(জারজ) ওলীদ ইবনে মুগীরা সম্পর্কে কুরআনের বর্ণনা।
---------------------------------
ওলীদ ইবনে মুগীরা ছিল মক্কার সেরা ধনী। আল্লাহ তাকে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্য দান করেছিলেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তার ফসলের ক্ষেত ও বাগ-বাগিচা মক্কা হ’তে ত্বায়েফ পর্যন্ত (৬০ মাইল) বিস্তৃত ছিল। ছওরী বলেন, তার বার্ষিক আয় ছিল এক কোটি দীনার। শীত-গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমে তার ক্ষেতের ফসল ও বাগানের আমদানী অব্যাহত থাকত। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেছেন,
وَجَعَلْتُ لَهُ مَالاً مَّمْدُوداً
‘তাকে আমি দিয়েছিলাম প্রচুর মাল-সম্পদ’ (মুদ্দাছছির৭৪/১২)।
তাকে আরবদের সরদার গণ্য করা হ’ত। সে ‘রায়হানাতু কুরায়েশ’ (কুরায়েশ-এর শান্তি) নামে খ্যাত ছিল। অহংকারে স্ফীত হয়ে সে নিজেকে ‘ওহীদ ইবনুল ওহীদ’ ‘অদ্বিতীয়ের বেটা অদ্বিতীয়’ বলত। অর্থাৎ সে ভাবত যে, গোটা কুরায়েশ বংশের মধ্যে সে ও তার বাপ ছিল অতুলনীয় ও অদ্বিতীয়। একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরা গাফের/মুমিন পাঠ করছিলেন-
حم، تَنزِيلُ الْكِتَابِ مِنَ اللهِ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ، غَافِرِ الذَّنبِ وَقَابِلِ التَّوْبِ شَدِيدِ الْعِقَابِ ذِي الطَّوْلِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ إِلَيْهِ الْمَصِيرُ
- ‘হা-মীম’। কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহর পক্ষ হ’তে, যিনি পরাক্রমশালী। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তাঁর কাছেই সবার প্রত্যাবর্তন স্থল’ (গাফের৪০/১-৩)।
শুরুতে উক্ত তিনটি আয়াত শুনে সে বলে উঠল... ‘আল্লাহর কসম আমি তার মুখে এমন কালাম শুনেছি, যা কোন মানুষের কালাম হ’তে পারে না এবং তা কোন জিনেরও কালাম হ’তে পারে না। এতে রয়েছে এক অপূর্ব মাধুর্য এবং এর শব্দ বিন্যাসে রয়েছে এক বিশেষ বর্ণাঢ্যতা। এর বাহ্যিক আবরণ হৃদয়গ্রাহী এবং অভ্যন্তরভাগে প্রবাহিত রয়েছে এক স্নিগ্ধ ফল্পুধারা। এটা নিশ্চিতই সবার ঊর্ধ্বে থাকবে এবং এর উপরে কেউ প্রবল হ’তে পারবে না। এটা কখনোই মানুষের কালাম নয়’।
কিন্তু দুঃখজনক কথা এই যে, সবকিছু স্বীকার করার পরও কেবল অহংকার ও বিদ্বেষবশতঃ সে রাসূলের নবুয়াতকে স্বীকৃতি না দিয়ে বিরুদ্ধাচরণের পথ বেছে নিল। ওইদিন ওলীদের গৃহে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাসূল (সাঃ) কে ‘জাদুকর’ বলে প্রচার করার সিদ্ধান্তের ঘটনা এবং ওলীদের বাকভঙ্গী আল্লাহ নিজস্ব রীতিতে বর্ণনা করেন নিম্নোক্ত ভাবে-
إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ- فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ نَظَرَ- ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ- ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَ- فَقَالَ إِنْ هَذَا إِلاَّ سِحْرٌ يُّؤْثَرُ- إِنْ هَذَا إِلاَّ قَوْلُ الْبَشَرِ-
‘সে চিন্তা করল ও মনস্থির করল’। ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থ করল’? ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থ করল’? ‘অতঃপর সে তাকাল’। ‘অতঃপর ভ্রুকুঞ্চিত করল ও মুখ বিকৃত করল’। ‘অতঃপর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল ও অহংকার করল’। ‘তারপর বলল, অর্জিত জাদু বৈ কিছু নয়’। ‘এটা মানুষের উক্তি বৈ কিছু নয়’ (মুদ্দাছছির৭৪/১৮-২৫)।
অত্র সূরায় ১১ হ’তে ২৬ পর্যন্ত ১৬টি আয়াত কেবল ওলীদ সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, ওলীদ রাসূল (সাঃ) কে ‘মিথ্যাবাদী’ বলতে সাহস করেনি। তাই অবশেষে কালামে পাকের জাদুকরী প্রভাবের কথা চিন্তা করে রাসূলকে ‘জাদুকর’ বলে অপবাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এতে আল্লাহ তাকে পরপর দু’বার অভিসম্পাৎ দিয়ে বলেন,
فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ-
‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থ করল’। ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থ করল’।
সূরা মুদ্দাছছির-১৯,২০
ওলীদ ইবনে মুগীরা একবার রাসুূল (সাঃ) এর সাথে বেয়াদবি করেছিল এবং রাসূল (সাঃ) কে পাগল বলেছিল। --- (নাউযুবিল্লাহ) তার এই বেয়াদবির কারনে নবীজি খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। এতে দয়াময় আল্লাহর গজবের সাগর উথলিয়ে উঠলো এবং আল্লাহ 'সূরা আল-ক্বলম' নাযিল করলেন। সূরার প্রথমে তাঁর রাসূল (সাঃ) এর ফযীলত ও গুণাবলী বর্ণনা করে রাসূল (সাঃ) কে শান্তনা দিলেনঃ ''হে আঁমার রাসূল (সাঃ)! আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহে আপনি পাগল নন। আপনার জন্য রয়েছে সীমাহীন মর্যাদা এবং নিশ্চয় আঁপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।''
অর্থাৎ হে রাসূল (সাঃ)! সে যা বলতে চায় বলুক। আমিতো আপনার প্রশংসা করছি। আপনি তার কথায় কান দিবেন না। আপনি (রাসূল) আঁমার (আল্লাহর) কথাই শুনুনঃ-
وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلَّافٍ مَّهِينٍ
(১) যে অধিক শপথ করে, (২) যে লাঞ্ছিত, আপনি তার আনুগত্য করবেন না।
هَمَّازٍ مَّشَّاء بِنَمِيمٍ
(৩) যে পশ্চাতে নিন্দা করে (৪) একের কথা অপরের নিকট লাগিয়ে ফিরে।
مَنَّاعٍ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيمٍ
(৫) যে ভাল কাজে বাধা দেয়, (৬) সে সীমালংঘন করে, (৭) সে পাপিষ্ঠ,
عُتُلٍّ بَعْدَ ذَلِكَ زَنِيمٍ
(৮) কঠোর স্বভাব, (৯) তদুপরি জারজ
সূরা আল ক্বলম-১০-১৩
১। সে মিথ্যা শপথ কারী,
২। মর্যাদাহীন(গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল),
৩। নিন্দুক (গীবতকারী),
৪। চোগলখোর,
৫। সৎকাজে বাধা দানকারী,
৬। জালেম (সীমালংঘনকারী),
৭। চরম পাপিষ্ঠ( ঝগড়াটে),
৮। পাষান হৃদয়,
৯। সর্বোপরি জারজ সন্তান।''
ওলীদ ইবনে মুগীরা এ আয়াত শুনে তার মায়ের কাছে গিয়ে বললো- মুহাম্মদ (ﷺ) আমার নয়টি দোষ বর্ণনা করেছে যার আটটি সম্পর্কে আমি সম্যক অবগত। বস্তুতপক্ষে, ঐ সকল দোষ আমার মধ্যে রয়েছে, তবে জারজ সন্তান কিনা, এ দোষের ব্যাপারে একমাত্র তুমিই বলতে পার। সত্যি সত্যি বল, আমি জারজ সন্তান কিনা? অন্যথায় তোমার গর্দান দু'টুকরা করে ফেলবো, মুহাম্মদে (ﷺ) এর কথা কখনো মিথ্যা হয়না। তদুত্তরে ওর মা বললো, তিনি একদম ঠিক বলেছেন, তুমি ঠিকই জারজ সন্তান।
তোমার বাপ ছিল পুরুষত্বহীন, কিন্তু অনেক সম্পদের অধিকারী। আমি মনে করলাম যে, আমার কোন সন্তান না হলে ধন- সম্পদ অন্যরা নিয়ে যাবে। সেজন্য এক রাখালের সাথে যিনা করেছিলাম, তুমি তারই ঔরসজাত (সন্তান)।
--------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক কলামিস্ট ও অনলাইন এক্টিভিস্ট।
0 Comments