব্যাপক দাওয়াত সম্প্রসারণ করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা দূর হয়ে যায়, তারা ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে এবং ইসলাম ও জাহিলিয়াতের পার্থক্য অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। সাথে সাথে জনগণের নৈতিক মাননান্নয়নেরও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অসৎ নেতৃত্বের প্রভাবে মুসলমানদের
মধ্যে যে অধ:পতন, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার সয়লাব বয়ে চলছে তার  প্রতিরােধের জন্যে পূর্ণ শক্তি নিয়ােগ করা উচিত। সত্য কথা হলাে, একটি জাতি সীমালংঘনকারী হয়ে যাওয়ার পর কোনাে ইসলামী রাষ্টের প্রজা হিসাবে জীবন যাপন করার যােগ্যতা হারিয়ে ফেলে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ সীমালংঘনের প্রবণতা যতােই বাড়বে তাদের সমাজে ইসলামী জীবন বিধানের প্রচলন ততােই কঠিন হয়ে পড়বে। মিথ্যাবাদী, আত্নসাতকারী, ঠক ও অসৎ চরিত্রের লােকেরা কুফরি ব্যবস্থার জন্যে যতাে বেশি উপযােগী, ইসলামী জীবন ব্যবস্থার জন্য ঠিক ততাে বেশি অনুপযােগী। 

ছয়: ধৈর্য ও বিজ্ঞতার সাথে কাজ করুন
ইসলামকে সমাজ জীবনে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে ময়দানে অবতীর্ণ হওয়া যুবকদের অধৈর্য হয়ে কাঁচা ভিত্তির উপর কোনাে ইসলামী বিপ্লব করার চেষ্টা করা উচিত নয়। আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্যে অসীম ধৈর্যের প্রয়ােজন। প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে যাচাই পরখ করে প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথম পদক্ষেপের পর দ্বিতীয় পদক্ষেপটি গ্রহণ করার পূর্বে পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে হবে যে, প্রথম পদক্ষেপটি থেকে যে ফল লাভ করা হয়েছিল তা পুরােপুরি স্থিতিশীল হয়ে গেছে। তাড়াহুড়া করে সামনে অগ্রসর হলে তা লাভের পরিবর্তে ক্ষতি ও বিপদ ডেকে আনবে বেশি। একটি উদাহরণ দিচ্ছি, মনে করা হয় অসৎ নেতৃত্বের সাথে শরিক হয়ে সহজেই মনযিলে মকসুদে পৌঁছা যাবে,
নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে কিছু না কিছু উপকৃত হওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিন্ন। বাস্তবে এ ধরনের লােভের ভালাে পরিণতি হতে পারে না। কারণ প্রশাসন ক্ষমতা যাদের হাতে থাকে আসলে তারা নিজেদের নীতি অনুযায়ী সবকিছু চালায়। তাদের সাথে যারা শরিক হয় প্রতি পদক্ষেপে ওদের সাথে তাদের আপােস করতে হয়। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ওদের ক্রীড়নকে পরিণত হতে হয়।

সাত: সশস্ত্র ও গােপন আন্দোলন থেকে দূরে থাকুন

ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের প্রতি আমার সর্বশেষ এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ হলাে, গােপন আন্দোলন পরিচালনা এবং সশস্ত্র বিপ্লব করার চেষ্টা থেকে অবশ্যি দূরে থাকুন। এ পথও মূলত অধৈর্য এবং তাড়াহুড়ারই রকমফের মাত্র। ফলাফলের দিক থেকে এ পথ অন্য অবস্থাগুলাের তুলনায় অনেক বেশি মন্দ।

একটি সঠিক বিপ্লব সব সময়ই গণআন্দোলনের মাধ্যমে সাধিত হয়। প্রকাশ্যে সাধারণভাবে দাওয়াতের কাজ করুন। ব্যাপকভাবে মানুষের মন ও চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনুন। মানুষের চিন্তাধারার দিক পরিবর্তন করুন। চারিত্রিক অস্ত্রের সাহায্যে মানুষের হৃদয় জয় করুন। এসব কাজ করতে গিয়ে যতাে রকম
বিপদ-মুসীবত আসে সাহসের সাথে তার মােকাবিলা করুন।

এই পদ্ধতিতে পর্যায়ক্রমে যে বিপ্লব সংঘটিত হবে তা হবে একটি শক্তিশালী ও টেকসই বিপ্লব। বিরােধী শক্তির ফাপা বিরােধিতার তুফান এ ধরণের বিপ্লবের ফলকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। তাড়াহুড়া করে কৃত্রিম পদ্ধতিতে কোনাে বিপ্লব সংঘটিত করে ফেললেও যে প্রক্রিয়ায় তা সংঘটিত করা হবে, ঠিক সে প্রক্রিয়ায়ই তাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা যাবে।

ইসলামী দাওয়াত ও সমাজ গড়ার কাজে যারা নিয়ােজিত আছেন, তাদের জন্যে এ ক'টি উপদেশ আমি জরুরি মনে করছি। মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেনাে আমাদের পথ দেখান। তিনি যেনাে তাঁর সত্য দীনের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সঠিক পদ্ধতিতে চেষ্টা সংগ্রাম চালাবার তৌফিক আমাদের দান করেন।

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি নিখিল জগতের প্রভু-পরিচালক।
(তর্জমানুল কুরআন : জুন ১৯৬৩)
সমাপ্ত

Post a Comment

0 Comments