শাইখ ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহঃ) এর মতে দীন কায়েমের উপকরণ হিসাবে গণতন্ত্র:
-------------------------------------------
রাসূলুল্লাহ (সা) কে প্রেরণ করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ
তিনি সেই সত্তা, যিনি নিজ রাসূলকে হিদায়াত এবং দীনুল হক্ব (তথা নির্ভুল জীবন বিধান) সহকারে প্রেরণ করেছেন, যেন ওকে অন্যান্য সকল দীনের উপর (তথা বিধানের উপর) বিজয়ী করে দেন।
(সূরা তওবাঃ৩৩, সূরা ফাতাহঃ২৮, সূরা সফঃ০৯)
অর্থাৎ আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর রাসূল (সা) কে সকল মানব রচিত ও শয়তান প্রদত্ত বিধানের উপরে দীন ইসলামের বিধানকে বিজয়ী করার জন্য প্রেরণ করেছেন। আর ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত ইসলামের বিধানকে অন্যান্য বিধানের উপর বিজয়ী করা সম্ভাব নয়। তাই রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর নবুওয়াতী জীবনে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দীন কায়েম করেন এবং দীন ইসলামকে বিজয়ী করেন। বর্তমানেও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত দীন কায়েম করা এবং দীন ইসলামকে অন্যান্য মানব রচিত বিধানের উপর বিজয়ী করা সম্ভব নয়।
তবে আমরা বর্তমান যুগে কিভাবে দীন কায়েম করব, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দীন কায়েমের উপকরণ হিসাবে গ্রহণ করব কি না- এ বিষয়ে আলোরণ সৃষ্টিকারী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ
"(ক) রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহর দীনের জন্য দাওয়াত দিয়েছেন। এক পর্যায়ে যখন মদীনার অধিকাংশ মানুষ ইসলামের ছায়া তলে চলে আসেন তখন সেখানে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহর ওহীর নির্দেশনা মুতাবেক রাসূলুল্লাহ (সা) ইসলামী শাসন -ব্যবস্থা অনুযায়ী রাষ্ট্র শাসন করেন এবং জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের ও মুসলমানদের সংরক্ষণ করেন।
(খ) খেলাফতে রাশেদার পরে সাহাবীগণ, তাবেঈগণ ও তাবে-তাবেঈগণ ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক ধরণের ব্যাতিক্রম, অন্যায় ও ইসলাম বিরোধীতা কর্মকান্ড দেখতে পান। এ সকল ক্ষেত্রে তাদের পদ্ধতি ছিল কথা বার্তা, লিখনি ইত্যাদির মাধ্যমে শাসকগণকে পরিপূর্ণ ইসলামী পদ্ধতিতে শাসন করতে এবং জনগণ কে পরিপূর্ণ ইসলামী জীবনব্যবস্থার মধ্যে চলতে আহ্বান করা।
(গ) যিনি শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন তাঁর জন্য পরিপূর্ণ ইসলাম অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করা ফরয। আলেম, ফকিহ ও সমাজের দায়িত্ববানদের জন্য শাসকের শাসন কার্যে সহযোগীতা করা, তাঁর কোন ভুল হলে তাকে সংশোধনের পথ দেখানো ও সঠিক পথে শাসন পরিচালনা করতে আহ্বান করা।
(ঘ) পূর্বের যুগগুলিতে যুদ্ধবিগ্রহ বা রক্তাক্ত বিল্পব ছাড়া 'সরকার পরিবর্তন' এর কোন সুযোগ ছিল না। এজন্য সাহাবী তাবেঈগণের যুগ থেকে পরবর্তী যুগে আলেম, ফকিহ ও সমাজ সংস্কারকগণ সাধারণত সরকার পরিবর্তন করার প্রচেষ্টাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। তাঁরা সর্বদা 'সরকারকে সংশোধন' করতে চেষ্টা করেছেন।
(ঙ) বর্তমান যুগে আমরা একটি বিষেশ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি, যা তাঁদের যুগে ছিল না। একদিকে আমরা অনেকে এমন সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস করি যেখানে সামান্য কিছু ইসলামী ব্যবস্থার পাশাপাশি সর্বস্তরে অনৈসলামিক পরিবেশ ও ব্যবস্থা বিদ্যমান। এগুলোর প্রতিবাদ করা ও পরিবর্তনের চেষ্টা করা আমাদের উপর ফরয। অপর দিকে আগের যুগে নির্বিঘ্ন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ ছিল না। বর্তমানে তা আছে। তার মাধ্যম হচ্ছে আধুনিক গণতান্ত্রিক দলীয় রাজনীতি।"
প্রশ্ন হলো: আমরা এখন কী ভাবে (দীন প্রতিষ্ঠার) কাজ করব? শুধু মাত্র শাসক ও জনগণকে ইসলামের দিকে আহ্বান, আদেশ, নিষেধ ইত্যাদির মধ্যেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখব? না কি এই আধুনিক (গণতান্ত্রিক) পদ্ধতি গ্রহণ করব?
বর্তমান মুসলিম বিশ্বে অনেক আলেম, ফকিহ, চিন্তাবিদ ও ধার্মিক মানুষ আধুনিক দলীয় ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নন। কারণ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বা সমাজে ইসলাম বিরোধী কাজ রোধে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করতে রাসূলুল্লাহ (সা), তাঁর সাহাবীগণ, তাবেঈগণ, তাবে তাবেঈগণ কখনোই রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রগণের জন্য দল গঠন, নির্বাচন ইত্যাদি করেন নি। তাঁরা শাসক ও জনগণ কে ইসলাম মতো চলতে আহ্বান করেতেন, শাসকের ভুলগুলো তাকে বলে তাকে সংশোধিত হওয়ার আহ্বান করতেন এবং ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ প্রচারে সাধ্যমত চেষ্টা করতেন। কাজেই আমাদেরও সেভাবে চলা উচিত।
এখানে সমস্যা হলো ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত বর্জনের পার্থক্য না করা। প্রথম যুগের মুসলিমগণ দলীয় রাজনীতি করেননি বা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন করে ভালো সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেননি তার কারণ হলো এই ব্যবস্থা তাঁদের যুগে ছিল না। তাঁদের রাষ্ট্রের শাসককে শান্তিপূর্ণ ভাবে পরিবর্তন করা যেত না। তাই তারা সাধারণত শাসক পরিবর্তনের চেষ্টা না করে সংশোধনের চেষ্টা করতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে সে সুযোগ আছে। আমরা যদি তা ব্যবহার না করি তবে দুই দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবো:
প্রথমত, সৎকাজে আদেশ ও সমাজে ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড পরিবর্তন করে পরিপূর্ণ ইসলাম প্রতিষ্ঠার একটি বড় মাধ্যম আমরা হারাব।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে সমাজে যারা ইসলামী মূল্যবোধের প্রসার ও প্রতিষ্ঠা চান না, তারা এই (গণতান্ত্রিক) মাধ্যম ব্যবহার করে ইসলামী মূল্যবোধের বিকাশ রোধ করবেন। এ কারণে ইসলামের বিরুদ্ধে সকল প্রচেষ্টার মোকাবিলা করাও আমাদের দায়িত্ব।
এ জন্য গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে একটি নব উদ্ভাবিত উপকরণ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে এবং প্রয়োজনে ইসলামী শরীয়তের শিক্ষার আলোকে শরীয়ত সম্মত ভাবে সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ ইত্যাদি ইসলামের সুনির্দিষ্ট ইবাতদ পালনের মাধ্যম হিসাবে একে ব্যবহার করতে হবে।
আল্লাহ তা'য়ালা ইসলামকে সকল যুগের, সকল জাতির, সকল মানুষের পালন ও অনুসরণ যোগ্য করে প্রেরণ করেছেন। জাগতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, জনকল্যাণমূলক ও প্রাকৃতিক কর্মকান্ডের মধ্যে ইসলামেখুবই প্রশস্ততা রাখা হয়েছে। যেন প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক জাতির মানুষ তাদের সমাজের প্রচলিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় রীতিনীতির মধ্য থেকেই পরিপূর্ণ ইসলামে প্রবেশ করতে পারে। এরই একটি দিক হলো রাষ্ট্র পরিচালনার দিক।
মহিমাময় আল্লাহ ও তাঁর মহান রাসূল (সা) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের পরামর্শ গ্রহণের এবং ন্যায়নীতি ও ইনসাফের সাথে শাসনের নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
[আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
وَشَاوِرْهُمْ فِى ٱلْأَمْرِۖ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلْمُتَوَكِّلِينَ
আর কার্য সম্বন্ধে তাদের সাথে পরামর্শ কর; অতঃপর তুমি যখন সংকল্প কর তখন আল্লাহর প্রতি নির্ভর কর; এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর উপর ভরসাকারীগণকে ভালবাসেন।
(সূরা আলি ইমরানঃ১৫৯)
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,
من بايع اميرا عن غير مشورة المسلمين فلا بيعة له. (مسند احمد)
যে ব্যক্তি মুসলিমদের পরামর্শ ছাড়াই আমীর হিসাবে বাইয়াত নেই তার বাইয়াত বৈধ হবে না।
(মুসনাদে আহমদ)]
কিন্তু পরামর্শ গ্রহণের পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দেননি। যেন সকল যুগের ও সকল দেশের মানুষ নিজ নিজ দেশের সামাজিক কাঠামোর মধ্য থেকে ইসলামী অনুশাসনের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের পরামর্শ ও মতামত গ্রহণের ব্যবস্থা করতে পারে। ফলে অতীত যুগে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত গোত্রীয় বা রাজতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে ইসলামের এই নির্দেশ পালন সম্ভব ছিল। এ জন্য কোন সামাজিক বিশৃঙ্খলার প্রয়োজন ছিল না। তেমনি বর্তমান গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও একই ভাবে আল্লাহর এই নির্দেশ পালন করা সম্ভাব। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের পরামর্শ গ্রহণের একটি নব উদ্ভাবিত উপকরণ ও পদ্ধতি হলো গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি। যেখানে এই পদ্ধতি ব্যবহারের সুযোগ আছে সেখানে মুসলিমগণ শরীয়তের নির্দেশনার ভিতরে তা ব্যবহার করবেন।"
(ড.খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহ্ইয়াউস সুনান, ৫ম অধ্যায়, পৃঃ৪৬৬-৪৬৯ দ্রঃ)
----------------------------------------------
লেখক : প্রবন্ধ লেখক কলামিস্ট ইতিহাস গবেষক দাঈ ও শিক্ষক।
0 Comments