কেমন ছিলো সেই দিনগুলো: ১৭ বছরের দমনপীড়ন আর আজকের লাগামহীন বাকস্বাধীনতা
বাংলাদেশের ইতিহাসে গত সতেরো বছর ছিলো দমনপীড়ন, একনায়কতন্ত্র আর মানুষের কণ্ঠরোধের প্রতীক। হাসিনা সরকারের সময়ে শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নয়, সাধারণ মানুষও বাকস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিলো। আইন, বিশেষ করে কুখ্যাত ডিজিটাল আইন, মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে ব্যবহার করা হয়েছিলো। সংবাদমাধ্যম ছিলো ভয়ে আচ্ছন্ন, রাজপথ ছিলো শূন্য, আর বিরোধী দলগুলো একপ্রকার জিম্মি দশায় কাটিয়েছে সেই দীর্ঘ সময়।
আজ যারা সরকারের সমালোচনা করছেন, তারা কি ভুলে গেছেন ২০১৩ সালে খালেদা জিয়াকে নিজ বাসায় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো? ভুলে গেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিলো? ভুলে গেছেন কিভাবে জামায়াতকে জঙ্গি তকমা দিয়ে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিলো? তখন রাজনৈতিক দলগুলো কিছুই করতে পারেনি। আন্দোলন করতে পারেনি, মিছিল-মিটিং করার সুযোগও পায়নি। একের পর এক গুম, খুন, নির্যাতন, অপহরণ হয়ে গেছে—তবুও চুপ থাকতে হয়েছে। সেই দিনগুলোর ভয়াবহতা কি তারা ভুলে গেছেন?
আজ যারা উচ্চকণ্ঠে সমালোচনা করছেন, তারা কি ভেবে দেখেছেন কোথা থেকে এই মুক্তি এসেছে? ছাত্র-জনতার আন্দোলন আর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বৈরাচার থেকে মুক্ত হয়েছে। আজকে মানুষ ইচ্ছেমতো কথা বলতে পারছে, সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা করছে, রাস্তা বন্ধ করে দাবি তুলছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে—এই বাকস্বাধীনতা অযথা কেউ আমাদের হাতে তুলে দেয়নি, এই বাকস্বাধীনতায় লেগে আছে প্রতিটি শহীদের রক্ত আর আহতদের আর্তনাদ।
আগে গণমাধ্যম ভয়ে সঠিক সংবাদ প্রকাশ করতে পারতো না, অথচ এখন তারা স্বাধীনভাবে সব বলতে পারছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কিছু সংবাদমাধ্যম এ বাকস্বাধীনতাকে দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার না করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপব্যবহার করছে। বাকস্বাধীনতা মানে লাগামহীনতা নয়, বরং সত্য প্রকাশের সাহসের সাথে দায়িত্বশীলতা।
সতেরো বছরে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছিলো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে বিচারব্যবস্থা—সবখানে ছিলো শাসকের ইচ্ছার প্রতিফলন। কিন্তু এটি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বভাবগত দোষ ছিলো না, বরং ক্ষমতাসীনদের স্বৈরাচারী মানসিকতার ফল। বর্তমান সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অযথা আঙুল তোলা অযৌক্তিক। আজকের সরকার জনগণের জন্য কাজ করছে, আর প্রতিষ্ঠানগুলো সেই কাজকেই বাস্তবায়ন করছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আজ মানুষ বাকস্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে, দাবি তুলতে পারছে, এমনকি সরকারের সমালোচনাও করতে পারছে। কিন্তু এই বাকস্বাধীনতাকে অনেকে লাগামহীনভাবে ব্যবহার করছে।
কুরআনের সুরা হুদের ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
“বিপদ কেটে গেলে মানুষ উৎফুল্ল ও অহংকারী হয়ে যায়।”
আমাদের অবস্থাও অনেকটা তাই।
আমদের ভুলে গেলে চলবে না, অহংকারের পতন অবশ্যম্ভাবী। হাসিনার পতন তার জীবন্ত উদাহরণ। তাই বাকস্বাধীনতার অপব্যবহার না করে আমাদের উচিত এই অর্জিত বাকস্বাধীনতাকে মূল্য দেওয়া, দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করা। আজকের সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য নির্বাচন আয়োজন করে সরে দাঁড়াবে। কিন্তু তার আগে আমাদেরও শিখতে হবে—বাকস্বাধীনতার সঙ্গে আসে দায়িত্ব, আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আবারও আমাদের অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে।
0 Comments