কুরআন ও হাদীসের আলোকে
বিবাহের গুরুত্ব, ফজিলত, না
করার পরিনতি এবং
করণীয়-বর্জনীয় ;
পর্ব--৫;
যাদেরকে বিয়ে করা হারামঃ
একজন মুসলমান কাকে বিয়ে করতে পারবেনা সে বিষয়ে আল কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে।
وَ لَا تَنْكِحُوْا مَا نَكَحَ اٰبَآؤُكُمْ مِّنَ النِّسَآءِ اِلَّا مَا قَدْ سَلَفَؕ اِنَّهٗ كَانَ فَاحِشَةً وَّ مَقْتًاؕ وَ سَآءَ سَبِیْلًا۠
আর তোমাদের পিতা যেসব স্ত্রীলোককে বিয়ে করেছে, তাদেরকে কোনোক্রমেই বিয়ে করো না। তবে আগে যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। আসলে এটা একটা নির্লজ্জতাপ্রসূত কাজ, অপছন্দনীয় ও নিকৃষ্ট আচরণ।
সূরা নিসাঃ ২২
যাদেরকে বিয়ে করা যাবে না, সে তালিকায় কুরআনে ১৪ জনের নাম এসেছে।
আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন,
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ وَبَنَاتُكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ وَعَمَّاتُكُمْ وَخَالاَتُكُمْ وَبَنَاتُ الأَخِ وَبَنَاتُ الأُخْتِ وَأُمَّهَاتُكُمُ اللاَّتِي أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُم مِّنَ الرَّضَاعَةِ وَأُمَّهَاتُ نِسَآئِكُمْ وَرَبَائِبُكُمُ اللاَّتِي فِي حُجُورِكُم مِّن نِّسَآئِكُمُ اللاَّتِي دَخَلْتُم بِهِنَّ فَإِن لَّمْ تَكُونُواْ دَخَلْتُم بِهِنَّ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْكُمْ وَحَلاَئِلُ أَبْنَائِكُمُ الَّذِينَ مِنْ أَصْلاَبِكُمْ وَأَن تَجْمَعُواْ بَيْنَ الأُخْتَيْنِ إَلاَّ مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّ اللّهَ كَانَ غَفُورًا رَّحِيمًا
‘তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা, তোমাদের কন্যা, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, ভ্রাতৃকণ্যা; ভগিনীকণ্যা তোমাদের সে মাতা, যারা তোমাদেরকে স্তন্যপান করিয়েছে, তোমাদের দুধ-বোন, তোমাদের স্ত্রীদের মাতা, তোমরা যাদের সঙ্গে সহবাস করেছ সে স্ত্রীদের কন্যা যারা তোমাদের লালন-পালনে আছে। যদি তাদের সঙ্গে সহবাস না করে থাক, তবে এ বিবাহে তোমাদের কোন গোনাহ নেই। তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রী এবং দুই বোনকে একত্রে বিবাহ করা; কিন্তু যা অতীত হয়ে গেছে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাকরী, দয়ালু।’
সূরা আন নিসাঃ ২৩
সুতরাং বংশতগত, বৈবাহিক কিংবা দুধপান করানোর ভিত্তিতে যাদের সঙ্গে বিয়ে নিষিদ্ধ তাদের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
‘তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে-
১. তোমাদের মা।
২. তোমাদের কন্যা।
৩. তোমাদের বোন।
৪. তোমাদের ফুফু।
৫. তোমাদের খালা।
৬. ভাইয়ের মেয়ে।
৭. বোনের মেয়ে।
৮. তোমাদের ওই মা, যারা তোমাদেরকে নিজেদের বুকে দুধ পান করিয়েছে।
৯. তোমাদের দুধ-বোন (বুকের দুধ পানকারীনী মায়ের মেয়ে)।
১০. তোমাদের স্ত্রীদের মা (শাশুরি)।
১১. তোমরা যাদের সঙ্গে সহবাস করেছ; সে সব স্ত্রীদের মেয়ে, যারা তোমাদের লালন-পালনে আছে।
(লালন পালনে থাকা মেয়ের মায়ের সঙ্গে যদি সহবাসের সম্পর্ক না থাকে, তবে এ বিয়েতে তোমাদের কোনো গোনাহ নেই।
১২. তোমাদের নিজ ছেলেদের স্ত্রী (পুত্রবধু)।
১৩. দুই বোনকে একত্রে বিবাহ করা।
কিন্তু অতীত যা হয়ে গেছে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাকারী, দয়ালু এবং
১৪. অন্যের বৈধ স্ত্রীকে বিবাহ করা হারাম।’
বংশগত সম্পর্কের দিক থেকে যাদের বিয়ে করা হারাম। তারা হলো-
আপন মা বিয়ে করা হারাম। মা থেকে উপরের দিকে নানি, নানির মা আবার মায়ের বোনসহ মা এর মেয়ে সন্তান, সন্তানের সন্তানকেও বিধানের আলোকে বিয়ে করা হারাম।
নিজের মেয়েকে বিয়ে করা হরাম। মেয়ে থেকে নিচের দিকে নাতনি (নিজ মেয়ের মেয়ে), নাতনির মেয়ে এভাবে নিচের দিকের মেয়েদের বিয়ে করা হারাম। এ ক্ষেত্রে ছেলের ঘরের নাতনিসহ নিচের দিকের মেয়েদেরও বিয়ে করা হারাম।
আপন বোনকে বিয়ে করা। আবার বাবার অন্য স্ত্রীর মেয়েদেরও বিয়ে করা যেমন হারাম তেমনি মায়ের অন্য স্বামীর মেয়েকেও বিয়ে করা হারাম।
বাবার আপন বোন ফুফুকে বিয়ে করা হারাম। আবার বাবার বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় বোনকেও বিয়ে করা হারাম।
মা এর আপন বোনকে (খালা) বিয়ে করা হারাম। আবার মা এর বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় বোনকেও বিয়ে করা হারাম।
ভাই এর মেয়ে ভাতিজির সঙ্গেও বিয়ে হারাম। ভাই আপন হোক কিংবা বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় হোক।
বোন এর মেয়ে ভাগিনিকে বিয়ে করা হরাম। চাই সে বোন আপন হোক কিংবা বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় হোক।
বৈবাহিক সম্পর্কে যারা হারাম:
স্ত্রীদের মাকে (শাশুড়ি) বিয়ে করা হারাম। স্ত্রীদের নানি, দাদিও এ বিধানের আলোকে হারাম।
নিজ স্ত্রীর সঙ্গে বিয়ের পর সহবাস করার পর স্ত্রীর অন্য স্বামীর ঔরসজাত মেয়েকে বিবাহ করাও হারাম।
ছেলের বউকে বিয়ে করা হারাম। ছেলে শব্দের ব্যাপকতার কারণে পৌত্র ও দৌহিত্রের স্ত্রীকেও বিয়ে করা যাবে না।
বংশ ও দুধ মায়ের দিকে থেকে দুই বোনকে এক সঙ্গে বিয়ে করা হারাম। স্ত্রীর ওই বোন হোক বৈমাত্রেয় কিংবা বৈপিত্রেয়। তবে যদি কোনো বোন মারা যায় কিংবা তালাকের মাধ্যমে সম্পর্ক ছিন্ন হয় তবে নির্ধারিত সময়ের পর অন্য বোনকে বিয়ে করা যাবে।
বুকের দুধ পান করানোর কারণে যাদের দিয়ে করা হারাম:
কুরআনের বিধান মতে দুধ মা ও দুধ বোনকে বিয়ে করা হারাম। যদি কোনো ছেলে কিংবা মেয়ে কোনো নারীর বুকের দুধ নির্দিষ্ট সময়কাল (২ বছর) পান করে তবে ওই সন্তানের জন্য দুধ পান করানো নারী তার মা, নারীর স্বামী তা বাবা, নারীর নিজ ছেলে মেয়ে তার ভাই-বোন, নারীর বোন তার খালা, স্বামীর বোন তার ফুফু হয়ে যায়। আর তাদের সঙ্গে সে সন্তানের বিয়েও হারাম হয়ে যায়।
তবে
খালাতো, মামাতো, ফুফাতো বা চাচাতো বোনদের বিয়ে করা হারাম নয়।
পালকপুত্রের স্ত্রী তালাক প্রাপ্ত হলে তাকে বিবাহ করা হারাম নয়।
পুত্র বলে স্বীকার করলে পুত্র হয় না : আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
ادْعُوهُمْ لِآبَائِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِندَ اللَّهِ فَإِن لَّمْ تَعْلَمُوا آبَاءهُمْ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَمَوَالِيكُمْ
‘তোমরা তাদেরকে তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাকো। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সংগত। যদি তোমরা তাদের পিতৃপরিচয় না জানো, তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই ও বন্ধুরূপে গণ্য হবে। ’
সূরা সিজদাঃ ৫
عَنْ سَعْدٍ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ مَنْ ادَّعَى إِلَى غَيْرِ أَبِيهِ وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهُ غَيْرُ أَبِيهِ فَالْجَنَّةُ عَلَيْهِ حَرَامٌ
সা’দ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- কে বলতে শুনেছি, যে অন্যকে নিজের পিতা বলে দাবি করে অথচ সে জানে যে সে তার পিতা নয়, জান্নাত তার জন্য হারাম। বুখারী ৪৩২৬, ৬৭৬৬, মুসলিম ১/২৭ ৬৩, আহমাদ ১৫৫৩
حَدَّثَنَا أَبُو مَعْمَرٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الوَارِثِ، عَنِ الحُسَيْنِ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ بُرَيْدَةَ، قَالَ: حَدَّثَنِي يَحْيَى بْنُ يَعْمَرَ، أَنَّ أَبَا الأَسْوَدِ الدِّيلِيَّ، حَدَّثَهُ عَنْ أَبِي ذَرٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّهُ سَمِعَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: «لَيْسَ مِنْ رَجُلٍ ادَّعَى لِغَيْرِ أَبِيهِ - وَهُوَ يَعْلَمُهُ - إِلَّا كَفَرَ، وَمَنِ ادَّعَى قَوْمًا لَيْسَ لَهُ فِيهِمْ، فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ»
আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে বলতে শুনেছেন, কোন লোক যদি নিজ পিতা সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও অন্য কাকে তার পিতা বলে দাবী করে তবে সে আল্লাহ্র কুফরী করল এবং যে ব্যক্তি নিজেকে এমন বংশের সঙ্গে বংশ সম্পর্কিত দাবী করল যে বংশের সঙ্গে তার কোন বংশ সম্পর্ক নেই, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়।
বুখারী ৩৫০৮
জাহেলি যুগের প্রথা ছিল যে যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কারো পুত্রকে পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করত, তাহলে এ পোষ্যপুত্র তার প্রকৃত পুত্র বলে গণ্য হতো। এ পোষ্যপুত্র সব ক্ষেত্রে প্রকৃত পুত্রের মর্যাদাভুক্ত হতো। তারা প্রকৃত সন্তানের মতো সম্পদের অংশীদার হতো এবং বংশ ও রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে যেসব নারীর সঙ্গে বিয়ে-শাদি হারাম, এ পোষ্যপুত্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এরূপ মনে করা হতো। বিয়েবিচ্ছেদ সংঘটিত হওয়ার পর ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করা যেরূপ হারাম, অনুরূপভাবে পালক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীও হারাম বলে মনে করা হতো। ইসলাম চিরতরে এ প্রথাকে বিলুপ্ত করেছে।
ইনশাআল্লাহ, চলবে....।
--------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট।
0 Comments